Friday, April 22, 2022

ঝরাপাতা(সাতাশ পর্ব)

ঝরাপাতা (সাতাশ পর্ব)
  বেশ কিছুক্ষণ দু'জনেই চুপ করে থাকলো।এইভাবেই কেটে গেলো সেকেন্ড থেকে বেশ কয়েক মিনিট।পুনরায় সুমিত বললো,
--- কেমন আছো তুমি? প্লিজ সুচন্দা এবার কথা বলো।
 আরও বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সুচন্দা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে,
--- ভালো আছি,তোমরা সবাই ভালো আছো তো?
 --- বাড়ির সবাই ভালো আছে।আর আমি?জীবন তো থেমে থাকবার জন্য নয় বেঁচে আছি যখন ভালোমন্দ মিশিয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে চলেছি।
 আবার দুই প্রান্তে দু'জনেই চুপ।সুমিত ও সুচন্দার এই নীরবতায় যেন হাজার হাজার মাইল দূর থেকে অনেক জমে থাকা সব কথা জানান দিচ্ছে।
--- সুমিত,তুমি এখন কোথায় আছো?আসলে তোমার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টটা পেয়ে তোমার প্রোফাইল দেখা হয়নি।
--- প্রথমে আমি বেশ কয়েক বছর লন্ডন ছিলাম।এখন কানাডায় আছি।এখানেই বাড়ি করেছি।আমার একছেলে আর এক মেয়ে।তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?কে কে আছেন ?তোমার ক'টি ছেলেমেয়ে?
--- প্রথমে শিলিগুড়ি ছিলাম।হাজব্যান্ডের চাকরীর বদলীর
 কারণে কলকাতা চলে আসি।এখানেই বাড়ি করেছি।আমারও একছেলে,একমেয়ে।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।মেয়ের বিয়ে ওর বাবা থাকতেই দিয়ে গেছে।এখন ---
 কথা শেষ হয় না সুচন্দার।তার মাঝেই সুমিত প্রশ্ন করে,
--- কোথায় গেছেন তোমার হাজব্যান্ড?
 সুচন্দা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে --
 সুচন্দার এই দীর্ঘনিশ্বাস যেন সুমিতের বুক চিরে বেরিয়ে আসে।সুমিত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
--- তাহলে বাড়িতে তুমি আর তোমার ছেলে?তুমি কিসে চাকরি করো?
 সুচন্দা একটু হেসে উত্তর দেয়,
--- না,ওসব আমার কপালে জোঠেনি।সঞ্জয়ের পেনশন আর বাড়ি ভাড়া ;চলে যাচ্ছে মা,ছেলের।তুমি এখন আর দেশে আসো না?
--- বহুদিন আর যাওয়া হয় না।বাবা,মা বেঁচে থাকতে যেতাম।
      কথা আর শেষ হয় না।কথা চলতেই থাকে শুধু সেদিনই নয় প্রতিদিন ঠিক নিয়ম করে দুবেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা।বিয়াল্লিশ বছরে নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা।দু'জনের স্মৃতি মাত্র এক কি দু'দিনের।কেউ তার নিজের জীবনের কোন কথায় কারো কাছে লুকায় না।এমন কি সুমিত ইতিকার কথাও সুচন্দার কাছে সব বলে।সুমিতের কাছে তার বৈবাহিক জীবনের সমস্ত কথা শুনে সুচন্দা বুঝতে পারে দুটি মানুষ একসাথে বছরের পর বছর একই ছাদের তলায় থাকলেই সুখী জীবন প্রত্যেকের কাটে না।গ্রামের সহজ সরল সুমিত যতই উচ্চপদে চাকরি করুক না কেন তার ভিতর আজও সেই সরলতা রয়েই গেছে।আত্মসম্মান,ছেলেমেয়ের ভবিৎষত সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে সেই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার গল্প শুধু যে নারী জীবনেই ঘটে তা কিন্তু মোটেই নয়।সময়ে সময়ে পুরুষও এই চক্রব্যুহের মধ্যে বন্দী হয়।জীবনে অর্থ,সম্পদ,বৈভব থাকা মানেই সুখী জীবন কাটানো তা কিন্তু মোটেই নয়। ফুটপাতেও দুটি নরনারী সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারে যদি মনের মিল হয়।সুমিত ও দীপালীর জীবনে সবকিছু থাকলেও মনের মিলটার বড়ই অভাব ছিল।দীপালীর আকাশচুম্বী চাহিদা মেটাতে সুমিত কখনোই কোন কার্পণ্য করেনি ;ঈশ্বর সে ক্ষমতাটা তাকে দিয়েও ছিলেন তবুও কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকেই গেছে।আর সম্ববত সে ফাঁকটা সুমিতের সরলতা।
 কিশোর বয়সে সুচন্দাকে ভালোবেসে তাকে হারানোর যন্ত্রণা পরবর্তীতে ইতিকার কাছ থেকে পাওয়া আঘাত সুমিত প্রতি মুহূর্তে যখন যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে তখন বাড়ির মানুষজন ভাবে এই মুহূর্তে সুমিতকে ঠিক রাখার একটাই উপায় একটা বিয়ে দিয়ে দেওয়া।বিয়ে হয়ে গেলে স্ত্রীর ভালোবাসায় নিজেকে সামলে নিতে পারবে।সুচন্দার কথাটা সুমিতের বোন বিশাখা একমাত্র জানতো।কিন্তু ইতিকার কথা বাড়ির সকলেই জানতো।তাদের মনের ইচ্ছাও ছিল মেয়েটিকে সুমিতের বউ করে আনা।
 কিন্তু  কার্যক্ষেত্রে সবকিছুই ওলটপালট হয়ে গেলো।সুমিতও তখন ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে দেখে বাড়ির সকলে প্রায় জোর করেই তার বিয়ের ব্যবস্থা করে।তখন সুমিতের মা বেঁচে।সুমিতের বউ দীপালীর অনেক দোষ-ত্রুটির কথা সুমিতের মা যখন ছেলের কাছে বলতেন তখন সে সব কথা সরল,সাদা ছেলে সুমিত গিয়ে তার বউকে বলতো।"এসব কথা কে বলেছে"- জানতে চাইলে সাতপাঁচ না ভেবে সুমিত তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছে জানিয়ে দিত। এ কথাগুলো বউকে বলার অন্য কোন উদ্দেশ্য তার ছিল না।সে শুধু চেয়েছিলো দীপা যাতে তার মায়ের কথা শোনে।এর ফলস্বরূপ দীপালী কোনদিনও তার শ্বাশুড়ীকে ভালো চোখে দেখেনি।অথচ গ্রাম্য সহজ,সরল এই মানুষটি তার ছেলের বউটিকে কিন্তু যথেষ্ঠ ভালোবাসতেন।কিন্তু স্বল্প শিক্ষিত মহিলা বুঝতেই পারেননি তার পুত্রবধূটির দোষ,ত্রুটিগুলো ছেলের কাছে বললে তা বিশাল আকার ধারণ করবে।প্রথম দিকে তিনি নিজেই চেষ্টা করেছিলেন তার সুমিতের বউ যে কটাদিন তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকবে অন্তত কাপড় পরে থাকুক।তিনি বারবার বলেও তা সম্ভব করতে পারেননি।আবার এ কথাও বলেছেন বাড়িতে বাইরের লোকজন থাকলে যেন সে উচ্চস্বরে কথা না বলে।এই ছোট ছোট চাহিদাগুলো মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য তিনি বধূটির কাছে দাবি করেছিলেন।কারণ সুমিত বিয়ের অনেক আগেই চাকরি পেয়ে গেছে এবং দেশের বাইরেই থাকে সে।বিয়ের পর সর্বসাকুল্যে মাত্র পনের থেকে কুড়ি দিন দীপালি তার শ্বশুরবাড়ি ছিল।কিন্তু দীপালী এটুকুও দিতে পারেনি বয়স্ক মানুষটিকে।সুমিতের বিয়ের পড়ে তাই যতবার সুমিত তার মাকে লন্ডন নিয়ে যেতে চেয়েছে তিনি প্রতিবারই এড়িয়ে গেছেন।সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ হলেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং জেদী।আর দিপালীকে তিনি খুব ভালোভাবেই চিনে গেছিলেন মাত্র ওই কটাদিনে।তাই ছেলের কথায় তার বাড়িতে কয়েকটা দিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে তিনি ছেলে বউয়ের বিরাগভাজন হয়ে তার সংসারের অশান্তি আনতে চাননি কখনোই। তাই সুমিত তার বউ নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার পড়ে সুমিতের জোড়াজুড়ি সর্তেও কোনদিন ছেলের কাছে যেতে চাননি ঠিক তেমনই ছেলেকেও কোনদিন দেশে আসতে বলেননি।
 একবার ভাইফোঁটার সময় বোন ও দিদির আব্দারে দিন পনেরর জন্য সুমিত দেশে এসেছিল বউ ছেলেমেয়েকে না নিয়ে একাই। তখনও মাকে বহুবার অনুরোধ করেছিল সে।কিন্তু তিনি কিছুতেই ছেলের সাথে ছেলের বাড়ি যেতে রাজি হননি।বুদ্ধিমতী ,জেদী মহিলা সামান্য কটাদিনেই তার সুমিতের বউকে খুব ভালোভাবেই চিনে গেছিলেন।আর এটাও বুঝেছিলেন তার সরল, ভোলাভালা ছেলেটির জীবনে সুম্পূর্ণ দাম্পত্য সুখ এনে দিতে তিনি পারেননি।তার কিংবা বাড়ির সকলের নির্বাচনে ঘাটতি রয়েই গেছে।তবে সুমিতের প্রতি এ বিশ্বাসও তার ছিল ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছেলের অসীম।সবকিছুর থেকে নিজেকে ব্রাত্য রেখে সে ঠিক ওই মেয়ের সাথেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
 সুমিতের মা যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তখন বাড়ির লোকেরা তাকে বারবার বলেছে যে তিনি সুমিতকে দেখতে চান কিনা - চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ার সাথে মাথা নাড়িয়ে তিনি প্রতিবারই 'না' বলে গেছেন।মৃত্যুর সময় তিনি তার সুমিতকে তাই দেখে যেতেও পারেননি।
 সুচন্দার সাথে নিয়ম করে প্রতিদিন দু'বেলা কথা বলার মাঝে নিজের জীবনের সমস্ত দুঃখ,কষ্টগুলো এতদিন পড়ে যেন সুমিত কাউকে বলার মত একজন মানুষ খুঁজে পেয়েছে।যে (সুচন্দা) এতদূর থেকে ফোনের মাধ্যমে তার দুঃখগুলোকে নিজের মনে করে সুমিতের ক্ষতে প্রলেপ ফেলতে পারছে আর সুমিতও মনের মধ্যে এতদিন ধরে জমে থাকা কষ্টের ভার লাঘব করতে পেরেছে।

ক্রমশঃ 
    

No comments:

Post a Comment