Monday, April 18, 2022

ঝরাপাতা (চব্বিশ পর্ব)

ঝরাপাতা (চব্বিশ পর্ব)
   দীপকদার কাছ থেকেই সুচন্দা জানতে পারে অফিসে এমন কোন জায়গা নেই যেখান থেকে সঞ্জয় লোন করেনি।সংসারে প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিতে লোনের বোঝা 
প্রতিমাসে বেরেই গেছে।আসল কোন মাসেই শোধ দিতে পারেনা শুধু প্রতিমাসে সুদটাই দিয়ে থাকে। দীপকদা সুচন্দাকে একথাও বলে,
--- তুমি কিন্তু ভেবো না আমি আমার বন্ধুর সম্পর্কে তোমার কাছে নালিশ কিংবা বদনাম করছি।আমি সঞ্জয়কে খুব ভালোবাসি। ও আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট।ওর মুখেই আমি শুনেছি তুমি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।গ্র্যাজুয়েশন করেছো।তোমায় জানালাম একটাই কারণে তুমি ওকে বুঝিয়ে আস্তে আস্তে এই লোনটা শোধ করাও। মাইনে পেয়েই সুদের টাকাটা দিয়ে বাকি টাকা সে সংসার খরচের জন্য নিয়ে আসে।দাদা হিসাবে তোমায় পরামর্শ দেবো তুমি কিছু টিউশনি শুরু করো।সেই টাকা সংসারের পিছনে দাও আর সঞ্জয় মাইনের টাকা থেকে একটু একটু করে লোনটা শোধ করুক।
 ভগবানের দূত হয়ে এসে দীপকদা সেদিন কথাগুলো না জানালে হয়তো লোনের বোঝা আরো বেড়ে যেত। সুচন্দার কাছে সঞ্জয় অস্বীকার করে না যে তার প্রচুর টাকা লোন অফিসে। লোনের টাকা শোধ করতে গেলে সংসারে অভাব দেখা দেবে তাই প্রতি মাসে শুধু সুদটাই দিয়ে আসে।সব শুনে সুচন্দা শুরু করে কিছু টিউশনি করতে।সামান্য হলেও পুরো টাকাটাই সে সংসারের পিছনে খরচ করতে থাকে আর সঞ্জয়কে অনেক বুঝিয়ে অফিসের লোনের টাকা কিছু কিছু করে শোধ করাতে থাকে।
 যে মানুষটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে সুচন্দাকে সবকিছু জানিয়ে গেছিলো সেই মানুষটাই হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো।
 একদিন অনেক রাত।সঞ্জয় তখনো অফিস থেকে আসেনি।অন্নপূর্ণাদেবী ঘরবার করছেন।সুচন্দার মেয়ের বয়স তখন পাঁচ বছর।মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে সে উদ্বিগ্ন চিত্তে তার কোলের কাছেই বসে ভাবছে কেন আজ এত দেরি হচ্ছে সঞ্জয়ের ফিরতে।মুঠোফোন তো দূরহস্ত পাড়ায় তখন হয়ত দু,একটি বাড়িতে ল্যান্ডফোন।তাই ঘরে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।
 সেদিন ছিল মাইনের দিন।দীপক ও সঞ্জয় একসাথেই অফিস থেকে বেরিয়েছে। বড় রাস্তার মোড়ে এসে প্রথমে দীপক ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়ায় রাস্তা পার হতে যায়।হঠাৎ করেই দ্রুত গতিতে একটি বাস এসে দীপককে পিষে দিয়ে চলে যায়।
 সারারাত দীপককে নিয়েই কেটে যায় সঞ্জয়ের।স্পট ডেথ।কিন্তু সেই মুহূর্তে রাস্তার মানুষের সাহায্যে সঞ্জয় দীপককে হাসপাতাল নিয়েও যায়।বাবা,মায়ের হাতে তুলে দেয় দীপকের পকেটে টাকা ছেলের রোজগারের শেষ সম্বলটুকু।এইসব শেষ করে সঞ্জয় যখন বাড়ি ফেরে তখন সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
  পরবর্তীতে নিঃসন্তান দীপকের স্ত্রী সরকারি চাকরী থেকে শুরু করে প্রফিডেন্ত ফান্ড, গ্রাচুয়েটি সমস্ত কিছুর মালিক হয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে ওঠে বৃদ্ধ শ্বশুর ,বৃদ্ধা শ্বাশুড়ীকে ফেলে রেখে।আসলে মানুষের জীবনের সমস্ত ঘটনায় অদৃশ্য একটা হাত যে সর্বদা কাজ করে চলেছে তা অনেকেই স্বীকার করার  সৎ সাহস দেখাতে পারে না।কিন্তু সঞ্জয় যখন দীপকের স্ত্রীর চাকরির জন্য অফিসে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ছুটাছুটি করছে তখন কিন্তু দীপকের স্ত্রী কথা দিয়েছিল চাকরি এবং টাকা-পয়সা পাওয়ার পর সে তার বৃদ্ধ শ্বশুর,শ্বাশুড়ীকে দেখবে।কার্যক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাই হয়।সঞ্জয় কিছুদিন দীপকের বাবা,মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখলেও পরে নিজের নানান সমস্যায় জর্জরিত সঞ্জয় আর কখনো তাদের খবর রাখতে পারেনি।দীপকের অবর্তমানে সম্পর্কের ইতি সেখানেই হয়।
 মানুষ তার নিজনিজ জীবনে প্রত্যেকেই স্বার্থপর।আসলে অনেকক্ষেত্রে স্বার্থপর না হয়ে বাঁচাও যায় না।জীবনে থাকে প্রতিটা মুহূর্তেই নানান সমস্যা।নিজের সমস্যা মোকাবেলা করতে করতে অন্যের সমস্যাগুলো একসময় মনের থেকে উধাও হয়ে যায়।
  শমিতা আসার বছর তিনেকের মধ্যে তার জেঠু শমিতাকে নিয়ে পারিবারিক অনেক ঝামেলা,ঝক্কি সামলানোর পর তাকে সুপাত্রস্ত করতে সমর্থ হন।পরবর্তীতে একমেয়ে ও একছেলের গর্বিত মা হয়েই দিনাতিপাত করতে থাকে সে।
  সুচন্দার মেয়ের জন্মের প্রায় ন'বছর বাদে একটি ছেলে হয়।সংসারের আর্থিক সমস্যার তখন অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।ছেলের মাধ্যমিক যখন সবে শেষ হয়েছে তখন হঠাৎ করেই একদিন অন্নপূর্ণাদেবী চলে গেলেন।মা অন্তঃপ্রাণ সঞ্জয় তখন খবুই ভেঙ্গে পরে।অন্যান্য ভায়েরা তখন সকলেই বিবাহিত স্ব স্ব ক্ষেত্রে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও নিজনিজ সংসার চালানোর ক্ষমতা রাখে।
 বাবার মৃত্যুর পর সংসারের জোয়াল যখন সঞ্জয়ের কাঁধে তখন সঞ্জয় দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছে এদিক ওদিক কাজ করতে গিয়ে।খিদে পেলে কখনো ছাতু নুতবা শুধু জল খেয়েই সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়েছে।পরিণামে যা হবার তাই হয়েছে।সঞ্জয়ের শরীরে বাসা বেঁধেছে টিবি নামক মারত্মক ব্যাধি।প্রথম অবস্থায় মা,বউকে গোপন করে গেলেও পরবর্তীতে ওষুধ,ডাক্তার করে সুস্থ্য হয়ে ওঠে।কিন্তু ডাক্তারের কথানুসারে সঞ্জয়ের ফুসফুস তখন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত।সারাজীবন তাকে স্মোকিং করতে ডাক্তার নিষেধ করেন কিন্তু কে শোনে কার কথা!সে বাড়িতে স্মোকিং না করলেও রাস্তাঘাটে,অফিসে সব সময়ের জন্যই এটা চালিয়ে যায়।একসময়ের অনাহার, অর্ধাহার,নিজের কাছের লোকগুলোকে বাঁচানোর তাগিদে অমানুষিক পরিশ্রম যার ফলশ্রুতিতে রাজরোগের বাসা শরীরে।চাকুরী জীবনে অফিসিয়াল টেনশনে একের পর এক সিগারেট সঞ্জয়ের একটা ফুসফুসকে প্রায় অকেজো করে দিলো।শুরু হল শ্বাসকষ্টের মত রোগ।ওষুধ,ইনহেলার,অক্সিজেন --- আস্তে আস্তে সবকিছুই ব্যর্থ হতে হতে নার্সিংহোম ভর্তি হতেই হল।দু'মাস আগে মায়ের মৃত্যু আর তারপরেই সঞ্জয় অসুস্থ্য।চাকরি থেকে রিটায়ার করার ঠিক পরের মাসেই তাকে ভর্তি করতে হল নার্সিংহোম।
  এর ঠিক তিন বছর আগে মেয়ের বিয়ে হয়েছে ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে।সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে তখন সুচন্দার শ্বশুরবাড়ির সংসার ভেঙ্গে ভায়েরা সব আলাদা বাড়ি করে যে যার মত আলাদা হয়ে গেছে।
  সঞ্জয়কে নিয়ে শুরু হল এক বিশাল টানাপোড়েন।তার অসুস্থতার খবর পেয়ে অফিস তার সমস্ত পাওনাগণ্ডা কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝিয়ে দিল একজন সৎ,একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে সঞ্জয়ের এটা পাওনা মনে করলো উপর মহল।যেখানে বছরের পর বছর চলে যায় সরকারি টাকা পেতে সেখানে সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে হল এর ব্যতিক্রম ।দুই দুইবারের অসুস্থতার ফলে জমানো সমস্ত টাকা যখন শেষ হল ডাক্তারও ঠিক তখনই জবাব দিয়ে দিলেন।ডাক্তার পরিস্কার বললেন,
--- একটা ফুসফুস পুরো অকেজো অন্যটা পঁচাত্তর ভাগ ড্যামেজ।এই অবস্থায় আপনারা যদি পেসেন্টকে নার্সিংহোম রাখেন তাহলে বৃথায় আপনাদের অর্থ খরচ হবে অথচ উনি কিন্তু আর ভেন্টিলেশন থেকে বেরোতে পারবেন না।তাই একজন ডাক্তার হিসাবে আমি বলবো আপনারা যেকোনো সরকারি হাসপাতালে উনাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
  মুঠোফোন তখন সকলের হাতে হাতে।ছেলেবেলা থেকে সুচন্দা গল্প,কবিতা লেখার অভ্যাসটা ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে আরও অনেকটা ছড়িয়ে গেছে তখন।কবিতা ও গল্প মিলিয়ে বেশ কয়েকটা বই বেরিয়েছে তখন।পরিচয় হয়েছে বেশ কিছু নামী দামী লোকের সাথে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কিছু মানুষদের সাথে।ডাক্তারের সমস্ত কথা শোনার পর সুচন্দা এই প্রথম জীবনে কারো কাছে কিছু সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে।রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় তার স্বামীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে সচেষ্ট হয়।
  
ক্রমশঃ




    

No comments:

Post a Comment