ঝরাপাতা (বাইশ পর্ব)
অভাব,দুঃখ,দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে করতে সঞ্জয় যখন প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মত ঠিক তখনই পূর্বে প্রচুর ইন্টারভিউ দেওয়া ;এমনই একটি সরকারী জায়গা হতে আসে এপোয়েনমেন্ট লেটার।বাড়িতে এ খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই যেন উৎসব লেগে যায়।
গাছের শুকনো,জীর্ণ পাতাগুলো ঝরে যাওয়ার পর যখন সে গাছে নূতন করে পাতা গজাতে দেখা যায় তখন মনেহয় মৃতপ্রায় গাছটার বুঝি প্রাণ ফিরে এলো।সঞ্জয়ের চাকরিটা তাদের বাড়ির এমনই যেন এক ইঙ্গিত বহন করছে।খুব সামান্য মাইনেতে ঢুকলেও আস্তে আস্তে চাকরির পদোন্নতির সাথে সাথে টাকার অংকটাও বাড়তে থাকে।খুব বেশি উপরে উঠতে পারে না সঞ্জয় কারণ তার ডিগ্রিটা ছিল না।বাবার মৃত্যুর পরই সংসারের জোয়াল তার উপর এসে পড়েছিল সে ভালোভাবেই জানতো এই টাকা কটা তার মায়ের হাতে তুলে দিতে পারলে তিনি সুনিপুণভাবে সংসারটাকে চালিয়ে নিতে পারবেন।বয়স তখন তার চৌত্রিশ বছর।চাকরি জীবনের ছ'মাস যেতে না যেতেই অন্নপূর্ণাদেবী চেষ্টা করেন তার ছেলেটির বিয়ে দিতে।কারণ সঞ্জয়ের জীবনেও অতি অল্প বয়সে ঘটে গেছিলো এক বিপর্যয়।
সঞ্জয় তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র।তার জীবনে আসে চন্দনা নামে একটি মেয়ে।কিশোর বয়সের প্রেম।খুব ভালোবেসে ফেলে চন্দনাকে।অপরদিকে চন্দনাও ঠিক তাই।চন্দনার বাড়ির থেকে যখন এ ঘটনা জানতে পারেন তার বাবা,মা তখন তারা তাদের মেয়েকে অন্যত্র পাত্রস্থ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে পড়েন।চন্দনার বাইরে বেরোনো তারা বন্ধ করে দেন।সব সময়ের জন্য তারা চন্দনাকে চোখে চোখে রাখেন।এদিকে সঞ্জয় চন্দনার খোঁজ না পেয়ে পাগলের মত রোজই তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে শুরু করে।চন্দনা ঘর থেকেই সঞ্জয়কে দেখতে পায়।
সেদিন অনেক রাতে চন্দনা তার বাড়ি থেকে সালোয়ার কামিজ পরে সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে সঞ্জয়দের বাড়িতে এসে ওঠে।অত রাতে অপরিচিত একটি মেয়েকে দেখে তিনি জানতে চান
-- এত রাতে তুমি আমার বাড়িতে কার কাছে এসেছো?
--- সঞ্জয়ের কাছে
--- ও সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক ?তুমি কি জানো ওর পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি;আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসার।তোমাকে দেখে তো মনেহচ্ছে তোমার আঠারো বছর বয়সও হয়নি।এত বড় একটা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে নিজের ভবিষ্যৎ এর কথা একবারও ভাবলে না?একটা স্কুল পড়ুয়া বেকার ছেলের উপর কতটা নির্ভর করতে পারো নিজের মনকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো।
এতো কথাবার্তার মাঝে সঞ্জয় ও তার ভাইদের ঘুম ভেংগে তারা ততক্ষনে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।সঞ্জয়ের দিকে মুখ করে তার মা বললেন,
-- তুমি তো অবিবেচক নও ।আমি তোমার কাছেই জানতে চাই তোমার এই ব্যাপারে কি মত?আমি বা তোমার বাবা দুজনেই মনেকরি আবেগের বশে তুমি কখনোই কোন সিদ্ধান্ত নেবে না।নিজেরাই পেট পুরে দুবেলা খেতে পারি না।তোমাদের লেখাপড়া শেষ হয়নি।মেয়েটিকে দেখে মনেহচ্ছে আঠারো বছর বয়স হয়নি।এক্ষেত্রে সকলে পুলিশের ঝামেলায় জড়িয়ে যাবো।ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভেবে উত্তর দাও।
সঞ্জয় মায়ের সব কথা মাথা নিচু করে শোনে।বাবা,ভায়েরা সব চুপচাপ দাঁড়িয়ে।সঞ্জয় চুপ করে আছে দেখে তার মা পুনরায় বললেন,
-- এখন অনেক রাত হয়েছে।যে যার মত গিয়ে শুয়ে পরো।সকাল হলে আমি নিজে গিয়ে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবো।এখন আমি ওকে নিয়ে শুয়ে পড়ছি।সঞ্জয় মুখ নিচু করে ঘরে চলে যায়।কারণ মায়ের কথাগুলো সে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।ইচ্ছা থাকলেও সে চন্দনার সাথে একটাও কথা বলে না।
এই ঘটনার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই চন্দনার বাবা পুলিশ নিয়ে এসে হাজির।সেদিন সঞ্জয় পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যায় শুধুমাত্র পুলিশ আসার সাথে সাথে অন্নপূর্ণাদেবী দরজা খোলার আগে ছেলেকে ডেকে বলে যান সে যেন কোন অবস্থাতেই বাইরে না বেরোয় যতক্ষণ না তিনি তাকে ডাকেন।
পুলিশের সাথে কথাবার্তা তিনিই বলেন।তিনি চন্দনাকে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলেন,
--- ছেলে মানুষ।আবেগের বশে একটা ভুল করে ফেলেছে।তবে আমি আপনাকে একটা কথা দিচ্ছি, যদি আপনার মত থাকে তাহলে আপনার মেয়েকেই আমি বাড়ির বউ করে আনবো আমার ছেলে চাকরি পেলে।আর যদি আপনার এতে মত না থাকে আমি আমার ছেলেকে বুঝিয়ে নেবো আপনি আপনার মেয়েকে সামলে রাখবেন।অফিসারের সামনেই বললাম যদি আপনার মেয়ে এরূপ কোন ভুল পদক্ষেপ নেয় তারজন্য আমার ছেলে কিন্তু দায়ী থাকবে না।এরপর আর কোন পুলিশের ঝামেলা যেন না হয়।
ভদ্রমহিলার এই এই ধরণের মানসিকতাকে পুলিশ অফিসারও সমর্থন করেন।
এরপর অন্নপূর্ণাদেবী সঞ্জয়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসে তাকে এই দারিদ্রের মধ্যে টেনে এনে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না।নিজের পায়ে আগে ভালোভাবে দাঁড়িয়ে পরে যেন সে এসব ভাবে।যদি ততদিনে চন্দনার বিয়ে না হয় তাহলে তিনি নিজে গিয়ে তার সাথে সম্মন্ধ করে বিয়ে দেবেন। মাতৃভক্ত সঞ্জয় এরপর আর কখনোই চন্দনার সাথে নিজের থেকে দেখা করেনি।কিন্তু রাস্তাঘাটে দেখা হলে অপেক্ষা করতে বলেছে যতদিন না সে চাকরি পায়।কিন্তু চন্দনার বাবা,মা অন্নপূর্ণাদেবীর দেওয়া কথা অগ্রাহ্য করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন।তবে একথা সত্যি চন্দনার বাবা তার মেয়ের জন্য সঞ্জয়দের পরিবার থেকে অনেক ভালো পরিবার এবং সুচাকুরে ছেলে জোগাড় করেছিলেন।
সঞ্জয় চাকরি পাওয়ার ছ'মাসের মধ্যেই অন্নপূর্ণাদেবী তার ছেলের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগেন।ভায়ের সাথে পরামর্শ করে মেয়ে দেখতে শুরু করেন আর সুচন্দাকে পছন্দ করেন।স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান,ভাগ্যের ফেরে দিদির কাছে থাকলেও অভাব যাকে কোনদিন ছুঁতে পারেনি সেই মেয়েটি কিনা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বউ হয়ে এলো শুধুমাত্র সঞ্জয়ের পিঠে একটা সরকারি চাকরির স্ট্যাম্প ছিল বলে।এটাকে ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যায় বলা হোকনা কেন সুচন্দা কিন্তু কোনদিনও তার ফেলে আসা অতীত কিংবা জীবনে দেখা একটা স্বপ্নও ছুঁতে না পারার জন্য কখনোই কোন আক্ষেপ কারো কাছেই প্রকাশ করেনি।তাই বলে কি তার মনের মধ্যে কোন দুঃখ কোন কষ্ট ছিল না? হ্যাঁ নিশ্চয় ছিল।সুমিতকে হারানোর পর থেকে কোন আঘাতই তার মনকে আর সেভাবে নাড়িয়ে দিতে কখনোই পারেনি ।"অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর"-- এই প্রবাদ বাক্যটি যেন সুচন্দার জীবনে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছিলো।জীবনে প্রথম ছোঁয়া,প্রথম ভালোবাসা যে হারিয়েছে একমাত্র সেই বুঝতে পারে না পাওয়ার যন্ত্রণা!একদিকে যেমন সুমিতকে না পাওয়ার যন্ত্রণা অন্যদিকে জীবনের স্বপ্নগুলো শুকনো ফুলের পাঁপড়ির মত একটা একটা করে ঝরে যাওয়ার বেদনা - সুচন্দাকে সত্যিই যেন পাথর তৈরি করে দিয়েছিল।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment