সুচন্দা ছেলের এবারে বিটেক শেষ বর্ষ।তার মাস্টার্স করার ইচ্ছা।সুচন্দা তার জীবনের না পাওয়াগুলিকে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মেনে নিলেও মনেমনে সুপ্ত এক আশা নিয়ে আছে যদি তার ছেলেটা মানুষের মত মানুষ হয় তাহলে হয়ত জীবনে আশা ভঙ্গের কষ্টগুলো কিছুটা হলেও প্রলেপ পাবে।
তাই আর্থিক পরিস্থিতি যতই খারাপ থাকুক না কেন ছেলেকে মানুষ করার জন্য সুচন্দা বিন্দুমাত্র ভাবে না।ছেলে সায়ক অবশ্য অনেকবারই তাকে বলেছে এডুকেশন লোন নিয়ে তাকে পড়াতে।কিন্তু সুচন্দা মোটেই তাতে রাজি নয়।সে চায় না আজ না হোক কাল ছেলের মনে এই প্রশ্নের উদয় হয় যে মা আমার মাথার উপর লোনের বোঝা চাপিয়ে আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন।তাই শত কষ্ট হলেও সুচন্দা ছেলে যতদূর পড়তে চায় সে পড়াবে।একজন আদর্শ মা হিসাবে সুচন্দা এই পথেই হাঁটবে।
লেখালেখির জগতে সুচন্দার একটা আলাদা পরিচয় সে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে অনেক আগেই।সঞ্জয় কোনদিনও সুচন্দার একটা লেখাও পড়েনি ঠিকই কিন্তু সুচন্দার লেখার ব্যাপারে তাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করতো সে।সারা জীবনই সুচন্দা রাত জেগে পড়াশুনা করেছে এমন কি এই লেখালেখিটাও সে রাত জেগেই করে।রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে সব কাজ সেরে সুচন্দা অন্য ঘরে বসে লিখতো।কিন্তু সঞ্জয় তাকে বলে,
--- তুমি আমাদের বেডরুমে বসেই লেখালেখি করবে।
--- কিন্তু বড় লাইট জ্বললে তোমার তো ঘুমের অসুবিধা হবে।
--- না হবে না।ওই ঘর থেকে তুমি চলে আসলে আমার খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।প্রয়োজনে আমি চোখের উপর একটা পাতলা কাপড় দিয়ে রাখবো।কিন্তু তুমি ওই ঘরে বসেই লিখো।
যে সঞ্জয় অফিস ছাড়া এক মুহুর্ত সময় একা থাকতে পারতো না সেই আজ প্রায় পাঁচ বছর সুচন্দা,তার বহু কষ্টে গুছানো নিজের সংসার ,তার ছেলেমেয়ে, জামাই সবাইকে ছেড়ে কোন অদৃশ্য লোকে আছে তা কেউই জানে না।সঞ্জয় চলে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম সুচন্দার মনে হত সে বুঝি সুচন্দার কাছাকাছিই রয়েছে।হয়ত মায়ার বাঁধন বা হয়ত মনের ভুল।মাঝে মধ্যেই তার গলার আওয়াজ শোনা,কাশির আওয়াজ শোনা যেন একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।সুচন্দার ছেলে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে মায়ের সাথে সাথে থেকে নানান গল্প-গুজবের মধ্য দিয়ে এই ভাবনা থেকে ঠিক মাকে বের করে এনেছে।আর সব থেকে বড় কথা হল জীবনে অসহনীয় দুঃখ ভোলার একমাত্র ওষুধই তো সময়।
অনেক রাত পর্যন্ত সুচন্দা তার লেখা নিয়ে জেগে থাকে।জীবনের ফেলে আসা অতীত একাকী নির্জন ঘরে একটু একটু করে সুচন্দাকে কলকাতা বাড়ির আশেপাশে পরিচিত মানুষগুলির খুব কাছাকাছি নিয়ে যায়।সঞ্জয় তার অন্তরে আছে ঠিকই কিন্তু এখন মাঝে মাঝেই সুমিত তার চেতন-অবচেতনে সামনে এসে দাঁড়ায়।এখন এত বছর বাদে সে বুঝতে পারে সঞ্জয়ের সাথে সুখে-দুখে জীবনের সাতাশটা বছর কাটিয়ে দিলেও তার প্রথম ভালোবাসা সুমিত ঠিক তার অন্তরেই রয়ে গেছে।ভুলতে চেষ্টা করে,মনে করতে চায় না সুমিত কে সে কিন্তু কিছুতেই মন থেকে সুমিতকে ঝেড়ে ফেলতে আগেও পারেনি আজ এতগুলো বছর বাদেও পারে না।কোন উপন্যাস বা কোন গল্পের প্রেমের আলাপন লিখতে গেলেই সুমিতের সেই উজ্জ্বল চোখ দুটিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।লিখতে লিখতে অনেক সময় বিয়াল্লিশ বছর আগের সেই প্রথম পরশের উপস্থিতি আজও শরীরে মনে সে টের পায়।মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যায় সে।সঞ্জয় যখন বেঁচে ছিলো কতশত হাজার হাজার বার সঞ্জয়ের কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে।কিন্তু আজও কেন সুমিতের সেই একদিনের কিছু সময়ের আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ মনে পড়লেই শরীর ও মন শিহরিত হয় সুচন্দা এর উত্তর পায় না --।সুমিতের কোন খবর সে জানে না।পরিচিত একজন বলেছিলো সে বিদেশেই সেটেল্ড হয়েছে।কখনো সখনো সুচন্দার মনে প্রশ্ন জাগে সুমিত কি আজও তাকে তার মত করেই মনে রেখেছে?সে কি এতগুলি বছর বাদে কখনো তার কথা মনে করে?
সুচন্দার লেখা প্রতিটা গল্প,কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে সুমিত। হ্যাঁ সঞ্জয়ও আসে ঠিকই কিন্তু প্রেমের দৃশ্য কল্পনায় সাতাশ বছরের বিবাহিত জীবনের অতি কাছের মানুষ সঞ্জয়কে পিছনে ফেলে দিয়ে মাত্র একদিনের সেই প্রথম ছোঁয়া সবকিছু যেন লন্ডভন্ড করে দেয়।
কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে এই যে দ্বিসত্তা কাজ করে তারজন্য সেই মানুষটি কিন্তু কখনোই দায়ী নয়।এটাই হয়ত মানব জীবন!জীবনে সে যা পায় হয়ত সে তা চেয়েছিলো না আবার যা সে পায় না সেটা পেলেই জীবনে খুব ভালো থাকতো এরূপ একটা ধারণা কাজ করে।অর্থাৎ পাওয়া এবং না পাওয়া দুটোতেই থাকে অধিকাংশ মানুষের আক্ষেপ!আর সেক্ষেত্রে মানুষ তার নিজের মনটাই ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না।কারণ মানুষের মন সব সময় নিজ কন্ট্রোলে থাকে না।
বিশাখাকে ফেসবুকে প্রচুর খুঁজলেও কি যেন এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে সুমিতকে কোনদিন খোঁজেনি সে। অস্মিতাকে খুঁজে পাওয়ার পর অনেক সময় অস্মিতা সুচন্দার লেখা শেয়ার করেছে।সুচন্দা তার ভালোবাসার কথা কলেজ লাইফে অস্মিতার সাথে শেয়ার করলেও কোনদিনও সে তার প্রেমিকের নামটি বলেনি।তাই অস্মিতা জানেই না সুচন্দার কিশরিবেলার প্রেমিক সুমিত।কিন্তু অদ্ভুতভাবে সুমিতের বোন বিশাখা আর অস্মিতা দুজনেই ফেসবুক ফ্রেন্ড।সুচন্দার লেখা অস্মিতা শেয়ার করার ফলে বিশাখার চোখে পড়ে।বিশাখা সেখান থেকে সুচন্দার প্রোফাইলের খোঁজ পায়।
বিশাখা, অস্মিতা,সুচন্দা যখন একে অন্যের ফেসবুক ফ্রেন্ড তখন সুচন্দা অতি কৌশলে বিশাখার কাছ থেকে সুমিতের সমস্ত খবর জেনে গিয়েও চুপ থাকে।এমনই একদিনে ফেসবুক খুলে সুচন্দা দেখে সুমিত তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে।সুমিতের নামটা দেখেই এই পঞ্চান্ন বছর বয়সেও সুচন্দার বুকের ভিতর সেই কিশরীবেলার ধুকপুকানি শুরু হয়।এতগুলো বছর বাদে সুমিতের খবর পেয়ে সুচন্দা আবেগবিহবল হয়ে ইনবক্সেই কল করে বসে সুমিতকে।
'হ্যালো' বলেই দুই প্রান্তের দুজনেই চুপ। কারো মুখেই কোন কথা শোনা যায় না।শুধুমাত্র ফোনের দুই পাশের দুটি মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।দীর্ঘ সময়ের বিরতির পর সুমিত প্রথম জানতে চায়
--- কেমন আছো তুমি?
সুচন্দা তখনো চুপ।সুমিত বুঝতে পারে ফোনের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুচন্দা এতদিনের কষ্ট,আবেগ,বিরহ সর্বোপরি পুনরায় পরিচিত হওয়ার অনুভূতিতে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে অন্যপ্রান্তে ফোন হাতে থাকা মানুষটি তার গলা শুনে যাতে তার আবেগ বুঝতে না পারে তাই সে মুখে কোন কথা না বলেই চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment