Tuesday, April 26, 2022

ঝরাপাতা (ঊনত্রিশ পর্ব)

ঝরাপাতা (ঊনত্রিশ পর্ব)
  প্রতিদিন দুটো মানুষের যেন নেশার মত পেয়ে বসে দিনে দু'বার ফোন করা।স্ত্রী দীপালিকে লুকিয়েই সুমিত সুচন্দাকে ফোন করে।কারণ তার স্ত্রী ভীষণ সন্দেহবাতিকগ্রস্ত একজন মহিলা।আপন বোনের সাথে হেসে কথা বলতে দেখলেও তার সন্দেহ হয়।বদ্ধ দরজার মধ্যে স্বামীর সাথে এটা নিয়েও সে ঝামেলা করতে ছাড়ে না।
।এই শেষ জীবনে এসে সংসারের কাউকে কোনরকম অবহেলা না করে  সমস্ত দায়িত্ব পালন করেও দূর থেকে একটি পুরুষ ও একটি নারী ফোনে কথা বলে শুনলেও চোখ কপালে তুলে তার চরিত্রের চৌদ্দগুষ্ঠি ধুয়ে দেয় আমাদের সমাজ।আজও এই বাঙ্গালী সমাজের ভিতরটা খুবই কর্দমাক্ত,নোংরা।তারা মানুষের দুঃখের সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে হাহুতাশ করে পিছন ফিরতে না ফিরতেই সেই দুখী মানুষটির সমালোচনায় রপ্ত হয়।অন্যের সুখে তাদের চোখ টাটায়। বাঙ্গালী সমাজ ভাবতেই পারে না একটা পুরুষ আর একটা নারী সারাজীবন বন্ধু হয়েই কাটিয়ে দিতে পারে।তারা সেই বন্ধুত্বের মাঝে খারাপ কিছু দেখবেই!সুস্থ্য,সুন্দর একটা সম্পর্কের মাঝে তারা টেনে আনবেই তাদের মনগড়া একটা যৌণ সম্পর্ক।আর সেই সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো একটা স্ক্রিপ্ট রচনা করে নরনারী দু'জনকে মাঝখানে রেখে নিজেরাই পার্শ্ব-চরিত্র হয়ে পুরো পাড়া কাঁপিয়ে অভিনয় করে চলে!
 সুমিতের ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা শেষ।মেয়েটি ভালো চাকরিও করে।ছেলেটি ছোটখাটো একটা চাকরি করলেও সুমিতের ইচ্ছা ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে সে বড় কোন কাজের চেষ্টা করুক।সেটা যদি বাইরে কোথাও হয় তার কোন আপত্তি নেই।কিন্তু ছেলের মায়ের আবার এ ব্যাপারে ঘোর আপত্তি।ছেলেকে ছাড়া তার আবার এক মুহূর্ত চলে না।ছেলেও মায়ের খুব ন্যাওটা।মায়ের কথায় তার কাছে শেষ কথা।নিজের মতামতের থেকে মায়ের মতামতকে সে গুরুত্ব দেয় বেশি।ছেলের গর্বে গর্বিত দীপালি।
আর অন্যদিকে মেয়ে হচ্ছে বাপ ভক্ত।তবে বাবার কথায় যে তার কাছে শেষ কথা তা কিন্তু নয়।সে তার যুক্তি তর্ক দিয়ে অনেক সময় বাবার মতকে নস্যাৎ করে দেয়।ভাই যেমন অন্ধ ভক্ত মায়ের সে ঠিক আবার তা নয়।এমনিতে সে খুব বুদ্ধিমতি।নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে সে গুরুত্ব দিতে জানে।তবে যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য সে বাবার সাথে আলোচনা না করে পারে না।বাবা তার বন্ধুর মত।সব কথায় সে তার বাবার সাথে খোলামনে আলোচনা করে থাকে।আর সুমিতও তার যেকোন সমস্যায় স্ত্রী দীপালি নয় সে তার মেয়ের সাথেই আলোচনা করে।কিন্তু এখন যে সে একবার দেশে আসবে সুচন্দার সাথে দেখা করতে একথা সে কি করে মেয়ে বা তার মাকে বলবে? একথা না বললেও কি কারণই বা তাদের দর্শাবে?কিন্তু আজকে যখন কথা প্রসঙ্গে দোদুল ও অস্মিতার কথা সুমিত জানতে পারে তখনই সে ঠিক করে এটাই একমাত্র উপায়।দোদুলের অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর ওকে নিয়েই সে দেশে ফিরবে।
 দোদুলের সাথে দীপালির আবার খুব ভালো সম্পর্ক।দোদুল সুস্থ্য থাকতে মাঝে মধ্যেই সে সুমিতদের বাড়িতে আসতো আর দীপালি তাকে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়তে না।সুমিত দীপালির কাছে দোদুলের ফেলে আসা অতীত নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে। দীপালিকে সুমিত জানায় 
--- দোদুলের অপারেশনটা সাকসেসফুল হলেই সে দোদুলকে নিয়ে শিলিগুড়ি আসবে আর দুজনকে যেভাবেই হোক রাজি করিয়ে এবার একটা রেজিস্ট্রি করিয়ে তবে ছাড়বে।
 দীপালি তার কথা সমর্থন করে।সুতরাং সুমিতের দেশে আসার পারিবারিক ভিসাটা সে জোগাড় করে ফেলে।এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
 এরই মাঝে একদিন দোদুলের সাথে দেখা করে সে সুচন্দা, অস্মিতা সকলের কথা বলে।বারবার দোদুলকে অনুরোধ করে অস্মিতার সাথে ফোনে কথা বলার জন্য।প্রথম অবস্থায় দোদুল কিছুতেই রাজি হতে চায় না।কিন্তু সুমিতও নাছোড়বান্দা হয়ে তাকে ঠিক রাজি করায়।আর এদিকে দোদুলের অপারেশনের জন্য নিজেই ছুটাছুটি করতে থাকে।
 দোদুল অস্মিতাকে ফোন করে।ফোনটা রিসিভ করেই অস্মিতা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতে করতে হাউমাউ করে যা বলছে দোদুল তার এক বর্ণও বুঝতে না পেরে হাসতে হাসতে বলে,
--- আরে এত কথা যে বলছো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।এখন তো কান্নাটা বন্ধ করো।সেই আগের মতই আছো দেখছি। কাঁদতে কাঁদতে কথা বলা।
 অস্মিতা কোনরকমে নিজেকে সামলিয়ে ধরা গলায় বলে,
--- আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার অর্থটা কি?আমার জীবনের সাথে তোমার জীবন জড়াতে চেয়েছিলাম না কারণ আমি চেয়েছিলাম তুমি বিয়ে করে সংসারী হও।ভালো থাকো জীবনে।
--- দূর পাগলী!ভালো যেমন একজনকেই মনপ্রাণ দিয়ে বাসা যায় আর সুখী হতে গেলে যে বিয়েটা দরকার সেটাও একবারই হয়।এর বাইরে যেগুলো ঘটে সেগুলো হচ্ছে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ।আমি আমার জীবনে একজনকেই সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম আর মনেমনে তাকেই স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম।সে বুঝতে পারেনি তারজন্য তো আমার কোন দোষ নেই।(হাসতে থাকে দোদুল)এখনো রাতে ঘুমাতে গেলে আমার একটা মুখই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
অস্মিতা তখন অনেকটাই নিজেকে সামলে নিয়েছে।সেও মৃদু রাগানিত্ব স্বরে বলল,
--- হ্যাঁ আর আমার ঘুমের সময় তো পাড়ার সব মানুষের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।যাচ্ছে তাই একটা!কোনদিন আমায় বুঝলোও না।সেই কবের থেকে ফোনের আশায় বসে আছি আর উনি অসুস্থ্য হয়েছেন বলে আমার সাথে কোন যোগাযোগই রাখলেন না।আমার এখন কি ইচ্ছা করছে জানো?
--- কি?
--- তোমার বুকের উপর বেশ কয়েকটা কিল ঘুষি মারতে!
--- আহারে!সেই সৌভাগ্য কি আমার আর হবে? অপারেশন সাকসেসফুল না হলে একটা পঙ্গু মানুষকে মেরে কি লাভ হবে তোমার?
 দোদুল হো হো করে হাসতে থাকে।আর অপর প্রান্তে সুচন্দা চিৎকার করে ওঠে,
--- আর একবার একথা বলে দেখো দেখা হলে তোমায় মেরেই ফেলবো।
--- জানো অস্মি কতদিন পর তোমার সাথে কথা বলতে পেরে মনের ভিতরে সেই কলেজ জীবনের অদ্ভুত সেই অনুভূতি কাজ করছে।এত যে বয়স বেড়েছে যখন তোমার সাথে কথা বলছি একবারও মনেই হচ্ছে না।সেই দুষ্টুমিগুলো বারবার মনে পড়ছে।আমি তো আশায় ছেড়ে দিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম তোমার সাথে আর দেখা হবে না।ভাগ্যিস সুচন্দা তোমায় খুঁজে পেয়েছিল।
--- সেই জন্য এতদিন দেরি করে ফোন করলে?
--- আসলে কি জানো অপারেশনের পর যখন পা ঠিক হল না আমি তখন আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।কিন্তু সুমিত বড় ডাক্তারের সাথে কন্ট্যাক্ট করে জানতে পারলো এটা ভালো হবার সম্ভবনা নিরানব্বই পার্সেন্ট।তোমার খবর পেয়েও ফোন করিনি ভেবেছিলাম এই পঙ্গু মানুষটার ভারটা সারাজীবন তোমার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে।
--- এই তুমি আবার এরকম উল্টোপাল্টা কথা বলছো?তুমি কি এই বয়সে এসেও সেই আগের মত আমাকে শুধু কাঁদাবে?
--- নাগো যদি পা টা ভালো হয় বিশ্বাস করো এবার আমি তোমাকে আমার কাছেই নিয়ে আসবো।এবার আর কোন কথা শুনবো না।
 অস্মিতা একথা শুনে অস্ফুট স্বরে বললো,
-- যাহ -- এই বয়সে ভীমরতি ধরেছে।
  কথাটা বলল ঠিকই সে,সেও কিন্তু এই বয়সেই পুনরায় লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।আসলে মানুষের বাইরের বয়সটাই বারে ভিতরের মানুষটা থেকে যায় সেই কিশোরী বা যুবতী বেলার।

ক্রমশঃ
 

Saturday, April 23, 2022

ঝরাপাতা (আঠাশ পর্ব)

 ঝরাপাতা (আঠাশ পর্ব)
  এই বয়সে এসে দুজনের নতুন করে আর কিছুই চাওয়ার নেই।ছেলেমেয়ের গল্প,দৈনন্দিন জীবনে কি ঘটলো না ঘটলো ,পুরনো দিনের কোন হাসিমজার গল্প চলে দু'জনের মধ্যে।এই কথার মধ্য দিয়েই যেন দুজনেরই মনেহয় শুধুমাত্র এই গল্পই জীবনের না পাওয়াগুলির একটু একটু করে পূর্ণতা দিচ্ছে।
  কথা বলতে বলতে যেদিন দু'জনেই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে সেদিন নিজেদের অজান্তেই তারা পৌঁছে যায় বারো থেকে পনের হাজার মাইল দূর থেকে পৃথিবীর দুই প্রান্তে দু'জনে থেকেও বিয়াল্লিশ বছর আগে যেদিন সুমিত তার বলিষ্ঠ দুটি বাহুর মধ্যে সুচন্দার লজ্জাবনত মুদিত দুই চক্ষু আর দুটি থরথর কম্পমান সেই ঠোঁট দুটির আলতো ছোঁয়ায় নিজের ভালোবাসার প্রকাশ করেছিল।আজও যেন দুজনেই সেই ঘটনার শরীর ও মনের শিহরণ অনুভব করে। যা উভয়ের কথাতেই প্রকাশ পায়।কিন্তু কেউ কারও আবেগ কাউকেই বুঝতে দেয় না।
 আমার পাঠককুল হয়ত ভাবতে পারেন জীবনের তিনটে অধ্যায় আলাদা আলাদাভাবে তাদের দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে দিয়ে এই বয়সে এসে সুমিত ও সুচন্দা যা করছেন সেটা মোটেই শোভনীয় নয়।কিন্তু সত্যিই কি তাই?মানুষের মন বলে যে জিনিসটি আছে তাকে কি সব সময় নিজ কন্ট্রোলে রাখা যায়?পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী যান হচ্ছে মানুষের মন।সেতো মুহূর্তেই যে কোন জায়গায় যে কোন পরিস্থিতিতে অন্যত্র পৌঁছে যেতে পারে!তারমধ্যে তো কোন অন্যায় বা খারাপ কিছু নেই।ফেলে আসা অতীতকে তারা কোনদিনও ফিরে পাবে না,সমাজ-সংসার,তাদের ছেলেমেয়েদের ফেলে কেউ নতুন করে নিজেদের নিয়ে কোনো স্বপ্নও দেখবে না।শুধুমাত্র ফোনে কথা বলে নিজেদের মনে জমানো সেই কষ্টের পাহাড়কে ডিঙিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দুজনেই একটু শান্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে মাত্র।আর কিছু না পেলেও সেই মুহূর্তে দুজনেই তাদের ফেলে আসা অতীতে বিচরণ করতে পারে।
  এইভাবেই একদিন কথা বলতে বলতে সুমিত বলে,
-- যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম সেই সময় কলেজে আমার একজন সহপাঠীর সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়।আজও সেই বন্ধুত্ব অটুট।সেও একটি মেয়েকে ভালোবাসতো জানো?কিন্তু ওই কপাল! তারও মেয়েটির সাথে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। দু'বাড়ির সকলেই রাজি ছিলেন।কিন্তু মেয়েটির বাবা হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পরে সেই মেয়েটির উপর।
 সুচন্দা চুপচাপ সুমিতের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। কারো জীবনের সাথে মেলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সুমিত যেহেতু ঘটনার বিবরণ দিয়েই চলেছে তাই সে কথার মাঝখানে কোন কথা বলছে না।সুমিতের কথাগুলো আবার মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে।
 "তখন আমার বন্ধু ওর প্রেমিকাকে বলেছিলো এ দায়িত্ব পালনে সেও তার পাশে থাকবে।কিন্তু জানো সুচন্দা মেয়েটি কিছুতেই রাজি হলো না।ফিরিয়ে দিলো আমার বন্ধুটিকে।বাবা,মা মারা যাওয়ার পড়ে বন্ধুটিরও আর কেউ রইলো না।সারাটা জীবন মানুষের সেবা করেই গেলো।সব কিছুই ঠিক ছিল।কিন্তু হঠাৎ করেই বন্ধুটির জীবনে নেমে এসেছে এক দুর্যোগ।এখন সে সম্পূর্ণভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল।"
--- কেন কি হয়েছে তার?বন্ধুটির নাম কি তোমার?আর তোমার বন্ধু যাকে ভালোবাসতো তারই বা নাম কি?
 সুমিত একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- কি হবে আর সেসব জেনে?তবে জানো আমার বন্ধুর বাড়ি কিন্তু শিলিগুড়ি ছিল -- 
--- তোমার বন্ধুর নাম কি দোদুল?
--- তুমি কি করে জানলে?
--- হা ভগবান!এই মানুষটার সাথে আমার পরিচয় সেই কলেজ লাইফ থেকে।কত বছর আমি দোদুলদাকে ভাইফোঁটা দিয়েছি। ফোনে সব সময় কথা হত।তবে এই কিছুদিন হল দাদা যেন একটু অন্যরকমভাবে কথা বলছে।বেশ কিছুদিন যোগাযোগ রাখেনি।শেষ ফোন করেছে দিন দশেক আগে।দাদা তো আমার বন্ধু অস্মিতাকে ভালোবাসতো।
--- কি বলছো এসব?তারমানে আমি যদি দোদুলকে আমার জীবনে তোমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা জানাতাম তবে সেই বিয়াল্লিশ বছর আগেই তোমার খোঁজ পেতাম?এখন আমার নিজের চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।পাগলের মত চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে।
--- কি হয়েছে দাদার?সেদিন কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ফোনটা কেটে দিলো। অস্মিতার খবর জানালাম কেমন উদাসীন মনেহল।কি হয়েছে বলো তো?
--- তুমি জানো এখন সে কোথায়?
--- দাদা তো তার কাজের প্রয়োজনে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়।আমায় শেষবার বলেছিলো আমেরিকা যাচ্ছে।তারপর তো অনেকদিন কোন যোগাযোগ ছিল না।আর সেদিন দাদা বেশিক্ষণ কথাও বলেনি। 
--- আমেরিকার কাজ শেষ করে ও ওর স্থায়ী ঠিকানা আমার বাড়ির কাছেই অর্থাৎ কানাডায় ফিরছিল।এয়ারপোর্টে এক্সক্লারেটরিতে থাকার সময়েই ওর হার্ট অ্যাটাক হয়।গড়িয়ে পড়ে যায় বেশ উপর থেকেই।হার্টের সমস্যা ছাড়াও দুই পায়েরই হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়।তড়িঘড়ি ওখান থেকেই তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়।দুটো ব্লকেজ ধরা পড়ে।হাঁটুর অপারেশন হয়।কিন্তু সাকসেসফুল হয় না।বেশ কিছুদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ও কানাডায় ফিরে আসে নিজ বাড়িতে।এখন হুইলচেয়ার ছাড়া নড়াচড়া করতে পারে না যদিও ডাক্তার আশ্বাস দিয়েছেন আর একটা অপারেশনের পর ও সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে যাবে।
--- কি অদ্ভুত লাগছে ঘটনাগুলো।দোদুলদা তোমার বন্ধু, অস্মিতা আমার বন্ধু।আমরা সবাই সবাইকে চিনি জানি।অথচ এতগুলো বছর ধরে আমরা কেউ কারো খবর জানতে পারলাম না শুধুমাত্র নিজেদের কষ্টগুলো নিজেদের মনের ভিতরে চেপে রাখার ফলে।তুমি আজ দাদার কাছে গিয়ে সবকিছু জানাবে আমাদের এই বন্ধুত্বের কথা। অস্মিতার সাথে কথা বলতে বলবে। অস্মিতার তখন কোন উপায় ছিল না ওকে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া।ভাইবোনগুলো সব ছোট ছিলো।সেই মুহূর্তে মাসীমাও খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। অস্মিতা ভেবেছিল দাদাকে ফিরিয়ে দিলে দাদা তার জীবনটাকে সুন্দরভাবে গড়ে নেবে।দাদাকে ভালোবেসে তাকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেও সারাটা জীবন একাকী থেকে কষ্ট পেয়ে গেলো।আমার কাছ থেকে দাদার ফোন নম্বর নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।কিন্তু দাদা কিছুতেই ওর সাথে যোগাযোগ করছে না।ও খুব ভেঙ্গে পড়েছে ,খুব কান্নাকাটিও করছে।সত্যি বলতে কি জানো?ওকে কিন্তু কোন দোষ দেওয়া যায় না।ও যদি তখন শক্ত হাতে সংসারের হালটা না ধরতো ওদের সংসারটা ভেসে যেত,ভাইবোনেরা কেউ মানুষ হত না।পরিস্থিতি মানুষকে কঠোর হতে বাধ্য করে।কিন্তু অস্মিতার মনের মধ্যে ভালোবাসার একটি নামই রয়ে গেছে সে আমার দোদুলদা।
 সুমিত তখন একটু দুষ্টুমি করে বলে,
--- আর তোমার মনের মধ্যে কে আছে?
 সুমিতের হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে সুচন্দা একটু ঘাবড়ে গেলো।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
--- আমরা কিন্তু দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হয়েছি।জীবনে অনেক কাঠখর পুড়িয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা করেছি।কে কতটা সুখী হয়েছি সে কথা নিজেরা ছাড়া অন্য কেউই জানে না।কিন্তু ওদের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।ওরা পরস্পরকে ভালোবেসেই পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।এখন আমাদের উচিত ওদের দুজনের একবার দেখা করিয়ে দেওয়ার।দাদা সুস্থ্য হয়ে গেলেই তুমি ওকে নিয়ে একবার দেশে আসবে। 
 সুমিত আবারও দুষ্টুমি করে বলল,
--- ওদের দেখা করিয়ে দেবো নিশ্চয় কিন্তু আমাদের দেখা হলে দু'জনে কিন্তু সেই বাড়িতে আবার যাবো।তখন যদি আবার ---
 সুচন্দা হাসতে হাসতে বলল,
--- মুখে যা আসছে তাই বলছো --।এত কথা তো আগে তোমার মুখে শুনিনি।
--- বারে আমি বড় হয়ে গেছি তো। তখন বাচ্চা ছিলাম এত সাহস ছিল না।(হাসতে হাসতে সুমিত বলে)
সুচন্দাও হাসতে হাসতে বলে,
--- বড় আর হলে কোথায়?বলো বুড়ো হয়ে গেছো।
 ফোনের দুইপ্রান্তে দু'জনেই হাসতে থাকে।

ক্রমশঃ
    

Friday, April 22, 2022

ঝরাপাতা(সাতাশ পর্ব)

ঝরাপাতা (সাতাশ পর্ব)
  বেশ কিছুক্ষণ দু'জনেই চুপ করে থাকলো।এইভাবেই কেটে গেলো সেকেন্ড থেকে বেশ কয়েক মিনিট।পুনরায় সুমিত বললো,
--- কেমন আছো তুমি? প্লিজ সুচন্দা এবার কথা বলো।
 আরও বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সুচন্দা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে,
--- ভালো আছি,তোমরা সবাই ভালো আছো তো?
 --- বাড়ির সবাই ভালো আছে।আর আমি?জীবন তো থেমে থাকবার জন্য নয় বেঁচে আছি যখন ভালোমন্দ মিশিয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে চলেছি।
 আবার দুই প্রান্তে দু'জনেই চুপ।সুমিত ও সুচন্দার এই নীরবতায় যেন হাজার হাজার মাইল দূর থেকে অনেক জমে থাকা সব কথা জানান দিচ্ছে।
--- সুমিত,তুমি এখন কোথায় আছো?আসলে তোমার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টটা পেয়ে তোমার প্রোফাইল দেখা হয়নি।
--- প্রথমে আমি বেশ কয়েক বছর লন্ডন ছিলাম।এখন কানাডায় আছি।এখানেই বাড়ি করেছি।আমার একছেলে আর এক মেয়ে।তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?কে কে আছেন ?তোমার ক'টি ছেলেমেয়ে?
--- প্রথমে শিলিগুড়ি ছিলাম।হাজব্যান্ডের চাকরীর বদলীর
 কারণে কলকাতা চলে আসি।এখানেই বাড়ি করেছি।আমারও একছেলে,একমেয়ে।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।মেয়ের বিয়ে ওর বাবা থাকতেই দিয়ে গেছে।এখন ---
 কথা শেষ হয় না সুচন্দার।তার মাঝেই সুমিত প্রশ্ন করে,
--- কোথায় গেছেন তোমার হাজব্যান্ড?
 সুচন্দা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে,
-- আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে --
 সুচন্দার এই দীর্ঘনিশ্বাস যেন সুমিতের বুক চিরে বেরিয়ে আসে।সুমিত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
--- তাহলে বাড়িতে তুমি আর তোমার ছেলে?তুমি কিসে চাকরি করো?
 সুচন্দা একটু হেসে উত্তর দেয়,
--- না,ওসব আমার কপালে জোঠেনি।সঞ্জয়ের পেনশন আর বাড়ি ভাড়া ;চলে যাচ্ছে মা,ছেলের।তুমি এখন আর দেশে আসো না?
--- বহুদিন আর যাওয়া হয় না।বাবা,মা বেঁচে থাকতে যেতাম।
      কথা আর শেষ হয় না।কথা চলতেই থাকে শুধু সেদিনই নয় প্রতিদিন ঠিক নিয়ম করে দুবেলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা।বিয়াল্লিশ বছরে নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা।দু'জনের স্মৃতি মাত্র এক কি দু'দিনের।কেউ তার নিজের জীবনের কোন কথায় কারো কাছে লুকায় না।এমন কি সুমিত ইতিকার কথাও সুচন্দার কাছে সব বলে।সুমিতের কাছে তার বৈবাহিক জীবনের সমস্ত কথা শুনে সুচন্দা বুঝতে পারে দুটি মানুষ একসাথে বছরের পর বছর একই ছাদের তলায় থাকলেই সুখী জীবন প্রত্যেকের কাটে না।গ্রামের সহজ সরল সুমিত যতই উচ্চপদে চাকরি করুক না কেন তার ভিতর আজও সেই সরলতা রয়েই গেছে।আত্মসম্মান,ছেলেমেয়ের ভবিৎষত সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে সেই মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার গল্প শুধু যে নারী জীবনেই ঘটে তা কিন্তু মোটেই নয়।সময়ে সময়ে পুরুষও এই চক্রব্যুহের মধ্যে বন্দী হয়।জীবনে অর্থ,সম্পদ,বৈভব থাকা মানেই সুখী জীবন কাটানো তা কিন্তু মোটেই নয়। ফুটপাতেও দুটি নরনারী সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারে যদি মনের মিল হয়।সুমিত ও দীপালীর জীবনে সবকিছু থাকলেও মনের মিলটার বড়ই অভাব ছিল।দীপালীর আকাশচুম্বী চাহিদা মেটাতে সুমিত কখনোই কোন কার্পণ্য করেনি ;ঈশ্বর সে ক্ষমতাটা তাকে দিয়েও ছিলেন তবুও কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকেই গেছে।আর সম্ববত সে ফাঁকটা সুমিতের সরলতা।
 কিশোর বয়সে সুচন্দাকে ভালোবেসে তাকে হারানোর যন্ত্রণা পরবর্তীতে ইতিকার কাছ থেকে পাওয়া আঘাত সুমিত প্রতি মুহূর্তে যখন যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে তখন বাড়ির মানুষজন ভাবে এই মুহূর্তে সুমিতকে ঠিক রাখার একটাই উপায় একটা বিয়ে দিয়ে দেওয়া।বিয়ে হয়ে গেলে স্ত্রীর ভালোবাসায় নিজেকে সামলে নিতে পারবে।সুচন্দার কথাটা সুমিতের বোন বিশাখা একমাত্র জানতো।কিন্তু ইতিকার কথা বাড়ির সকলেই জানতো।তাদের মনের ইচ্ছাও ছিল মেয়েটিকে সুমিতের বউ করে আনা।
 কিন্তু  কার্যক্ষেত্রে সবকিছুই ওলটপালট হয়ে গেলো।সুমিতও তখন ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে দেখে বাড়ির সকলে প্রায় জোর করেই তার বিয়ের ব্যবস্থা করে।তখন সুমিতের মা বেঁচে।সুমিতের বউ দীপালীর অনেক দোষ-ত্রুটির কথা সুমিতের মা যখন ছেলের কাছে বলতেন তখন সে সব কথা সরল,সাদা ছেলে সুমিত গিয়ে তার বউকে বলতো।"এসব কথা কে বলেছে"- জানতে চাইলে সাতপাঁচ না ভেবে সুমিত তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছে জানিয়ে দিত। এ কথাগুলো বউকে বলার অন্য কোন উদ্দেশ্য তার ছিল না।সে শুধু চেয়েছিলো দীপা যাতে তার মায়ের কথা শোনে।এর ফলস্বরূপ দীপালী কোনদিনও তার শ্বাশুড়ীকে ভালো চোখে দেখেনি।অথচ গ্রাম্য সহজ,সরল এই মানুষটি তার ছেলের বউটিকে কিন্তু যথেষ্ঠ ভালোবাসতেন।কিন্তু স্বল্প শিক্ষিত মহিলা বুঝতেই পারেননি তার পুত্রবধূটির দোষ,ত্রুটিগুলো ছেলের কাছে বললে তা বিশাল আকার ধারণ করবে।প্রথম দিকে তিনি নিজেই চেষ্টা করেছিলেন তার সুমিতের বউ যে কটাদিন তাদের গ্রামের বাড়িতে থাকবে অন্তত কাপড় পরে থাকুক।তিনি বারবার বলেও তা সম্ভব করতে পারেননি।আবার এ কথাও বলেছেন বাড়িতে বাইরের লোকজন থাকলে যেন সে উচ্চস্বরে কথা না বলে।এই ছোট ছোট চাহিদাগুলো মাত্র কয়েকটা দিনের জন্য তিনি বধূটির কাছে দাবি করেছিলেন।কারণ সুমিত বিয়ের অনেক আগেই চাকরি পেয়ে গেছে এবং দেশের বাইরেই থাকে সে।বিয়ের পর সর্বসাকুল্যে মাত্র পনের থেকে কুড়ি দিন দীপালি তার শ্বশুরবাড়ি ছিল।কিন্তু দীপালী এটুকুও দিতে পারেনি বয়স্ক মানুষটিকে।সুমিতের বিয়ের পড়ে তাই যতবার সুমিত তার মাকে লন্ডন নিয়ে যেতে চেয়েছে তিনি প্রতিবারই এড়িয়ে গেছেন।সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ হলেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং জেদী।আর দিপালীকে তিনি খুব ভালোভাবেই চিনে গেছিলেন মাত্র ওই কটাদিনে।তাই ছেলের কথায় তার বাড়িতে কয়েকটা দিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে তিনি ছেলে বউয়ের বিরাগভাজন হয়ে তার সংসারের অশান্তি আনতে চাননি কখনোই। তাই সুমিত তার বউ নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার পড়ে সুমিতের জোড়াজুড়ি সর্তেও কোনদিন ছেলের কাছে যেতে চাননি ঠিক তেমনই ছেলেকেও কোনদিন দেশে আসতে বলেননি।
 একবার ভাইফোঁটার সময় বোন ও দিদির আব্দারে দিন পনেরর জন্য সুমিত দেশে এসেছিল বউ ছেলেমেয়েকে না নিয়ে একাই। তখনও মাকে বহুবার অনুরোধ করেছিল সে।কিন্তু তিনি কিছুতেই ছেলের সাথে ছেলের বাড়ি যেতে রাজি হননি।বুদ্ধিমতী ,জেদী মহিলা সামান্য কটাদিনেই তার সুমিতের বউকে খুব ভালোভাবেই চিনে গেছিলেন।আর এটাও বুঝেছিলেন তার সরল, ভোলাভালা ছেলেটির জীবনে সুম্পূর্ণ দাম্পত্য সুখ এনে দিতে তিনি পারেননি।তার কিংবা বাড়ির সকলের নির্বাচনে ঘাটতি রয়েই গেছে।তবে সুমিতের প্রতি এ বিশ্বাসও তার ছিল ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছেলের অসীম।সবকিছুর থেকে নিজেকে ব্রাত্য রেখে সে ঠিক ওই মেয়ের সাথেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
 সুমিতের মা যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তখন বাড়ির লোকেরা তাকে বারবার বলেছে যে তিনি সুমিতকে দেখতে চান কিনা - চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ার সাথে মাথা নাড়িয়ে তিনি প্রতিবারই 'না' বলে গেছেন।মৃত্যুর সময় তিনি তার সুমিতকে তাই দেখে যেতেও পারেননি।
 সুচন্দার সাথে নিয়ম করে প্রতিদিন দু'বেলা কথা বলার মাঝে নিজের জীবনের সমস্ত দুঃখ,কষ্টগুলো এতদিন পড়ে যেন সুমিত কাউকে বলার মত একজন মানুষ খুঁজে পেয়েছে।যে (সুচন্দা) এতদূর থেকে ফোনের মাধ্যমে তার দুঃখগুলোকে নিজের মনে করে সুমিতের ক্ষতে প্রলেপ ফেলতে পারছে আর সুমিতও মনের মধ্যে এতদিন ধরে জমে থাকা কষ্টের ভার লাঘব করতে পেরেছে।

ক্রমশঃ 
    

Thursday, April 21, 2022

ঝরাপাতা (ছাব্বিশ পর্ব)

 ঝরাপাতা (ছাব্বিশ পর্ব)
  সুচন্দা ছেলের এবারে বিটেক শেষ বর্ষ।তার মাস্টার্স করার ইচ্ছা।সুচন্দা তার জীবনের না পাওয়াগুলিকে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মেনে নিলেও মনেমনে সুপ্ত এক আশা নিয়ে আছে যদি তার ছেলেটা মানুষের মত মানুষ হয় তাহলে হয়ত জীবনে আশা ভঙ্গের কষ্টগুলো কিছুটা হলেও প্রলেপ পাবে।
  তাই আর্থিক পরিস্থিতি যতই খারাপ থাকুক না কেন ছেলেকে মানুষ করার জন্য সুচন্দা বিন্দুমাত্র ভাবে না।ছেলে সায়ক অবশ্য অনেকবারই তাকে বলেছে এডুকেশন লোন নিয়ে তাকে পড়াতে।কিন্তু সুচন্দা মোটেই তাতে রাজি নয়।সে চায় না আজ না হোক কাল ছেলের মনে এই প্রশ্নের উদয় হয় যে মা আমার মাথার উপর লোনের বোঝা চাপিয়ে আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন।তাই শত কষ্ট হলেও সুচন্দা ছেলে যতদূর পড়তে চায় সে পড়াবে।একজন আদর্শ মা হিসাবে সুচন্দা এই পথেই হাঁটবে।
  লেখালেখির জগতে সুচন্দার একটা আলাদা পরিচয় সে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে অনেক আগেই।সঞ্জয় কোনদিনও সুচন্দার একটা লেখাও পড়েনি ঠিকই কিন্তু সুচন্দার লেখার ব্যাপারে তাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করতো সে।সারা জীবনই সুচন্দা রাত জেগে পড়াশুনা করেছে এমন কি এই লেখালেখিটাও সে রাত জেগেই করে।রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে সব কাজ সেরে সুচন্দা অন্য ঘরে বসে লিখতো।কিন্তু সঞ্জয় তাকে বলে,
--- তুমি আমাদের বেডরুমে বসেই লেখালেখি করবে।
--- কিন্তু বড় লাইট জ্বললে তোমার তো ঘুমের অসুবিধা হবে।
--- না হবে না।ওই ঘর থেকে তুমি চলে আসলে আমার খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।প্রয়োজনে আমি চোখের উপর একটা পাতলা কাপড় দিয়ে রাখবো।কিন্তু তুমি ওই ঘরে বসেই লিখো।
  যে সঞ্জয় অফিস ছাড়া এক মুহুর্ত সময় একা থাকতে পারতো না সেই আজ প্রায় পাঁচ বছর সুচন্দা,তার বহু কষ্টে গুছানো নিজের সংসার ,তার ছেলেমেয়ে, জামাই সবাইকে ছেড়ে কোন অদৃশ্য লোকে আছে তা কেউই জানে না।সঞ্জয় চলে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম সুচন্দার মনে হত সে বুঝি সুচন্দার কাছাকাছিই রয়েছে।হয়ত মায়ার বাঁধন বা হয়ত মনের ভুল।মাঝে মধ্যেই তার গলার আওয়াজ শোনা,কাশির আওয়াজ শোনা যেন একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।সুচন্দার ছেলে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে মায়ের সাথে সাথে থেকে নানান গল্প-গুজবের মধ্য দিয়ে এই ভাবনা থেকে ঠিক মাকে বের করে এনেছে।আর সব থেকে বড় কথা হল জীবনে অসহনীয় দুঃখ ভোলার একমাত্র ওষুধই তো সময়।
 অনেক রাত পর্যন্ত সুচন্দা তার লেখা নিয়ে জেগে থাকে।জীবনের ফেলে আসা অতীত একাকী নির্জন ঘরে একটু একটু করে সুচন্দাকে কলকাতা বাড়ির আশেপাশে পরিচিত মানুষগুলির খুব কাছাকাছি নিয়ে যায়।সঞ্জয় তার অন্তরে আছে ঠিকই কিন্তু এখন মাঝে মাঝেই সুমিত তার চেতন-অবচেতনে সামনে এসে দাঁড়ায়।এখন এত বছর বাদে সে বুঝতে পারে সঞ্জয়ের সাথে সুখে-দুখে জীবনের সাতাশটা বছর কাটিয়ে দিলেও তার প্রথম ভালোবাসা সুমিত ঠিক তার অন্তরেই রয়ে গেছে।ভুলতে চেষ্টা করে,মনে করতে চায় না সুমিত কে সে কিন্তু কিছুতেই মন থেকে সুমিতকে ঝেড়ে ফেলতে আগেও পারেনি আজ এতগুলো বছর বাদেও পারে না।কোন উপন্যাস বা কোন গল্পের প্রেমের আলাপন লিখতে গেলেই সুমিতের সেই উজ্জ্বল চোখ দুটিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।লিখতে লিখতে অনেক সময় বিয়াল্লিশ বছর আগের সেই প্রথম পরশের উপস্থিতি আজও শরীরে মনে সে টের পায়।মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যায় সে।সঞ্জয় যখন বেঁচে ছিলো কতশত হাজার হাজার বার সঞ্জয়ের কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে।কিন্তু আজও কেন সুমিতের সেই একদিনের কিছু সময়ের আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ মনে পড়লেই শরীর ও মন শিহরিত হয় সুচন্দা এর উত্তর পায় না --।সুমিতের কোন খবর সে জানে না।পরিচিত একজন বলেছিলো সে বিদেশেই সেটেল্ড হয়েছে।কখনো সখনো সুচন্দার মনে প্রশ্ন জাগে সুমিত কি আজও তাকে তার মত করেই মনে রেখেছে?সে কি এতগুলি বছর বাদে কখনো তার কথা মনে করে?
 সুচন্দার লেখা প্রতিটা গল্প,কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে সুমিত। হ্যাঁ সঞ্জয়ও আসে ঠিকই কিন্তু প্রেমের দৃশ্য কল্পনায় সাতাশ বছরের বিবাহিত জীবনের অতি কাছের মানুষ সঞ্জয়কে পিছনে ফেলে দিয়ে মাত্র একদিনের সেই প্রথম ছোঁয়া সবকিছু যেন লন্ডভন্ড করে দেয়।
  কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে এই যে দ্বিসত্তা কাজ করে তারজন্য সেই মানুষটি কিন্তু কখনোই দায়ী নয়।এটাই হয়ত মানব জীবন!জীবনে সে যা পায় হয়ত সে তা চেয়েছিলো না আবার যা সে পায় না সেটা পেলেই জীবনে খুব ভালো থাকতো এরূপ একটা ধারণা কাজ করে।অর্থাৎ পাওয়া এবং না পাওয়া দুটোতেই থাকে অধিকাংশ মানুষের আক্ষেপ!আর সেক্ষেত্রে মানুষ তার নিজের মনটাই ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না।কারণ মানুষের মন সব সময় নিজ কন্ট্রোলে থাকে না।
  বিশাখাকে ফেসবুকে প্রচুর খুঁজলেও কি যেন এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে সুমিতকে কোনদিন খোঁজেনি সে। অস্মিতাকে খুঁজে পাওয়ার পর অনেক সময় অস্মিতা সুচন্দার লেখা শেয়ার করেছে।সুচন্দা তার ভালোবাসার কথা কলেজ লাইফে অস্মিতার সাথে শেয়ার করলেও কোনদিনও সে তার প্রেমিকের নামটি বলেনি।তাই অস্মিতা জানেই না সুচন্দার কিশরিবেলার প্রেমিক সুমিত।কিন্তু অদ্ভুতভাবে সুমিতের বোন বিশাখা আর অস্মিতা দুজনেই ফেসবুক ফ্রেন্ড।সুচন্দার লেখা অস্মিতা শেয়ার করার ফলে বিশাখার চোখে পড়ে।বিশাখা সেখান থেকে সুচন্দার প্রোফাইলের খোঁজ পায়।
  বিশাখা, অস্মিতা,সুচন্দা যখন একে অন্যের ফেসবুক ফ্রেন্ড তখন সুচন্দা অতি কৌশলে বিশাখার কাছ থেকে সুমিতের সমস্ত খবর জেনে গিয়েও চুপ থাকে।এমনই একদিনে ফেসবুক খুলে সুচন্দা দেখে সুমিত তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে।সুমিতের নামটা দেখেই এই পঞ্চান্ন বছর বয়সেও সুচন্দার বুকের ভিতর সেই কিশরীবেলার ধুকপুকানি শুরু হয়।এতগুলো বছর বাদে সুমিতের খবর পেয়ে সুচন্দা আবেগবিহবল হয়ে ইনবক্সেই কল করে বসে সুমিতকে।
 'হ্যালো' বলেই দুই প্রান্তের দুজনেই চুপ। কারো মুখেই কোন কথা শোনা যায় না।শুধুমাত্র ফোনের দুই পাশের দুটি মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।দীর্ঘ সময়ের বিরতির পর সুমিত প্রথম জানতে চায়
--- কেমন আছো তুমি?
 সুচন্দা তখনো চুপ।সুমিত বুঝতে পারে ফোনের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুচন্দা এতদিনের কষ্ট,আবেগ,বিরহ সর্বোপরি পুনরায় পরিচিত হওয়ার অনুভূতিতে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে অন্যপ্রান্তে ফোন হাতে থাকা মানুষটি তার গলা শুনে যাতে তার আবেগ বুঝতে না পারে তাই সে মুখে কোন কথা না বলেই চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে।

ক্রমশঃ

Wednesday, April 20, 2022

ঝরাপাতা (পঁচিশ পর্ব)

ঝরাপাতা (পঁচিশ পর্ব)
   ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস!যে মেয়েটার জন্ম হয়েছিল সোনার চামচ মুখে নিয়ে, রুপেগুনে পড়াশুনায় যে সকলকেই মুগ্ধ করেছিলো। যার স্বপ্ন ছিল খুব ভালোভাবে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার;সবকিছুর মিশেলে যে হাওয়ায় উড়ছিলো কিন্তু একবারও সে ভেবে দেখেনি তার স্বপ্ন, আশা আকাঙ্খা নিয়ে সে যখন মশগুল বিধাতা সেই সময়ে শুধু তার হাতের সুতোটা একটু আলগা করেছিলেন মাত্র!তার জীবনে সবকিছু হারানোর পরেও সে যখন সঞ্জয়ের বউ হয়ে সে বাড়িতে এসেছিলো ;চরম দুঃখ,দারিদ্রের সাথে লড়াই করেও তার জীবনের না পাওয়াগুলিকে একটু একটু করে প্রায় ভুলেই গেছিল সঞ্জয় এবং সেই বাড়ির সকলের ভালোবাসায়।কিন্তু হঠাৎ করেই সঞ্জয়ের চলে যাওয়ায় সুচন্দার জীবনে সময় যেন আবার কিছুটা স্তব্ধ হয়ে গেলো।
  একসময় সুচন্দা তার সমস্ত গায়ের গয়না বিক্রি করে আর কিছুটা ধারদেনা করে নিজেও একটু বাড়ি করেছিলো। হ্যাঁ সঞ্জয়দের নিজেদের বাড়িই ছিল।কিন্তু সে জমির পরিমাণ এতটাই কম ছিল যে বাড়ির মেম্বার অনুযায়ী সকলের একটা করে ঘর হওয়ারও কোন সম্ভাবনা ছিল না।তাই অন্নপূর্ণাদেবী ছেলেদের সাথে পরামর্শ করে শ্বশুরবাড়িটি বিক্রি করে যার যার টাকার পরিমাণ প্রতিটা ছেলের হাতে দিয়ে দেন। যার যেখানে পছন্দ সে সেখানে জমি কেনে।
 সঞ্জয়ের চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা দিন সুচন্দা কেমন থম মেরে গেছিলো।ওই সময় তার মেয়ে,জামাই সব তার সাথেই ছিল।আত্মীয়স্বজন তখন কিছু কিছু আসা যাওয়া করতো।কিন্তু পরবর্তীতে আত্মীয়স্বজনের সমাগম কমতে থাকে।ভায়েরা তো আসেই না।তবে হ্যাঁ পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান হলে দেখা সাক্ষাৎ হলেই গলাগলিতে কোন পক্ষই হার স্বীকার করে না।এক সময় সঞ্জয়কে ছাড়া সুচন্দা একা যে থাকতে পারবে সেটাই কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি।কিন্তু দিব্যি তাকে ছাড়া ছেলেমেয়ে,জামাই,সংসারের দায়িত্ব সবকিছু একলাই সামলাতে পারছে।আসলে মানুষ পরিস্থিতিতে না পড়লে ঠিক বুঝতে পারে না সে কিভাবে কোন পথে তার অভিস্পা লক্ষ্যে পৌঁছাবে।
 সুচন্দার ছেলে সায়ক এখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র।বাবার মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ বছর।সেই বয়সে সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন পরিণত বয়সের এক যুবক।কি অদ্ভুতভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে হাসপাতাল থেকে বারবার ফোন করে মা,দিদির খবর নিয়েছে।কাকাদের ও ভগ্নিপতির সমস্ত কথা শুনে ধীরে, সুস্থে সমস্ত কাজ করেছে।তাকে দেখে তখন কে বলবে যে সে সদ্য পিতৃহারা হয়েছে।বাবার মৃত্যু যেন রাতারাতি তাকে অনেকটা বড় আর পরিণত করে তুলেছে।
 ছন্দা সারাজীবনই খুব গুছানো আর সংসারী মেয়ে।সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ার পর মেয়ে,জামাই চলে গেলো তাদের বাড়ি।মা আর ছেলের সংসার।ছন্দা শুরু করলো পুরোদমে আবার গল্প ,কবিতা লিখতে।এই ভার্চুয়াল জগতের সূত্র ধরে কলকাতা,শিলিগুড়ির অনেক বন্ধুদের আস্তে আস্তে খোঁজ পেতে থাকে।
  এইভাবেই সে একদিন খোঁজ পায় অস্মিতার। অস্মিতার সাথে তখন প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা হয় ;এই কথা প্রসঙ্গেই দোদুলের কথা সব জানতে পারে অস্মিতা।কিন্তু প্রায় দিনপণের বাদেও দোদুল অস্মিতার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখতে পায় না।এদিকে সুচন্দার সাথেও তার কোন যোগাযোগ নেই।প্রতিটা মুহূর্ত,প্রতিটা ক্ষণ সেই কিশোরী কিংবা যুবতী বয়সের মত দোদুলের জন্য অপেক্ষা! যা একদিন সম্পূর্ণভাবে তার ছিল আজ সবকিছু তার হাতের নাগালের বাইরে।ইচ্ছা করলেই সে দোদুলকে ছুঁতে পারছে না,দেখতে পারছে না।এদিকে সুচন্দাও খুব চিন্তিত তার দাদার খবর না পেয়ে।
 প্রায় কুড়িদিন বাদে সুচন্দা যখন অনেক রাতে তার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দোদুল সুচন্দাকে কল করে।কল রিসিভ করেই তো নানান  অভিযোগের তীর একসাথে সুচন্দা তার দাদার দিকে ছুঁড়ে দেয়।দোদুল চুপ করে শুধু শুনেই যায়।তারপরেই সে অস্মিতার কথা বলে কিন্তু তাতেও দোদুলের কোন ভাবান্তর আসে না।কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে বুঝতে পেরে সুচন্দা বলে,
--- দাদা,তোমার শরীর ঠিক আছে তো?তোমার মধ্যে সেই স্বতস্ফুর্ততা বুঝতে পারছি না।কি হয়েছে তোমার?তুমি অস্মিতার কথা শুনেও তো কোন কিছু বললে না।
 দোদুলের বুক চিরে যেন এক গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো।কিছুটা উদাস হয়েই বললো,
--- কি আর হবে?জীবন তো শেষের পথে --- যা আমার ছিল না তা কোনদিনও আমার হয়নি আর এখন তো কোন প্রশ্নই নেই।
--- দাদা তোমার হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারছি না।আমাকে পরিষ্কার করে বোলো তোমার কি হয়েছে?
 এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে দোদুল তার বোন চন্দাকে বলে,
--- শোন আমার একটা দরকারি ফোন আসছে।আমি পরে তোকে আবার কল করবো।তুই অস্মিতাকে বলে দিস আমি তো ফেসবুক করিনা তাই ওর রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করিনি।একদিন সময় করে ওর সাথে কথা বলে নেবো।তুই বরং ওর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা আমায় সেন্ড কর।
 দোদুল ফোন কেটে দেয়।সুচন্দা ভীষণ অবাক হয়।কি এমন হল।মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে দাদার এত পরিবর্তন হল কি করে? অস্মিতার কথা শুনেও কোন ভাবান্তর নেই।দেখা করতে চাওয়া,ফোন করতে চাওয়া কোন কিছুই বললো না কেন?সারাটা দিন মনের ভিতরে এক অজানা আশঙ্কায় কেটেছে।তাহলে কি দাদার কোন কঠিন অসুখ করেছে?
  সারাদিনে অস্মিতাকে অন দেখতে পায়নি সুচন্দা।বারবার কল করেও কোন রেসপন্স পায়নি অপর প্রান্ত থেকে।সন্ধ্যা হতেই অস্মিতাকে অন দেখেই ফোন করে।ফোন ধরেই অস্মিতা তাকে জানায় সারাটাদিন বোনের শরীর খারাপ থাকায় তাই নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল সে।বোনের কি হয়েছে,বোনকে নিয়ে কোথায় কোথায় গেছে,ডাক্তার বোনকে কি বলেছে এইসব অনর্গল বলে যায় সে।চুপচাপ শোনে সুচন্দা সেসব।কিছুক্ষণ পর অস্মিতা বলে,
--- কি হল ?তুই কথা বলছিস না কেন?এত থম্ মেরে আছিস কেন?
 সুচন্দা তখন আমতা আমতা করতে করতে বলে,
--- তোকে একটা খবর দেওয়ার জন্য ফোন করেছিলাম।সারাটাদিন তুই তো অন হওয়ার সুযোগ পাসনি।আমার ফোনটাও রিসিভ করিসনি।তাই খবরটা দিতে পারিনি।আজ দোদুলদা সকালে ফোন করেছিলো।দাদার সাথে কথা বলে মনেহল দাদা ভালো নেই।কথা বলতে বলতেই ফোনটা কেটে দিলো।তোর কথা বললাম কিন্তু সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্চও করলো না।কেমন যেন একটা গা ছাড়া ভাব।
--- আমার কথা শুনে কোন কথা কেন বলবে বলতো ?আমি স্বার্থপরের মত তার জীবনটা শেষ করে দিয়েছি।সারাজীবন পাশে থাকতে চেয়েছিলো অথচ আমি সে পথও বন্ধ করে দিয়েছি।আমি তো ভেবেছিলাম আমি ওকে দূরে সরিয়ে দিলে ও নিজের জীবনটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নেবে।কিন্তু একবারও ভাবিনি আমাকে কষ্ট দিতে ও এইভাবে নিজেকে সবকিছুর থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
--- আমি ওকে তোর নম্বরটা দিয়েছি।তোকে দাদার নম্বরটা দিচ্ছি।তুই অবশ্যই একটা মেসেজ করে রাখবি হোয়াটসঅ্যাপে।কিছু তো একটা দাদার হয়েছেই ।

ক্রমশঃ 

Monday, April 18, 2022

ঝরাপাতা (চব্বিশ পর্ব)

ঝরাপাতা (চব্বিশ পর্ব)
   দীপকদার কাছ থেকেই সুচন্দা জানতে পারে অফিসে এমন কোন জায়গা নেই যেখান থেকে সঞ্জয় লোন করেনি।সংসারে প্রয়োজনের সাথে পাল্লা দিতে লোনের বোঝা 
প্রতিমাসে বেরেই গেছে।আসল কোন মাসেই শোধ দিতে পারেনা শুধু প্রতিমাসে সুদটাই দিয়ে থাকে। দীপকদা সুচন্দাকে একথাও বলে,
--- তুমি কিন্তু ভেবো না আমি আমার বন্ধুর সম্পর্কে তোমার কাছে নালিশ কিংবা বদনাম করছি।আমি সঞ্জয়কে খুব ভালোবাসি। ও আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট।ওর মুখেই আমি শুনেছি তুমি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।গ্র্যাজুয়েশন করেছো।তোমায় জানালাম একটাই কারণে তুমি ওকে বুঝিয়ে আস্তে আস্তে এই লোনটা শোধ করাও। মাইনে পেয়েই সুদের টাকাটা দিয়ে বাকি টাকা সে সংসার খরচের জন্য নিয়ে আসে।দাদা হিসাবে তোমায় পরামর্শ দেবো তুমি কিছু টিউশনি শুরু করো।সেই টাকা সংসারের পিছনে দাও আর সঞ্জয় মাইনের টাকা থেকে একটু একটু করে লোনটা শোধ করুক।
 ভগবানের দূত হয়ে এসে দীপকদা সেদিন কথাগুলো না জানালে হয়তো লোনের বোঝা আরো বেড়ে যেত। সুচন্দার কাছে সঞ্জয় অস্বীকার করে না যে তার প্রচুর টাকা লোন অফিসে। লোনের টাকা শোধ করতে গেলে সংসারে অভাব দেখা দেবে তাই প্রতি মাসে শুধু সুদটাই দিয়ে আসে।সব শুনে সুচন্দা শুরু করে কিছু টিউশনি করতে।সামান্য হলেও পুরো টাকাটাই সে সংসারের পিছনে খরচ করতে থাকে আর সঞ্জয়কে অনেক বুঝিয়ে অফিসের লোনের টাকা কিছু কিছু করে শোধ করাতে থাকে।
 যে মানুষটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে সুচন্দাকে সবকিছু জানিয়ে গেছিলো সেই মানুষটাই হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো।
 একদিন অনেক রাত।সঞ্জয় তখনো অফিস থেকে আসেনি।অন্নপূর্ণাদেবী ঘরবার করছেন।সুচন্দার মেয়ের বয়স তখন পাঁচ বছর।মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে সে উদ্বিগ্ন চিত্তে তার কোলের কাছেই বসে ভাবছে কেন আজ এত দেরি হচ্ছে সঞ্জয়ের ফিরতে।মুঠোফোন তো দূরহস্ত পাড়ায় তখন হয়ত দু,একটি বাড়িতে ল্যান্ডফোন।তাই ঘরে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।
 সেদিন ছিল মাইনের দিন।দীপক ও সঞ্জয় একসাথেই অফিস থেকে বেরিয়েছে। বড় রাস্তার মোড়ে এসে প্রথমে দীপক ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়ায় রাস্তা পার হতে যায়।হঠাৎ করেই দ্রুত গতিতে একটি বাস এসে দীপককে পিষে দিয়ে চলে যায়।
 সারারাত দীপককে নিয়েই কেটে যায় সঞ্জয়ের।স্পট ডেথ।কিন্তু সেই মুহূর্তে রাস্তার মানুষের সাহায্যে সঞ্জয় দীপককে হাসপাতাল নিয়েও যায়।বাবা,মায়ের হাতে তুলে দেয় দীপকের পকেটে টাকা ছেলের রোজগারের শেষ সম্বলটুকু।এইসব শেষ করে সঞ্জয় যখন বাড়ি ফেরে তখন সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
  পরবর্তীতে নিঃসন্তান দীপকের স্ত্রী সরকারি চাকরী থেকে শুরু করে প্রফিডেন্ত ফান্ড, গ্রাচুয়েটি সমস্ত কিছুর মালিক হয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে ওঠে বৃদ্ধ শ্বশুর ,বৃদ্ধা শ্বাশুড়ীকে ফেলে রেখে।আসলে মানুষের জীবনের সমস্ত ঘটনায় অদৃশ্য একটা হাত যে সর্বদা কাজ করে চলেছে তা অনেকেই স্বীকার করার  সৎ সাহস দেখাতে পারে না।কিন্তু সঞ্জয় যখন দীপকের স্ত্রীর চাকরির জন্য অফিসে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ছুটাছুটি করছে তখন কিন্তু দীপকের স্ত্রী কথা দিয়েছিল চাকরি এবং টাকা-পয়সা পাওয়ার পর সে তার বৃদ্ধ শ্বশুর,শ্বাশুড়ীকে দেখবে।কার্যক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাই হয়।সঞ্জয় কিছুদিন দীপকের বাবা,মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখলেও পরে নিজের নানান সমস্যায় জর্জরিত সঞ্জয় আর কখনো তাদের খবর রাখতে পারেনি।দীপকের অবর্তমানে সম্পর্কের ইতি সেখানেই হয়।
 মানুষ তার নিজনিজ জীবনে প্রত্যেকেই স্বার্থপর।আসলে অনেকক্ষেত্রে স্বার্থপর না হয়ে বাঁচাও যায় না।জীবনে থাকে প্রতিটা মুহূর্তেই নানান সমস্যা।নিজের সমস্যা মোকাবেলা করতে করতে অন্যের সমস্যাগুলো একসময় মনের থেকে উধাও হয়ে যায়।
  শমিতা আসার বছর তিনেকের মধ্যে তার জেঠু শমিতাকে নিয়ে পারিবারিক অনেক ঝামেলা,ঝক্কি সামলানোর পর তাকে সুপাত্রস্ত করতে সমর্থ হন।পরবর্তীতে একমেয়ে ও একছেলের গর্বিত মা হয়েই দিনাতিপাত করতে থাকে সে।
  সুচন্দার মেয়ের জন্মের প্রায় ন'বছর বাদে একটি ছেলে হয়।সংসারের আর্থিক সমস্যার তখন অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।ছেলের মাধ্যমিক যখন সবে শেষ হয়েছে তখন হঠাৎ করেই একদিন অন্নপূর্ণাদেবী চলে গেলেন।মা অন্তঃপ্রাণ সঞ্জয় তখন খবুই ভেঙ্গে পরে।অন্যান্য ভায়েরা তখন সকলেই বিবাহিত স্ব স্ব ক্ষেত্রে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও নিজনিজ সংসার চালানোর ক্ষমতা রাখে।
 বাবার মৃত্যুর পর সংসারের জোয়াল যখন সঞ্জয়ের কাঁধে তখন সঞ্জয় দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছে এদিক ওদিক কাজ করতে গিয়ে।খিদে পেলে কখনো ছাতু নুতবা শুধু জল খেয়েই সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়েছে।পরিণামে যা হবার তাই হয়েছে।সঞ্জয়ের শরীরে বাসা বেঁধেছে টিবি নামক মারত্মক ব্যাধি।প্রথম অবস্থায় মা,বউকে গোপন করে গেলেও পরবর্তীতে ওষুধ,ডাক্তার করে সুস্থ্য হয়ে ওঠে।কিন্তু ডাক্তারের কথানুসারে সঞ্জয়ের ফুসফুস তখন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত।সারাজীবন তাকে স্মোকিং করতে ডাক্তার নিষেধ করেন কিন্তু কে শোনে কার কথা!সে বাড়িতে স্মোকিং না করলেও রাস্তাঘাটে,অফিসে সব সময়ের জন্যই এটা চালিয়ে যায়।একসময়ের অনাহার, অর্ধাহার,নিজের কাছের লোকগুলোকে বাঁচানোর তাগিদে অমানুষিক পরিশ্রম যার ফলশ্রুতিতে রাজরোগের বাসা শরীরে।চাকুরী জীবনে অফিসিয়াল টেনশনে একের পর এক সিগারেট সঞ্জয়ের একটা ফুসফুসকে প্রায় অকেজো করে দিলো।শুরু হল শ্বাসকষ্টের মত রোগ।ওষুধ,ইনহেলার,অক্সিজেন --- আস্তে আস্তে সবকিছুই ব্যর্থ হতে হতে নার্সিংহোম ভর্তি হতেই হল।দু'মাস আগে মায়ের মৃত্যু আর তারপরেই সঞ্জয় অসুস্থ্য।চাকরি থেকে রিটায়ার করার ঠিক পরের মাসেই তাকে ভর্তি করতে হল নার্সিংহোম।
  এর ঠিক তিন বছর আগে মেয়ের বিয়ে হয়েছে ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে।সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে তখন সুচন্দার শ্বশুরবাড়ির সংসার ভেঙ্গে ভায়েরা সব আলাদা বাড়ি করে যে যার মত আলাদা হয়ে গেছে।
  সঞ্জয়কে নিয়ে শুরু হল এক বিশাল টানাপোড়েন।তার অসুস্থতার খবর পেয়ে অফিস তার সমস্ত পাওনাগণ্ডা কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝিয়ে দিল একজন সৎ,একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে সঞ্জয়ের এটা পাওনা মনে করলো উপর মহল।যেখানে বছরের পর বছর চলে যায় সরকারি টাকা পেতে সেখানে সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে হল এর ব্যতিক্রম ।দুই দুইবারের অসুস্থতার ফলে জমানো সমস্ত টাকা যখন শেষ হল ডাক্তারও ঠিক তখনই জবাব দিয়ে দিলেন।ডাক্তার পরিস্কার বললেন,
--- একটা ফুসফুস পুরো অকেজো অন্যটা পঁচাত্তর ভাগ ড্যামেজ।এই অবস্থায় আপনারা যদি পেসেন্টকে নার্সিংহোম রাখেন তাহলে বৃথায় আপনাদের অর্থ খরচ হবে অথচ উনি কিন্তু আর ভেন্টিলেশন থেকে বেরোতে পারবেন না।তাই একজন ডাক্তার হিসাবে আমি বলবো আপনারা যেকোনো সরকারি হাসপাতালে উনাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
  মুঠোফোন তখন সকলের হাতে হাতে।ছেলেবেলা থেকে সুচন্দা গল্প,কবিতা লেখার অভ্যাসটা ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে আরও অনেকটা ছড়িয়ে গেছে তখন।কবিতা ও গল্প মিলিয়ে বেশ কয়েকটা বই বেরিয়েছে তখন।পরিচয় হয়েছে বেশ কিছু নামী দামী লোকের সাথে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কিছু মানুষদের সাথে।ডাক্তারের সমস্ত কথা শোনার পর সুচন্দা এই প্রথম জীবনে কারো কাছে কিছু সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে।রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় তার স্বামীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে সচেষ্ট হয়।
  
ক্রমশঃ




    

Sunday, April 17, 2022

ঝরাপাতা (তেইশ পর্ব)

ঝরাপাতা (তেইশ পর্ব)

  সঞ্জয়দের পরিবারে বউ হয়ে এসে জীবনে প্রথম যে উপলব্ধিটা সুচন্দার হয় সেটা হল সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার যদি অভাব না থাকে,খুব বেশি একটা চাহিদা না থাকলে তাহলে সুখী হওয়াটা খুব কষ্টের নয়।স্বামী, দেওররা সর্বোপরি শ্বাশুড়ী মায়ের ভালোবাসায় ফিকে হয়ে যাওয়া অতীতকে প্রায় ভুলেই গেছিলো সুচন্দা।দুবছরের মাথায় সুচন্দার মা হওয়ার খবরে সকলেই খুব খুশি হল।কতদিন পরে বাড়িতে একটা শিশুর আগমণ ঘটবে এই নিয়েই সর্বক্ষণ আলোচনা।সুচন্দা হাঁটতে লাগলেও যেন বাড়ির লোক খেয়াল রাখে যাতে তার কোন কষ্ট না হয়। অর্থই যে সবসময় সুখ এনে দেয় না তার প্রমাণ সঞ্জয়দের বাড়ির প্রত্যেকে প্রতি পদেপদে দিয়েছে।
  কিন্তু বিধাতা মনেহয় এখানেও সুচন্দার জীবনে অন্যকিছু লিখেছিলেন।হঠাৎ করে তাদের সংসারে এলো সঞ্জয়ের মামাত বোন শমিতা।বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর শমিতা আশ্রয় নিয়েছিল তার বড়বোন অনিতার কাছে।অনিতার ছিল এক দেওর।তার ছিল শমিতার দিকে নজর।কিন্তু শমিতা তাকে মোটেই পাত্তা দিত না।তাতে ইন্দ্রনীল গেলো আরও ক্ষেপে।একদিন তার দাদা,বৌদি বাড়িতে না থাকার ফলে সে সুযোগ পেয়ে শমিতার ঘরে ঢুকে তার উপর চড়াও হয়।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনীলের উদ্দেশ্য সফল হয় না।ধস্তাধস্তির মাঝে সুযোগ বুঝে শমিতা দরজা খুলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।দিদি,ভগ্নিপতি বাড়িতে ফিরে এলে পাশের বাড়ির সেই কাকিমা শমিতাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়।অনিতাকে বুদ্ধি দেয় বোনকে এখানে না রেখে পরিচিত বিশ্বাসী কোন বাড়িতে রাখার জন্য আর সেরূপ কেউ না থাকলে যেন খুব তাড়াতাড়ি তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
 ইন্দ্রনীল এরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে দীঘা চলে যায় যা সে আগেই তার দাদা,বৌদিকে জানিয়ে রেখেছিল যে সে কয়েকদিনের জন্য দীঘা বেড়াতে যাবে। অনিতা ও তার স্বামী সেদিন দুপুরে গেছিলো এক উপনয়ন বাড়িতে।নিমন্ত্রণ ছিল না শমিতার।ইন্দ্রনীল জানতো দাদা, বৌদি বেরিয়ে গেলে শমিতা একা বাড়ি থাকবে।তাই সে আগে থাকতেই তার প্ল্যান ঠিক করে রেখেছিল।সেই মত সে জানিয়ে দিয়েছিল সেদিন বিকেলেই সে দীঘা যাবে।ইন্দ্রনীল তার পূর্ব প্ল্যান মোতাবেক সবকিছু ঠিকঠাক করতে পারলেও শমিতাকে বাগে আনতে না পেরে দুপুরেই বাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
 অনিতা বাড়ি ফিরে সবকিছু শুনে সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় শমিতাকে পিসির বাড়িই পাঠিয়ে দেবে।তখনকার দিনে মুঠোফোনের এত রমরমা ছিল না।পিসির পারিবারিক পরিস্থিতি অজানা ছিল না।তার উপর বড়দা মানে সঞ্জয়ের সবে বিয়ে হয়েছে।আগের থেকে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসলেও চাহিদার সাথে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা এখনো তাদের হয়নি।কিন্তু তবুও মানসম্মান বজায় রেখে বোনকে বাঁচাতে গেলে এই ছাড়া অনিতার আর কোন উপায়ও ছিল না।
  চাকদার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভগ্নিপতির সাথে বেরিয়ে সূর্য্য যখন মাঝ আকাশে ঠিক তখন এসে শমিতা তার ভগ্নিপতির সাথে বড় পিসির বাড়িতে উপস্থিত হল।সুচন্দাকে দ্বিপ্রহরের ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল।শুরু হল নূতন করে রান্নাবান্না।খুব তাড়াতাড়ি দুটি খেয়ে শমিতার ভগ্নিপতি বেরিয়ে যেতে চাইলেন।তিনি বা শমিতা কোন কথায় অন্নপূর্ণাদেবীকে কেউ বলে না।কি কারণে?কিসের জন্য?কেন এসেছে?কোন কিছুই অন্নপূর্ণাদেবী বা তার বাড়ির কেউই তখনো পর্যন্ত জানেন না।বেরিয়ে যাওয়ার আগে শমিতার ভগ্নিপতি পকেট থেকে একটি চিঠি বের করে পিসিশ্বাশুড়ির হাতে দিয়ে বললেন,
--- আপনার ভাইঝি এই চিঠিটা আপনাকে দিয়েছে।এতে সবকিছু লেখা আছে।আর বাকিটা শর্মির কাছ থেকে শুনে নেবেন।আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।কিছুদিন ও আপনার কাছেই থাক পড়ে সব দেখছি।
 ভাইঝি জামাই বেরিয়ে চলে গেলো সন্ধ্যার আগেই।অন্নপূর্ণাদেবী অনিতার চিঠি পড়ে তো পুরো থ।এই অভাবের সংসারে সবে ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ এনেছেন।খরচ তো বেরেছেই তার উপর সুচন্দা মা হবে। উপরন্তু শমিতার শুধু তো খাওয়া-পরায় নয়; সমত্ত মেয়ে,টুকটাক চাহিদার সাথে পরবর্তীতে বিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন হবে।মুখে কিছু না বললেও চিন্তার পাহাড় তার মাথার মধ্যে গিজগিজ করতে লাগলো।তিনি ছেলে বৌমাদের ডেকে সকলকেই চিঠির সারমর্ম জানিয়ে দিলেন।সকলেই শুধু তার কথা শুনলো কিন্তু কেউ কোন কথায় বললো না।আর বলবেই বা কি শমিতার মান-সম্মানের ব্যাপারটাই তো এখানে মুখ্য।
 শমিতা যে এসে দিদির কাছে উঠেছে সেদিনই সঞ্জয়ের মামা জানতে পারলেন।তার ইচ্ছা থাকলেও মেয়েটিকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারলেন না তার অর্ধাঙ্গিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে।অগত্যা শমিতার ঠাঁই হল ঘরের এককোণে তার পিসির পাশেই।
 কয়েকটা মাস বেশ ভালোই কাটলো।বৌদির সাথেও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো ঠিক অন্যখানে।পরিবারে কোন মেয়ে ছিল না।অন্নপূর্ণাদেবী সবকিছুই দেখেন সাদা দৃষ্টিতে। শমিতা আসার পরেই সুচন্দার ছোটখাটো দোষত্রুটিগুলিকে এক বিশাল আকার করে পিসি এবং দাদাদের কাছে তুলে ধরতে লাগলো।পরিণাম যা হওয়ার তাই হল। দেওররা আর আগের মত বৌদির সাথে হাসিঠাট্টা,গল্পগুজব করে না।অন্নপূর্ণাদেবীও সুচন্দার কাজকর্মের ভুল ধরতে লাগলেন।
 সুখের সংসারে বলতে গেলে অশান্তির ঝড় উঠলো।সঞ্জয়ের মামা সব দেখে শুনে স্থির করলেন মেয়েটিকে তিনি যেভাবে হোক তার বাড়িতেই আশ্রয় দেবেন।তিনি তার স্ত্রীর কথায় এবার কোন পাত্তা না দিয়েই শমিতাকে তার বাড়িতে এনে তুললেন।কারণ দোষে-গুনে সব মানুষ বলেই তিনি পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছিলেন শমিতার দায়িত্ব তার দিদির নয়।জেঠু হিসাবে এ দায়িত্ব সম্পূর্ণই তার।
 সুচন্দার সংসারে কিছুটা হলেও শান্তি আসে ঠিকই কিন্তু পরিবারের প্রত্যেকের প্রতি যে একটা আত্মিক টান ছিল তা কিছুটা হলেও কেমন একটা গা ছাড়া ভাব হয়ে দাঁড়ায়।এদিকে সুচন্দা তো তখন প্রেগন্যান্ট।
  শমিতার জেঠু ছিলেন খুব কড়া ধাতের মানুষ।তিনি পরিস্কার তার ভাইজিটিকে বলে দিয়েছিলেন,
--- সকলকে নিয়ে থাকতে গেলে একের কথা অন্যকে জানালে সেই সংসারে শান্তি থাকে না,ভালোবাসা থাকে না।উপায়ান্তর না দেখেই অনিতা তোমায় পাঠিয়েছে। কারো দোষ না দেখে মিলেমিশে থাকতে পারলে আখের তোমারই লাভ হবে দেখো।এই একটা কথায় শমিতার তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আমূল পরিবর্তন এনে দেয়।কিন্তু সুচন্দার সাথে তার দেওরদের সেই আগের সম্পর্ক আর ফিরে আসে না।
 যথা সময়ে সুচন্দার একটি কন্যা সন্তান হয়।তিন পুরুষ পর সংসারে আবার কন্যা সন্তানের জন্ম।স্বভাবতই বাড়িতে খুশির আমেজ বইতে থাকে।
  ভাইদের পড়া তখনো শেষ হয়নি এদিকে মেয়ের পিছনে খরচ।অভাব যেন পরিবারটির থেকে আর পিছু ছাড়ে না।এরই মাঝে একদিন সঞ্জয়ের অফিস কলিগ কাম বন্ধু দীপক সরকার বাড়িতে আসে।প্রথম দিন থেকেই বয়সে অনেক ছোট সুচন্দাকে দেখে বলে,
--- শোনো তুমি কিন্তু ভেবো না তোমায় আমি বৌদি বলে ডাকবো।তুমি বয়সে আমার অনেক ছোট।তুমি আমায় দাদা বলবে আর আমি তোমায় নাম ধরেই ডাকবো।মন খুলে আমার সাথে কথা বলবে।ভাইফোঁটার দিনে তুমি যেখানেই থাকবে আমায় না ডাকলেও চলে যাবো তোমার কাছে ফোঁটা নিতে।সঞ্জয় আমার কলিগ হলেও আজ থেকে ওর প্রধান পরিচয় আমার কাছে ও আমার একমাত্র ভগ্নিপতি।

ক্রমশঃ 

Thursday, April 14, 2022

ঝরাপাতা (বাইশ পর্ব)

ঝরাপাতা (বাইশ পর্ব)
  অভাব,দুঃখ,দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে করতে সঞ্জয় যখন প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার মত ঠিক তখনই পূর্বে প্রচুর ইন্টারভিউ দেওয়া ;এমনই একটি সরকারী জায়গা হতে আসে এপোয়েনমেন্ট লেটার।বাড়িতে এ খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই যেন উৎসব লেগে যায়।
 গাছের শুকনো,জীর্ণ পাতাগুলো ঝরে যাওয়ার পর যখন সে গাছে নূতন করে পাতা গজাতে দেখা যায় তখন মনেহয় মৃতপ্রায় গাছটার বুঝি প্রাণ ফিরে এলো।সঞ্জয়ের চাকরিটা তাদের বাড়ির এমনই যেন এক ইঙ্গিত বহন করছে।খুব সামান্য মাইনেতে ঢুকলেও আস্তে আস্তে চাকরির পদোন্নতির সাথে সাথে টাকার অংকটাও বাড়তে থাকে।খুব বেশি উপরে উঠতে পারে না সঞ্জয় কারণ তার ডিগ্রিটা ছিল না।বাবার মৃত্যুর পরই সংসারের জোয়াল তার উপর এসে পড়েছিল সে ভালোভাবেই জানতো এই টাকা কটা তার মায়ের হাতে তুলে দিতে পারলে তিনি সুনিপুণভাবে সংসারটাকে চালিয়ে নিতে পারবেন।বয়স তখন তার চৌত্রিশ বছর।চাকরি জীবনের ছ'মাস যেতে না যেতেই অন্নপূর্ণাদেবী চেষ্টা করেন তার ছেলেটির বিয়ে দিতে।কারণ সঞ্জয়ের জীবনেও অতি অল্প বয়সে ঘটে গেছিলো এক বিপর্যয়।
 সঞ্জয় তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র।তার জীবনে আসে চন্দনা নামে একটি মেয়ে।কিশোর বয়সের প্রেম।খুব ভালোবেসে ফেলে চন্দনাকে।অপরদিকে চন্দনাও ঠিক তাই।চন্দনার বাড়ির থেকে যখন এ ঘটনা জানতে পারেন তার বাবা,মা তখন তারা তাদের মেয়েকে অন্যত্র পাত্রস্থ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে পড়েন।চন্দনার বাইরে বেরোনো তারা বন্ধ করে দেন।সব সময়ের জন্য তারা চন্দনাকে চোখে চোখে রাখেন।এদিকে সঞ্জয় চন্দনার খোঁজ না পেয়ে পাগলের মত রোজই তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে শুরু করে।চন্দনা ঘর থেকেই সঞ্জয়কে দেখতে পায়।
 সেদিন অনেক রাতে চন্দনা তার বাড়ি থেকে সালোয়ার কামিজ পরে সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে সঞ্জয়দের বাড়িতে এসে ওঠে।অত রাতে অপরিচিত একটি মেয়েকে দেখে তিনি জানতে চান
-- এত রাতে তুমি আমার বাড়িতে কার কাছে এসেছো?
--- সঞ্জয়ের কাছে
--- ও সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক ?তুমি কি জানো ওর পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি;আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসার।তোমাকে দেখে তো মনেহচ্ছে তোমার আঠারো বছর বয়সও হয়নি।এত বড় একটা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে নিজের ভবিষ্যৎ এর কথা একবারও ভাবলে না?একটা স্কুল পড়ুয়া বেকার ছেলের উপর কতটা নির্ভর করতে পারো নিজের মনকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো।
 এতো কথাবার্তার মাঝে সঞ্জয় ও তার ভাইদের ঘুম ভেংগে তারা ততক্ষনে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।সঞ্জয়ের দিকে মুখ করে তার মা বললেন,
-- তুমি তো অবিবেচক নও ।আমি তোমার কাছেই জানতে চাই তোমার এই ব্যাপারে কি মত?আমি বা তোমার বাবা দুজনেই মনেকরি আবেগের বশে তুমি কখনোই কোন সিদ্ধান্ত নেবে না।নিজেরাই পেট পুরে দুবেলা খেতে পারি না।তোমাদের লেখাপড়া শেষ হয়নি।মেয়েটিকে দেখে মনেহচ্ছে আঠারো বছর বয়স হয়নি।এক্ষেত্রে সকলে পুলিশের ঝামেলায় জড়িয়ে যাবো।ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভেবে উত্তর দাও।
 সঞ্জয় মায়ের সব কথা মাথা নিচু করে শোনে।বাবা,ভায়েরা সব চুপচাপ দাঁড়িয়ে।সঞ্জয় চুপ করে আছে দেখে তার মা পুনরায় বললেন,
-- এখন অনেক রাত হয়েছে।যে যার মত গিয়ে শুয়ে পরো।সকাল হলে আমি নিজে গিয়ে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবো।এখন আমি ওকে নিয়ে শুয়ে পড়ছি।সঞ্জয় মুখ নিচু করে ঘরে চলে যায়।কারণ মায়ের কথাগুলো সে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।ইচ্ছা থাকলেও সে চন্দনার সাথে একটাও কথা বলে না।
  এই ঘটনার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই চন্দনার বাবা পুলিশ নিয়ে এসে হাজির।সেদিন সঞ্জয় পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যায় শুধুমাত্র পুলিশ আসার সাথে সাথে অন্নপূর্ণাদেবী দরজা খোলার আগে ছেলেকে ডেকে বলে যান সে যেন কোন অবস্থাতেই বাইরে না বেরোয় যতক্ষণ না তিনি তাকে ডাকেন।
 পুলিশের সাথে কথাবার্তা তিনিই বলেন।তিনি চন্দনাকে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলেন,
--- ছেলে মানুষ।আবেগের বশে একটা ভুল করে ফেলেছে।তবে আমি আপনাকে একটা কথা দিচ্ছি, যদি আপনার মত থাকে তাহলে আপনার মেয়েকেই আমি বাড়ির বউ করে আনবো আমার ছেলে চাকরি পেলে।আর যদি আপনার এতে মত না থাকে আমি আমার ছেলেকে বুঝিয়ে নেবো আপনি আপনার মেয়েকে সামলে রাখবেন।অফিসারের সামনেই বললাম যদি আপনার মেয়ে এরূপ কোন ভুল  পদক্ষেপ নেয় তারজন্য আমার ছেলে কিন্তু দায়ী থাকবে না।এরপর আর কোন পুলিশের ঝামেলা যেন না হয়।
 ভদ্রমহিলার এই এই ধরণের মানসিকতাকে পুলিশ অফিসারও সমর্থন করেন।
 এরপর অন্নপূর্ণাদেবী সঞ্জয়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসে তাকে এই দারিদ্রের মধ্যে টেনে এনে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না।নিজের পায়ে আগে ভালোভাবে দাঁড়িয়ে পরে যেন সে এসব ভাবে।যদি ততদিনে চন্দনার বিয়ে না হয় তাহলে তিনি নিজে গিয়ে তার সাথে সম্মন্ধ করে বিয়ে দেবেন। মাতৃভক্ত সঞ্জয় এরপর আর কখনোই চন্দনার সাথে নিজের থেকে দেখা করেনি।কিন্তু রাস্তাঘাটে দেখা হলে অপেক্ষা করতে বলেছে যতদিন না সে চাকরি পায়।কিন্তু চন্দনার বাবা,মা অন্নপূর্ণাদেবীর দেওয়া কথা অগ্রাহ্য করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন।তবে একথা সত্যি চন্দনার বাবা তার মেয়ের জন্য সঞ্জয়দের পরিবার থেকে অনেক ভালো পরিবার এবং সুচাকুরে ছেলে জোগাড় করেছিলেন।
 সঞ্জয় চাকরি পাওয়ার ছ'মাসের মধ্যেই অন্নপূর্ণাদেবী তার ছেলের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগেন।ভায়ের সাথে পরামর্শ করে মেয়ে দেখতে শুরু করেন আর সুচন্দাকে পছন্দ করেন।স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান,ভাগ্যের ফেরে দিদির কাছে থাকলেও অভাব যাকে কোনদিন ছুঁতে পারেনি সেই মেয়েটি কিনা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বউ হয়ে এলো শুধুমাত্র সঞ্জয়ের পিঠে একটা সরকারি চাকরির স্ট্যাম্প ছিল বলে।এটাকে ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যায় বলা হোকনা কেন সুচন্দা কিন্তু কোনদিনও তার ফেলে আসা অতীত কিংবা জীবনে দেখা একটা স্বপ্নও ছুঁতে না পারার জন্য কখনোই কোন আক্ষেপ কারো কাছেই প্রকাশ করেনি।তাই বলে কি তার মনের মধ্যে কোন দুঃখ কোন কষ্ট ছিল না? হ্যাঁ নিশ্চয় ছিল।সুমিতকে হারানোর পর থেকে কোন আঘাতই তার মনকে আর সেভাবে নাড়িয়ে দিতে কখনোই পারেনি ।"অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর"-- এই প্রবাদ বাক্যটি যেন সুচন্দার জীবনে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছিলো।জীবনে প্রথম ছোঁয়া,প্রথম ভালোবাসা যে হারিয়েছে একমাত্র সেই বুঝতে পারে না পাওয়ার যন্ত্রণা!একদিকে যেমন সুমিতকে না পাওয়ার যন্ত্রণা অন্যদিকে জীবনের স্বপ্নগুলো শুকনো ফুলের পাঁপড়ির মত একটা একটা করে ঝরে যাওয়ার বেদনা - সুচন্দাকে সত্যিই যেন পাথর তৈরি করে দিয়েছিল।

ক্রমশঃ 

Monday, April 11, 2022

ঝরাপাতা (একুশ পর্ব)

ঝরাপাতা (একুশ পর্ব)
  সুচন্দা তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির সংসারটিকে খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিয়েছিলো।চাহিদা সংসারে প্রচুর থাকলেও মানুষগুলির ব্যক্তিগত কোন চাহিদা ছিল না।তাই সেইসব চাহিদাগুলোকে সুচারুরূপে প্রত্যেকেই এড়িয়ে চলতে পারতো।
 সুচন্দার শ্বাশুড়ী ছিলেন মাটির মানুষ।তিনি তার এই বড় বৌমাটিকে নিজ মেয়ের মত স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন।কখনো কোনদিনও শ্বাশুড়ী মায়ের সাথে সুচন্দার তর্ক বা ঝগড়া হয়নি।বরং দেখা গেছে সঞ্জয়ের সাথে সামান্য তর্ক বা ঝামেলায় সুচন্দা যখন মুখটি গম্ভীর করে রেখেছে তখনই তিনি বুঝতে পেরেছেন তার সঞ্জুই বৌমাটিকে মুখ কালো করে কোন কথা বলেছে।সুচন্দার অনুপস্থিতিতে তিনি তার ছেলেকে বকাবকি করেছেন,বুঝিয়েছেন।
 শ্বাশুড়ী অন্নপূর্ণাদেবী অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে বিশাল বড় এক সংসারের বউ হয়ে এসেছিলেন।সংসারে অভাব ছিল নিত্য সঙ্গী।রোজগেরে মানুষ একজন - তার স্বামী।সংসারের যাবতীয় সব কাজ করেও উঠতে বসতে তাকে গঞ্জনা সইতে হত।কিন্তু কোনদিনও কোন প্রতিবাদ তিনি করেননি তার একটাই কারণ ছিল ঝগড়াঝাঁটি তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না।ছোট একটা পাউরুটির কারখানায় চাকুরীরত স্বামীর সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের পর যখন তিনি ঘরে ফিরতেন তখন তার সেই শুকনো কালি বর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলার আর ইচ্ছা থাকতো না।স্বল্প শিক্ষিত অন্নপূর্ণাদেবী সংসারে কিছুটা সুরাহা করতে ঘরে বসে কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি করে বিক্রি করতেন।অথর্ব অবিবাহিত খুড়তুতো শ্বশুর,দুই অবিবাহিত ননদ উপরুন্ত দেশভাগের পর অন্নপূর্ণাদেবীর শ্বাশুড়ির বাপের বাড়ির দিক থেকে দুই বিধবা মাসি শ্বাশুড়ী।তারা সবাই কোনরকমে মাথা গোঁজার মত একটা আশ্রয় পেয়েছিলেন ওই সংসারে।কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারে বউ হয়ে এসে অন্নপূর্ণাদেবী পড়েন অথৈ সমুদ্রে।সেই সংসারে কিছুটা সুরাহা করতে স্বামীর কাছ থেকে মত নিয়ে শুরু করেন কাগজ কিনে এনে ঠোঙ্গা তৈরি করতে। আস্তে আস্তে বাড়ির প্রায় সকলেই এই কাজে হাত লাগায়।অনেক বড় বড় দোকানও তাদের তৈরি কাগজের এই ঠোঙ্গা নিতে শুরু করে।সংসারে বিশাল কিছু উপকারে না আসলেও কিছুটা সাশ্রয় হয়।
 সময়ের সাথে সাথে বয়সের ভারে,রোগ-শোকে অনেকেই সংসার ছেড়ে চিরতরে পাড়ি দেন অজানা দেশে। শ্বাশুড়ীও শয্যাশায়ী হন।দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রায় বছর খানেক বিছানায় থেকে তিনিও চলে যান।অবশ্য চলে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে তিনি তার পুত্র বধুটির কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেন।
 অন্নপূর্ণাদেবীর প্রথম সন্তান সঞ্জয়ের জন্মের পর তার স্বামী ছোট একটা পাউরুটির কারখানায় চাকরী পান।নিজ পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সেই ছোট্ট কারখানাটিকে কিছুটা হলেও মালিককে লাভের মুখ দেখাতে সক্ষম হন।মালিক সম্পূর্ণভাবে সঞ্জয়ের বাবা বিশ্বনাথের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।একটু একটু করে যখন কারখানার উন্নতি সাধিত হচ্ছে বিশ্বনাথবাবুর মাস মাইনে তরতর গতিতে বেড়ে চলায় সংসারে একটু সুখের মুখ দেখতে সকলে শুরু করেছে ঠিক তখনই একদিন রাতে সর্টসার্কিট হয়ে পুরো কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
 বিশ্বনাথবাবুর সংসারে নেমে এলো পুনরায় দুর্যোগ।বিশাল সংসারের দায়িত্ব ,বয়স্কদের রোগ-যন্ত্রণা আর সর্বোপরি প্রথম সন্তান সঞ্জয়ের লেখাপড়া।তিনিও দিনরাত ঠোঙ্গা তৈরিতে মন দিলেন।কিন্তু কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি করে আর কটা পয়সা পাওয়া যায়?কমতে শুরু করলো অন্নপূর্ণাদেবীর
 গয়নার বাক্স হতে একটা একটা করে গয়না।
 এইভাবে অভাব,দুঃখ,দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে করতে বয়সের ভারে সাথে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেকেই অকালে চলে গেলেন।সংসারে পড়ে রইলেন স্বামী,স্ত্রী আর তাদের বাচ্চা।খেয়ে না খেয়ে চলতে লাগলো সংসার।এমনই একদিনে দামী গাড়ি হাঁকিয়ে জীর্ণ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো পুড়ে যাওয়া কারখানার মালিক।তিনি বিশ্বনাথবাবুকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন ছাই হয়ে পড়ে থাকা কারখানার কাছে।করজোড়ে অনুরোধ করলেন সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে তার এই শেষ হয়ে যাওয়া কারখানাটিকে পুনর্জীবিত করতে।বিশ্বনাথবাবু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন।তিনি এমনই একটি আশা বুকের ভিতর লালন করে চলেছেন কারখানায় আগুন লাগার পর থেকেই।কিন্তু সাহস করে মালিককে বলে উঠতে পারেননি।মনেমনে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন।ঈশ্বর তার মনের কথা শুনেছেন। সৎ,সত্যবাদী,একনিষ্ঠ, বিশ্বাসী কর্মীর হাতে হাজার হাজার টাকা তুলে দিয়ে শুধু দিনান্তে গাড়ি করে এসে কতটুকু কাজ হয়েছে দেখে যাওয়ায় ছিল কারখানার মালিক অমিযকান্তি সাহার কাজ।দিনরাত এক করে একটু একটু করে পাউরুটির কারখানাটিকে পুনরায় দাঁড় করান বিশ্বনাথবাবু।যখন প্রথম দিকে তিনি কারখানার কাজ শুরু করেন তখন বেশ কিছুদিন তিনি রাস্তার পাশেই জোগাড় করা একটি বেঞ্চের উপর রাত কাটিয়েছেন যাতে বিল্ডার্সের মালামাল চুরি না হয়ে যায়।কয়েক মাসের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায় সেই পাউরুটির কারখানা যার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিশ্বনাথবাবুর। হ্যাঁ মালিক অমিয়কান্তি সাহা তার মর্যাদা রেখেছিলেন।কারখানা চালু হলেই তিনি বিশ্বনাথবাবুকে সেখানকার ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে তার অবর্তমানে এই ছোট্ট কারখানার মালিক অন্নপূর্ণাদেবীর একটা পেনশনের ব্যবস্থাও করে রেখে গেছিলেন ; যা অন্নপূর্ণাদেবী আমৃত্যু পেয়ে গেছেন।
 এরপরেই কিছুটা সুখ ও শান্তি ফিরে আসে সংসারে।কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষের পরিশ্রম করে সুফল পাওয়ার পর সেই সুখ সবার কপালে বেশিদিন স্থায়ী হয় না।বিশ্বনাথবাবুর ক্ষেত্রেও হল তাই।হঠাৎ করেই তিনি ইউরিন ইনফেকশনে মারাত্মকভাবে অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন।অমিয়কান্তিবাবু চেষ্টা করেছিলেন অর্থের বিনিময়ে তাকে সুস্থ্য করে তুলতে।কিন্তু আয়ু তো থাকে বাঁধা।
  চলে গেলেন তিনি তার স্ত্রী,পুত্রদের রেখে।তখন সবেমাত্র সঞ্জয় বারো ক্লাস পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে।সংসারের জোয়াল এসে পড়লো সম্পূর্ণভাবে তার উপর।কোন রকমে পরীক্ষাটা দিয়েই মা,ভাইদের জন্য দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে তাদের কিছুই না জানিয়ে যখন যা পেয়েছে সেই কাজ করেছে।সে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে থেকে কুলির কাজ।ততদিনে সঞ্জয়ের মামাও একটি ভালো সরকারি চাকরী পেয়ে গেছেন একটু বেশি বয়সেই।তিনিও নানানভাবে তার দিদির সংসারটিকে আর্থিক সাহায্য করে গেছেন।অন্নপূর্ণাদেবী পুনরায় শুরু করেন কাগজের সেই ঠোঙ্গার ব্যবসা।মাঝে কয়েক বছর একটু সুখের মুখ দেখে এ সবই তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
  সঞ্জয় ভালোভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলেও ওখানেই তার পড়ার ইতি টানতে হয় শুধুমাত্র সংসারটিকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে।সামান্য এই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সে একটার পর একটা চাকরির পরীক্ষা দিয়ে চলে।ইতিমধ্যে সে একটি সেলসের কাজ জুটিয়ে নেয়।সকাল থেকে সন্ধ্যা সাইকেল করে কলকাতা থেকে দূরদুরান্তের মফরসল শহর খালি পেটে ছুটে গেছে।খুব খিদে পেলে ছাতু আর জল ছাড়া কোনদিন কিছুই তার পেটে পড়েনি।মা,ভাইদের দুবেলা পেট পুড়ে খাবার জোগাড়ের তাগিদে নিজের ক্ষুদা তৃষ্ণা ভুলে গিয়ে দিনের পর দিন অনিচ্ছা সর্ত্বে নিজের শরীরের ক্ষতি করে গেছে যা তাকে পরবর্তীতে ভুগতে হয়েছে নানান রোগের বাসা শরীরে তৈরি করে।

ক্রমশঃ

Saturday, April 2, 2022

ঝরাপাতা (কুড়ি পর্ব)

ঝরাপাতা (কুড়ি পর্ব)
     সন্ধ্যার অনেক আগেই দোদুল অস্মিতাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হল। অস্মিতা তখনো অফিস থেকে বাড়িতে ফেরেনি। অস্মিতার মা কিংবা ভাইবোনেদের ব্যবহার সেই পূর্বের মতই।দোদুল বুঝতে পারে অস্মিতা তারমানে এদের কোনকিছুই জানায়নি।
    সন্ধ্যা হয় হয় তখন। অস্মিতা বাড়ি ফেরে।দরজা খুলে দেয় ওর মেঝবোন।সেখানেই দাঁড়িয়ে সে দিদিকে জানায়,
-- দিদি, দোদুলদা এসেছে 
--- কখন?কোথায় সে?এতবার করে বলার পরেও ---
 শেষের কথাটা খুবই আস্তে বলে সে।বোন লিপি ঠিক শুনতে পায়না।সেও খুবই আস্তে আস্তে দিদির কাছে জানতে চায়,
--- তুই কি বললি এত আস্তে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না
--- না,কিছু না দোদুলকে চা দিয়েছিস?
--- একটা কথা বলতো দিদি,তুই কি দোদুলদার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছিস?তোর ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য অন্যের জীবনের কোন ক্ষতি তুই করতে পারিস না কিন্তু।
--- চুপ কর লিপি।বেশি বকিস না।দোদুল শুনতে পাবে 
 কথাগুলো বলতে বলতে অস্মিতা দোদুল যে ঘরে বসা অর্থাৎ ড্রয়িং রুমের দিকে এগোতে থাকে।লিপিও তার নিজের ঘরে চলে যায়।
  সেদিন অস্মিতা দোদুলকে ফিরিয়েই দেয়।দোদুল তার পাশে থেকে অস্মিতার ভাইবোনদের বড় দাদা হয়ে তাদের মানুষ করতে চেয়েছিলো।কিন্তু অস্মিতা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিল এ লড়াই তার একার।এখন তার জীবন আর দোদুলের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে সে কিছুতেই দোদুলের জীবনটা নষ্ট করতে পারবে না।একথা শুনে দোদুল আহত পাখির মত যন্ত্রণায় ছটফট করেছে অস্মিতার সামনে কিন্তু অস্মিতা তার মনকে আগেই শক্ত করে নিয়েছিল।সে চায়নি তার জীবনের সাথে জড়িয়ে দোদুলের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক।
 আসলে মানুষ তার জীবনে অর্থাৎ জীবন রঙ্গমঞ্চে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সে স্ক্রিপ্ট লেখা বিধাতার হাতে।যে কোন সময় তিনি স্ক্রিপ্টের রদবদল করে চরিত্রের পরিবর্তন করে থাকেন।মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।এই জীবনের রঙ্গমঞ্চে তাই মানুষের স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার মধ্যে থেকে যায় বিস্তর প্রভেদ।স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে মিল খুঁজে না পেয়ে অনেকেই ভেঙ্গে পরে আবার অনেকেই সময়ের সাথে সাথে নিজেকে নূতন কোন ভূমিকায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয় সেও সেই অদৃশ্য কারো ইঙ্গিতে।
 অস্মিতা একে একে তার ছোট ভাইবোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে।তারা তাদের বড়দিদির এই পরিশ্রমের দামও দেয়।প্রত্যেকেই তাদের নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভও করে একমাত্র মেঝবোন লিপি ছাড়া।বাবা যখন মারা যান তখন লিপি অনেকটাই বড়।সংসারের প্রতি দিদির এই অমানুষিক পরিশ্রম,দিদির নিজের ভালোবাসাকে তাদের জন্য নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলতে ও দেখেছে।তাই দিদির সহচরী হয়ে দিদির পাশে থেকে তার এই লড়াইয়ে সমানভাবে পাশে থেকে গেছে।লিপি নিজেও একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।এখন দুই বোনের সংসার।মা ও বিদায় নিয়েছেন অনেকদিন আগেই।ভাই এখন বিদেশে।বছরে শুধুমাত্র পুজোর সময় সকল ভাইবোনগুলো দশ, বারো দিনের জন্য একজায়গায় হয়।
 অস্মিতার সাথে দোদুল তারপর আর কোন যোগাযোগ না করলেও তার প্রতিটা খবর সে রাখে।কারণ সুচন্দার সাথে আজও তার সম্পর্কটা রয়ে গেছে।সুচন্দার ছেলের মুখেভাতে দোদুল আসছে শুনে অস্মিতা সেদিন না গিয়ে পরেরদিন গিয়েছিল।কিন্তু অস্মিতা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি তাকে দোদুল না পেয়ে নিজেও সারাটা জীবন একাকী কাটিয়ে দেবে।
  জীবন থেকে অনেকগুলি বছর এইভাবেই হারিয়ে গেলো একই স্বপ্ন দেখা দুটি তরুণ তরুণীর জীবন থেকে।কে কোথায় আছে কেউই জানে না,কেউই কারও খবর জানার বা শোনার আগ্রহ কারো কাছেই প্রকাশ না করলেও দুটি মনের অলিন্দে দুজনেই রয়ে গেছে। কতশত মানুষের জীবন থেকে কত স্বপ্ন হারিয়ে যায় কর্তব্যের বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে।স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা,ইচ্ছা সবকিছু বুকের ভিতর একটা ভারী পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেয় অনেকেই।
 দোদুলকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর কেটে গেছে ত্রিশটি বছর।সুচন্দার ছেলের মুখেভাতের পড়ে অস্মিতার সাথে সুচন্দার যোগাযোগটাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।কিন্তু ত্রিশ বছর পর আবার ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে দুই বন্ধুর নূতন করে পরিচয় হয়;এখন নিত্য কথাও হয় তাদের মধ্যে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার দোদুলের সাথে সুচন্দার যোগাযোগটা কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়নি কোনদিন।প্রথম দিকে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান তারপর মুঠোফোনের দৌলতে রোজ একবার করে কানাডাবাসী দোদুলদাদার সাথে সুচন্দার নিত্য যোগাযোগ।
    সুচন্দার সাথে এখন অস্মিতার নিত্য যোগাযোগের ফলে দোদুলের কথা অস্মিতা জানতে পারে।কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা এখন অবিবাহিত দোদুল।বাবা,মা অনেক আগেই গত হয়েছেন।আজ প্রায় দশ বছর সে দেশে ফেরে না।'স্মিতা ফাউন্ডেশন' নামে সংস্থার চেয়ার পার্সন যা শিলিগুড়িতে কিছু বিশ্বস্ত কাছের মানুষ দেখভাল করলেও যার দায়ভার সম্পুর্নভাবে দোদুলের।এখানে গরীব,অসহায় মানুষদের নানানভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় স্মিতা ফাউন্ডেশন।
 দোদুল সম্পর্কে বর্তমানে সবকিছু জানার পর কয়েকটা রাত শুধু কেঁদেই ভাসিয়েছে সে।পাশে শুয়ে থাকা বোন লিপি সব বুঝতে পারলেও সে দিদির কাছে ধরা দেয়নি।সুচন্দা তার সখীর ইনবক্সে দোদুলের প্রোফাইলের লিঙ্ক পাঠিয়েছে।দুদিন শুধু প্রোফাইলটা ঘেঁটেই গেছে অস্মিতা।দুরুদুরু বুকে সে তার একসময়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে সেকেন্ড,মিনিট,ঘণ্টা গুনে চলেছে।কিন্তু ব্যস্ত দোদুল সেসব দেখবার সময়ও পায়নি।সুচন্দা তাকে বলেই দিয়েছিল দাদা খুব কম অন হয় ভার্চুয়াল জগতের সাথে তার যোগাযোগটা খুবই কম।ওই একটা প্রোফাইল খুলে রেখেছে গোছের।
 দোদুলের প্রোফাইল লিংক পাওয়ার পর থেকে অস্মিতা আর নেট ওফ করেনি সেই থেকে।প্রতিটা মুহূর্তে সে সেই আগের থেকেও বেশি যেন দোদুলের অপেক্ষায় আছে।বয়স বেড়েছে অনেকটাই।কিন্তু বুকের ভিতরের সেই ধুকপুকানি আজও সেই একইভাবে রয়ে গেছে।নিজেই বারবার নিজের দোদুলকে লেখা মেসেজগুলো পড়ছে।দিদির ভিতর যে এক অস্থিরতা কাজ করছে লিপির চোখ এড়ায় না।তারউপর কয়েকদিন অন্ধকার ঘরে অনেক রাতে দিদিকে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখেছে।
 চাকরি আছে অস্মিতার আরও কয়েক বছর।লিপি দিদির এই অস্থিরতা দেখে একসময় বলেই বসলো,
-- তোর কি হয়েছে বলতো?শরীর খারাপ তো মনে হচ্ছে না।কয়েকটা দিন রাতেও বেশ ছটফট করলি -- সে রকম হলে কটাদিন অফিস থেকে ছুটি নে;আমরা কোথাও ঘুরে আসি।
 অস্মিতা ধরা পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বোনকে বললো,
-- স্বার্থপর হয়ে বাঁচতে পারবো না বলে দোদুলকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম যাতে ও অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হয়।কিন্তু সে যে এইভাবে নিজেকে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র আমায় হারিয়ে দেবে বুঝতে পারিনি রে !
--- কিভাবে খবর পেলি তার?
--- কয়েকদিন আগেই তো জানিস সুচন্দাকে খুঁজে পেয়েছি।ওর সাথে দোদুলের যোগাযোগ রয়েছে।ওই সব খবর দিলো আমায়।খুব একটা ফেসবুক না করলেও প্রোফাইল একটা আছে।কানাডায় থাকে এখন।ওখানেই বাড়ি করেছে।একাই থাকে বিয়ে থা করেনি।আমার জন্যই ওর জীবনটা তছনচ হয়ে গেলো।কথাগুলো বলতে বলতে সে লিপির সামনেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।

ক্রমশঃ