ঝরাপাতা (ঊনত্রিশ পর্ব)
প্রতিদিন দুটো মানুষের যেন নেশার মত পেয়ে বসে দিনে দু'বার ফোন করা।স্ত্রী দীপালিকে লুকিয়েই সুমিত সুচন্দাকে ফোন করে।কারণ তার স্ত্রী ভীষণ সন্দেহবাতিকগ্রস্ত একজন মহিলা।আপন বোনের সাথে হেসে কথা বলতে দেখলেও তার সন্দেহ হয়।বদ্ধ দরজার মধ্যে স্বামীর সাথে এটা নিয়েও সে ঝামেলা করতে ছাড়ে না।
।এই শেষ জীবনে এসে সংসারের কাউকে কোনরকম অবহেলা না করে সমস্ত দায়িত্ব পালন করেও দূর থেকে একটি পুরুষ ও একটি নারী ফোনে কথা বলে শুনলেও চোখ কপালে তুলে তার চরিত্রের চৌদ্দগুষ্ঠি ধুয়ে দেয় আমাদের সমাজ।আজও এই বাঙ্গালী সমাজের ভিতরটা খুবই কর্দমাক্ত,নোংরা।তারা মানুষের দুঃখের সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে হাহুতাশ করে পিছন ফিরতে না ফিরতেই সেই দুখী মানুষটির সমালোচনায় রপ্ত হয়।অন্যের সুখে তাদের চোখ টাটায়। বাঙ্গালী সমাজ ভাবতেই পারে না একটা পুরুষ আর একটা নারী সারাজীবন বন্ধু হয়েই কাটিয়ে দিতে পারে।তারা সেই বন্ধুত্বের মাঝে খারাপ কিছু দেখবেই!সুস্থ্য,সুন্দর একটা সম্পর্কের মাঝে তারা টেনে আনবেই তাদের মনগড়া একটা যৌণ সম্পর্ক।আর সেই সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো একটা স্ক্রিপ্ট রচনা করে নরনারী দু'জনকে মাঝখানে রেখে নিজেরাই পার্শ্ব-চরিত্র হয়ে পুরো পাড়া কাঁপিয়ে অভিনয় করে চলে!
সুমিতের ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা শেষ।মেয়েটি ভালো চাকরিও করে।ছেলেটি ছোটখাটো একটা চাকরি করলেও সুমিতের ইচ্ছা ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে সে বড় কোন কাজের চেষ্টা করুক।সেটা যদি বাইরে কোথাও হয় তার কোন আপত্তি নেই।কিন্তু ছেলের মায়ের আবার এ ব্যাপারে ঘোর আপত্তি।ছেলেকে ছাড়া তার আবার এক মুহূর্ত চলে না।ছেলেও মায়ের খুব ন্যাওটা।মায়ের কথায় তার কাছে শেষ কথা।নিজের মতামতের থেকে মায়ের মতামতকে সে গুরুত্ব দেয় বেশি।ছেলের গর্বে গর্বিত দীপালি।
আর অন্যদিকে মেয়ে হচ্ছে বাপ ভক্ত।তবে বাবার কথায় যে তার কাছে শেষ কথা তা কিন্তু নয়।সে তার যুক্তি তর্ক দিয়ে অনেক সময় বাবার মতকে নস্যাৎ করে দেয়।ভাই যেমন অন্ধ ভক্ত মায়ের সে ঠিক আবার তা নয়।এমনিতে সে খুব বুদ্ধিমতি।নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে সে গুরুত্ব দিতে জানে।তবে যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য সে বাবার সাথে আলোচনা না করে পারে না।বাবা তার বন্ধুর মত।সব কথায় সে তার বাবার সাথে খোলামনে আলোচনা করে থাকে।আর সুমিতও তার যেকোন সমস্যায় স্ত্রী দীপালি নয় সে তার মেয়ের সাথেই আলোচনা করে।কিন্তু এখন যে সে একবার দেশে আসবে সুচন্দার সাথে দেখা করতে একথা সে কি করে মেয়ে বা তার মাকে বলবে? একথা না বললেও কি কারণই বা তাদের দর্শাবে?কিন্তু আজকে যখন কথা প্রসঙ্গে দোদুল ও অস্মিতার কথা সুমিত জানতে পারে তখনই সে ঠিক করে এটাই একমাত্র উপায়।দোদুলের অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর ওকে নিয়েই সে দেশে ফিরবে।
দোদুলের সাথে দীপালির আবার খুব ভালো সম্পর্ক।দোদুল সুস্থ্য থাকতে মাঝে মধ্যেই সে সুমিতদের বাড়িতে আসতো আর দীপালি তাকে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়তে না।সুমিত দীপালির কাছে দোদুলের ফেলে আসা অতীত নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে। দীপালিকে সুমিত জানায়
--- দোদুলের অপারেশনটা সাকসেসফুল হলেই সে দোদুলকে নিয়ে শিলিগুড়ি আসবে আর দুজনকে যেভাবেই হোক রাজি করিয়ে এবার একটা রেজিস্ট্রি করিয়ে তবে ছাড়বে।
দীপালি তার কথা সমর্থন করে।সুতরাং সুমিতের দেশে আসার পারিবারিক ভিসাটা সে জোগাড় করে ফেলে।এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এরই মাঝে একদিন দোদুলের সাথে দেখা করে সে সুচন্দা, অস্মিতা সকলের কথা বলে।বারবার দোদুলকে অনুরোধ করে অস্মিতার সাথে ফোনে কথা বলার জন্য।প্রথম অবস্থায় দোদুল কিছুতেই রাজি হতে চায় না।কিন্তু সুমিতও নাছোড়বান্দা হয়ে তাকে ঠিক রাজি করায়।আর এদিকে দোদুলের অপারেশনের জন্য নিজেই ছুটাছুটি করতে থাকে।
দোদুল অস্মিতাকে ফোন করে।ফোনটা রিসিভ করেই অস্মিতা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতে করতে হাউমাউ করে যা বলছে দোদুল তার এক বর্ণও বুঝতে না পেরে হাসতে হাসতে বলে,
--- আরে এত কথা যে বলছো আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।এখন তো কান্নাটা বন্ধ করো।সেই আগের মতই আছো দেখছি। কাঁদতে কাঁদতে কথা বলা।
অস্মিতা কোনরকমে নিজেকে সামলিয়ে ধরা গলায় বলে,
--- আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার অর্থটা কি?আমার জীবনের সাথে তোমার জীবন জড়াতে চেয়েছিলাম না কারণ আমি চেয়েছিলাম তুমি বিয়ে করে সংসারী হও।ভালো থাকো জীবনে।
--- দূর পাগলী!ভালো যেমন একজনকেই মনপ্রাণ দিয়ে বাসা যায় আর সুখী হতে গেলে যে বিয়েটা দরকার সেটাও একবারই হয়।এর বাইরে যেগুলো ঘটে সেগুলো হচ্ছে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ।আমি আমার জীবনে একজনকেই সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম আর মনেমনে তাকেই স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিলাম।সে বুঝতে পারেনি তারজন্য তো আমার কোন দোষ নেই।(হাসতে থাকে দোদুল)এখনো রাতে ঘুমাতে গেলে আমার একটা মুখই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
অস্মিতা তখন অনেকটাই নিজেকে সামলে নিয়েছে।সেও মৃদু রাগানিত্ব স্বরে বলল,
--- হ্যাঁ আর আমার ঘুমের সময় তো পাড়ার সব মানুষের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।যাচ্ছে তাই একটা!কোনদিন আমায় বুঝলোও না।সেই কবের থেকে ফোনের আশায় বসে আছি আর উনি অসুস্থ্য হয়েছেন বলে আমার সাথে কোন যোগাযোগই রাখলেন না।আমার এখন কি ইচ্ছা করছে জানো?
--- কি?
--- তোমার বুকের উপর বেশ কয়েকটা কিল ঘুষি মারতে!
--- আহারে!সেই সৌভাগ্য কি আমার আর হবে? অপারেশন সাকসেসফুল না হলে একটা পঙ্গু মানুষকে মেরে কি লাভ হবে তোমার?
দোদুল হো হো করে হাসতে থাকে।আর অপর প্রান্তে সুচন্দা চিৎকার করে ওঠে,
--- আর একবার একথা বলে দেখো দেখা হলে তোমায় মেরেই ফেলবো।
--- জানো অস্মি কতদিন পর তোমার সাথে কথা বলতে পেরে মনের ভিতরে সেই কলেজ জীবনের অদ্ভুত সেই অনুভূতি কাজ করছে।এত যে বয়স বেড়েছে যখন তোমার সাথে কথা বলছি একবারও মনেই হচ্ছে না।সেই দুষ্টুমিগুলো বারবার মনে পড়ছে।আমি তো আশায় ছেড়ে দিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম তোমার সাথে আর দেখা হবে না।ভাগ্যিস সুচন্দা তোমায় খুঁজে পেয়েছিল।
--- সেই জন্য এতদিন দেরি করে ফোন করলে?
--- আসলে কি জানো অপারেশনের পর যখন পা ঠিক হল না আমি তখন আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।কিন্তু সুমিত বড় ডাক্তারের সাথে কন্ট্যাক্ট করে জানতে পারলো এটা ভালো হবার সম্ভবনা নিরানব্বই পার্সেন্ট।তোমার খবর পেয়েও ফোন করিনি ভেবেছিলাম এই পঙ্গু মানুষটার ভারটা সারাজীবন তোমার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে।
--- এই তুমি আবার এরকম উল্টোপাল্টা কথা বলছো?তুমি কি এই বয়সে এসেও সেই আগের মত আমাকে শুধু কাঁদাবে?
--- নাগো যদি পা টা ভালো হয় বিশ্বাস করো এবার আমি তোমাকে আমার কাছেই নিয়ে আসবো।এবার আর কোন কথা শুনবো না।
অস্মিতা একথা শুনে অস্ফুট স্বরে বললো,
-- যাহ -- এই বয়সে ভীমরতি ধরেছে।
কথাটা বলল ঠিকই সে,সেও কিন্তু এই বয়সেই পুনরায় লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।আসলে মানুষের বাইরের বয়সটাই বারে ভিতরের মানুষটা থেকে যায় সেই কিশোরী বা যুবতী বেলার।
ক্রমশঃ