ছোট গিন্নী (তৃতীয় পর্ব)
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
এভাবেই দিন গড়িয়ে যেতে থাকে।টুকুন তাদের কাছে আসার পর থেকে শমিত, রুমা ভুলেই গেছে তাদের সন্তান না হওয়ার কষ্টটা।এতোটাই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে টুকুন যে সময় টুকু বাড়িতে থাকে বাড়িটাকে পুরো মাতিয়ে রাখে।আর শমিতও কম যায়না;সবসময় টুকুনের পিছনে লেগেই আছে।ছুটির দিনগুলিতে তিনজনেই বেরিয়ে পড়ে।কোনদিন সিনেমা তো কোনদিন থিয়েটার দেখে রাতে কোন ভালো রেস্টুরেন্টে খেয়ে হৈ হৈ করতে করতে বাড়ি ফেরা।শালী ভগ্নিপতির এই খুনসুটিপনাটা রুমা খুব উপভোগ করে।রুমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা যেন সমবয়সী। ওরা দু'জনে চুপ করে থাকলে বরং রুমারই ভালো লাগেনা।কিছু একটা বলে দু'জনকেই খেপিয়ে দেয়।তারপর বসে বসে মজা দেখে।
একদিন দুপুর থেকেই আকাশের মুখ ভার | চারিদিকে অন্ধকার করে নিয়ে এসেছে | দুপুরবেলাতেই মনেহচ্ছে সন্ধ্যা নেমে এসেছে | অফিস , রাস্তা সমস্ত জায়গাতেই বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠেছে | অফিসের সকলেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের হাতের কাজ যত শীগ্র সম্ভব শেষ করে যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার | কাজ ফেলে রেখে গেলে তো আবার ওই বদমেজাজী বসের খপ্পরে পড়তে হবে | টুকুন তার টেবিলের কাজ সেরে একটু ওয়াসরুমে ঢোকে | কিন্তু ফেরার পথে এক বিপত্তি | সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তার রুমে ঢুকতে যাবে ব্যাগটা নিতে আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বদমেজাজী , রাগী বস অরুনের সাথে সামনাসামনি জোর ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে ---- আর ঠিক তখনই তার বস তাকে ধরে ফেলে |
--- সরি স্যার
--- কিসের জন্য ?
--- আসলে বৃষ্টি আসছে দেখে একটু তাড়াতাড়ি যেতে গিয়েই ---
--- কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আমাকে থাঙ্কস বলবেন ---
টুকুন মনেমনে ভাবে ' লোকটা বলে কি ? আজকে মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি ? প্রয়োজন ছাড়া যে মানুষটা একটাও কথা বলেনা সে আজ এতো কথা বলছে
---?
--- কি হল ? চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন যে ? অফিস তো পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে | বেরিয়ে পড়ুন ---|
--- থাঙ্কস স্যার
--- এটা কিসের জন্য ?
--- ওই যে আমাকে পরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচালেন ---|
--- তবে একটা কথা বলি , জীবনে চলার পথে যতই তাড়া থাকনা কেন আশেপাশে , সামনে দেখে হাঁটাচলা করবেন | তানাহলে কিন্তু সবসময় বিপদে পড়বেন |
টুকুন মনেমনে বললো,' জ্ঞানদাতা --- আমি বিপদে পড়ি আর না পড়ি তোমায় তা নিয়ে ভাবতে হবেনা |'
আর বসকে বললো ," মনে থাকবে স্যার |"
বাড়ি ফেরার পূর্ব পর্যন্ত রাস্তা এমনকি বাসে বসেও টুকুন ভেবেই চললো , লোকটার আজকে হল কি ? এতো কথা বললো কেন ? অফিসের এই বসগুলোকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করা যায়না | কখন আবার কি রূপ ধারণ করে | সেরকম কিছু বুঝলেই সঙ্গে সঙ্গেই চাকরিটা ছেড়ে দেবো | তবে তার আগে লোকটার মুখোশ খুলে ছাড়বো '---
কিন্তু না ঐদিনের পরে আবার যে কে সেই | ফাইলগুলো সই করে টেবিলে রেখে দেয় সেখান থেকে ফাইলগুলো নিয়ে টুকুন বেরিয়ে আসে | 'কি আজব জীব রে বাবা | কখনো মুখে খই ফুঁটছে আবার কখনো মনেহয় পুরো বোবা | লোকটার এতো অহংকার কেন যে তা একমাত্র মনেহয় ঈশ্বরই জানেন |'
এরই মাঝে একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভিড়ের জন্য টুকুন বাসে উঠতেই পারেনা।এক একটা বাস আসে দৌড়ে গিয়ে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু ভিড়ের চাপে আবার পিছনে পড়ে যায়।এইভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। এমন সময় একটা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়ায়।গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মুখটা বের করে গাড়ির মালিক বলে,"বাসে উঠতে পারছেন না তো?প্রচন্ড ভিড় কি তাই তো?আরে এদিকে ওদিকে কি দেখছেন?আপনাকেই তো বলছি.....
টুকুন প্রথমে একটু হতভম্ব হয়ে যায়।ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগে।আরে এতো তারই অফিসের বস -মিঃ অরুন মুখার্জী। যে কিনা প্রয়োজন না হলে একটা বাক্য ব্যয় করেনা সে কিনা জানতে চাইছে....
"কি অতশত ভাবছেন?উঠে আসুন।আমি বেহালার দিকেই যাচ্ছি। আপনি তো বেহালাতেই থাকেন।আপনাকে নির্দিষ্ট জায়গাতেই নামিয়ে দেবো।
গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,"আসুন।"
---পেয়ে যাবো বাস।
---আরে আসুন।আমিও একটু গল্প করতে করতে যেতে পারবো।
টুকুন গাড়িতে উঠে খুব জড়োসড়ো হয়ে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে অরুনই বলে,
---আরে আপনি ওইরকম জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন কেন?আমি বাঘ না ভাল্লুক?আরে আমি মানুষটা মোটেই খারাপ নই।হ্যাঁ অফিসে একটু গম্ভীর হয়ে থাকি।বলতে পারেন থাকতে বাধ্য হই।আমার অনেক সিনিয়র রয়েছেন ওখানে।
একটু গম্ভীর হয়ে না থাকলে তাদের কাছ থেকে কাজটা ঠিকমত আদায় করতে পারবোনা-মানে তারা আমায় পাত্তাই দেবেননা।তাই অফিসে আমি ভীষন রাগী মিঃ মুখার্জী।
টুকুন এবার হেসে দিলো।ওর হাসির দিকে অরুন মুখার্জী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে মুখটা নীচু করে হাসি থামিয়ে বলে,
---আপনার অফিসে এই গম্ভীর হয়ে থাকার সিক্রেটটা আমি যদি সকলকে বলে দিই?
---হ্যাঁ তা বলতেই পারেন।তাহলে আমাকে তখন আরও গম্ভীর হয়ে আপনাকে তলব করতে হবে।
---ওরে বাবা!যে গম্ভীর হয়ে আপনি থাকেন তার উপর আরও গম্ভীর?দরকার নেই বাবা আপনার সিক্রেট ফাঁস করবার।
কথা বলতে বলতেই ওরা বেহালা এসে পড়ে।টুকুন বলে,"এবার নেমে যাই। "অরুন গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
---এখানে তো শুধু দোকানপাট দেখতে পাচ্ছি,কোন বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না তো?
---না না এখানে কোথায় বাড়ি?আমাদের বাড়িটা একটু ভিতরে।বি.সি.রোডে।এখান থেকে আমি হেঁটেই যেতে পারবো।
---চলে তো আসতে ওই বাসস্টপ থেকেই আপনি পারতেন।কিন্তু এতো দূর যখন আমি এলাম তখন বাড়ির সামনেই আপনাকে নামিয়ে দিই।আপনি বরং রাস্তার ডিরেকশনটা দিন। না, আপনার কোন ভয় নেই |
--- মানে --?
--- মানে এই আর কি আপনার বাড়িটা চিনে গেলে আপনার বাড়িতে এসে কখনোই উপদ্রব করবোনা বা আপনাকে কোন বিপদে ফেলবোনা |
--- আমি কিন্তু তা বলিনি স্যার আর এইসব উল্টোপাল্টা কথাবার্তা আমার মাথায়ও আসেনি | আর সত্যিই যদি সেরকম কিছু হয় আপনি আমাদের তল্লাটে ঢুকে জ্যান্ত ফিরতে পারবেন ?
কথাটা বলে হাসতে থাকে টুকুন |
অরুনও টুকুনের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে | স্টিয়ারিং হাতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে ,
--- এবার কোন দিকে বলুন ---|
No comments:
Post a Comment