ছোট গিন্নী (৪র্থ পর্ব)
টুকুন বাড়ির রাস্তার ডাইরেকশন দিচ্ছে আর আড়চোখে তার বসকে দেখে চলেছে | ' এই লোকটার ভিতর দুটো সত্বা কাজ করে | অফিসে তার কর্মচারীদের কাছে একরকম আর বাইরে ঠিক তার উল্টোটা | মানুষটা মনেহয় সত্যিই খারাপ না | নাকি আমার পরেই সদয় হয়েছেন --- |' ভাবনায় ছেদ পরে বাড়ির সামনে এসে --- " এ-খা-নে এ-খা-নে দাঁড়ান ---"|
গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। আগে অরুন নেমে গাড়ির দরজা খুলে টুকুনকে নামতে বলে।এদিকে টুকুনের দেরি হচ্ছে দেখে শমিত ও রুমা দুজনেই গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে।টুকুনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে শমিতের চক্ষু চড়কগাছ।সে রুমাকে কনুইয়ের এক ধাক্কা দিয়ে বললো,
---আরে আমার ছোটগিন্নী তো বেশ বড় একটা বোয়াল তুলেছে।
রুমা চোখ পাকিয়ে শমিতের দিকে তাকিয়ে বলে,
---আস্তে,শুনতে পাবে তো!তোমায় নিয়ে আর পারিনা।
টুকুন গাড়ি থেকে নেমে জামাইবাবুকে দেখেই বলে উঠলো,
---জিজু, আমার বস।আজ এতো ভিড় ছিলো যে বাসে উঠতেই পারছিলাম না।কি ভিড় কি ভিড়।উনি দয়া করে পৌঁছে দিলেন তাই এখন আসতে পারলাম।
শমিত বিড়বিড় করে বললো , " তুমি সুন্দরী , শিক্ষিতা, আধুনিকা দয়া তো করবেই ---" কথাটা কারও কান পর্যন্ত অবশ্য পৌঁছালোনা |
অরুন একটু এগিয়ে গেলো শমিতের দিকে। হাতটা এগিয়ে দিয়েও কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রণাম করতে করতে বলে,
---কেমন আছো শমিতদা ?
শমিত একটু হকচকিয়ে গেলো।
---ভালো তো আছি ভায়া।কিন্তু তোমায় তো ঠিক চিনতে পারছিনা।
--- গেস করো --- | আমি তো দেখেই তোমায় চিনতে পারলাম |
--- বয়স হয়েছে ভায়া | স্মৃতিশক্তিগুলো আস্তে আস্তে জং ধরতে শুরু করেছে |
--- সে-- ই তবে আমার মনেহয় দাদা পুরনো পাড়ার স্মৃতি ঘাটলেই তোমার সব মনে পড়বে --|
--আরে পরিচয়টা দিয়েই ফেলো ভাই |
--- চিনতে পারলে না তো ? অবশ্য এরজন্য তোমার কোন দোষ নেই | সব দোষ সময়ের | আর আমি তো এখন তোমার ছোট্ট যুধিষ্ঠির নই।
সঙ্গে সঙ্গে শমিত বাচ্চাদের মত চিৎকার করে বলে উঠলো ,
---যুধিষ্ঠির?আরে আমি তো তোকে চিনতেই পারতামনা যদি কিনা আমার দেওয়া এই মিষ্টি নামটা না বলতিস।চল ভিতরে চল।কত বছর পর দেখা হোল ,অনেক কথা জমে আছে।
--- পরে একদিন জমানো কথার ঝুড়ি উল্টে দিলে হয়না ?
--- তা কি করে হয় ? তুই বাড়ির ভিতরে না ঢুকেই চলে যাবি ?না - না ভিতরে চল |
অগত্যা অরুনকে ভিতরে ঢুকতেই হল | অবশ্য একেবারে যে তার ইচ্ছা ছিলোনা তাও নয় কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটা আটকাচ্ছিলো |
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে শমিত রুমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
---রুমা ও কিন্তু আমার ছোট ভাই।আমরা একই পাড়াতে থাকতাম।ওর দাদা আমার প্রাণের বন্ধু ছিলো।অনেকদিন বরুনের সাথে কোন যোগাযোগ নেই।কলেজ জীবন শেষ করার পর সবাই যেন চারিপাশে ছিটকে গেলাম।অনেক গল্প শোনার আছে ওর কাছে।ও রাতে খেয়েদেয়েই যাবে।দুই বোন মিলে জমিয়ে রান্না করো আর আমরা দুই ভাই মিলে জমিয়ে গল্প করি।কিন্তু তার আগে একটা গল্প শুনে যাও আমরা কেন ওকে যুধিষ্ঠির বলে ডাকতাম।
আমরা যখন এন্টালীতে ভাড়া থাকতাম তার পাশেই ছিলো রমেশ ঘোষের বিশাল বাগানবাড়ী।একবার বৈশাখ কি জৈষ্ঠ্য মাসে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রাচীর টপকে ঘোষবাবুর বাগান বাড়িতে ঢুকলাম আম চুরি করতে।অরুনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,এটা সবসময় আমাদের পিছন পিছন ঘুরতো।ওর তখন কত আর বয়স হবে এই ধরো আট কি ন' বছর।আমরা তো প্রাচীর টপকে ভিতরে ঢুকলাম;ওকে বললাম,তুই বাইরে থাক বাইরে যে আমগুলি পড়বে সেগুলো তুই কুড়াবি।গাছটা ছিলো একদম প্রাচীরের গায়ে।আমরা তো যে যার মত আম পেড়ে চলেছি।হঠাৎ দারোয়ানের দিবানিদ্রা শেষ।তিনি লাঠি উঁচিয়ে 'কে আম পারিস?'বলে ছুটে এলেন।আমরা তো যে যার মতন প্রাচীরের যে কোন দিক থেকে লাফ দিয়ে দে-ছুট।আর এই বিচ্ছুটা কয়েকটা আম তখনও বাইরে পড়ে ছিলো কুড়িয়ে চলেছে।দারোয়ান গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এটাকেই ধরলো।কারা কারা গাছে উঠেছে জানতে চাওয়ায় সে সকলের নামধাম সব বলে দিলো।খবর গেলো সকলের বাবার কাছে।সকলেই যে যার বাবার কাছে মার খেলাম।আর আমার বাবা তো খড়ম পড়তেন, খড়ম দিয়েই দমাদম মার।সবাই তো ক্ষেপে আগুন ওর প্রতি।ওর সত্যবাদিতার জন্য নাম-ই হয়ে গেলো যুধিষ্ঠির।তারপর থেকে আমরা ওকে লুকিয়েই আমাদের কাজগুলো করতাম।গল্প শুনে দুইবোন হেসে গড়াগড়ি। দুই বোনের এই প্রাণখোলা হাসি দেখে অরুন যে একদৃষ্টিতে শমিতের ছোটগিন্নীর দিকে তাকিয়ে আছে তা কিন্তু শমিতের দৃষ্টি এড়ায়না | শমিতের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না তার ছোটগিন্নী মিষ্টার অরুন মুখাৰ্জীর অফিসেই শুধু কাজ করেনা তার মনের ঘরেও কাজ করতে শুরু করেছে |
চলবে :-
No comments:
Post a Comment