Friday, April 24, 2020

ছোটগিন্নী ( দ্বিতীয় পর্ব )

ছোট গিন্নী (দ্বিতীয় পর্ব)
     
      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

       টুকুনের পড়াশুনা প্রায় শেষের পথে।দিদির ইচ্ছা তার বোনের বিয়ে দেওয়া।কিন্তু শমিতের ইচ্ছা তার ছোট গিন্নী পড়াশুনা শেষ করে চাকরী করুক। সবসময় এই নিয়ে রুমা আর শমিতের কথা কাটাকাটি।টুকুন বেশ মজা পায় তাকে নিয়ে দিদি আর জিজুর এই ঝগড়ায়।মাঝে মাঝে didir.পক্ষ নিয়ে বলে, 
---ঠিকই তো বলছে দিদি।এখন যদি বিয়ে না করি আর কবে বিয়ে করবো?শেষে যদি একটা বুড়ো বর কপালে ঝোঠে,তখন কি হবে দিদি?তার থেকে তোরা এখন আমার বিয়ে দিয়ে দে। 
  আবার কখনো বা শমিতের দিকে ঝুলে পড়ে -
---কি বলিস দিদি তুই?এতো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখলাম শুধু কি ওই হাতাখুন্তি নাড়াতে?না গো জিজু আমি এখন কিছুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবো না।আমি চাকরী করবো। 
   নিত্যদিন রাতে খাবার আগে পরে টুকুনের বিয়ে নিয়ে আলোচনা,ঝামেলা, কথা কাটাকাটি,মান-অভিমান চলতেই থাক।শেষমেষ রুমা কোন কোনদিন রেগেমেগে আগেই শুতে চলে যায়। আর রুমাকে রাগিয়ে দিয়ে শালী ভগ্নিপতি হো হো করে হাসতে শুরু করে।আবার পরদিন সকালে সব ঠিক।এভাবেই রুমা,শমিত আর টুকুনের হাসিখুশিতে দিন চলে যেতে থাকে। 
     জামাইবাবুর পরিচিতির সূত্র ধরেই টুকুন পাশ করার পর একটা ভালো নামী কোম্পানীতে চাকরীও পেয়ে যায়। আর সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় অরুনের সাথে।সুদর্শন,রাগী, অহংকারী অল্প বয়সী টুকুনের বস।রোজই প্রায় দু'একবার তার বসের কাছে যেতেই হয় ফাইলপত্র সই করাতে।ভীষন গম্ভীর।প্রয়োজনের একটা বেশি কথা তিনি বলেননা।বলতে গেলে টুকুন একটু ভয়ই পায় তার এই অহংকারী গম্ভীর বসকে।টুকুন মনে মনে ভাবে অল্প বয়সে এইরূপ উচ্চপদে চাকরী পেয়ে লোকটার মাথাটাই বোধহয় বিগড়ে গেছে।মুখে কখনোই হাসি নেই।লোকটা বোধহয় জানেই না হাসি কি জিনিস।এ ভাবেই টুকুনের চাকরীর বয়স একমাস হয়ে যায়।সে মাইনে পেয়ে দিদি আর জিজুর জন্য প্রাণভরে মার্কেটিং করে।বাড়িতে ফিরে এসে বাকি টাকা সে তার জিজুর পায়ের কাছে রেখে সেখানেই নিজে বসে জিজুকে বলে, 
---আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে এইভাবেই আমি মাইনের টাকাটা তার পায়ের কাছেই রাখতাম।কিন্তু তিনি আজ নেই।তোমাকেই আমি সেই জায়গায় বসিয়েছি।তুমিই আমার বাবা, আমার দাদা,আমার বন্ধু, আমার জামাইবাবু -সব সব তুমি।তুমি এটা নিলে আমি খুব খুশি হবো।
শমিতের দু'চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। সে টুকুনকে তুলে মাথাটা বুকের পরে রেখে বলে, 
---তুই টাকাটা তোর কাছেই রাখ।যখন আমার দরকার হবে আমি নিজেই তোর কাছ থেকে চেয়ে নেবো।তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল!ওরে তুই তো শুধু আমার শালী না রে!তুই আমার মেয়ে, আমার বোন -তারপর মুখটা তুলে নিয়ে চিবুকটা ধরে বলে, আমার আদরের ছোটগিন্নী।ব্যস-অমনি শুরু হয়ে গেলো চিৎকার,চেঁচামেচি।শমিতকে মারার জন্য ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি।শমিতও ঘরের মধ্যে এদিকে ওদিকে দৌড়াতে লাগলো।রুমা এতক্ষণ সোফায় বসে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে যাচ্ছিলো।এবার হেসে পড়ে বললো, 
---আবার শুরু হোল বাচ্চাদের মত।ঘরটা এতক্ষণ গুমোট হয়ে ছিলো।এবার ঠিক হোল।তারপর সোফা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, 
---তোমাদের মারপিট শেষ হলে দয়া করে খেতে এসো।আমি খাবার রেডি করছি।

  খাবার  টেবিলেও  একপ্রস্ত  হৈ হট্টগোল  | রুমা  কাতলার  কালিয়া  করে  তিন  বাটিতে  তিনজনের  জন্য  ঢেলে  রেখেছে  | ওদের  দুজনের  সামনে  দুটো  বাটি এগিয়ে  দিয়ে  নিজেরটা  নিয়ে  সবে ভাত মেখে  মুখে  দিতে  গেছে  সামনের  দিকে  তাকিয়ে  দেখে  শালী  ভগ্নিপতি  দুজনে  মিলে বাচ্চাদের  মত  করছে  | একবার  টুকুন  তার  মাছের  বাটি তার  জিজুর  দিকে  এগিয়ে  দেয় তো  পরক্ষণে তার  জিজু  সেই  বাটি নিয়ে  টুকুনের  দিকে  এগিয়ে  দেয় | খাওয়া  বন্ধ  করে  রুমা  তাদের  এই  ছেলেমানুষি  দেখতে  দেখতে  একসময়  হাসতে হাসতে বলে ,
--- এটা কি  ছেলেমানুষি  হচ্ছে  তোমাদের  ?
--- তুই  কেন  আমাকে  বড়  মাছের  পিসটা দিয়ে  জিজুকে ছোট  মাছের  পিস দিয়েছিস  ?
--- তোর  জিজুকে বড়  পিসটা দিলে  যে  সে  সেটা  খেতোনা  | উল্টে  আমাকে  বকাবকি  করতো | 
--- এটা একদম  ঠিক  হচ্ছেনা  জিজু | তোমরা আমাকে  যে  ভালোবাসা  দিয়েছো  তার  ঋণ আমি  কোনদিনও  শোধ  করতে  পারবোনা | এতদিন  আমি  এই  খাওয়ার  ব্যাপারে  কিচ্ছু বলিনি | কিন্তু  এখন  তোমার  বয়স  হচ্ছে  , তোমার  এখন  খাওয়াদাওয়ার দিকে  একটু  নজর  দেওয়া  দরকার  | এখন  তো  আর  আমি  সেই  ছোট্টটি  নেই | প্রতিদিন  এই  যে  দু  দুবার  বাসে করে  অফিস  যাতায়াত  করো  তাতে  কি  তোমার  কম  পরিশ্রম  হয় ? আর  দিদি  তুইও  না  --- তুই  কেমন  ধরণের বৌ  রে  --- স্বামীকে  কম  দিয়ে  বোনকে  বেশি  দিস --- |
 শমিতের  চোখদুটি  ছলছল করে  | টুকুনের  দিকে  তাকিয়ে  বলে ,
--- প্রত্যেক  বাবা , মা  তার  সন্তানদের  নিজেদের  থেকে  ভালো  খাবারটা  , ভালো  পোশাকটা  দেওয়ার  চেষ্টা  করে | তুমি  যে  আমাদের  জীবনে  সেই  জায়গাটাই নিয়েছো | নিজেরা  খাওয়ার  থেকে  ভালোটা  তোমায়  খাওয়াতে  পারলে  আমরা  যে  দুজনেই  খুব  খুশি  হই টুকুন | আমাদের  জীবনে  তুমি  ছাড়া  আর  তো  কেউ  নেই  | বাবা  মায়ের  কাছে  সন্তানের  কোন  ঋণ থাকেনা  | থাকে  শুধু  দায়িত্ব  আর  কর্তব্য | বাবা  মা  তাদের  সবটুকু  ভালোবাসা  দিয়ে  সন্তানের  প্রতি  তাদের  দায়িত্ব  আর  কর্তব্য  পালন  করে  থাকেন  আর  অপরদিকে  তাদের  বৃদ্ধবয়সে  সন্তানেরাও  ভালোবাসার  আবদ্ধেই  তাদের  দায়িত্ব  কর্তব্য  সম্পাদন  করে  |
 কথাটা  শেষ  করে  শমিত টুকুনের  মাছের  বাটি থেকে  কিছুটা  মাছ  নিয়ে  টুকুনের  মুখে  দিয়ে  দেয় | টুকুনও ঠিক  একই  কাজ  করে | শমিত একটা  বড়  হা  করে  টুকুনের  মাথায়  বাহাতটা দিয়ে  বলে ,
--- পাগলী  চোখে জল  কেন  ?
--- মাছের  কালিয়াটাই দিদি  একটু  বেশি  ঝাল  দিয়ে  ফেলেছে |
 কথাটা  শুনে  রুমা  বললো ,
--- ঠিক  বলেছিস  | আমারও  খুব  ঝাল  লেগেছে |
 কথাটা  বলে  আঁচলের  খুট  দিয়ে  চোখ  মুছতে  মুছতে রুমা   রান্নাঘরের  দিকে  চলে  গেলো |

No comments:

Post a Comment