ছোটগিন্নী ( প্রথম পর্ব )
শমিত ফোনটা পেয়ে চুপ করে বসে থাকে | রবিবার বলে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে সে আজ | রুমার চিৎকার চেঁচামেচিতে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বেরোতে যাবে এরই মধ্যে ল্যান্ডফোনটা বেজে ওঠে | অপরপ্রান্ত থেকে যে কথাটা সে শুনতে পায় তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি | কি করবে সে এখন ?কেমন করে রুমাকে সে এই দুঃসংবাদটা দেবে ?ভাবতে ভাবতেই সোফার উপর বসে পরে | রুমা শমিত বেরিয়ে গেছে ভেবে দরজা দিতে আসে | কিন্তু শমিতকে সোফার উপর চুপচাপ বসে থাকতে দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে," তুমি এখনো বেরোও নি ? এরপর তো কিছু পাবেনা আর বাজারে | তোমাকে নিয়ে সত্যি আমি আর পারিনা | বললে চা খেয়েই বাজারে বেরোবে--- চুপচাপ বসে কি ভাবছো বলোতো --- ?"
শমিত রুমার হাতটা ধরে নিয়ে তার পাশে বসায় | খুব আস্তে বলে ,
-- রুমা মাথা ঠান্ডা করো | চুপ করে আমার একটা কথা শোনো |
শমিতের এই ব্যবহারে রুমা ভয় পেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- কি হয়েছে গো ? শরীর ঠিক আছে তো? ফোনের আওয়াজ পেয়েছিলাম কোন খারাপ খবর---
রুমার কথার মাঝখানেই শমিত ওর হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলে,
--- আমি ঠিক আছি , কিন্তু আমাদের এক্ষুনি একবার মধ্যমগ্রাম যেতে হবে |
মধ্যমগ্রাম রুমার বাপেরবাড়ি | সঙ্গে সঙ্গে রুমা বলে ওঠে ,
--- কারও শরীর খারাপ করেনি তো ? মা, বাবা, টুকুন, সবাই ঠিক আছে তো ?
শমিত এবার রুমাকে আরও কিছুটা কাছে টেনে নিয়ে বলে ,
--- দেখো যা হয়েছে তা হয়ে গেছে | এতে আমাদের কারও কোন হাত নেই | এটা আমাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয় | কিন্তু আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে , চলো বেরিয়ে পড়ি |
রুমা কাঁদতে কাঁদতে জানতে চায় ,
--- আরে কি হয়েছে আমায় খুলে বলো --| আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা |
শমিত নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে রুমার মাথাটা নিজের বুকের উপর নিয়ে বললো,
--- একটা একসিডেন্ট --- বাবা আর মা দুজনেই সকালে বাজার করতে বেরিয়েছিলেন , বাজার শেষে দুজনে একটা রিক্সা করে বাড়ি ফিরছিলেন | তখন পিছন থেকে একটা প্রাইভেটকার ধাক্কা মারে | দুজনেই দুদিকে ছিটকে পড়েন | কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য কেউই আর---
রুমা ডুকরে কেঁদে ওঠে | শমিত দুহাতে রুমাকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে রাখে | কিছুক্ষণ সময় এভাবেই কেটে যায় | রুমা কাঁদতে কাঁদতে একসময় শান্ত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পরে | শমিত রুমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ,
--- আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে | চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি | টুকুনটা একা রয়েছে | ওকে শান্তনা দেওয়ার মতোও পাশে কেউ নেই | আমরা যত দেরি করবো ওর কষ্টটা তত বাড়বে | এই মুহূর্তে ওর যে আমাদের খুব দরকার |
টুকুন ওরফে সোমা | রুমার ছোটবোন | বেশ অনেকটাই ছোট | রুমার যখন বিয়ে হয় তখন টুকুনের বয়স কত আর -- এই দশ কি এগারো বছর হবে | রুমার বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক | কোন সন্তান হয়নি | চিকিৎসারও কোন ত্রুটি শমিত রাখেনি | দোষটা রুমারই | শমিত এটা দুর্ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছে | শমিতের যেহেতু কোন ভাইবোন নেই তাই সে প্রথম থেকেই টুকুনকে খুব ভালোবাসে | ওরা আর সময় নষ্ট না করে সেই মুহূর্তেই একটা ট্যাক্সি ধরে মধ্যমগ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে | ওদের বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখেই টুকুন দৌড়ে গিয়ে তার জিজুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে | শমিত টুকুনকে নিয়ে একটি খাটের উপর বসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ,
--- ভাগ্যের উপর কারও কোন হাত নেই | এই একটা জায়গায় মানুষ বড্ড অসহায় | বাবা , মায়ের শূন্যস্থান কেউ কখনোই পূরণ করতে পারেনা | আমি আর তোমার দিদি দুজনে মিলে চেষ্টা করবো ভালোবাসা দিয়ে তোমার এই শূন্যস্থানটা কিছুটা হলেও ভরিয়ে দিতে |
তারপর কিছুটা সময় চুপ করে থেকে আবারো বলতে শুরু করে, "তোমরা দুবোন মিলে যদি এতো কান্নাকাটি করো তাহলে তাদের আত্মা শান্তি পাবেনা যে --- | অনেকটা পথ এখনো তোমায় এগোতে হবে | আমি কথা দিচ্ছি তোমার এই জিজু সারাজীবন তোমার সাথে থাকবে |
দিন পনেরর মধ্যে এখানকার যাবতীয় কাজ সেরে তারা টুকুনকে সাথে নিয়েই কলকাতা ফিরে আসে |
সে থেকে টুকুনের যাবতীয় সবকিছু অথাৎ সে কোন কলেজে ভর্তি হবে , কোন প্রফেসারের কাছে পড়লে ভালো হবে সবই শমিত দেখাশুনা করে |r রুমা মোটেই এসবের ভিতর ঢোকেনা | সে তার বোনের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে শমিতের উপর নির্ভরশীল | শমিত ,রুমার বিয়ের পর থেকেই সে টুকুনকে ছোটগিন্নী বলে ডাকে | রাস্তাঘাটে শমিত যখন এই নামে টুকুনকে ডাকে তখন টুকুন প্রচন্ড ক্ষেপে যায় | মাঝে মধ্যে চিৎকার করে বলে ওঠে , " জিজু এটা কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছেনা | লোকে ভাবছে আমার মত সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ের বর এই বুড়ো লোকটা |"
" আরে ছোটগিন্নী ঘাবড়াচ্ছো কেন? বাইরেটা আমার বুড়ো দেখতে হলে হবে কি --- ভিতরটা একদম কচি |"
" দিদি , এটা কিন্তু একদম ভালো হচ্ছেনা |"
রাস্তার মধ্যেই শালী , ভগ্নিপতির ঝগড়া শুরু হয় | রুমাকেই তখন সালিশি করতে হয় | বলা বাহুল্য রুমা সবসময় তার বোনের দিকেই ঝুলে থাকে | তানাহলে তো আবার তার মুখ ফুলে লাল হয়ে যায় | বাড়িতে ফিরে তো দিদি আর জিজুকে জব্দ করার একমাত্র উপায় 'খাবোনা' - বলে শুয়ে পড়া | সে না খেলে যে অন্য মানুষদুটিও খেতে পারেনা | স্বামী , স্ত্রী দুজনেই জানে টুকুনের এটা ঠিক রাগ নয় | একটু অভিমান | টুকুনও এতে যেমন মজা পায় রুমা , শমিতও এই মান অভিমানের পালাটি বেশ উপভোগ করে | নিঃসন্তান জীবনে টুকুনই যেন তাদের জন্য আলোর বন্যা নিয়ে এসেছে |
No comments:
Post a Comment