রোজ কলেজে যাওয়ার পথে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করা পাগলটাকে কিছুনা কিছু খাবার রোজি দিয়েই যায় | আজ দুবছর ধরে এটা চলছে | রোজির মা তাকে টিফিন দেওয়ার সময় আর একটা পাত্রে ওই পাগলটার জন্যও খাবার দিয়ে দেন রোজির কথামত | তার অবশ্য কারণও আছে | একদিন পাগলটাকে কিছু উঠতি বয়সের ছেলেরা মারাত্মকভাবে বিরক্ত করছিলো | রোজি তাদের বাধা দেয় | বয়সে রোজির থেকে তারা ছোটই হবে একটু | পাগলটা সেদিন খুব কাঁদছিলো | তখন রোজি তার ব্যাগ থেকে একটা কমলালেবু বের করে তাকে দেয় | লেবুটা হাতে পেয়ে সে দুঃখ ভুলে হাসতে থাকে | রোজি তার কাছে জানতে চায় ,
--- তুমি কোথায় থাকো ?
একটা আগুল তুলে দূরে একটা ঝুপড়ি দেখিয়ে দেয় | সে তখন মহানন্দে কমলালেবুটা খাচ্ছে | এরই মধ্যে সেখানে আর একটি দশ বারো বছরের বাচ্চা আসে যার বাস ওই ফুটপাথেই | পাগলটা তখন তার লেবু থেকে তাকে কয়েকটি কোয়া দেয় খেতে | তা দেখে রোজি মুগ্ধ হয়ে যায় আর মনেমনে ভাবে ' নিজের পেটে খিদে অথচ তারই সমগোত্রীয় একটি বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়াতেই সামান্য খাবার থেকেই সে তাকে খেতে দিলো | আর আমরা ? আমাদের প্রচুর থাকা সর্ত্বেও আমাদের মানসিকতা কত নিচু | আমরা অন্যদের ভাগ দিয়ে খেতে জানিনা | লোকটা পাগল ভিখারি হলেও মনের দিক থেকে সে সম্পদশালী | সেই শুরু | আজ দুবছর ধরে রোজ নিয়ম করে রোজি ওই পাগলটার জন্য খাবার নিয়ে আসে | আর সেও অপেক্ষা করে থাকে রোজ রোজি কখন আসবে | বাড়ি ফেরার সময় যতক্ষণ না রোজি বাসে ওঠে তৎক্ষণ সে তার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে | অনেকদিন রোজি খেয়াল করে দেখেছে বাসটা যতক্ষণ দেখা যায় সে একদৃষ্টিতে বাসের দিকে তাকিয়ে থাকে |
দুদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি | পাগল তার ঝুপড়ির ভিতরই রয়েছে | হঠাৎ একটা পুলিশের জীপ এসে থামলো | প্লাস্টিক ফাঁক করে দেখে একটু ধরে আসা বৃষ্টির মাঝেই প্রচুর পুলিশ আর মানুষের জটলা | পাগল হলেও সে মানুষ | হঠাৎ তার বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো | কোনদিন তো এরকম হয়নি --| বৃষ্টির কারণে দুদিন ধরে সে বেরোতেই পারেনি | দিদিমনির খাবারও তার জোঠেনি | বাইরে বেরোতে গিয়েও মাথা তুলতে পারলোনা | শুয়েই থাকলো | দুর্বলতায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি | ঘুম ভাঙ্গলো তার সেই কমলা ভাগ করে দেওয়া ছেলেটার স্পর্শে |
--- আমায় ডাকলি কেন ?
একটা কাগজের ঠোঙ্গায় কয়েকটি মুড়ি তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো ,
--- তুমি এই মুড়িগুলো খাও আর শোনো যে দিদিমনি তোমায় রোজ খাবার দিয়ে যেত তাকে কাল কারা যেন মেরে ফেলেছে ---|
দুর্বল শরীরে হঠাৎ করে যেন বল ফিরে পেলো | লাফ দিয়ে উঠে বসলো |
--- কি কি বললি ?
--- হ্যাঁ গো -- কাল বৃষ্টির মধ্যে কারা যেন দিদিমনিকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে তারপর মেরে ফেলেছে |
লাফ দিয়ে ঝুপড়ি থেকে বের হয়ে পাগল ছুটতে লাগলো চিৎকার করতে করতে ," আমি ছাড়বোনা যারা আমার দিদিমনিকে মেরে ফেলেছে তাদের একটা একটা করে আমি শেষ করবো | কিছুতেই তোরা বাঁচতে পারবিনা |' কিছুটা এগিয়ে দুর্বল শরীরে ঝপ করে রাস্তায় পরে গেলো | কিছু পথচারী তাকিয়ে দেখে যে যার মত কাজে চলে গেলো |
পাগল এখন সারাটাদিন ঘুমায় আর রাত হলেই পাহারাদারের মত সারা রাস্তা টহল দিয়ে বেড়ায় | এমনিই একদিন রাতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত শরীরে গাছের গোড়া বাঁধানো আর একটি মানুষের পাশে এসে শুয়ে পরে |
' না আমাকে ভিতরে যেতে দাও -- আমার অফিসারের সাথে কথা আছে |'
--- দূর পাগল , আমায় বল আমি বলে দেবো |
গেটে পুলিশ কনস্টেবল তাকে আটকায় |
--- আমি সব জানি | কিন্তু তোমায় কিছু বলবোনা |
--- হ্যাঁ তুই অনেক জানিস যা এতো রাতে আর বিরক্ত করিসনা | স্যার জানতে পারলে মেরে তোর পিঠের চামড়া তুলে নেবে |
জোর করে থানার ভিতর পাগল ঢুকতে যায় | কিন্তু কনস্টেবলের ধাক্কায় পরে গিয়ে তার কপাল কেটে রক্ত ঝরতে থাকে | চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে | তাকে দুজন মিলে টেনে থানা থেকে বের করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে আর সে একটি লাইটপোস্ট জড়িয়ে ধরে চেঁচাতে থাকে ," আমাকে ভিতরে যেতে দাও আমার দিদিমনিকে কারা মেরে ফেলেছে আমি জানি , আমার দিদিমনি খুব কষ্ট পেয়েছে --- আমি সব বলে দেবো সবাইকে ---
হঠাৎ একটা পুলিশের জীপ এসে ঢোকে |
অফিসার বেরিয়ে এসে বলেন ," কিসের এতো চেঁচামেচি ?
--- স্যার এই পাগলটা তখন থেকে এসে ঝামেলা করছে |
--- একি? এর কপাল কাটলো কি করে ?
পাগল দৌড়ে গিয়ে অফিসারের পা জড়িয়ে ধরে বললো ,
--- স্যার আমি ব্যথা পাইনি | কিন্তু আমার দিদিমনি অনেক ব্যথা পেয়েছে | কারা তাকে ব্যথা দিয়েছে আমি জানি স্যার |
--- কি পাগলামী হচ্ছে ? কে তোমার দিদিমনি ?
--- আমায় রোজ খাবার দিতো স্যার | খুব ভালো মানুষ ছিলো | কিন্ত ওরা ওর উপর অত্যাচার করে মেরে ফেলেছে --- পাগলটা ডুকরে কেঁদে উঠলো |
অফিসার কিছুর একটা গন্ধ পেয়ে কনস্টেবলকে বললেন ,
--- ওকে আমার রুমে নিয়ে এসো |
পাগল তার অসংলগ্ন কথায় অফিসারকে যা বললো তার সারমর্ম হল - ওদের দলে তিনজন ছিল | ওরা মেয়েটিকে নিয়ে নির্মীয়মান একটা ফ্ল্যাটে উঠেছিল | বৃষ্টির কারণে ওই ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছিল এক মধ্যবয়সী | সেও এক ঝুপড়িবাসী | মেয়েটির উপর অত্যাচার করে তাকে খুন করে যখন তারা বেরিয়ে যায় তখন ওই মধ্যবয়সীর সাথে তাদের দেখা হয় | তার মুখ বন্ধ করতে কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়ে গাড়ি নিয়ে তারা বেরিয়ে যায় | কিন্তু ওই তিনজনের মধ্যে একজনকে সে চেনে যে কলেজেই ঝাড়ুদারের কাজ করে |
--- এতো কথা তুমি জানলে কি করে ?
পাগল মাথা চুলকে বললো ,
--- কেন জানবোনা ? আমি তো রোজ রাতে দিদিমনিকে যারা মেরেছে তাদের ধরার জন্য ঘুরে বেড়াই | সেদিন রাতে রাস্তায় একজনের কাছে গিয়ে বসেছিলাম | সে প্রচুর মদ খেয়েছিলো | সেই তো আমাকে এই কথাগুলো বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো | আমি তার কাছে বসেই থাকলাম | ভোররাতে উঠে সে যখন তার ঝুপড়িতে ফিরে গেলো আমিও তার সাথে গিয়ে তার ঘর দেখেই এখানে ছুটে আসলাম | কিন্তু ওরা আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে দেবেনা বলছিলো |
অফিসার পাগলের জন্য খাবার আনালেন কিন্তু পাগল তা ছুঁয়েও দেখলোনা | যে কেসের কিনারা আজ কদিন ধরেও তারা করতে পারেননি তা একজন পাগল ভিক্ষুকের সহায়তায় এতো সহজে হবে প্রথমে অফিসার নিজেও এটা বুঝতে পারেননি |
পাগলের দেখিয়ে দেওয়া ঝুপড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক | তাকে নিয়ে সোজা থানায় এনে জেরা করার পর জানা গেলো কলেজের ঝাড়ুদারের সাথে ওই মধ্যবয়সীর বন্ধুত্বের কথা |
সেদিন বৃষ্টির মধ্যে পাগলটাকে দেখতে না পেয়ে শুনশান ফুটপাথ ধরে ছাতা মাথায় দিয়ে রোজি তার খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে তার ঝুপড়ির দিকে এগোচ্ছিল | হঠাৎ একটি গাড়ি এসে রোজিকে জোর করে গাড়ির ভিতর তুলে নিয়ে যায় | বলাবাহুল্য বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে চিৎকার করেও কোন লাভ হয়না | কারণ বৃষ্টির আওয়াজের মাঝে রোজির আওয়াজ কেউই শুনতে পায়নি |
ক্লাসে কিছু ছাত্রী ঢুকে যাওয়ার পর ঝাড়ুদার ক্লাস ঝাঁট দিতে ঢুকেছিলো | এই নিয়ে রোজির সাথে তার বচসা হয় | প্রতিশোধ নিতে সে তার পাড়ার দুই মস্তানের শরণাপন্ন হয় | তারা কাজ হাসিল করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাতাল নরেশের সাথে তাদের দেখা হয় | আর কথা গোপন রাখতে কিছু টাকা তাকে সেই মুহূর্তে দিয়েও মাঝে মধ্যে তাকে বোতল কিনে দিয়ে যাচ্ছে | অফিসার বুঝতে পারেন ওরা তিনজন প্রমাণ লোপাট করতে নরেশকেও মেরে ফেলবে | এখনো সে সুযোগ তারা পায়নি তাই কাজটা শেষ করতেও পারেনি |তিনি নরেশকে এনে থানায় রাখেন | পরদিন ঝাড়ুদারকে কলেজ থেকেই ভোরে এরেস্ট করে তাকে সঙ্গে নিয়েই বাকি দুজনের খোঁজ পান |
রাস্তার পাগল ভিক্ষুক রাস্তাতেই থেকে যায় | আগের মত রোজই সে দিদিমনির জন্য নিদিষ্ট জায়গাতেই অপেক্ষা করে | মাঝে মধ্যে তার খাবারও আসে অন্য কারও হাত দিয়ে | সে জানে এটা তার দিদিমনিই পাঠায় তাকে | কিন্তু লজ্জায় সামনে আসতে পারেনা |
পুলিশ অফিসার দূরে দাঁড়িয়ে অন্যের হাত দিয়ে এই অবোধ লোকটাকে খাবার পাঠিয়ে তার মুখের ওই হাসিটুকু দেখেন আর ভাবেন আমি একজন অফিসার হয়ে যা পারিনি তুমি তা করে দেখিয়েছো | এই সামান্য খাবারটুকু তোমার কাছে পৌঁছালে তোমার দিদিমনির আত্মা শান্তি পাবে |
No comments:
Post a Comment