ছোট গিন্নী ( নবম ও শেষ পর্ব)
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
গাড়ির ভিতর ওরা পাশপাশি।দু'জনেই চুপ।সন্ধ্যা তখনো হয়নি।মাঝে মাঝে দু'জনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে।দু'জনেই তখন হেসে ফেলছে।অনেক্ষণ এভাবে চলার পর নিস্তব্দতা ভেঙ্গে টুকুন-ই বললো,
---যে মানুষটার অফিসে এতো হম্বিতম্বি সকলে কথা বলতে পর্যন্ত ভয় পায় সেই মানুষটা যে 'ভালোবাসি' এই কথাটা বলতে এতো তোতলাবে সত্যি বলছি আমি কিন্তু এটা বুঝতে পারিনি।
অরুন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো টুকুন হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে বলে,
---এটা অফিস নয়,এখন আমি যা বলবো সেটা শুনতে হবে।ওই রুমটার মধ্যে যখন আমি ঢুকি আমার মনেহয় বাঘের খাঁচায় কেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
এবার অরুন টুকুনের মুখে দেওয়া হাতটা আলতো করে ধরে বলে,
--- আসলে কি জানো--আমি কোনদিন কোন মেয়ের সাথে সেভাবে মেশা তো দূরের কথা কোনদিন কোন মেয়ের সাথে কথায় বলিনি।কখনো কথা বললে সেটা শুধুমাত্র প্রয়োজনে।তোমাকে যেদিন প্রথম অফিসে দেখি সেদিনই তোমাকে আমার ভালো লেগে যায়।যা অন্য কারও ক্ষেত্রে কোনদিন হয়নি।হয়তো আমার এই ভালোলাগা বা ভালোবাসার কথাটা কোনদিনও তোমায় জানাতে পারতামনা যদি না শমিতদার মত মানুষ সাহস যোগাতো।
---টুকুন বিস্ময়ে অরুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"জিজু?"
---হ্যাঁ তিনিই তো আমায় ধাক্কাটা মারলেন!একদম সরাসরি জানতে চাইলেন,"আমার ছোটগিন্নীকে তোমার কেমন লাগে?"আমি তো শুনেই অবাক!এইভাবে যে আমি উপরমহলের সমর্থন পাবো তা স্বপ্নেও ভাবিনি।সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলাম 'খুব ভালো'--।গম্ভীর হয়ে আমায় আদেশ দিলেন,"কথাটা তাকে যত তাড়াতাড়ি পারো জানাও।কখন আবার কোথায় ঝুলে পড়বে,সময় থাকতে থাকতেই কাজটা সেরে ফেলো।' সেদিনও যে তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম সেটাও শমিতদার কথামত।আমার উপর আদেশ জারি হয়েছিলো সেদিনই বলতে হবে।কিন্তু আমি তা পারলাম কোথায়?বোকা বোকা কিছু কথা জানতে চেয়ে পালিয়ে এলাম।আজ সকালে অফিসে ফোন করে জোর ধমক--একটা পুরুষ ছেলে হয়ে একটা মেয়েকে ভালোবাসার কথাটা বলতে এতো দেরি করছি কেন?আর শমিতদার ধমক যাতে খেতে না হয় কথাটা তাই বলেই ফেললাম।(এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই অরুন হাসতে লাগলো।)
টুকুনও হাসতে হাসতে বললো,
---ভাগ্যিস জিজু ছিলো।তানাহলে আরও কতদিন সময় নিতে কে জানে?আর আমিও ভিতরে ভিতরে গুমরে মরতাম।(তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে)বাবা, মা দু'জনেই একসাথে চলে যাওয়ার পর মানষিকভাবে ভীষন ভেঙ্গে পড়েছিলাম।কিন্তু দিদি আর জিজু বিশেষ করে জিজু হাসি,ঠাট্টা দিয়ে আমায় সবসময় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।এই মানুষটা আমার জীবনে দেবতার মত।আমি সারাজীবনেও জিজুর ঋণ শোধ করতে পারবোনা।
অরুন পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য টুকুনকে বলে,
---কই আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও...
---এর পরেও উত্তর?
---বারে!আমি যেভাবে বললাম সেইভাবে বলবে তো...
---ওই একইভাবে বলতে হবে?
---সেতো নিশ্চয়।তুমিই তো বললে উত্তরটা বাইরে দেবে।তা গাড়ির মধ্যেই বলবে নাকি গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বলবে?
---না না গাড়ির ভিতরই বলছি।
টুকুন নিজের মুখটা অরুনের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, "ভালোবাসি,ভালোবাসি খুব ভালোবাসি।"
গাড়ি সোজা এসে শমিতের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।টুকুন ঘরে ঢুকে দেখে জিজু বসে টিভি দেখছে। অরুন গিয়ে শমিতের পাশে বসে। টুকুন ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে দিদিকে ডাকতে শুরু করে।"দিদি ও দিদি তুই কোথায়?তাড়াতাড়ি আয়।শুনে যা তোর বর কি সাঙ্ঘাতিক একটা কান্ড করেছে।আমার পিছনে এক বুদ্ধুরামকে কিভাবে লেলিয়ে দিয়েছে।"
রুমা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বললো,
---কি হোল?এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কে তোর পিছনে কাকে লেলিয়ে দিয়েছে?আর বুদ্ধুরামটা কে?
টুকুন হাত দিয়ে অরুনকে দেখিয়ে বললো, "ওই হচ্ছে বুদ্ধুরাম,(এবার শমিতের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে)আর উনি হচ্ছেন নাটের গুরু।"
---ও তাহলে তোর জিজু ঠিকই বলেছিলো ....তোরা দু'জনেই হাবুডুবু খাচ্ছিলি...তা ঠিকই তো করেছে আমার বর।সত্যি বলছি রে বোন আজ আমার বরের জন্য আমার খু --উ --ব গর্ব হচ্ছে।
শমিত লাফ দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পিছন থেকে রুমাকে ধরে বলে,
---এই না হলে আমার বৌ!
রুমা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে শমিতের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
---কি হচ্ছে কি ওদের সামনে?মাথাটা কি একেবারেই গেছে?
---আরে ছাড়ো ছাড়ো ...আমরা তো ঘরের মধ্যে আর ওরা তো গাড়ির মধ্যে যা তাই করে আসলো!
টুকুন ছুটে এগিয়ে গিয়ে জিজুর বুকে পিঠে দুমদুম চড় বসাতে লাগলো।শমিত টুকুনের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
---অরুন,ও কিন্তু শুধুমাত্র আমার শালী-ই নয়।ও আমার বোন, আমার মেয়ে আর সবথেকে বড় কথা কি জানো ভায়া?ও আমার আদরের ছোটগিন্নী।ওর চোখ থেকে কখনো জল পড়লে ভাই আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাবো।
অরুন উঠে এসে শমিত ও রুমাকে প্রণাম করে বলে,
---একদম ভাববেননা শমিতদা।আমি কোনদিন ওকে কষ্ট পেতে দেবোনা।ও কষ্ট পাওয়া মানে তো আমিও কষ্টে থাকবো।সেটা কখনও হবেনা।
এই ঘটনার মাসদু'এক পরে বেশ ঘটা করে শমিত তার আদরের ছোটগিন্নীর দু'হাত তার যুধিষ্ঠিরের হাতে সমর্পণ করে।