Thursday, April 30, 2020

ছোটগিন্নী ( নবম ও শেষ পর্ব )

ছোট গিন্নী ( নবম  ও শেষ পর্ব)
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

      
  
      গাড়ির ভিতর ওরা পাশপাশি।দু'জনেই চুপ।সন্ধ্যা তখনো হয়নি।মাঝে মাঝে দু'জনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে।দু'জনেই তখন হেসে ফেলছে।অনেক্ষণ এভাবে চলার পর নিস্তব্দতা ভেঙ্গে টুকুন-ই বললো, 
---যে মানুষটার অফিসে এতো হম্বিতম্বি সকলে কথা বলতে পর্যন্ত ভয় পায় সেই মানুষটা যে 'ভালোবাসি' এই কথাটা বলতে এতো তোতলাবে সত্যি বলছি আমি কিন্তু এটা বুঝতে পারিনি। 
অরুন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো টুকুন হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে বলে, 
---এটা অফিস নয়,এখন আমি যা বলবো সেটা শুনতে হবে।ওই রুমটার মধ্যে যখন আমি ঢুকি আমার মনেহয় বাঘের খাঁচায় কেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। 
এবার অরুন টুকুনের মুখে দেওয়া হাতটা আলতো করে ধরে বলে, 
--- আসলে কি জানো--আমি কোনদিন কোন মেয়ের সাথে সেভাবে মেশা তো দূরের কথা কোনদিন কোন মেয়ের সাথে কথায় বলিনি।কখনো কথা বললে সেটা শুধুমাত্র প্রয়োজনে।তোমাকে যেদিন প্রথম অফিসে দেখি সেদিনই তোমাকে আমার ভালো লেগে যায়।যা অন্য কারও ক্ষেত্রে কোনদিন হয়নি।হয়তো আমার এই ভালোলাগা বা ভালোবাসার কথাটা কোনদিনও তোমায় জানাতে পারতামনা যদি না শমিতদার মত মানুষ সাহস যোগাতো। 
---টুকুন বিস্ময়ে অরুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"জিজু?"
---হ্যাঁ তিনিই তো আমায় ধাক্কাটা মারলেন!একদম সরাসরি জানতে চাইলেন,"আমার ছোটগিন্নীকে তোমার কেমন লাগে?"আমি তো শুনেই অবাক!এইভাবে যে আমি উপরমহলের সমর্থন পাবো তা  স্বপ্নেও ভাবিনি।সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলাম 'খুব ভালো'--।গম্ভীর হয়ে আমায় আদেশ দিলেন,"কথাটা তাকে যত তাড়াতাড়ি পারো জানাও।কখন আবার কোথায় ঝুলে পড়বে,সময় থাকতে থাকতেই কাজটা সেরে ফেলো।' সেদিনও যে তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম সেটাও শমিতদার কথামত।আমার উপর আদেশ জারি হয়েছিলো সেদিনই বলতে হবে।কিন্তু আমি তা পারলাম কোথায়?বোকা বোকা কিছু কথা জানতে চেয়ে পালিয়ে এলাম।আজ সকালে অফিসে ফোন করে জোর ধমক--একটা পুরুষ ছেলে হয়ে একটা মেয়েকে ভালোবাসার কথাটা বলতে এতো দেরি করছি কেন?আর শমিতদার ধমক যাতে খেতে না হয় কথাটা তাই বলেই ফেললাম।(এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই অরুন হাসতে লাগলো।)
টুকুনও হাসতে হাসতে বললো, 
---ভাগ্যিস জিজু ছিলো।তানাহলে আরও কতদিন সময় নিতে কে জানে?আর আমিও ভিতরে ভিতরে গুমরে মরতাম।(তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে)বাবা, মা দু'জনেই একসাথে চলে যাওয়ার পর মানষিকভাবে ভীষন ভেঙ্গে পড়েছিলাম।কিন্তু দিদি আর জিজু বিশেষ করে জিজু হাসি,ঠাট্টা দিয়ে আমায় সবসময় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।এই মানুষটা আমার জীবনে দেবতার মত।আমি সারাজীবনেও জিজুর ঋণ শোধ করতে পারবোনা।  
     অরুন পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য টুকুনকে বলে, 
---কই আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও...
---এর পরেও উত্তর? 
---বারে!আমি যেভাবে বললাম সেইভাবে বলবে তো...
---ওই একইভাবে বলতে হবে? 
---সেতো নিশ্চয়।তুমিই তো বললে উত্তরটা বাইরে দেবে।তা গাড়ির মধ্যেই বলবে নাকি গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বলবে? 
---না না গাড়ির ভিতরই বলছি। 
টুকুন নিজের মুখটা অরুনের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, "ভালোবাসি,ভালোবাসি খুব ভালোবাসি।"
         গাড়ি সোজা এসে শমিতের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।টুকুন ঘরে ঢুকে দেখে জিজু বসে টিভি দেখছে। অরুন গিয়ে শমিতের পাশে বসে। টুকুন ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে দিদিকে ডাকতে শুরু করে।"দিদি ও দিদি তুই কোথায়?তাড়াতাড়ি আয়।শুনে যা তোর বর কি সাঙ্ঘাতিক একটা কান্ড করেছে।আমার পিছনে এক বুদ্ধুরামকে কিভাবে লেলিয়ে দিয়েছে।"
  রুমা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বললো, 
---কি হোল?এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কে তোর পিছনে কাকে লেলিয়ে দিয়েছে?আর বুদ্ধুরামটা কে? 
টুকুন হাত দিয়ে অরুনকে দেখিয়ে বললো, "ওই হচ্ছে বুদ্ধুরাম,(এবার শমিতের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে)আর উনি হচ্ছেন নাটের গুরু।"
---ও তাহলে তোর জিজু ঠিকই বলেছিলো ....তোরা দু'জনেই হাবুডুবু খাচ্ছিলি...তা ঠিকই তো করেছে আমার বর।সত্যি বলছি রে বোন আজ আমার বরের জন্য আমার খু --উ --ব গর্ব হচ্ছে। 
  শমিত লাফ দিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পিছন থেকে রুমাকে ধরে বলে, 
---এই না হলে আমার বৌ!
রুমা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে শমিতের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, 
---কি হচ্ছে কি ওদের সামনে?মাথাটা কি একেবারেই গেছে? 
---আরে ছাড়ো ছাড়ো ...আমরা তো ঘরের মধ্যে আর ওরা তো গাড়ির মধ্যে যা তাই করে আসলো! 
  টুকুন ছুটে এগিয়ে গিয়ে জিজুর বুকে পিঠে দুমদুম চড় বসাতে লাগলো।শমিত টুকুনের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলে, 
---অরুন,ও কিন্তু শুধুমাত্র আমার শালী-ই নয়।ও আমার বোন, আমার মেয়ে আর সবথেকে বড় কথা কি জানো ভায়া?ও আমার আদরের ছোটগিন্নী।ওর চোখ থেকে কখনো জল পড়লে ভাই আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাবো।
  অরুন উঠে এসে শমিত ও রুমাকে প্রণাম করে বলে, 
---একদম ভাববেননা শমিতদা।আমি কোনদিন ওকে কষ্ট পেতে দেবোনা।ও কষ্ট পাওয়া মানে তো আমিও কষ্টে থাকবো।সেটা কখনও হবেনা। 
   এই ঘটনার মাসদু'এক পরে বেশ ঘটা করে শমিত তার আদরের ছোটগিন্নীর দু'হাত তার যুধিষ্ঠিরের হাতে সমর্পণ করে।

    

Wednesday, April 29, 2020

ছোটগিন্নী ( অষ্টম পর্ব )

ছোট গিন্নী (অষ্টম পর্ব)
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

      পরদিন অফিসে যথারীতি টুকুন ফাইল নিয়ে সই করাতে অরুনের রুমে ঢোকে।অরুন আজ মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,"বসুন।" ফাইল সই করিয়ে টুকুন যখন নিঃশব্দে রোজের মত বেরিয়ে যাচ্ছে অরুন মৃদু স্বরে বলে ওঠে,"একটা কথা ছিলো।" টুকুন ঘুরে দাঁড়িয়ে পরে।অরুন আবার বলে, 
---অফিস ছুটির পর বাইরে আমাকে কিছুটা সময় দেবেন?আমার আপনাকে কিছু বলার আছে। 
---আপনি এখানেই বলুন।সবাই যা আপনাকে ভয় পায় এখানে কেউই আসবেনা। 
---না,মানে এখানে বলা যাবেনা। 
   টুকুনের বুঝতে অসুবিধা হয়না তার বস তাকে কি বলবে।কিন্তু সে ধরা দেয়না।খুব গম্ভীরভাবে বলে, 
---সরি স্যার,আজ আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। 
   কথাটা বলেই সে অরুনের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।বাড়িতে ফিরে সে সর্বগল্পের সঙ্গী জিজুকেও কিছু বলেনা।শমিত অনেকবার ইয়ার্কির ছলে জানতে চেয়েছে অরুন তাকে কিছু বলেছে কিনা। কিন্তু টুকুন প্রতিবারই কথাটা পাশ কাটিয়ে গেছে।শমিত নানানভাবে তার আদরিনী শালীর কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করে বিফল হয়েছে। 
   এদিকে পরেরদিন টুকুন আবার যখন অরুনের রুমে যায় অরুন সেদিনও তাকে একই কথা বলে।টুকুন আজ একটু জোরেই বলে, 
---রোজই তো বলছেন একটা কথা বলবেন।কিন্তু বলছেন কোথায়?বলুন আজ আমি আপনার কথা শুনেই যাবো। বলুন ----
---বললাম তো এখানে বলা যাবেনা। 
---এখানে বলা না গেলে আপনাকে কথাটা  আর আমাকে বলতে হবেনা।অফিসের বাইরে গিয়ে অফিসের বসকে সময় দেওয়ার সময় আমার হবেনা।তাছাড়া লোকে জানলে কি বলবে? 
---কিন্তু এটা তো অফিস! 
---তাতে কি?অফিসে কাজের কথা ছাড়া অন্য কথা কেউ বলেনা? 
---না ঠিক তা নয়।তবে এই কথাটা ---(অরুন আমতা আমতা করতে লাগে)
---কি এমন কথা বলবেন আপনি?এখানেই বলুন,কই বলুন ---আরে বাবা বলেই ফেলুননা---
---হ্যাঁ -এখানেই বলছি।অরুন গলাটা চড়িয়েই বলে, আমি মানে আ-আমি---
অরুন থেমে যায়--
টুকুন কোনরকমে নিজের হাসি চেপে বলে, 
---আমি --আমি --এটা আবার কি কথা?কথাটা শেষ করুন! 
অরুন তখন পড়েছে মহা ফ্যাসাদে।কথাটা যেন তার গলায় আটকে আছে।না পারছে গিলতে না পারছে উগরাতে। এ  কি ধরনের  মেয়ে  রে  বাবা ? বসকেই চাপ  দিচ্ছে  বললে  এখানে  বলুন  আর  না  হলে  বলতে  হবেনা ? কিন্তু  আজ  তো  কথাটা  বলতেই  হবে  নাহলে  তো  আবার ---| মাথা  কাজ  করছেনা , পাদুটো  কেমন  কাঁপছে  মনেহচ্ছে | এসি তো  চলছে  তবে  এতো  ঘামছি  কেন ? দূর বাবা  এ  কোন  বিপদে  পড়লাম  ভালোবাসতে  গিয়ে ? এখন কি  করি ?
--- কই স্যার  কিছু  বলবেন  না  আমি  আসবো ----?
--- হ্যাঁ বলবো  তো --- কিন্তু  কি  করে  বলবো  তাই  ভাবছি ---
--- তাহলে  আপনি  ভাবুন  স্যার  ভেবে  ভেবে  ঠিক  করতে  পারলে  আমায়  ডেকে  নেবেন | আমার  হাতে  অনেক  কাজ  রয়েছে  স্যার | কাজগুলো  ঠিক  সময়ে  শেষ  নাহলে  আবার  আপনার  বকা  খেতে  হবে | কিন্তু  একটা  কথা  কিছুতেই  মাথায়  আসছেনা  আপনি  কি  এমন  কথা  বলবেন  যে  আপনার  মত  একজন  রাগী, বদমেজাজি  মানুষ  কথাটা  বলতে  গিয়ে  এই  এসি রুমে  থেকেও  এভাবে  ঘামছেন ? কান , মুখ  সব  লাল  হয়ে  যাচ্ছে  ?
--- আমার  রাগ  আর  মেজাজটাই  শুধু  দেখলেন ? আর  তার  কারণটা  বললাম  সেটা  বুঝতে  পারলেননা  ?
 --- তাহলে  স্যার  আমি  আসি  পরে  অন্য একদিন  নাহয়  আপনার  কথা  শুনবো |
--- কিন্তু  আজই আমায়  বলতে  হবে ---
--- তা  বলুন  , আমি  আজ  শুনেই  যাবো |
  অরুন  কিছুটা সময় ঢোক গিলে বেশ কয়েকবার বোকার মত এদিকওদিক তাকিয়ে গড় গড় করে টুকুনের মুখের দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে ফেললো,"আমি আপনাকে ভালোবাসি"-বলেই পিছন ঘুরে দাঁড়ালো। 
---এই কথাটা বলার জন্য বাইরে কোথাও যেতে চেয়েছিলেন? 
  অরুন পিছন দিক থেকেই মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। 
এবার টুকুন তাকে বললো, 
---তা চলুন,কোথায় যাবেন বলছিলেন---  অরুন টুকুনের দিকে ফিরে তাকিয়ে কিছুটা অবাক চোখে উত্তর দেয়, 
---বলা হয়ে গেছে তো! 
---উত্তরটা জানবেন না ? 
  অরুন এবার টুকুনের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।টুকুন দুষ্টুমীভরা হাসি নিয়ে অরুনের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, 
--কই চলুন,অবশ্য আপনার যদি উত্তরটা জানতে ইচ্ছা না করে তাহলে যাবেন না।আর যদি উত্তরটা জানতে চান তাহলে আপনাকে যেতে হবে।আমি বেরোচ্ছি আপনি গেলে আসুন---কথাগুলি বলে টুকুন বেরিয়ে পরে। 

  চলবে  :-
  
      

ছোটগিন্নী ( সপ্তম পর্ব )

ছোট গিন্নী (সপ্তম পর্ব)
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

    শমিতের গলার আওয়াজে রুমা এসে ঢোকে।অরুনকে দেখে বলে, 
---ওমা তোমরা একসাথে এলে বুঝি? 
---আরে না -আমি তো এসে দেখি ছোটগিন্নী কিছুতেই বসকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছেনা।আর বস ও জোর করে যাচ্ছে সে ভিতরে ঢুকবেই। এসে দেখি দু'জনে ধস্তাধস্তি, হাতাহাতি ......আমি তো শেষে ....শমিতের কথা শেষে হবার আগেই টুকুন চেঁচিয়ে ওঠে, 
---জিজু ভালো হচ্ছেনা কিন্তু!উনি কাজের মানুষ।কাজের কথা ছাড়া বেশি কথা একদম পছন্দ করেননা।কি দরকারে উনি তোমার কাছে এসেছেন সেটা জেনে নাও। 
  অরুন বুঝতে বুঝতে পারে তাকে 'ঘা' দেবার জন্যই সোমা কথাগুলো বলেছেন। 
শমিত অরুনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, 
---আমার কাছে?না,না ছোটগিন্নী,তুমি ভুল করছো,তুমি দু'দিন অফিস যাওনি-তোমার বস ভেবেছেন,তোমার শরীর খারাপ।উনি তোমায় দেখতে এসেছেন ছোটগিন্নী,আমায় নয়।আর তাছাড়া আমার কাছে ওর কি কাজ থাকবে?কাজ তো সব তোমার কাছে। 
  টুকুন কৃতিম রাগ দেখিয়ে বললো, 
---হ্যাঁ তা যা বলেছো জিজু,ওনার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই,ওনার অধস্তন কর্মচারী কেন অফিস যাচ্ছেনা তাই বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিয়ে বেড়ান।খুব ভালো মানুষ আর কি! 
---ঠিক কথাটা একদম ঠিক বলেছো ছোটগিন্নী,তা ভায়া তুমি সত্যিই আমার কাছে এসেছো?না -না -না আমি জোর দিয়ে একথা বলতে পারি......
রুমা চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে শমিতের কথাটা তার কানে যাওয়ায় সে শমিতের কাছে জানতে চায়, 
---কি জোর দিয়ে বলতে পারো গো? 
শমিত প্রসঙ্গটা পাল্টে দিয়ে বলে, 
---চা এসে গেছে।এবার সকলে গরমাগরম চা খাও। 
 শমিতের এই  খোলামেলা  কথাবার্তায়  অরুন  ভীষণ  অপ্রস্তুত  হয়ে  পরে | কিন্তু  কিচ্ছু করার  নেই --- নিজের  বোকামিতে  এখন  নিজেই  লজ্জা  পাচ্ছে | 
শমিত চা শেষ করে অরুনকে বলে, 
---বসো ভায়া,আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি।তুমিও টিফিনটা নিয়ে এসো।(রুমার দিকে তাকিয়ে শমিত ইশারায় রুমাকেও চলে যেতে বলে।)
ওরা চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে টুকুনও উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।
---একটা কথা ছিলো। 
টুকুন যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়লো। 
অরুন বলতে শুরু করলো, 
---আমি ঠিক গুছিয়ে কারও সাথে কথা বলতে পারিনা।অফিসে আমি ঠিক আছি।কিন্তু যে কথাগুলি বলবো বলে এসেছি -কিভাবে সেটা শুরু করবো সেটাই ভাবছি। 
টুকুন এবার বসে পড়লো।"যেভাবে খুশি বলুন,আমি নাহয় আপনার এলেমেলো কথাগুলি গুছিয়ে নেবো।"
---আসলে আপনি ক'দিন অফিস যাননি তো-আমার না কেন জানিনা পুরো অফিসটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো।কত কর্মচারী রোজ অফিসে আসেনা,কিন্তু কোনদিনও এটা আমার মনে হয়নি।এই প্রথম কারও ক্ষেত্রে আমার এইরূপ মনে হচ্ছে।আপনি তো পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বেশি আমার রুমে থাকেনও না।তবে কেন এটা মনে হচ্ছে আপনি জানেন?
  কথাগুলো  শেষ  করে  নিজের  মাথায়  নিজেরই  বারী মারতে  ইচ্ছা  করছে  | কি  হচ্ছে  তার  আজ ?যা  বলতে  চাইছেনা তাই  বলে  ফেলছে  | আর  বলার  পরে  বুঝতে  পারছে  প্রত্যেকটা  কথা  কেমন  বোকা  বোকা -- |
টুকুন দুষ্টুমিভরা চাউনিতে বললো, 
"আচ্ছা আপনার কেন এটা মনে হচ্ছিলো সেটা আমি কি করে জানবো?আপনার মনের খবর জানা কি আমার পক্ষে সম্ভব?"
---হ্যাঁ সেটা তো একদম ঠিক কথা।আসলে আপনার কাছে জানতে চাইলাম আপনি না থাকাতেই তো এটা মনে হচ্ছিলো তাই।কিছু মনে করবেননা কথাটা বললাম বলে।
---না না এতে মনে করার কি আছে?(আর মনে মনে বললো বুদ্ধু একটা!ভালোবাসে এই কথাটাও বুঝতে পারছেনা।)তা এই কথাটা বলার জন্যই এসেছিলেন? 
---না শুধু এটা নয়।অনেক কথা বলবো বলেই এসেছিলাম।কিন্তু সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।(কোনরকম দ্বিধা না করে অরুন টুকুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে) আপনি কাল অফিস যাবেন তো? 
"হ্যাঁ হ্যাঁ যাবে।ওর শরীর মন সব ঠিক হয়ে গেছে", কথাগুলো বলতে বলতে শমিত এসে সোফায় বসে।টুকুন উঠে দাঁড়ায় ভিতরে যাবার জন্য।শমিত হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়।"পালাচ্ছ কোথায় ছোটগিন্নী? বসো,সকলে মিলে একটু আড্ডা মারি।ওই যে তোমার দিদি টিফিন নিয়ে আসছে,আজ খুব খিদে পেয়েছে।এবার খেতে খেতেই সকলে মিলে গল্প করি।ভায়া,খেয়েদেয়েই যাবে কিন্তু।"
---না না শমিতদা আজ নয়।আবার পরে একদিন।আজ একটু তাড়া আছে। 
 
  শমিতের অনেক জোরাজুরি সত্ত্বেও অরুন রাজি হয়না সেদিন।বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে অরুন বেরিয়ে পরে।আর সঙ্গে সঙ্গেই শমিত টুকুনের পিছনে অরুনকে নিয়ে লেগে পরে।
   আসলে অরুনের সেদিন কোন কাজই ছিলোনা।কিন্তু টুকুনের সামনে অরুনের কেমন জানি একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো।অনেক কথা তাকে বলতে ইচ্ছা করছিলো,একটু নিরিবিলি পাশপাশি বসে গল্প করতে মন চাইছিলো।কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে কোনটাই সম্ভব ছিলোনা।তাই কাজের বাহানায় সে বেরিয়ে পরে।
  ভালোবাসা  মানুষের  জীবনে  যখন  আসে  অনেক  সময়  মানুষ  নিজেকে  কন্ট্রোল  করতে  পারেনা | হয়তো  সে  যা  করতে  চায়নি  তা  করে  ফেলে  বা  হয়তো  যা  বলতে  চায়নি  তা  বলে  ফেলে | আবেগে  নিজের  অজান্তেই  ঘটে  যায়  কত  ঘটনা | পরে  যখন  সে  স্থির  মস্তৃষ্কে  তার  করা  বা  বলা  কথাগুলো  মনেমনে  চিন্তা  করে  তখন  নিজেকে  নিজে  পৃথিবীর  সবথেকে  বুদ্ধুরাম  বলেই  গালি  দেয় | অরুনের  পরিস্থিতিও  ঠিক  এইরকমই  |

 চলবে  :- 

    

Tuesday, April 28, 2020

ছোটগিন্নী ( ষষ্ঠ পর্ব )

ছোট গিন্নী (ষষ্ঠ পর্ব)
         নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

  টুকুন টেবিল  থেকে  ফাইলগুলো  তুলে  নিয়ে  বেরিয়ে  গেলো  | অরুন একটা  দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে মনেমনে বললো, ' নিশ্চয়ই আমায় খুব ছোটলোক ভাবছেন।কিন্তু আমি নিরুপায়।এটা আমার কাজের জায়গা।এখানে আমি কোন কর্মচারির আত্মীয় নই,পরিচিত নই।এখানে শুধু কাজ আর কাজ।' 
  পরদিনও ঠিক  সেই  একই  রুটিং | টুকুন  অরুনের  রুমে  নক  করলো | সেদিকে  না  তাকিয়েই  অরুন  বললো ' ইয়েস' -- টুকুন  ফাইলগুলো  সামনে  রাখলো | টুকুনের  আজ  তার  বসকে  দেখে  মনে  হচ্ছে  লোকটা  একটু  উদ্ভ্রান্ত | কিন্তু  জিজ্ঞাসা  করার  উপায়  নেই  উনি  তো  আবার  রাগী বস | টুকুন  যে  ফাইলগুলো  তার  সামনে  রেখেছে  বোধকরি  মিষ্টার অরুন  মুখার্জী  সেগুলো  দেখতেই  পায়নি  এমনভাবেই  সে  তার  নিজের  কাজ  নিয়ে  ব্যস্ত  আছে  | কিছুক্ষণ অপেক্ষার  পর  টুকুন  বলে ,
--- স্যার  ফাইলগুলো  --?
  হঠাৎ  করেই  অরুন  টুকুনের  মুখের  দিকে  একঝলক   তাকিয়ে  ফাইলগুলো  নিজের  কাছে  টেনে  নিলো | কিন্তু  অরুন  মুখার্জীর  ওই  একঝলক  দৃষ্টিতে  এমনকিছু  ছিল  যা  টুকুন   বুকের  ভিতর  এক  বৈদ্যুতিক  শক অনুভব  করলো  | বসের  সই  শেষ  হলে  কোনরকমে  সে  ওখান  থেকে  দ্রুত  বেরিয়ে  আসলো | যা  কোনদিনও  তার  জীবনে  ঘটেনি  কিন্তু  আজ  সামান্য  দৃষ্টি  বিনিময়ে  ঘটে  যাওয়ায়  সেও  কিছুটা  অন্যমনস্ক  হয়ে  পরে | ভাবতে  থাকে  তবে  কি  সে  তার  বসকে  ভালোবেসে ফেলেছে ?তা  কি  করে  সম্ভব? এইরকম  একজন  মানুষ  যার  সাথে  তার  কোন  মিলই নেই --- তার  আচারআচরণ , অফিস  কলিগদের  সাথে  তার  ব্যবহার  কোন  কিছুই  তো  টুকুনের  পছন্দ  নয় --- তবে  কেন  বস তার  দিকে  আজ  তাকালে  তার  বুকের  ভিতরটা  এমন  ধক করে  উঠলো | কি  ছিল  তার  ওই  দৃষ্টিতে? একদম  যে  এতদিনে  তার  সাথে কোন  দৃষ্টি  বিনিময়  হয়নি  তাতো  একদমই  নয় | কিন্তু  আজ  ওই  দৃষ্টিতে  না  বলেই  যেন  তিনি  অনেককিছু  বলে  দিয়েছেন | তবুও  নিজেকে  সামলে  নিতে  হবে | নিজের  আচারআচরণ বা  ব্যবহারে  কোন  অবস্থাতেই  বসের  সামনে  নিজের  দুর্বলতা  প্রকাশ  করা  যাবেনা | সত্যিই  যদি  তাকে  নিয়ে  বসের  এতটুকু  ভাবনা  থাকে  তা  তার  মুখ  থেকেই  বের  করতে  হবে | 
   পরদিন টুকুন ইচ্ছা করেই অফিস গেলোনা। তাকে  নিয়ে  তার  বস  সত্যিই  কিছু  ভাবছে  কিনা  সেটা  একমাত্র  অফিস  না  গেলেই  প্রমান  পাওয়া  যাবে  | হয়  সে  ফোন  করবে  নাহয়  নিজেই  এসে  উপস্থিত  হবে | 
 সকালে  ছোটগিন্নী অফিসে  বেরোনোর  জন্য  ছুটাছুটি  করছেনা দেখে  শমিত বললো ,
--- বলো  ছোটগিন্নী শরীর  খারাপ  নাকি  মন  খারাপ  কারও জন্য  ?
--- জিজু  ভালো  হবেনা  বলছি | শরীর  মন  দুইই ঠিক  আছে | মুখে  একটা  আগুল দিয়ে  বেশ  ভাবুকের  মত  বললো ,
--- আসলে  আমি  ভেবে দেখলাম  আমি  রোজ  রোজ  অফিস  যাবো  আর  কোম্পানি  আমাকে  মাত্র  একদিন  মাইনে দেবে  --- তাই  মাঝে  মাঝে  একটু  আধটু  ডুব  দেবো ভাবছি |
 শমিত আর  টুকুন  দুজনেই  হাসতে লাগলো | একটু  পরে শমিত বললো, 
--- দেখো  ছোটগিন্নী অফিসে  মাঝে  মাঝে  ডুব  দাও  ক্ষতি  নেই  কিন্তু  ডুবে  ডুবে  জল  খেওনা  --- | এই  হৃদয়ে  ব্যথা  দিওনা |( নিজের  বুকে  একটা  হাত  দিয়ে  কাচুমাচু  হয়ে  বলেই  হেসে  দিলো |)
 টুকুন  বেশ  কয়েকটা  কিল  , ঘুষি  তার  জিজুর  পিঠে  বসিয়ে  দিলো | এদিকে  ওদের  চিৎকার  চেঁচামেচিতে  রুমা  এসে  উপস্থিত  হল |
--- কিগো তোমরা  আজ  কেউ  অফিস  যাবেনা ?
--- না  আজ  আমরা  কেউই  অফিস  যাবোনা  |
--- সে  কি ? তুমিও  অফিস  যাবেনা  জিজু  ?
 ---ছোটগিন্নী,আজ আমিও ডুব দিই। চলো তিনজনে মিলে সিনেমা দেখে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরি"।টুকুনের ইচ্ছা না থাকলেও জামাইবাবুকে সে কোনদিন মুখের উপর না বলেনি।
   তাই তার কথামত রাজি হয়ে গেলো।অনেক রাতে তিনজনে বাড়ি ফিরে সামান্য গল্প-গুজব করে শুয়ে পড়ে।তারপরেও পরপর দু'দিন টুকুন শরীর খারাপের অজুহাতে অফিস যায়না।দিদি,জামাইবাবুকে বলে,'শরীরটা ভালো লাগছেনা।'কিন্তু মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা বোধ করতে থাকে।কিন্তু কেন তাও বুঝতে পারছেনা।ওই রকম তো সে রোজই মিঃমুখার্জীর রুমে ঢোকে।ফাইলপত্র সই করায় তারপর নীরবেই বেরিয়ে যায়।কোনদিনও মনে হয়না মিঃ মুখার্জী তাকে কিছু  বলতে  চায়  যা  সে  বলতে  পারছেনা  অথচ  তার  দৃষ্টিতে  সে  কথা  প্রকাশ  পাচ্ছে   |
   অরুনও অফিসে পরপর তিনদিন টুকুনকে দেখতে না পেয়ে ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলো। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে কেন তার এরকম হচ্ছে।কিন্তু উত্তরটা অধরায় থেকে যায়।মন কিছুতেই মানছেনা।একবার সোমা চক্রবর্তীর খবরটা তাকে জানতেই হবে।প্রথমদিন অরুনের মনে হয়েছিলো হয়তো কোন কাজে আটকে গিয়ে সোমা অফিসে আসতে পারেননি।কিন্তু তৃতীয়দিনও অফিসে না আসায় অরুন সত্যিই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে।সেদিন অফিস ছুটির পর সোমাদের বাড়িতে যাবে কি যাবেনা ভাবতে ভাবতেই বিশাল এক মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে তাদের বাড়ি হাজির হয়ে যায়।শমিত তখনও বাড়িতে ফেরেনি।রুমা টিফিন করছিলো শমিত ফিরলে সকলে একসাথেই তারা টিফিন করে।এরই মধ্যে বেলের আওয়াজ পেয়ে জিজু ফিরেছে মনে করে টুকুনই দরজা খোলে।কিন্তু অরুনকে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।অরুনও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাতপাঁচ না ভেবেই বোকার মত প্রশ্ন করে ফেলে, 
---দু'তিনদিন অফিস যাননি কেন? 
  সঙ্গে সঙ্গে টুকুন খুব মৃদু স্বরে দিদি যাতে শুনতে না পায় অরুনের দিকে চোখ তুলে গম্ভীরভাবে বলে, 
---আপনি বুঝি আপনার অফিসের কর্মচারীরা অফিস না গেলে বাড়িবাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে বেড়ান কে,কেনো, কিসের জন্য অফিস যায়নি।"
    অরুনও খুব লজ্জা পেয়ে যায় এরকম একটা বোকার মত প্রশ্ন সে করলো কি করে? আমতা  আমতা  করতে  থাকে  |এরই মধ্যে শমিতের প্রবেশ।
---আরে যুধিষ্ঠির যে? ছোটগিন্নী,তুমি ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেন?চলো ভায়া ভিতরে চলো। 
 শমিত মুচকি  মুচকি  হাসতে থাকে  |

 চলবে :-

    

Sunday, April 26, 2020

ছোটগিন্নী ( পঞ্চম পর্ব )

ছোট গিন্নী (৫ম পর্ব)
              নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

    সেদিন রাতে রুমাদের ভালোবাসা মিশ্রিত   আতিথেয়তায় মুগ্ধ অরুন বলে গেলো,"বৌদি আমি কিন্তু আবার আসবো। এতদিন  আমার  কোন  আত্মীয়স্বজন  ছিলোনা  এখন  আমি  শমিতদাকে পেয়ে  গেছি  মাঝে  মধ্যেই  বিরক্ত  করতে  চলে  আসবো |"
--- হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই  নিশ্চয়ই  আসবে | আমাদেরও  তো  সেরকম  কেউ  নেই  , তুমি  আসলে  আমাদের  সকলের  খুব  ভালো  লাগবে |
 রুমার  কথা  শেষ  হলেই  শমিত তার  কানের  কাছে  মুখটা  নিয়ে  বলে  উঠলো ,
--- আসার  উদ্দেশ্য  কি  শুধুই  আমাদের  সাথে  গল্প  করা ? নাকি  অন্য উদ্দেশ্যও  আছে  ---?
--- ওর  কানে  কানে  আবার  কি  বলছো ? 
 রুমা  শমিতের দিকে  তাকিয়ে  বলে  ওঠে  |
  আর  অরুনের  তখন  'ছেড়ে  দে  মা  কেঁদে  বাঁচি' পরিস্থিতি | সে  তাড়াতাড়ি  দরজার  দিকে  পা  বাড়ালো  ' আসছি ' বলেই  |
 শমিত মনেমনে  বললো , ' একটু  সবুর  করো  সব  ব্যবস্থায়  আমি  করবো |'

   অরুনের বড় ভাই বরুন ছিলো শমিতের বন্ধু।অরুনের কাছ থেকে শমিত  জানতে পারে অফিসের কাজে বরুন আমেরিকায় গেছিলো। সেখানে  সে  পনেরদিন  মত  ছিল  | অফিসের  সমস্ত  কাজ  গুছিয়েও  নিয়েছিল  | কিন্তু  যেদিন  সে  আসবে  সেদিনই  এয়ারপোর্ট  আসতে গিয়ে  হঠাৎই  তার  একসিডেন্ট  হয়  | স্পট  ডেথ  | সেদিন  সারারাতের  অপেক্ষার  পর  অফিস  মারফত পরদিন   সন্ধ্যা  নাগাদ  সব  খবর  জানা  যায়  | 
   এই শোক তাদের মা,বাবা সামলাতে পারেননা।তারা দুজনেই ছ'মাসের ব্যবধানে অরুনকে রেখে না ফেরার দেশে চলে যান।এখন অরুন সম্পূর্ণ একা।একজন বয়স্ক মহিলা দু'বেলা এসে রান্না ও ঘরের কাজ করে যান।অফিস আর বাড়ি।চিরদিনের মেধাবী ছাত্র অরুন চাকরী পাওয়ার পর বছর তিনেকের মধ্যেই অফিসের উচ্চপদে চলে যায়। 
 অল্প বয়সে  এইরূপ  একটা  পদে  চাকরি  করা  চাট্টিখানি  কথা  নয়  যেখানে  রয়েছে  তার  অনেক  সিনিয়র | তাই  অফিস  চত্বরের  মধ্যে  বাধ্য  হয়ে  তাকে  রসকষহীন  একটা  মুখোশ  পরে  থাকতে  হয় | কিন্তু  মনটা  তার  শিশুর  মত  সরল | কোনদিন  কোন  মেয়ের  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  দেখেছে  বলে  তার  মনেপড়ে  না  | কিন্তু  এই  মিস  সোমা  এসেই -----|
        এদিকে রাতে রুমা শমিতকে বলে,"এই দেখো না গো -ছেলেটাকে খুব ভালো মনে হল,টুকুনের সাথে যদি ওর ---"
কথাটাকে শমিত শেষ করতে দেয়না-
---দেখো,ছেলেবেলায় ওর সত্যকথার জন্য বাবার হাতে প্রাণটা চলে যাচ্ছিলো।তখন ওর নাম দিয়েছিলাম যুধিষ্ঠির।এখন তো আমাকে আগে জানতে হবে ও যুধিষ্ঠির থেকে দুঃশাসন হয়ে গেছে কিনা।তাছাড়া আমার মনে হোল আমার ছোটগিন্নী একটু হলেও অরুনের বুকে দোলা দিয়েছে।আগে দু'জনেই মনে মনে একটু দোল খাক।তুমি না সত্যি খুব বেরসিক!ভুলে গেলে (শমিত রুমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে)আমরা কলেজে পড়ার সময় দু'জনে কেমন দুলছিলাম।বিয়ে করলাম ব্যস দোলা বন্ধ হয়ে গেলো।ওদের একটু রোমান্স করতে দাও।তবে সবার আগে আমাকে জানতে হবে ভায়া আমার সেই আগের মত যুধিষ্ঠিরই  আছে নাকি দুঃশাসন হয়ে গেছে। 
---দূর!তুমি কোনদিনই সিরিয়াস হবেনা।আমার ঘুম পেয়েছে।আমি ঘুমাচ্ছি।তুমি মহাভারত লেখো। 
  কথাগুলো বলে রুমা পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। 
  পরেরদিন নিত্যদিনের মত শালী ভগ্নিপতি এক সাথেই অফিস বেরোলো।শমিত ঘর থেকে বেরোনোর আগে টুকুনকে কাছে ডেকে মাথায় একটু থুথু দিয়ে বললো,"যেভাবে বস পিছনে লেগেছে এবার আমার ছোটগিন্নী আমায় ছেড়ে চলে যাবে।"
 --- ওই  বদমেজাজি, রাগী বসকে  বিয়ে  করার  থেকে  সারাজীবন  আইবুড়ো  থাকা  অনেক  ভালো | এতদিন  হয়ে  গেলো  অফিসে  চাকরি  করছি  কোনদিন  একটু  হাসি  দেখলামনা  উনার  মুখে --- | 
---- খুব  অন্যায়  কথা | আমার  সুন্দরী  ছোটগিন্নীকে  দেখেও  একটু  হাসেনা --- যাক  গে যাক  --- আমরা  বসের  দিকে  এগোবোই  না | অন্য ছেলে  দেখে  বিয়ে  দিয়ে  শ্বশুরবাড়ি  পাঠিয়ে  দেবো |
---আমি যে বাড়িতেই  যাইনা কেন তোমাদের দু'জনকে সঙ্গে নিয়েই যাবো।তানাহলে তাকেই বলবো আমাকে বিয়ে করতে হলে এখানেই এসে থাকতে হবে।(জিজুর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে টুকুন কথাগুলো বলে।)
শমিত কথাটা শুনে চশমাটা খুলে জলভর্তি চোখটা মুছে নিয়ে রুমার উদ্দেশ্যে হাক দেয়,"কই গো দরজাটা দাও আমরা বেরোচ্ছি। 
    দুপুরের দিকে কিছু দরকারী ফাইলপত্র সই করাতে টুকুন বস অরুনের রুমে ঢুকলো।অরুন রোজের মত হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে।নিজের হাতের কাজটা সেরে নিয়ে টুকুনের দিকে হাত বাড়ালো ফাইলটা নিতে।ঠিক সেই মুহূর্তে টুকুন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো।কারন সে ভাবছিলো কি অভদ্র লোকটা!কাল গিয়ে খেয়েদেয়ে আনন্দ করে আসলো আর আজ এমন ভাব দেখাচ্ছে যে আমি শুধুমাত্র তার অফিসের সামান্য মাইনের এক অধস্তন  কর্মচারী মাত্র। 
---কই ফাইলটা দিন। মনেহচ্ছে  কিছু  ভাবছেন ?
 --- নো  স্যার  , বলেই  ফাইলটা  সামনে  এগিয়ে  দেয় | 
 টুকুন  খেয়াল  করে  এক  একটা  কাগজ  উল্টে  সই  করছেন  ঠিকই  কিন্তু  অন্যদিনের  তুলনায়  যেন  সময়  একটু  বেশি  লাগছে | মনেহচ্ছে  লোকটা  কিছু  বলতে  চাইছে  অথচ  বলতে  পারছেনা | কি  ধরণের মানুষ  মাইরি --- কাল  নিজের  থেকে  ডেকে  গাড়িতে  তুলে  নিয়ে  বাড়ি  পর্যন্ত  পৌঁছে  দিলো | ভালোমন্দ  পেট  ভরে খেয়ে  আসলো  আর  আজ  ---
 অরুন  ফাইলগুলো  একসাথে  করে  টুকুনের  সামনে  এগিয়ে  দিয়ে  আবার  মুখ  নিচু  করে  নিজের  কাজে  মন  দেয় |

  চলবে  :-

পাগলের ভালোবাসা

   রোজ  কলেজে  যাওয়ার  পথে  রাস্তায়  বসে  ভিক্ষা  করা  পাগলটাকে  কিছুনা  কিছু  খাবার  রোজি  দিয়েই  যায় | আজ  দুবছর  ধরে  এটা চলছে | রোজির  মা  তাকে  টিফিন  দেওয়ার  সময়  আর  একটা  পাত্রে  ওই  পাগলটার  জন্যও  খাবার  দিয়ে  দেন  রোজির  কথামত  | তার  অবশ্য  কারণও আছে | একদিন  পাগলটাকে  কিছু  উঠতি  বয়সের  ছেলেরা  মারাত্মকভাবে  বিরক্ত  করছিলো | রোজি  তাদের  বাধা  দেয় | বয়সে  রোজির  থেকে  তারা  ছোটই হবে  একটু | পাগলটা  সেদিন  খুব  কাঁদছিলো | তখন  রোজি  তার  ব্যাগ  থেকে  একটা  কমলালেবু  বের  করে  তাকে  দেয় | লেবুটা  হাতে  পেয়ে  সে  দুঃখ  ভুলে  হাসতে থাকে | রোজি  তার  কাছে  জানতে  চায় ,
--- তুমি  কোথায়  থাকো ?
একটা  আগুল তুলে  দূরে  একটা  ঝুপড়ি  দেখিয়ে  দেয় | সে  তখন  মহানন্দে  কমলালেবুটা খাচ্ছে | এরই  মধ্যে  সেখানে  আর  একটি  দশ  বারো  বছরের  বাচ্চা আসে  যার  বাস  ওই  ফুটপাথেই | পাগলটা তখন  তার  লেবু  থেকে  তাকে  কয়েকটি  কোয়া  দেয় খেতে | তা  দেখে  রোজি  মুগ্ধ  হয়ে  যায় আর  মনেমনে  ভাবে  ' নিজের  পেটে খিদে  অথচ  তারই  সমগোত্রীয়  একটি  বাচ্চা  ছেলে  এসে  দাঁড়াতেই  সামান্য  খাবার  থেকেই  সে  তাকে  খেতে  দিলো | আর  আমরা ? আমাদের  প্রচুর  থাকা  সর্ত্বেও  আমাদের  মানসিকতা  কত  নিচু  | আমরা  অন্যদের  ভাগ   দিয়ে  খেতে  জানিনা | লোকটা   পাগল ভিখারি  হলেও  মনের  দিক  থেকে  সে  সম্পদশালী | সেই  শুরু | আজ  দুবছর  ধরে  রোজ  নিয়ম  করে  রোজি  ওই  পাগলটার  জন্য  খাবার  নিয়ে  আসে | আর  সেও  অপেক্ষা  করে  থাকে  রোজ  রোজি  কখন  আসবে | বাড়ি  ফেরার  সময়  যতক্ষণ না  রোজি  বাসে ওঠে  তৎক্ষণ সে  তার  কাছেই  দাঁড়িয়ে  থাকে | অনেকদিন  রোজি  খেয়াল  করে  দেখেছে  বাসটা যতক্ষণ দেখা  যায়  সে  একদৃষ্টিতে  বাসের  দিকে  তাকিয়ে  থাকে | 

  দুদিন  ধরে  মুষলধারে  বৃষ্টি  | পাগল  তার  ঝুপড়ির  ভিতরই রয়েছে  | হঠাৎ  একটা  পুলিশের  জীপ এসে  থামলো  | প্লাস্টিক  ফাঁক করে  দেখে  একটু  ধরে  আসা  বৃষ্টির  মাঝেই  প্রচুর  পুলিশ  আর  মানুষের  জটলা | পাগল  হলেও  সে  মানুষ  | হঠাৎ  তার  বুকের  ভিতরটা  ছ্যাৎ করে  উঠলো | কোনদিন  তো  এরকম  হয়নি  --| বৃষ্টির  কারণে দুদিন  ধরে  সে  বেরোতেই  পারেনি  | দিদিমনির  খাবারও তার  জোঠেনি | বাইরে  বেরোতে  গিয়েও  মাথা  তুলতে  পারলোনা  | শুয়েই  থাকলো  | দুর্বলতায়  কখন  যে  ঘুমিয়ে  পড়েছে  সে  নিজেও  বুঝতে  পারেনি  | ঘুম  ভাঙ্গলো তার  সেই  কমলা  ভাগ  করে  দেওয়া  ছেলেটার  স্পর্শে |
--- আমায়  ডাকলি  কেন  ?
একটা  কাগজের  ঠোঙ্গায় কয়েকটি  মুড়ি  তার  সামনে  এগিয়ে  দিয়ে  বললো ,
--- তুমি  এই  মুড়িগুলো  খাও  আর  শোনো  যে  দিদিমনি  তোমায়  রোজ  খাবার  দিয়ে  যেত তাকে  কাল  কারা যেন  মেরে  ফেলেছে  ---|
দুর্বল  শরীরে  হঠাৎ  করে  যেন  বল  ফিরে  পেলো | লাফ  দিয়ে  উঠে  বসলো |
--- কি  কি  বললি ?
--- হ্যাঁ গো  -- কাল  বৃষ্টির  মধ্যে  কারা যেন  দিদিমনিকে  জোর  করে  গাড়িতে  তুলে  নিয়ে  গিয়ে  অত্যাচার  করে  তারপর  মেরে  ফেলেছে  |
  লাফ  দিয়ে  ঝুপড়ি  থেকে  বের  হয়ে  পাগল  ছুটতে  লাগলো  চিৎকার  করতে  করতে  ," আমি  ছাড়বোনা  যারা  আমার  দিদিমনিকে  মেরে  ফেলেছে  তাদের  একটা  একটা  করে  আমি  শেষ  করবো | কিছুতেই  তোরা  বাঁচতে  পারবিনা |' কিছুটা  এগিয়ে  দুর্বল  শরীরে  ঝপ করে  রাস্তায়  পরে  গেলো  | কিছু  পথচারী  তাকিয়ে  দেখে  যে  যার  মত  কাজে  চলে  গেলো |
পাগল  এখন  সারাটাদিন  ঘুমায়  আর  রাত হলেই  পাহারাদারের  মত  সারা  রাস্তা  টহল  দিয়ে  বেড়ায়  | এমনিই  একদিন  রাতে  ঘুরতে  ঘুরতে  ক্লান্ত  শরীরে  গাছের  গোড়া  বাঁধানো  আর  একটি  মানুষের  পাশে  এসে  শুয়ে  পরে  | 

' না  আমাকে  ভিতরে  যেতে  দাও  -- আমার  অফিসারের  সাথে  কথা  আছে |'
--- দূর  পাগল , আমায়  বল  আমি  বলে  দেবো |
গেটে  পুলিশ  কনস্টেবল  তাকে  আটকায় |
--- আমি  সব  জানি | কিন্তু  তোমায়  কিছু  বলবোনা |
--- হ্যাঁ তুই  অনেক  জানিস  যা  এতো  রাতে  আর  বিরক্ত  করিসনা  | স্যার  জানতে  পারলে  মেরে  তোর  পিঠের  চামড়া  তুলে  নেবে  |
জোর  করে  থানার  ভিতর  পাগল  ঢুকতে  যায়  | কিন্তু  কনস্টেবলের  ধাক্কায়  পরে  গিয়ে  তার  কপাল  কেটে  রক্ত  ঝরতে  থাকে  | চিৎকার  চেঁচামেচি  করতে  শুরু  করে  | তাকে  দুজন  মিলে টেনে  থানা  থেকে  বের  করে  দিতে  আপ্রাণ  চেষ্টা  চালিয়ে  যেতে  থাকে  আর  সে  একটি  লাইটপোস্ট  জড়িয়ে  ধরে  চেঁচাতে থাকে  ," আমাকে  ভিতরে  যেতে  দাও  আমার  দিদিমনিকে  কারা মেরে  ফেলেছে  আমি  জানি  , আমার  দিদিমনি  খুব  কষ্ট  পেয়েছে --- আমি  সব  বলে  দেবো সবাইকে  --- 
হঠাৎ  একটা  পুলিশের  জীপ এসে  ঢোকে  |
অফিসার  বেরিয়ে  এসে  বলেন ," কিসের  এতো  চেঁচামেচি  ?
--- স্যার  এই  পাগলটা  তখন  থেকে  এসে  ঝামেলা  করছে |
--- একি? এর  কপাল  কাটলো  কি  করে  ?
পাগল  দৌড়ে  গিয়ে  অফিসারের  পা  জড়িয়ে  ধরে  বললো ,
--- স্যার  আমি  ব্যথা  পাইনি  | কিন্তু  আমার  দিদিমনি  অনেক  ব্যথা  পেয়েছে  | কারা তাকে  ব্যথা  দিয়েছে  আমি  জানি  স্যার  |
--- কি  পাগলামী হচ্ছে ? কে  তোমার  দিদিমনি  ?
--- আমায়  রোজ  খাবার  দিতো  স্যার | খুব  ভালো  মানুষ  ছিলো | কিন্ত  ওরা ওর  উপর  অত্যাচার  করে  মেরে  ফেলেছে  --- পাগলটা  ডুকরে  কেঁদে  উঠলো  |
অফিসার  কিছুর  একটা  গন্ধ  পেয়ে  কনস্টেবলকে  বললেন ,
--- ওকে  আমার  রুমে  নিয়ে  এসো | 
  
  পাগল  তার  অসংলগ্ন  কথায়  অফিসারকে  যা  বললো  তার  সারমর্ম  হল - ওদের  দলে তিনজন  ছিল | ওরা মেয়েটিকে  নিয়ে  নির্মীয়মান  একটা  ফ্ল্যাটে  উঠেছিল  | বৃষ্টির  কারণে ওই  ফ্ল্যাটে  আশ্রয়  নিয়েছিল  এক  মধ্যবয়সী  | সেও  এক  ঝুপড়িবাসী | মেয়েটির  উপর  অত্যাচার  করে  তাকে  খুন  করে  যখন  তারা  বেরিয়ে  যায়  তখন  ওই  মধ্যবয়সীর  সাথে  তাদের  দেখা  হয় | তার  মুখ  বন্ধ  করতে  কিছু  টাকা  তার  হাতে  গুঁজে  দিয়ে  গাড়ি  নিয়ে  তারা  বেরিয়ে  যায়  | কিন্তু  ওই  তিনজনের  মধ্যে  একজনকে  সে  চেনে  যে  কলেজেই  ঝাড়ুদারের  কাজ  করে |
--- এতো  কথা  তুমি  জানলে  কি  করে  ?
পাগল  মাথা  চুলকে  বললো ,
--- কেন  জানবোনা ? আমি  তো  রোজ  রাতে  দিদিমনিকে  যারা  মেরেছে  তাদের  ধরার  জন্য  ঘুরে  বেড়াই  | সেদিন রাতে  রাস্তায়  একজনের  কাছে  গিয়ে  বসেছিলাম  | সে  প্রচুর  মদ  খেয়েছিলো  | সেই  তো  আমাকে  এই  কথাগুলো  বলতে  বলতে  ঘুমিয়ে  পড়লো  | আমি  তার  কাছে  বসেই  থাকলাম  | ভোররাতে  উঠে  সে  যখন  তার  ঝুপড়িতে   ফিরে  গেলো  আমিও  তার  সাথে  গিয়ে  তার  ঘর  দেখেই  এখানে  ছুটে আসলাম  | কিন্তু  ওরা আমাকে  আপনার  সাথে  দেখা  করতে  দেবেনা  বলছিলো  | 
অফিসার  পাগলের  জন্য  খাবার  আনালেন  কিন্তু  পাগল  তা  ছুঁয়েও  দেখলোনা  | যে  কেসের  কিনারা  আজ  কদিন   ধরেও  তারা  করতে  পারেননি  তা  একজন  পাগল  ভিক্ষুকের  সহায়তায়  এতো  সহজে  হবে  প্রথমে  অফিসার  নিজেও  এটা বুঝতে  পারেননি  | 
   পাগলের  দেখিয়ে  দেওয়া  ঝুপড়ির  ভিতর  থেকে  বেরিয়ে  এলো  বছর  পঁয়ত্রিশের  এক  যুবক  | তাকে  নিয়ে  সোজা  থানায়  এনে  জেরা  করার  পর  জানা  গেলো  কলেজের  ঝাড়ুদারের  সাথে  ওই  মধ্যবয়সীর  বন্ধুত্বের  কথা  | 

  সেদিন  বৃষ্টির  মধ্যে  পাগলটাকে  দেখতে  না  পেয়ে  শুনশান  ফুটপাথ  ধরে  ছাতা  মাথায়  দিয়ে  রোজি  তার  খাবারের  প্যাকেটটা  নিয়ে  তার  ঝুপড়ির  দিকে  এগোচ্ছিল  | হঠাৎ  একটি  গাড়ি  এসে  রোজিকে  জোর  করে  গাড়ির  ভিতর  তুলে  নিয়ে  যায় | বলাবাহুল্য  বাধা  দেওয়ার  চেষ্টা  করে  চিৎকার  করেও  কোন  লাভ  হয়না  | কারণ  বৃষ্টির  আওয়াজের  মাঝে  রোজির  আওয়াজ  কেউই  শুনতে  পায়নি | 
  ক্লাসে  কিছু  ছাত্রী  ঢুকে  যাওয়ার  পর  ঝাড়ুদার  ক্লাস  ঝাঁট  দিতে  ঢুকেছিলো | এই  নিয়ে  রোজির  সাথে  তার  বচসা  হয় | প্রতিশোধ  নিতে  সে  তার  পাড়ার  দুই  মস্তানের শরণাপন্ন  হয়  | তারা  কাজ  হাসিল  করে  বেরিয়ে  যাওয়ার  সময়  মাতাল  নরেশের  সাথে  তাদের  দেখা  হয়  | আর  কথা  গোপন  রাখতে  কিছু  টাকা  তাকে  সেই  মুহূর্তে  দিয়েও  মাঝে  মধ্যে  তাকে  বোতল  কিনে  দিয়ে  যাচ্ছে  | অফিসার  বুঝতে  পারেন  ওরা তিনজন  প্রমাণ লোপাট  করতে  নরেশকেও  মেরে  ফেলবে  | এখনো  সে  সুযোগ  তারা  পায়নি  তাই  কাজটা  শেষ  করতেও  পারেনি  |তিনি  নরেশকে  এনে  থানায়  রাখেন  | পরদিন  ঝাড়ুদারকে  কলেজ  থেকেই  ভোরে  এরেস্ট  করে  তাকে  সঙ্গে  নিয়েই  বাকি  দুজনের  খোঁজ  পান  |
  রাস্তার  পাগল  ভিক্ষুক  রাস্তাতেই  থেকে  যায়  | আগের  মত  রোজই সে  দিদিমনির  জন্য  নিদিষ্ট  জায়গাতেই  অপেক্ষা  করে  | মাঝে  মধ্যে  তার  খাবারও আসে  অন্য কারও হাত  দিয়ে  | সে  জানে  এটা তার  দিদিমনিই  পাঠায়  তাকে  | কিন্তু  লজ্জায়  সামনে  আসতে পারেনা  | 

  পুলিশ  অফিসার  দূরে  দাঁড়িয়ে  অন্যের  হাত  দিয়ে  এই  অবোধ  লোকটাকে  খাবার  পাঠিয়ে  তার  মুখের  ওই  হাসিটুকু  দেখেন  আর  ভাবেন  আমি  একজন  অফিসার  হয়ে  যা  পারিনি  তুমি  তা  করে  দেখিয়েছো  | এই  সামান্য  খাবারটুকু  তোমার  কাছে  পৌঁছালে  তোমার  দিদিমনির  আত্মা  শান্তি  পাবে  |

Saturday, April 25, 2020

ছোটগিন্নী ( চতুর্থ পর্ব )

ছোট গিন্নী (৪র্থ পর্ব)


     টুকুন  বাড়ির  রাস্তার  ডাইরেকশন  দিচ্ছে  আর  আড়চোখে  তার  বসকে  দেখে  চলেছে | ' এই  লোকটার  ভিতর  দুটো  সত্বা কাজ  করে | অফিসে  তার  কর্মচারীদের  কাছে  একরকম  আর  বাইরে  ঠিক  তার  উল্টোটা | মানুষটা  মনেহয়  সত্যিই  খারাপ  না | নাকি  আমার  পরেই সদয়  হয়েছেন --- |' ভাবনায়  ছেদ  পরে  বাড়ির  সামনে  এসে --- " এ-খা-নে  এ-খা-নে  দাঁড়ান  ---"|
          

     গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। আগে অরুন নেমে গাড়ির দরজা খুলে টুকুনকে নামতে বলে।এদিকে টুকুনের দেরি হচ্ছে দেখে শমিত ও রুমা দুজনেই গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে।টুকুনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে শমিতের চক্ষু চড়কগাছ।সে রুমাকে কনুইয়ের এক ধাক্কা দিয়ে বললো, 
---আরে আমার ছোটগিন্নী তো বেশ বড় একটা বোয়াল তুলেছে। 
রুমা চোখ পাকিয়ে শমিতের দিকে তাকিয়ে বলে, 
---আস্তে,শুনতে পাবে তো!তোমায় নিয়ে আর পারিনা। 
টুকুন গাড়ি থেকে নেমে জামাইবাবুকে দেখেই বলে উঠলো, 
---জিজু, আমার বস।আজ এতো ভিড় ছিলো যে বাসে উঠতেই পারছিলাম না।কি ভিড় কি ভিড়।উনি দয়া করে পৌঁছে দিলেন তাই এখন আসতে পারলাম। 
 শমিত বিড়বিড়  করে  বললো , " তুমি  সুন্দরী , শিক্ষিতা, আধুনিকা দয়া  তো  করবেই ---" কথাটা  কারও কান  পর্যন্ত  অবশ্য  পৌঁছালোনা |
   অরুন একটু এগিয়ে গেলো শমিতের দিকে। হাতটা  এগিয়ে  দিয়েও  কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রণাম করতে করতে বলে, 
---কেমন আছো শমিতদা ? 
শমিত একটু হকচকিয়ে গেলো।
---ভালো তো আছি ভায়া।কিন্তু তোমায় তো ঠিক চিনতে পারছিনা। 
 --- গেস করো  --- | আমি  তো  দেখেই  তোমায়  চিনতে  পারলাম  |
--- বয়স  হয়েছে  ভায়া  | স্মৃতিশক্তিগুলো  আস্তে  আস্তে  জং ধরতে  শুরু  করেছে |
 --- সে-- ই  তবে  আমার  মনেহয়  দাদা  পুরনো পাড়ার  স্মৃতি  ঘাটলেই তোমার  সব  মনে  পড়বে --|
--আরে পরিচয়টা  দিয়েই  ফেলো  ভাই  |
--- চিনতে  পারলে  না  তো ? অবশ্য  এরজন্য  তোমার  কোন  দোষ  নেই | সব  দোষ  সময়ের | আর  আমি তো এখন তোমার ছোট্ট যুধিষ্ঠির নই। 
 সঙ্গে  সঙ্গে  শমিত বাচ্চাদের  মত  চিৎকার  করে  বলে  উঠলো ,
---যুধিষ্ঠির?আরে আমি তো তোকে চিনতেই পারতামনা যদি কিনা আমার দেওয়া এই মিষ্টি নামটা না বলতিস।চল ভিতরে চল।কত বছর পর দেখা হোল ,অনেক কথা জমে আছে। 
 --- পরে  একদিন  জমানো  কথার  ঝুড়ি  উল্টে  দিলে  হয়না  ?
--- তা  কি  করে  হয় ? তুই  বাড়ির  ভিতরে  না  ঢুকেই  চলে  যাবি ?না - না ভিতরে  চল  |
 অগত্যা  অরুনকে  ভিতরে  ঢুকতেই  হল  | অবশ্য  একেবারে  যে  তার  ইচ্ছা  ছিলোনা  তাও নয়  কিন্তু  কোথায়  যেন  কিছু  একটা  আটকাচ্ছিলো  |
   ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে শমিত রুমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, 
---রুমা ও কিন্তু আমার ছোট ভাই।আমরা একই পাড়াতে থাকতাম।ওর দাদা আমার প্রাণের বন্ধু ছিলো।অনেকদিন বরুনের সাথে কোন যোগাযোগ নেই।কলেজ জীবন শেষ করার পর সবাই যেন চারিপাশে ছিটকে গেলাম।অনেক গল্প শোনার আছে ওর কাছে।ও রাতে খেয়েদেয়েই যাবে।দুই বোন মিলে জমিয়ে রান্না করো আর আমরা দুই ভাই মিলে জমিয়ে গল্প করি।কিন্তু তার আগে একটা গল্প শুনে যাও আমরা কেন ওকে যুধিষ্ঠির বলে ডাকতাম। 
    আমরা যখন এন্টালীতে ভাড়া থাকতাম তার পাশেই ছিলো রমেশ ঘোষের বিশাল বাগানবাড়ী।একবার বৈশাখ কি জৈষ্ঠ্য মাসে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রাচীর টপকে ঘোষবাবুর বাগান বাড়িতে ঢুকলাম আম চুরি করতে।অরুনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,এটা সবসময় আমাদের পিছন পিছন ঘুরতো।ওর তখন কত আর বয়স হবে এই ধরো আট কি ন' বছর।আমরা তো প্রাচীর টপকে ভিতরে ঢুকলাম;ওকে বললাম,তুই বাইরে থাক বাইরে যে আমগুলি পড়বে সেগুলো তুই কুড়াবি।গাছটা ছিলো একদম প্রাচীরের গায়ে।আমরা তো যে যার মত আম পেড়ে চলেছি।হঠাৎ দারোয়ানের দিবানিদ্রা শেষ।তিনি লাঠি উঁচিয়ে 'কে আম পারিস?'বলে ছুটে এলেন।আমরা তো যে যার মতন প্রাচীরের যে কোন দিক থেকে লাফ দিয়ে দে-ছুট।আর এই বিচ্ছুটা কয়েকটা আম তখনও বাইরে পড়ে ছিলো কুড়িয়ে চলেছে।দারোয়ান গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এটাকেই ধরলো।কারা কারা গাছে উঠেছে জানতে চাওয়ায় সে সকলের নামধাম সব বলে দিলো।খবর গেলো সকলের বাবার কাছে।সকলেই যে যার বাবার কাছে মার খেলাম।আর আমার বাবা তো খড়ম পড়তেন, খড়ম দিয়েই দমাদম  মার।সবাই তো ক্ষেপে আগুন ওর প্রতি।ওর সত্যবাদিতার জন্য নাম-ই হয়ে গেলো যুধিষ্ঠির।তারপর থেকে আমরা ওকে লুকিয়েই আমাদের কাজগুলো করতাম।গল্প শুনে দুইবোন হেসে গড়াগড়ি। দুই  বোনের  এই  প্রাণখোলা  হাসি  দেখে  অরুন  যে  একদৃষ্টিতে  শমিতের ছোটগিন্নীর দিকে  তাকিয়ে  আছে  তা  কিন্তু  শমিতের দৃষ্টি  এড়ায়না | শমিতের বুঝতে  একটুও  অসুবিধা  হয়না  তার  ছোটগিন্নী মিষ্টার অরুন  মুখাৰ্জীর অফিসেই  শুধু  কাজ  করেনা তার  মনের  ঘরেও  কাজ  করতে  শুরু  করেছে  |

    চলবে :-

Friday, April 24, 2020

ছোটগিন্নী ( তৃতীয় পর্ব )

ছোট গিন্নী (তৃতীয় পর্ব)
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

  এভাবেই দিন গড়িয়ে যেতে থাকে।টুকুন তাদের কাছে আসার পর থেকে শমিত, রুমা ভুলেই গেছে তাদের সন্তান না হওয়ার কষ্টটা।এতোটাই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে টুকুন যে সময় টুকু বাড়িতে থাকে বাড়িটাকে পুরো মাতিয়ে রাখে।আর শমিতও কম যায়না;সবসময় টুকুনের পিছনে লেগেই আছে।ছুটির দিনগুলিতে তিনজনেই বেরিয়ে পড়ে।কোনদিন সিনেমা তো কোনদিন থিয়েটার দেখে রাতে কোন ভালো রেস্টুরেন্টে খেয়ে হৈ হৈ করতে করতে বাড়ি ফেরা।শালী ভগ্নিপতির এই খুনসুটিপনাটা রুমা খুব উপভোগ করে।রুমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা যেন সমবয়সী। ওরা দু'জনে চুপ করে থাকলে বরং রুমারই ভালো লাগেনা।কিছু একটা বলে দু'জনকেই খেপিয়ে দেয়।তারপর বসে বসে মজা দেখে। 
  একদিন  দুপুর  থেকেই  আকাশের  মুখ  ভার | চারিদিকে  অন্ধকার  করে  নিয়ে  এসেছে | দুপুরবেলাতেই  মনেহচ্ছে  সন্ধ্যা  নেমে  এসেছে | অফিস , রাস্তা  সমস্ত  জায়গাতেই  বৈদ্যুতিক  আলো জ্বলে  উঠেছে | অফিসের  সকলেই  চেষ্টা  চালিয়ে  যাচ্ছে  নিজেদের  হাতের  কাজ  যত শীগ্র  সম্ভব  শেষ  করে  যার  যার  বাড়ির  উদ্দেশ্যে  রওনা  দেওয়ার | কাজ  ফেলে  রেখে  গেলে  তো  আবার  ওই  বদমেজাজী বসের  খপ্পরে  পড়তে  হবে | টুকুন  তার  টেবিলের  কাজ  সেরে  একটু  ওয়াসরুমে  ঢোকে | কিন্তু  ফেরার  পথে  এক  বিপত্তি | সে  ওয়াশরুম  থেকে  বেরিয়ে  তার  রুমে  ঢুকতে  যাবে  ব্যাগটা  নিতে  আর  ঠিক  সেই  মুহূর্তেই  বদমেজাজী , রাগী বস  অরুনের  সাথে  সামনাসামনি  জোর  ধাক্কা  খেয়ে  টাল সামলাতে  না  পেরে  ---- আর  ঠিক  তখনই তার  বস  তাকে  ধরে  ফেলে |
--- সরি  স্যার  
--- কিসের  জন্য  ?
--- আসলে  বৃষ্টি  আসছে  দেখে  একটু  তাড়াতাড়ি  যেতে  গিয়েই  ---
--- কিন্তু  আমি  তো  ভেবেছিলাম  আপনি  আমাকে  থাঙ্কস  বলবেন ---
 টুকুন  মনেমনে  ভাবে  ' লোকটা  বলে  কি ? আজকে  মাথাটা  খারাপ  হয়ে  গেল  নাকি ? প্রয়োজন  ছাড়া  যে  মানুষটা  একটাও  কথা  বলেনা সে  আজ  এতো  কথা  বলছে  
---?
--- কি  হল ? চুপচাপ  দাঁড়িয়ে  আছেন  যে ? অফিস  তো  পুরো  ফাঁকা  হয়ে  গেছে | বেরিয়ে  পড়ুন  ---|
--- থাঙ্কস  স্যার  
--- এটা কিসের  জন্য  ?
--- ওই  যে  আমাকে  পরে  যাওয়ার  হাত  থেকে  বাঁচালেন  ---|
--- তবে  একটা  কথা  বলি , জীবনে  চলার  পথে  যতই  তাড়া থাকনা কেন  আশেপাশে , সামনে  দেখে  হাঁটাচলা  করবেন | তানাহলে  কিন্তু  সবসময়  বিপদে  পড়বেন  |
 টুকুন  মনেমনে  বললো,' জ্ঞানদাতা --- আমি  বিপদে  পড়ি  আর  না  পড়ি  তোমায়  তা  নিয়ে  ভাবতে  হবেনা |'
 আর  বসকে  বললো ," মনে  থাকবে  স্যার |"
 বাড়ি  ফেরার  পূর্ব  পর্যন্ত  রাস্তা  এমনকি  বাসে বসেও  টুকুন  ভেবেই  চললো , লোকটার  আজকে  হল  কি ? এতো  কথা  বললো  কেন ? অফিসের  এই  বসগুলোকে  বিন্দুমাত্র  বিশ্বাস  করা  যায়না | কখন  আবার  কি  রূপ  ধারণ  করে | সেরকম  কিছু  বুঝলেই  সঙ্গে  সঙ্গেই  চাকরিটা  ছেড়ে  দেবো | তবে  তার  আগে  লোকটার  মুখোশ  খুলে ছাড়বো '---
 কিন্তু  না  ঐদিনের  পরে  আবার  যে  কে  সেই | ফাইলগুলো  সই  করে  টেবিলে  রেখে  দেয় সেখান  থেকে  ফাইলগুলো  নিয়ে  টুকুন  বেরিয়ে  আসে | 'কি  আজব  জীব  রে  বাবা | কখনো  মুখে  খই ফুঁটছে আবার  কখনো  মনেহয়  পুরো  বোবা | লোকটার  এতো  অহংকার  কেন  যে  তা  একমাত্র  মনেহয়  ঈশ্বরই জানেন |'
   এরই  মাঝে  একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভিড়ের জন্য টুকুন বাসে উঠতেই পারেনা।এক একটা বাস আসে দৌড়ে গিয়ে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু ভিড়ের চাপে আবার পিছনে পড়ে যায়।এইভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। এমন সময় একটা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়ায়।গাড়ির কাঁচ নামিয়ে মুখটা বের করে গাড়ির মালিক বলে,"বাসে উঠতে পারছেন না তো?প্রচন্ড ভিড় কি তাই তো?আরে এদিকে ওদিকে কি দেখছেন?আপনাকেই তো বলছি.....
টুকুন প্রথমে একটু হতভম্ব হয়ে যায়।ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগে।আরে এতো তারই অফিসের বস -মিঃ অরুন মুখার্জী। যে কিনা প্রয়োজন না হলে একটা বাক্য ব্যয় করেনা সে কিনা জানতে চাইছে....
"কি অতশত ভাবছেন?উঠে আসুন।আমি বেহালার দিকেই যাচ্ছি। আপনি তো বেহালাতেই থাকেন।আপনাকে নির্দিষ্ট জায়গাতেই নামিয়ে দেবো।
গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,"আসুন।"
---পেয়ে যাবো বাস। 
---আরে আসুন।আমিও একটু গল্প করতে করতে যেতে পারবো।
  টুকুন গাড়িতে উঠে খুব জড়োসড়ো হয়ে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে অরুনই বলে, 
---আরে আপনি ওইরকম জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন কেন?আমি বাঘ না ভাল্লুক?আরে আমি মানুষটা মোটেই খারাপ নই।হ্যাঁ অফিসে একটু গম্ভীর হয়ে থাকি।বলতে পারেন থাকতে বাধ্য হই।আমার অনেক সিনিয়র রয়েছেন ওখানে।
একটু গম্ভীর হয়ে না থাকলে তাদের কাছ থেকে কাজটা ঠিকমত আদায় করতে পারবোনা-মানে তারা আমায় পাত্তাই দেবেননা।তাই অফিসে আমি ভীষন রাগী মিঃ মুখার্জী। 
টুকুন এবার হেসে দিলো।ওর হাসির দিকে অরুন মুখার্জী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে মুখটা নীচু করে হাসি থামিয়ে বলে, 
---আপনার অফিসে এই গম্ভীর হয়ে থাকার সিক্রেটটা আমি যদি  সকলকে বলে দিই? 
---হ্যাঁ তা বলতেই পারেন।তাহলে আমাকে তখন আরও গম্ভীর হয়ে আপনাকে তলব করতে হবে। 
---ওরে বাবা!যে গম্ভীর হয়ে আপনি থাকেন তার উপর আরও গম্ভীর?দরকার নেই বাবা আপনার সিক্রেট ফাঁস করবার। 
   কথা বলতে বলতেই ওরা বেহালা এসে পড়ে।টুকুন বলে,"এবার নেমে যাই। "অরুন গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, 
---এখানে তো শুধু দোকানপাট দেখতে পাচ্ছি,কোন বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না তো? 
---না না এখানে কোথায় বাড়ি?আমাদের বাড়িটা একটু ভিতরে।বি.সি.রোডে।এখান থেকে আমি হেঁটেই যেতে পারবো। 
---চলে তো আসতে ওই বাসস্টপ থেকেই আপনি পারতেন।কিন্তু এতো দূর যখন আমি এলাম তখন বাড়ির সামনেই আপনাকে নামিয়ে দিই।আপনি বরং রাস্তার ডিরেকশনটা দিন। না, আপনার  কোন  ভয়  নেই  | 
--- মানে  --?
--- মানে  এই  আর  কি  আপনার  বাড়িটা  চিনে  গেলে  আপনার  বাড়িতে  এসে  কখনোই  উপদ্রব  করবোনা  বা  আপনাকে  কোন  বিপদে  ফেলবোনা  |
--- আমি  কিন্তু  তা  বলিনি  স্যার  আর  এইসব  উল্টোপাল্টা  কথাবার্তা  আমার  মাথায়ও আসেনি | আর  সত্যিই  যদি  সেরকম  কিছু  হয়  আপনি  আমাদের  তল্লাটে  ঢুকে  জ্যান্ত  ফিরতে  পারবেন  ?
কথাটা  বলে  হাসতে থাকে  টুকুন |
 অরুনও  টুকুনের  কথা  শুনে  মুচকি  মুচকি  হাসতে থাকে | স্টিয়ারিং  হাতে  সামনের  দিকে  তাকিয়ে  বলে ,
--- এবার  কোন  দিকে  বলুন ---|

ছোটগিন্নী ( দ্বিতীয় পর্ব )

ছোট গিন্নী (দ্বিতীয় পর্ব)
     
      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

       টুকুনের পড়াশুনা প্রায় শেষের পথে।দিদির ইচ্ছা তার বোনের বিয়ে দেওয়া।কিন্তু শমিতের ইচ্ছা তার ছোট গিন্নী পড়াশুনা শেষ করে চাকরী করুক। সবসময় এই নিয়ে রুমা আর শমিতের কথা কাটাকাটি।টুকুন বেশ মজা পায় তাকে নিয়ে দিদি আর জিজুর এই ঝগড়ায়।মাঝে মাঝে didir.পক্ষ নিয়ে বলে, 
---ঠিকই তো বলছে দিদি।এখন যদি বিয়ে না করি আর কবে বিয়ে করবো?শেষে যদি একটা বুড়ো বর কপালে ঝোঠে,তখন কি হবে দিদি?তার থেকে তোরা এখন আমার বিয়ে দিয়ে দে। 
  আবার কখনো বা শমিতের দিকে ঝুলে পড়ে -
---কি বলিস দিদি তুই?এতো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখলাম শুধু কি ওই হাতাখুন্তি নাড়াতে?না গো জিজু আমি এখন কিছুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবো না।আমি চাকরী করবো। 
   নিত্যদিন রাতে খাবার আগে পরে টুকুনের বিয়ে নিয়ে আলোচনা,ঝামেলা, কথা কাটাকাটি,মান-অভিমান চলতেই থাক।শেষমেষ রুমা কোন কোনদিন রেগেমেগে আগেই শুতে চলে যায়। আর রুমাকে রাগিয়ে দিয়ে শালী ভগ্নিপতি হো হো করে হাসতে শুরু করে।আবার পরদিন সকালে সব ঠিক।এভাবেই রুমা,শমিত আর টুকুনের হাসিখুশিতে দিন চলে যেতে থাকে। 
     জামাইবাবুর পরিচিতির সূত্র ধরেই টুকুন পাশ করার পর একটা ভালো নামী কোম্পানীতে চাকরীও পেয়ে যায়। আর সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় অরুনের সাথে।সুদর্শন,রাগী, অহংকারী অল্প বয়সী টুকুনের বস।রোজই প্রায় দু'একবার তার বসের কাছে যেতেই হয় ফাইলপত্র সই করাতে।ভীষন গম্ভীর।প্রয়োজনের একটা বেশি কথা তিনি বলেননা।বলতে গেলে টুকুন একটু ভয়ই পায় তার এই অহংকারী গম্ভীর বসকে।টুকুন মনে মনে ভাবে অল্প বয়সে এইরূপ উচ্চপদে চাকরী পেয়ে লোকটার মাথাটাই বোধহয় বিগড়ে গেছে।মুখে কখনোই হাসি নেই।লোকটা বোধহয় জানেই না হাসি কি জিনিস।এ ভাবেই টুকুনের চাকরীর বয়স একমাস হয়ে যায়।সে মাইনে পেয়ে দিদি আর জিজুর জন্য প্রাণভরে মার্কেটিং করে।বাড়িতে ফিরে এসে বাকি টাকা সে তার জিজুর পায়ের কাছে রেখে সেখানেই নিজে বসে জিজুকে বলে, 
---আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে এইভাবেই আমি মাইনের টাকাটা তার পায়ের কাছেই রাখতাম।কিন্তু তিনি আজ নেই।তোমাকেই আমি সেই জায়গায় বসিয়েছি।তুমিই আমার বাবা, আমার দাদা,আমার বন্ধু, আমার জামাইবাবু -সব সব তুমি।তুমি এটা নিলে আমি খুব খুশি হবো।
শমিতের দু'চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। সে টুকুনকে তুলে মাথাটা বুকের পরে রেখে বলে, 
---তুই টাকাটা তোর কাছেই রাখ।যখন আমার দরকার হবে আমি নিজেই তোর কাছ থেকে চেয়ে নেবো।তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল!ওরে তুই তো শুধু আমার শালী না রে!তুই আমার মেয়ে, আমার বোন -তারপর মুখটা তুলে নিয়ে চিবুকটা ধরে বলে, আমার আদরের ছোটগিন্নী।ব্যস-অমনি শুরু হয়ে গেলো চিৎকার,চেঁচামেচি।শমিতকে মারার জন্য ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি।শমিতও ঘরের মধ্যে এদিকে ওদিকে দৌড়াতে লাগলো।রুমা এতক্ষণ সোফায় বসে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে যাচ্ছিলো।এবার হেসে পড়ে বললো, 
---আবার শুরু হোল বাচ্চাদের মত।ঘরটা এতক্ষণ গুমোট হয়ে ছিলো।এবার ঠিক হোল।তারপর সোফা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, 
---তোমাদের মারপিট শেষ হলে দয়া করে খেতে এসো।আমি খাবার রেডি করছি।

  খাবার  টেবিলেও  একপ্রস্ত  হৈ হট্টগোল  | রুমা  কাতলার  কালিয়া  করে  তিন  বাটিতে  তিনজনের  জন্য  ঢেলে  রেখেছে  | ওদের  দুজনের  সামনে  দুটো  বাটি এগিয়ে  দিয়ে  নিজেরটা  নিয়ে  সবে ভাত মেখে  মুখে  দিতে  গেছে  সামনের  দিকে  তাকিয়ে  দেখে  শালী  ভগ্নিপতি  দুজনে  মিলে বাচ্চাদের  মত  করছে  | একবার  টুকুন  তার  মাছের  বাটি তার  জিজুর  দিকে  এগিয়ে  দেয় তো  পরক্ষণে তার  জিজু  সেই  বাটি নিয়ে  টুকুনের  দিকে  এগিয়ে  দেয় | খাওয়া  বন্ধ  করে  রুমা  তাদের  এই  ছেলেমানুষি  দেখতে  দেখতে  একসময়  হাসতে হাসতে বলে ,
--- এটা কি  ছেলেমানুষি  হচ্ছে  তোমাদের  ?
--- তুই  কেন  আমাকে  বড়  মাছের  পিসটা দিয়ে  জিজুকে ছোট  মাছের  পিস দিয়েছিস  ?
--- তোর  জিজুকে বড়  পিসটা দিলে  যে  সে  সেটা  খেতোনা  | উল্টে  আমাকে  বকাবকি  করতো | 
--- এটা একদম  ঠিক  হচ্ছেনা  জিজু | তোমরা আমাকে  যে  ভালোবাসা  দিয়েছো  তার  ঋণ আমি  কোনদিনও  শোধ  করতে  পারবোনা | এতদিন  আমি  এই  খাওয়ার  ব্যাপারে  কিচ্ছু বলিনি | কিন্তু  এখন  তোমার  বয়স  হচ্ছে  , তোমার  এখন  খাওয়াদাওয়ার দিকে  একটু  নজর  দেওয়া  দরকার  | এখন  তো  আর  আমি  সেই  ছোট্টটি  নেই | প্রতিদিন  এই  যে  দু  দুবার  বাসে করে  অফিস  যাতায়াত  করো  তাতে  কি  তোমার  কম  পরিশ্রম  হয় ? আর  দিদি  তুইও  না  --- তুই  কেমন  ধরণের বৌ  রে  --- স্বামীকে  কম  দিয়ে  বোনকে  বেশি  দিস --- |
 শমিতের  চোখদুটি  ছলছল করে  | টুকুনের  দিকে  তাকিয়ে  বলে ,
--- প্রত্যেক  বাবা , মা  তার  সন্তানদের  নিজেদের  থেকে  ভালো  খাবারটা  , ভালো  পোশাকটা  দেওয়ার  চেষ্টা  করে | তুমি  যে  আমাদের  জীবনে  সেই  জায়গাটাই নিয়েছো | নিজেরা  খাওয়ার  থেকে  ভালোটা  তোমায়  খাওয়াতে  পারলে  আমরা  যে  দুজনেই  খুব  খুশি  হই টুকুন | আমাদের  জীবনে  তুমি  ছাড়া  আর  তো  কেউ  নেই  | বাবা  মায়ের  কাছে  সন্তানের  কোন  ঋণ থাকেনা  | থাকে  শুধু  দায়িত্ব  আর  কর্তব্য | বাবা  মা  তাদের  সবটুকু  ভালোবাসা  দিয়ে  সন্তানের  প্রতি  তাদের  দায়িত্ব  আর  কর্তব্য  পালন  করে  থাকেন  আর  অপরদিকে  তাদের  বৃদ্ধবয়সে  সন্তানেরাও  ভালোবাসার  আবদ্ধেই  তাদের  দায়িত্ব  কর্তব্য  সম্পাদন  করে  |
 কথাটা  শেষ  করে  শমিত টুকুনের  মাছের  বাটি থেকে  কিছুটা  মাছ  নিয়ে  টুকুনের  মুখে  দিয়ে  দেয় | টুকুনও ঠিক  একই  কাজ  করে | শমিত একটা  বড়  হা  করে  টুকুনের  মাথায়  বাহাতটা দিয়ে  বলে ,
--- পাগলী  চোখে জল  কেন  ?
--- মাছের  কালিয়াটাই দিদি  একটু  বেশি  ঝাল  দিয়ে  ফেলেছে |
 কথাটা  শুনে  রুমা  বললো ,
--- ঠিক  বলেছিস  | আমারও  খুব  ঝাল  লেগেছে |
 কথাটা  বলে  আঁচলের  খুট  দিয়ে  চোখ  মুছতে  মুছতে রুমা   রান্নাঘরের  দিকে  চলে  গেলো |

Thursday, April 23, 2020

ছোটগিন্নী ( প্রথম পর্ব )

ছোটগিন্নী ( প্রথম  পর্ব  )

  শমিত ফোনটা পেয়ে  চুপ  করে  বসে  থাকে  | রবিবার  বলে  একটু  দেরিতেই  ঘুম  থেকে  ওঠে  সে  আজ | রুমার  চিৎকার  চেঁচামেচিতে  বাজারের  ব্যাগটা  নিয়ে  বেরোতে  যাবে  এরই  মধ্যে  ল্যান্ডফোনটা  বেজে  ওঠে | অপরপ্রান্ত  থেকে  যে  কথাটা  সে  শুনতে  পায় তা  সে  স্বপ্নেও  কল্পনা  করেনি | কি  করবে  সে  এখন ?কেমন  করে  রুমাকে  সে  এই  দুঃসংবাদটা  দেবে ?ভাবতে ভাবতেই  সোফার  উপর  বসে  পরে | রুমা  শমিত বেরিয়ে  গেছে  ভেবে  দরজা  দিতে  আসে | কিন্তু  শমিতকে সোফার  উপর  চুপচাপ  বসে  থাকতে  দেখে  চিৎকার  করে  বলে  ওঠে," তুমি  এখনো  বেরোও নি ? এরপর  তো  কিছু  পাবেনা আর  বাজারে | তোমাকে  নিয়ে  সত্যি  আমি  আর  পারিনা | বললে  চা  খেয়েই  বাজারে  বেরোবে--- চুপচাপ  বসে  কি  ভাবছো  বলোতো --- ?"
 শমিত রুমার  হাতটা  ধরে  নিয়ে  তার  পাশে  বসায় | খুব  আস্তে  বলে ,
-- রুমা  মাথা  ঠান্ডা  করো | চুপ  করে  আমার  একটা  কথা  শোনো |
 শমিতের এই  ব্যবহারে  রুমা  ভয়  পেয়ে  ওর  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  বলে,
--- কি  হয়েছে  গো ? শরীর  ঠিক  আছে তো? ফোনের  আওয়াজ  পেয়েছিলাম  কোন  খারাপ  খবর---
 রুমার  কথার  মাঝখানেই  শমিত ওর  হাতদুটো  শক্ত  করে  ধরে  বলে,
 --- আমি  ঠিক  আছি , কিন্তু  আমাদের  এক্ষুনি  একবার  মধ্যমগ্রাম  যেতে  হবে |
 মধ্যমগ্রাম  রুমার  বাপেরবাড়ি | সঙ্গে  সঙ্গে  রুমা  বলে  ওঠে ,
--- কারও শরীর  খারাপ  করেনি  তো ? মা, বাবা, টুকুন,  সবাই  ঠিক  আছে  তো ?
 শমিত এবার  রুমাকে  আরও কিছুটা  কাছে  টেনে  নিয়ে  বলে ,
--- দেখো  যা  হয়েছে  তা  হয়ে  গেছে | এতে  আমাদের  কারও কোন  হাত  নেই | এটা আমাদের  দুর্ভাগ্য  ছাড়া  আর  কিছুই  নয়  | কিন্তু  আমাদের  দেরি  হয়ে  যাচ্ছে , চলো  বেরিয়ে  পড়ি  |
 রুমা  কাঁদতে  কাঁদতে  জানতে  চায় ,
--- আরে কি  হয়েছে  আমায়  খুলে  বলো --|  আমি  তো  কিছুই  বুঝতে  পারছিনা  |
 শমিত নিজেকে  কিছুটা  সামলে  নিয়ে  রুমার  মাথাটা  নিজের  বুকের  উপর  নিয়ে  বললো,
--- একটা  একসিডেন্ট --- বাবা  আর  মা  দুজনেই  সকালে  বাজার  করতে  বেরিয়েছিলেন , বাজার  শেষে  দুজনে  একটা  রিক্সা করে  বাড়ি  ফিরছিলেন | তখন  পিছন  থেকে  একটা  প্রাইভেটকার  ধাক্কা  মারে | দুজনেই  দুদিকে  ছিটকে  পড়েন | কিন্তু  আমাদের  দুর্ভাগ্য  কেউই  আর---
 রুমা  ডুকরে  কেঁদে  ওঠে | শমিত দুহাতে  রুমাকে  বুকের  সাথে শক্ত  করে চেপে  ধরে রাখে | কিছুক্ষণ সময়  এভাবেই  কেটে  যায় | রুমা  কাঁদতে  কাঁদতে  একসময়  শান্ত  হয়ে  নিস্তেজ  হয়ে  পরে | শমিত রুমার  মাথায়  হাত  বুলাতে  বুলাতে  বলে ,
--- আমাদের  দেরি  হয়ে  যাচ্ছে | চলো  আমরা  বেরিয়ে  পড়ি | টুকুনটা  একা রয়েছে  | ওকে  শান্তনা দেওয়ার  মতোও পাশে  কেউ  নেই | আমরা  যত দেরি  করবো  ওর  কষ্টটা  তত  বাড়বে | এই  মুহূর্তে  ওর  যে  আমাদের  খুব  দরকার  | 
 টুকুন  ওরফে  সোমা | রুমার  ছোটবোন | বেশ  অনেকটাই  ছোট | রুমার  যখন  বিয়ে  হয়  তখন  টুকুনের  বয়স  কত  আর  -- এই  দশ  কি  এগারো  বছর  হবে | রুমার  বিয়ে  হয়েছে  বছর  সাতেক | কোন  সন্তান  হয়নি | চিকিৎসারও  কোন  ত্রুটি  শমিত রাখেনি | দোষটা রুমারই | শমিত এটা দুর্ভাগ্য  বলেই  মেনে  নিয়েছে | শমিতের যেহেতু  কোন  ভাইবোন  নেই  তাই  সে  প্রথম  থেকেই  টুকুনকে  খুব  ভালোবাসে | ওরা আর  সময়  নষ্ট  না  করে  সেই  মুহূর্তেই  একটা  ট্যাক্সি  ধরে  মধ্যমগ্রামের  উদ্দেশ্যে  বেরিয়ে  পরে | ওদের  বাড়ির  ভিতর  ঢুকতে  দেখেই  টুকুন  দৌড়ে  গিয়ে  তার  জিজুকে জড়িয়ে  ধরে  হাউহাউ  করে  কাঁদতে  থাকে | শমিত টুকুনকে  নিয়ে  একটি  খাটের উপর  বসে  তার  মাথায়  হাত  বুলাতে  বুলাতে  বলে ,
--- ভাগ্যের  উপর  কারও কোন  হাত  নেই  | এই  একটা  জায়গায়  মানুষ  বড্ড  অসহায় | বাবা , মায়ের  শূন্যস্থান  কেউ  কখনোই  পূরণ করতে  পারেনা | আমি  আর  তোমার  দিদি  দুজনে  মিলে চেষ্টা  করবো  ভালোবাসা  দিয়ে  তোমার  এই  শূন্যস্থানটা কিছুটা  হলেও ভরিয়ে  দিতে | 
তারপর  কিছুটা  সময়  চুপ  করে  থেকে  আবারো  বলতে  শুরু  করে, "তোমরা  দুবোন  মিলে যদি  এতো  কান্নাকাটি  করো  তাহলে  তাদের  আত্মা  শান্তি  পাবেনা যে --- | অনেকটা  পথ  এখনো  তোমায়  এগোতে  হবে | আমি  কথা  দিচ্ছি  তোমার  এই  জিজু  সারাজীবন  তোমার  সাথে  থাকবে |
 দিন  পনেরর মধ্যে  এখানকার  যাবতীয়  কাজ  সেরে  তারা  টুকুনকে  সাথে  নিয়েই  কলকাতা  ফিরে  আসে |
 সে  থেকে  টুকুনের  যাবতীয়  সবকিছু  অথাৎ  সে  কোন  কলেজে  ভর্তি  হবে , কোন  প্রফেসারের কাছে  পড়লে  ভালো  হবে  সবই  শমিত দেখাশুনা  করে |r রুমা  মোটেই  এসবের  ভিতর  ঢোকেনা | সে  তার  বোনের  ব্যাপারে  সম্পূর্ণভাবে  শমিতের উপর  নির্ভরশীল | শমিত ,রুমার  বিয়ের  পর  থেকেই  সে  টুকুনকে  ছোটগিন্নী  বলে  ডাকে | রাস্তাঘাটে  শমিত যখন  এই  নামে টুকুনকে  ডাকে  তখন  টুকুন  প্রচন্ড  ক্ষেপে  যায় | মাঝে  মধ্যে  চিৎকার  করে  বলে  ওঠে , " জিজু  এটা কিন্তু  একদম  ঠিক  হচ্ছেনা | লোকে  ভাবছে  আমার  মত  সুন্দরী  অল্পবয়সী মেয়ের  বর এই  বুড়ো  লোকটা |"
 " আরে ছোটগিন্নী ঘাবড়াচ্ছো  কেন? বাইরেটা  আমার  বুড়ো  দেখতে  হলে  হবে  কি  --- ভিতরটা  একদম  কচি |"
 " দিদি , এটা কিন্তু  একদম  ভালো  হচ্ছেনা |"
 রাস্তার  মধ্যেই  শালী , ভগ্নিপতির  ঝগড়া  শুরু  হয় | রুমাকেই  তখন  সালিশি  করতে  হয় | বলা  বাহুল্য  রুমা  সবসময়  তার  বোনের  দিকেই  ঝুলে  থাকে | তানাহলে  তো  আবার  তার  মুখ  ফুলে  লাল  হয়ে  যায় | বাড়িতে  ফিরে  তো  দিদি  আর  জিজুকে  জব্দ  করার  একমাত্র  উপায়  'খাবোনা' - বলে  শুয়ে  পড়া | সে  না  খেলে  যে  অন্য মানুষদুটিও  খেতে  পারেনা | স্বামী , স্ত্রী  দুজনেই  জানে  টুকুনের  এটা ঠিক  রাগ   নয়  | একটু  অভিমান | টুকুনও এতে  যেমন  মজা  পায় রুমা , শমিতও এই  মান অভিমানের  পালাটি  বেশ  উপভোগ  করে | নিঃসন্তান  জীবনে  টুকুনই  যেন  তাদের  জন্য  আলোর  বন্যা  নিয়ে  এসেছে |

Wednesday, April 22, 2020

একই রূপ

একই রূপ 
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

     বাথরুমে যাওয়ার পথে মায়ের ঘর থেকে এতো রাতে কথা শুনে অতসী একটু চমকেই গেলো।মা কাকে যেন বলছেন,"এ বিয়ে যেভাবেই হোক তোমায় আটকাতে হবে।তুমি তোমার ছেলেকে যা বলার বলবে।এই ব্যপারে আমি মেয়ের সাথে কোন কথা বলতে পারবোনা।এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।সম্পর্কে ওরা ভাই-বোন।এ বিয়ে হতে পারেনা।"এই কথা শুনে অতসী আর সেখানে দাঁড়ায়না। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে।অরিন্দম সম্পর্কে তার দাদা?ভাবতেই পারছেনা।মা সধবার বেশে থাকেন ঠিকই কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছে তার বাবা অফিসের কাজে বাইরে যেয়ে আর ফিরে আসেননি।খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু খবর পাওয়া যায়নি।আর এটাকেই সে সত্যি মনে করে বিশ্বাস করেছে।তারমানে মা তাকে মিথ্যা বলেছেন।বাবা এই শহরেই থাকেন তার ছেলের সাথে। 
       অরিন্দমের সাথে মাত্র দু'বছরের আলাপ।ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে।মাকে সবকিছু জানানোয় মা অরিন্দমকে দেখতে চেয়েছিলেন।অরিন্দমের সাথে আলাপচারিতায় মা তার বাবার নাম ও বাড়ি কোথায় জেনেই কেমন গুম মেরে যান। আর কোন কথা না বলে শরীর খারাপ লাগছে এই অজুহাতে ঘরে চলে যান।অরিন্দম চলে যাওয়ার পর সে মায়ের ঘরের কাছে এসে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।কয়েকবার ডাকার পর তিনি সাড়া দিয়ে বলেন,"একটু ঘুমালেই শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে।তুমি ডিনার সেরে নাও।আমি আজ আর কিছু খাবোনা।আর আমাকে বিরক্ত কোরোনা এসে।"
       নীতাদেবী ফিরে যান একুশ বছর আগের জীবনে।তখন ছেলে অরিন্দমের বয়স চার আর অতসীর ছ'মাস।সুখি সংসার।নীতাদেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা আর তার স্বামী ছিলেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে।দূর সম্পর্কের এক বোন থাকতো দু'জন বাইরে বেরিয়ে গেলে বাচ্চাদু'টিকে সামলানোর জন্য।একদিন সকালে দু'জনে একসাথেই যে যার অফিসে বেরিয়ে যান।স্কুল থেকে ফিরে এসে বারবার বেল বাজিয়েও কোন লাভ না হওয়ায় ফ্লাটের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তিনি ঘরে ঢুকে সোজা দোতলায় নিজের ঘরে চলে যান।অরিন্দম ও অতসী তখন নিচের বেডরুমে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু তিনি তার বেডরুমে ঢুকে যা দেখেন তা তিনি কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেননি।রূপা  তার খাটের উপর আর পাগলের মত আভাষ তাকে ইচ্ছেমত ছিড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে।আপ্রাণ চেষ্টা করছে রূপা নিজেকে রক্ষা করার ওই পশুটার হাত থেকে।কিন্তু পারছে কোথায়?নীতাকে দেখতে পেয়ে রূপা চিৎকার করে ওঠে, "দিদি তুমি আমাকে বাঁচাও।"হাতের কাছে একটা পিতলের ফুলদানী ছিলো।রাগে ঘেন্নায় সেটা দিয়ে সজোরে আভাষের পিঠে নীতা আঘাত করে।আভাষ আ-আ-আ-বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠে।রূপা দৌড়ে এসে নীতাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,"দিদি, জামাইবাবু আজ এতো ড্রিংক করেছেন তার কোন জ্ঞানই নেয়।আমি অনেক কাকুতিমিনতি করেছি।উনি শোনেননি।জ্ঞান থাকলে তো শুনবেন!"
       সেই মুহূর্তে বাচ্চাদু'টিকে আর রুপাকে সাথে নিয়ে ঘর ছেড়েছে নীতা।পরে বহুবার আভাষ এসেছে ক্ষমা চেয়ে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।কিন্তু নীতা  যায়নি।অরিন্দমকে একটা ভালো বোডিং স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল নীতা।কিন্তু আভাষ কেস করে সন্তানদের তার কাছে রাখার জন্য।রায় বেরোয় যেহেতু দুটি সন্তান তাই ছোটটি থাকবে মায়ের কাছে আর বড়টি তার বাবার কাছে।রায় বেরোনোর পর একবারই মাত্র নীতা ছেলেকে দেখতে বোডিং স্কুলে গেছিলো।তারপর আর কখনো যোগাযোগ রাখেনি। 
         আজ এতোগুলো বছর বাদে নীতা  বাধ্য হলেন আভাষকে ফোন করতে। আর এদিকে সারাটা রাত ছটফট করতে করতে ভোর হওয়া মাত্র মায়ের ঘরের ল্যান্ডফোনে রিডায়াল করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে আভাষ চৌধুরীর সাথে কথা বলে সকালেই পৌঁছে যায় অতসী তার বাবার বাড়ি।ঘরে ঢুকেই সে আভাষ চৌধুরীর সামনাসামনি হয়ে প্রথমেই যে কথাটা বললো তা হোল, 
---আমি নীতা চৌধুরীর মেয়ে।কাল পর্যন্ত আমি জানতামনা আমার বাবা কে?শুধু নামটাই শুনেছিলাম।আপনাদের মধ্যে কি হয়েছিলো আমি বা আমার দাদা জানিনা।কিন্তু আমরা দু'জনেই কেউ পিতৃস্নেহ কেউবা মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি।পৃথিবীতে যা কখনোই সম্ভব নয় ঠিক তেমনই একটি ঘটনা আমার ও আমার দাদার জীবনে ঘটেছে।এসবকিছুর জন্য আপনি না মা দায়ী আমি জানিনা।মাকে যতটুকু জেনেছি তিনি তার সংসার জীবনে কখনোই কোন অন্যায় করেননি।আর বাকি থাকলেন আপনি!এখন আমরা বড় হয়েছি নিশ্চয় জানার আমার  অধিকার আছে কি এমন ঘটেছিলো যে মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো? 
       এতক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো তিনি শুনছিলেন।মেয়েটিকে দেখতে তার নিজের মত হলেও সাহস ও কথা বলার ভঙ্গিমাটা পুরো তার মায়ের মত।তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়ের মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, 
---একুশ বছর আগে যে ঘটনার জন্য তোমার মাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো তারজন্য সম্পূর্ণভাবেই আমি দায়ী।অনেকবার তোমার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।কিন্তু অত্যন্ত জেদী তোমার মা।যা আমি জ্ঞানে করিনি তা জানা সত্বেও তিনি আমায় ক্ষমা করেননি।আমি অনুতপ্ত।কিন্তু সবকিছু আমার হাতের বাইরে ছিলো।পারলে আমায় ক্ষমা কোর। 
---আমি এখানে এসেছিলাম মা যেন না জানেন।দাদাকে যা বলার আজই তাকে বলে দেবেন।সে ইচ্ছা করলে মাকে দেখতে যেতেই পারে।তবে আমার সাথে আর কখনোই আপনাদের দেখা হবেনা।কথাগুলো বলে অতসী গটগট করে হেঁটে চলে গেলো।আভাষ চৌধুরী একুশ বছর আগের জেদী,একরোখা নিতা কে যেন পূণরায় দেখতে পেলেন। 

                  শেষ