সময় কথা বলে
সকাল থেকে নন্দিনীর দম ফেলবার ফুসরৎ নেই | আজ তার শ্বাশুড়িমা আসবেন তার কাছে | এখন থেকে তিনি এখানেই থাকবেন | সেও তো বিয়ের পরেই তাই চেয়েছিলো |ছোটবেলায় নিজের মাকে হারিয়েছে তাই শ্বাশুড়িমাকে নিজের মায়ের জায়গাটা দেবে | গাল ভরে মা বলে ডাকবে | স্কুলে পড়ার সময় সকল বন্ধুদের মায়েরা যখন তাদের নিতে আসতো সে হা করে তাকিয়ে থাকতো আর মনেমনে ভাবতো ' সকলের মা আছে আমার মা কেন যে হারিয়ে গেলো ' --- বাবা , মামা আর মামী যার কাছেই মায়ের কথা জানতে চেয়েছে সেই তাকে বলেছে ,
" তোমার মা হারিয়ে গেছে কিন্তু তুমি যখন বড় হবে তোমার মা আবার আসবেন ' - পরে যখন বুঝতে শিখেছে তখন থেকে মায়ের কথা আর কোনদিন কারও কাছে জানতে চায়নি | আরও বড় হওয়ার পরে জেনেছে তার মা তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে নিজেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে |
জম্মের পর থেকে সে মামা বাড়িতেই মানুষ | বাবা মাঝে মাঝে আসতেন তাকে দেখতে | বাবা মায়ের মৃত্যুর দুবছরের মাথায় আবার বিয়ে করেন | তারপর থেকেই বাবার তাকে দেখতে আসা আস্তে আস্তে কমতে থাকে | নিঃসন্তান মামা মামী তাকে তাদের সন্তান স্নেহেই মানুষ করেছেন | বিয়েও দিয়েছেন তারাই দেখাশুনা করে |
সব মেয়েরাই শ্বশুরবাড়িতে পা রাখে দুরুদুরু বুকে | সংসারে স্বামী আর শ্বাশুড়ি | নন্দিনীর কোথাও যেন নিজের প্রতি এক আস্তা ছিল শ্বাশুড়ির মন সে জয় করে নেবে তার কাজ ও সেবা দিয়ে | কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তার এই ধারণা যে ভুল তার প্রমাণ সে পায় | সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে করেও শ্বাশুড়ির গালমন্দের হাত থেকে সে রেহাই পায়না | সবকিছুতেই একটা খুদ ধরা তার যেন স্বভাব | বিনা কারণেই আঘাত দিয়ে কথা বলেন | একদিন হঠাৎ বলে বসলেন ,
" জম্মের পরে যে মেয়ে মাকে খেয়েছে সে শিক্ষাদীক্ষা আর পাবে কোথা থেকে ? কাজ শুধু করলেই হয়না তারও একটা শ্রী থাকার দরকার |" স্বামী অনুপ খুব রাগী মানুষ তাই তাকে সে কোনদিনও এসব কথা জানাতোনা কারণ বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে | মাকে তো আর সে ফেলে দিতে পারবেনা | এইসব সাতপাঁচ ভেবে সে কোনদিন তাকে কিছুই জানায়নি | এভাবে দু'বছর কেটে যাওয়ার পর নন্দিনী যখন নমাসের অন্তঃসত্বা একদিন সন্ধ্যায় অনুপ একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে এসে গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে শোনে মা নন্দিনীকে সন্ধ্যায় শুয়ে থাকতে দেখে বলছেন ,
-- বাড়িতে লক্ষ্মী ঢুকবে কেমন করে এইরূপ অলক্ষ্মীর মত সন্ধ্যায় শুয়ে থাকলে ? তা হেঁসেলের কাজগুলো কি এমনি এমনিই হবে ? সারাটাদিন অফিসে গাধার মত পরিশ্রম করে ছেলেটা আমার ঘরে ফিরবে তাকে কে জলখাবার দেবে শুনি ?
অনুপ ধীরপায়ে ঘরে ঢোকে | তাকে দেখে তার মা ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন |
--- তুই এতো তাড়াতাড়ি ?
--- ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি এসেছিলাম নাহলে তো তোমার আসল রূপটাই সারাজীবন আমার কাছে ঢাকা পরে থাকতো |
' অনুপ '- বলে চিৎকার করে ওঠেন তার মা |
--- এখন যাও তুমি এখান থেকে |
এগিয়ে যায় সে নন্দিনীর খাটের কাছে | বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও কোন সারা না পেয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে বেহুস হয়ে সে পরে আছে | ডাক্তারকে ফোন করে তার কথামত তাকে নার্সিংহোম ভর্তি করে | তিনদিনের মাথায় তার জ্বর কমে | সিজারের পর তাকে নিয়ে অনুপ আর তার মায়ের কাছে ফিরে আসেনা | বাড়ি সে আগেই দেখে রেখেছিলো ছেলে ও নন্দিনীকে নিয়ে সে তার ভাড়া করা বাড়িতেই উঠে যায় | নন্দিনী বহুবার তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছিল | জবাবে সে জানিয়েছিল কিছুদিন মায়ের চোখের আড়ালে থাকলে মা তার ভুল বুঝতে পারবেন | কিন্তু তিনবছরেও মায়ের ভুল ভাঙ্গেনি | মায়ের সাথে অফিস ছুটির পর দেখা করে তবে সে তার ভাড়া করা বাড়িতে ফেরে | মাসের প্রথমেই মায়ের হাতে তার সংসার খরচের টাকা দিয়ে যায় | তাছাড়া ওষুধপত্র সে নিজেই কিনে দিয়ে যায় | কিন্তু এই তিনবছরে নাতির কথা জানতে চাইলেও বৌমার কথা ভুলেও মুখে আনেননি |
আচমকা অনুপের অফিসে দুপুরবেলায় পাশের বাড়ির বৌদির ফোন যায় বাথরুমে পরে গিয়ে অনুপের মা কোমরে চোট পেয়েছেন | তড়িঘড়ি অনুপ বাড়িতে এসে মাকে নিয়ে নার্সিংহোম ভর্তি করে | পরদিন নন্দিনী দেখতে আসে | কোমরের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় এই বয়সে অপারেশনের ঝুঁকি নিতে ডক্টর রাজি নন | অগত্যা ট্রাকশন দিয়ে রাখা | দিনপনের নার্সিংহোম থাকার পর অনুপ ও নন্দিনী মাকে তাদের কাছে নিয়ে আসে | নন্দিনী মনপ্রাণ ঢেলে শ্বাশুড়ির সেবাযত্ন করতে লাগে | টুকটাক কথাবার্তা হয় প্রয়োজনে | একদিন তিনি নন্দিনীর হাতদুটি জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন |
--- আমাকে ক্ষমা করে দে মা অনেক অত্যাচার করেছি তোর উপর | আসলে আমার শ্বাশুড়িমা আমার উপর বিনা কারণে চড়াও হতেন | দিনরাত আমায় খোঁটা দিয়ে কথা বলতেন | খুব কষ্ট পেতাম | তোর শ্বশুরকে বললে তিনি কোন প্রতিবাদ করতেননা | যতদিন আমার শ্বাশুড়ি বেঁচে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত চোখের জল না ফেলে আমি ভাতের গ্রাস মুখে তুলিনি | এতগুলো বছর বাদে তোর উপর সেই রাগ দেখাতাম | আমার মাথা গরম থাকার ফলে তোর কোন গুনই আমার চোখে ধরা পড়তোনা |
--- এভাবে বলবেননা মা | আপনি আমার গুরুজন | আমি জম্মের পরেই মাকে হারিয়েছি | কোনদিন মা বলে কাউকে ডাকতে পারিনি | আপনাদের বাড়িতে এসে আপনাকে মা ডেকে সেই স্বাদ আমার মিটেছে |
--- তুই আমার ঘরের লক্ষ্মী | অনুপকে বলিস আমরা আমাদের বাড়িতেই ফিরে যাবো | আমার ভুল আমি স্বীকার করছি | তোরা আমায় ক্ষমা করে দে | কালই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা কর |
--- তাই হবে মা | আপনার ছেলে আসলে আমি কথাটা বলবো | এখন আপনি চুপ করে একটু ঘুমান |
No comments:
Post a Comment