Sunday, March 8, 2020

এ যুগের শ্বাশুড়ি

  
     
   
 এ  যুগের  শ্বাশুড়ি  

   -- বলি  ও  গিন্নি  এবার  বেরোও অনেক  দেরি  হয়ে  গেছে  এমনিতেই  | শুভক্ষণ  থাকতে  থাকতে  তো  সেখানে  পৌঁছাতে  হবে  |
-- বাবা , আমি  রেডি  |
 সমরবাবু  তাকিয়ে  দেখেন  তার  অষ্টাদশী  মেয়ে  জিন্স  আর  টিশার্ট  পরে  দাদার  আশীর্বাদে  যাবে  বলে  সেজেগুজে  চলে  এসেছে  |
 -- আজকের  দিনে  তুই  এই  ড্রেসটা  না  পড়লেই  পারতিস  | বাঙ্গালীর সাংস্কৃতি বলে  তো  একটা  কথা  আছে  | যা  মা  ঘরে  গিয়ে  শাড়ি  বা  চুড়িদার  পরে  আয় |
-- আমি  তো  এই  ড্রেস  পরেই সবজায়গায়  যাই  | তবে  আজ  পড়লে  অসুবিধা  কোথায়  ?
--- কইগো  চলো  আমার  হয়ে  গেছে  | এতক্ষণ তো  চেঁচাচ্ছিলে  দেরি  হয়ে  যাচ্ছে  বলে  , আমার  তো  ছেলেটার  জন্য  দুটি  ফুটিয়ে  বেরোতে  হবে  --- ওই  বাড়িতে  আমরা  নাহয়  আজ  ভালোমন্দ  খাবো  --- আরে হা  করে  দাঁড়িয়ে  --
-- দেখো  তোমার  মেয়ের  ড্রেস  | যাবো  ওর  দাদার  বিয়ের  আশীর্বাদ  করতে,  বললাম  ছোটদের  যেতে  নেই  , যদিবা  রাজি  হলাম  উনি  ওয়েস্টার্ন  ড্রেস  পরে  চলে  এলেন  --|
 এতক্ষণে সাবিত্রীদেবী  মেয়ের  দিকে  তাকিয়ে  দেখলেন  তার  পোশাক  |
--- এখন  সকলেই  এই  পোশাক  পরে  | তবে  হ্যা  আজ  না  পড়লেই  পারতো  | খারাপ  কিছু  লাগছেনা  | আমরা  আর  আমাদের সমাজের   যতই  উন্নতি  হোকনা  কেন  কিছু  কিছু  জায়গায়  আমরা  আজও আমাদের  বাঙালীয়ানাকে  অস্বীকার  করতে  পারিনা  | বিদেশী  কালচার  আজ  আমাদের  প্রতিটা  পরিবারের  মধ্যে  ঢুকে  পড়েছে  | ওয়েস্টার্ন  পোশাক  আর  খাবার  যতই  খাইনা  কেন  আজও আমাদের  কিছু  কিছু  অনুষ্ঠান  আছে  যেখানে  এগুলো  একটু  বেমানান  লাগে  কিছু  মানুষ বিরূপ  সমালোচনাও  করে  থাকে  | তাই  জায়গা  বুঝে  পোশাকআশাক  পরাই ভালো  | তবে  তোমাকেও  বলে  রাখছি  আমি  তুমি  কিন্তু  ভেবোনা  তোমার  বৌমাটি এসে  কাপড়  পরে  ঘোমটা  দিয়ে  ঘুরঘুর  করে  বেড়াবে  |
-- আরে ঘরের  বৌ  শাড়িতেই  মানাই -- গিন্নির  উদ্দেশ্যে  কথাগুলি  ছুড়ে  দিলেন  সমরবাবু  | 
--- সে  দেখা  যাবে  এখন  চলো  | দিদি  আবার  পথের  মাঝখানে  দাঁড়িয়ে  থাকবে  | দূর্গা  দূর্গা  করে  এখন বেরিয়ে  পড়ি  | বলি  ও  বাবু  , দরজাটা  দে  --
 ছেলের  উদ্দেশ্যে  হাক পারলেন  |
  একমাত্র  বড়  ননদ  শিবানী  | তিনি  বালিগঞ্জ  থাকেন  | ভগ্নিপতির  শরীর  খারাপ  থাকাতে তিনি  যেতে  পারবেননা  | সমরবাবুরা  বেহালায়  থাকেন  | তারা  যাওয়ার  সময়  দিদিকে  নিদ্দিষ্ট  জায়গা  থেকে  তুলে  নেবেন  বলেই  কথা  হয়েছে  আর  সমরবাবুর  একছেলে  একমেয়ে  | মেয়ে সঞ্চালি  এবার  কলেজে  ভর্তি  হয়েছে  ইংলিশে  অনার্স  নিয়ে  আর  ছেলে  সুখময়  একটি  মাল্টিন্যাশনাল  কোম্পানিতে  আছে  | অফিস  থেকে  পাঁচ  বছরের  জন্য  সিঙ্গাপুর  যাওয়ার  কথা  হচ্ছে  তাই  তড়িঘড়ি  ছেলের  বিয়েটা  দিয়ে  দিচ্ছেন  সমরবাবু  | তার  মনে  আবার  ভয়  রয়েছে  ছেলে  কোন  বিদেশিনীকে  বিয়ে  করে  নিয়ে  না  আসে  | এ  পর্যন্ত  তিনি  অনেক  মেয়েই  দেখেছেন  কিন্তু  বিয়ের  পর  কোন  মেয়ের  বাপ মা  ই  তাদের  মেয়েকে  অত দূরে পাঠাতে  রাজি  হননি  | শেষে  ভগ্নিপতির  সহায়তায়  এই  মেয়েটি  পছন্দ  হয়  আর  পরিবারটিও  রাজি  হয়  মেয়ে  জামাই  বাইরে  গেলে  তাদের  কোন  আপত্তি  নেই  এতে  বরং তারা  খুশিই  হবেন |
  জোরকদমে  বিয়ের  তোড়জোড়  শুরু  হল  | সাবিত্রীদেবী  একদিন  মেয়েকে  ডেকে  বললেন  ,
--- শোন  মা  আজ  বিকালে  আমি  আর  তুই  একটু  শপিংয়ে  যাবো  | কাউকে  কিছু  বলবিনা  |
--- কেন  মা ? কি  কিনতে  যাবো  ?
--- সে  গেলেই  দেখতে  পাবি  | বাবাকে  কি  বলবে  ?
--- ও  নিয়ে  তোকে  কিছু  ভাবতে  হবেনা  |
   শপিংমলে  ঢুকে  একটা  কাগজের  চিরকুট  মেয়ের  হাতে  ধরিয়ে  বললেন , "একটু  ভালো  দেখে  এই  তুই  যেমন  ড্রেস  পরিস এইরকম  দুচারটে  ড্রেস  কেন  তো  |
-- এগুলো  কার  মা  ?
--- এতো  প্রশ্ন  করিস কেন  বলতো ? এগুলো সব  তোর  বৌদির  |
--- বৌদির  জন্য  জিন্স , টিশার্ট , ল্যাগিস, কুর্তা    এইসব  কিনবে  ?
--- কেন  অসুবিধা  কোথায় ? তুই  যদি  পরতে পারিস সে  পরলে দোষ  কোথায় ? ওহ  তুই  নিজের  মেয়ে  আমার  পেটে হয়েছিস  আর  ও  পরের  মেয়ে  অন্যের  পেটে হয়েছে  সেই  কারণে ?
--- আরে না  , আমি  সেসব  কিছু  মিন  করে  বলিনি  | আচ্ছা  মা  কখন  আনলে  তুমি  বৌদির  এই  মাপগুলো  ?
--- আরে আশীর্বাদে  যাওয়ার  আগেই  আমি  ওকে  একদিন  ফোন  করে  বলে দিয়েছিলাম  দোকানে  গিয়ে  মাপগুলো  লিখে  আনতে | ও  রেডি  করে  রেখেছিলো  তোরা  যখন  তিনজন  বেরিয়ে  গেলি  আমি  বাথরুমে  যাওয়ার  নাম  করে  ভিতরে  ঢুকলাম  না ? ওই  তখনই মাপটা  আনতে গেছিলাম  | জানিস  মুক্তা আমার  হাতে  কাগজটা  দিয়ে  জড়িয়ে  ধরে  সে  কি  আদর  | আর  বলে,  'আমার  খুব  চিন্তা  ছিল  ; আমি  তো  শাড়ি  পরতেই পারিনা  | আজ  কদিন  ধরে  মা শাড়ি  পরা শেখাচ্ছেন  | সত্যি  তুমি  খুব  ভালো  মামনি  |'
-- তোমায়  মামনি  বললো  ?
--- হ্যাঁ তাই  তো  বললো  -- আর  ওর  মা  কি  খুশি  | আমায়  জড়িয়ে  ধরে  বললো  ,' বুকের  উপর  থেকে  একটা  ভারী  পাথর  নেমে  গেলো  দিদি  | একমাত্র  মেয়ে  আমার  | খুব  চিন্তায়  ছিলাম  ওর  শ্বশুরবাড়ি  কেমন  হবে  তাই  নিয়ে  | যেদিন  আপনি  ফোন  করে  ওকে  দোকানে  গিয়ে  মাপগুলি  আনতে বললেন  সেদিনই   বুঝতে পেরেছি   কোন  ভুল  আমরা  করিনি  | জম্মের  পর  থেকে  মেয়েকে  মানুষ  করে  পরের  হাতে  তুলে  দিতে  যে  কত  কষ্ট  তা  যার  মেয়ে  নেই  সে  কোনদিনও  বুঝবেনা  |'
   বিয়ে  হয়ে  গেলো  সুখময়  ও  মুক্তার  | বৌভাতের  দিন  সকালবেলা  ভাত কাপড়  দেওয়ার  সময়  দু ট্রে ভর্তি  জামাকাপড়  আর এক   থালাতে  মাছ , ভাত ,মিষ্টি  ,পায়েস , পঞ্চব্যঞ্জন  | জামাকাপড়ের   ট্রেটায় সকলের  নিচুতে  কাপড়টা  আর  উপরের  দিকে  জিন্স , চুড়িদার  | এক  প্রতিবেশী  কিছু  বলতে  গেলে  সাবিত্রীদেবী  বলে  ওঠেন  ,
--- এখনকার  মেয়েরা  কাপড়  খুব  কম  পরে  | তাই  যে  পোশাক  তারা  পরে  সেগুলিই  তো  দেওয়া  হয়েছে  | নিয়ম  রক্ষার্তে  একটি  তাঁতের  শাড়ি  তো  আছে  | তারা  যা  পরে  বা  পরতে ভালোবাসে  বিয়ের  সাথে  সাথে  সবকিছু  জলাঞ্জলি  দিয়ে  আজকের  যুগেও  ঘোমটা  পরা বৌ  হয়ে  থাকতে  হবে  | আমাদের  সময়ে  আলাদা  ব্যাপার  ছিল  | কিন্তু  আজকের  দিনের  মেয়েরা  ঘরে  বাইরে  সমান  পাল্লা  দিয়ে  চলেছে  | আমরা  আমাদের  সময়ে  সুখস্বচ্ছন্দ সবকিছু  ভুলে  পরের  বাড়িতে  এসে  তাদের  সুখস্বচ্ছন্দকেই  আপন  করে  নিয়েছি  | যুগের  পরিবর্তন  হয়েছে  | আমাদের  মানসিকতারও  তো  পরিবর্তন  আনতে হবে  | আমার  মেয়েটি  জিন্স  পরে  স্বচ্ছন্দে  ঘুরে  বেড়াচ্ছে  সেটা  যদি  আমার  চোখে  দৃষ্টিকটু  না  লাগে  ছেলের  বৌটি  পরলে মেনে  নিতে  পারবোনা  কেন ? মেয়ের  বিয়ে  দিয়ে  জামাইকে  ছেলে  ভাবতে  পারবো  , ছেলের  বিয়ে  দিয়ে  তার  বৌটিকে  মেয়ে  ভাবতে  পারবোনা কেন ? আর  এটা কেউ  ভাবতে  পারেনা  বলেই  শ্বাশুড়ি  বৌয়ের  ঝামেলাটা  লেগেই  থাকে  | যাগকে এসব  কথা  | এবার  দে  দেখি  বৌমাকে  ভাত কাপড়টা  দে  | 
  আত্মীয়স্বজন , পাড়াপ্রতিবেশীরা  এর  ওর  মুখের  দিকে  তাকাচ্ছে  ঠিকই  কিন্তু  মুখে  তাদের  কোন  কথা  নেই  | কারণ  সাবিত্রীদেবীকে  পাড়ার  বৌঝিরা  একটু  এড়িয়েই  চলে  | অনেকেই  তার  অনুপস্থিতিতে  তাকে  ঠোঁটকাটা  বলে  সম্মোধনও  করে  থাকেন  | সোফায়  বসে  থাকা  সমরবাবুর  কানে  সবই  গেলো  | কিন্তু  তিনিও  কোন  বাক্য ব্যয়  করলেননা  | কারণ গিন্নির  কথাগুলো  তার আজ   যুক্তিগ্রাহ্য  বলেই  মনে  হল  | তিনি  অনুষ্ঠান  মিটে গেলে  হাসিমুখে  সেখান  থেকে  উঠে  যেতে  যেতে  মনেমনে  বললেন, 'গিন্নি  তোমার  মত  একটি  শ্বাশুড়ি  যেন  আমার  মেয়েটিও  পায়|'

       
 

No comments:

Post a Comment