#আমার_লেখনীতে
বোঝার ভুল
ভগ্নিপতি ও দিদির সাথে কফিশপে কফি খেতে খেতে বারবার একজন সুন্দর সুপুরুষের সাথে চোখাচোখি হয় শ্রেষ্ঠার | খুব যেন চেনা চেনা লাগছে শ্রেষ্ঠার | কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেনা | ভদ্রলোকটিও কারনে অকারনে ওর দিকে তাকাচ্ছে | তবে কি উনিও তাকে চেনেন ?
মানুষের একটি স্বভাবজাত ধারণা যদি সে খুব জানা বিষয় হঠাৎ করে মনে করতে না পারে সেটি যতক্ষন পর্যন্ত মনে না পরে তা মাথার মধ্যে ঘুরতেই থাকে | শ্রেষ্ঠার ও ঠিক তাই হল | সারা সন্ধ্যা ভেবে কোন কিছুই তার মনে পড়লোনা | বাবা ও মা মারা যাওয়ার পর দিদি জামাইবাবু তাকে তাদের সন্তান অয়ন্তীর সাথে আলাদা চোখে দেখেনি | অয়ন্তীর সাথে বয়সের পার্থক্য দশ বছরের | তবুও মাসি বোনঝি যেন দুই বন্ধু | মাসিকে অয়ন্তী তুই সম্মোধনেই কথা বলে | দিদি , জামাইবাবু অনেক নিষেধ করেছে | কিন্তু শ্রেষ্ঠা অয়ন্তীকে তুই বলেই কথা বলতে বলেছে | একাদশ শ্রেণীতে পড়া অয়ন্তী ও কলেজ প্রফেসর শ্রেষ্ঠা একই ঘরে থাকে | মাসিকে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত দেখে অয়ন্তী জানতে চায় ,
--- কি হয়েছে বলতো তোর আজ ?
--- আর বলিসনা | আজ সন্ধ্যায় আমরা যখন বেরিয়েছিলাম তখন কফিশপে এক ভদ্রলোককে খুব চেনা লাগছিলো | কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিনা |
অয়ন্তী লাফ দিয়ে উঠে বসে মাসির গলা জড়িয়ে ধরে বলে ,
--- চোখ বুঝে চিন্তা করে দেখ মাসি ওটা তোর পুরানো প্রেমিক |( ফিক ফিক করে হাসতে থাকে অয়ন্তী )
--- তুই বড্ডো পেকেছিস | দাঁড়া কাল তোর বাবাকে বলতে হচ্ছে তোর মাথায় প্রেমের পোঁকা ধরেছে |
অয়ন্তী ঘুমিয়ে পড়লেও কিছুতেই শ্রেষ্ঠার ঘুম আসেনা | সে উঠে বেড সুইচের আলোতে আলমারি খুলে কলেজ লাইফের বন্ধুদের সাথে তোলা ছবির এলবামটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে পুরনো ছবিগুলি দেখতে বসে | ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবিতে এসে তার চোখ আটকে যায় | ' হ্যা এই ছবিটার সাথে আজকের দেখা ভদ্রলোকটির মুখের মিল আছে | তবে কি ও সুরভীর দাদা দেবারুন ?দেবারুন তাহলে আমায় চিনতে পেরেই বারবার দেখছিলো ?" না আজ অনেক রাত হয়ে গেছে | কালই সুরভীকে একটা ফোন করতে হবে | সুরভী তো বলেছিলো ওর দাদা এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে | আর দেশে ফিরবেনা বলেছে |
তখন শ্রেষ্ঠার ক্লাস নাইন | সুরভী আর শ্রেষ্ঠা দুজন প্রাণের বন্ধু | কারনে অকারনে একই পাড়ায় থাকার ফলে দুজনের বাড়িতে দুজনের ছিল অবারিত দ্বার | সুরভীর দাদা ছিল খুব গম্ভীর | সে তখন সবে ডাক্তারীতে ভর্তি হয়েছে | শ্রেষ্ঠাও তাকে দাদা বলেই ডাকতো | শ্রেষ্টারা দুই বোন | ভাইফোঁটার দিনে সুরভী যখন ওর দাদাকে ফোঁটা দিত তখন খাটের উপর বসে শ্রেষ্ঠা দেখতো আর ভাবতো ইস আমার যদি একটা দাদা বা ভাই থাকতো তাহলে আমিও ফোঁটা দিতে পারতাম | সুরভী ওর মনের কথাটা হয়তো টের পেয়েছিলো | তাই বলেছিলো ,
--- তুই তো আমার দাদাকেই ফোঁটা দিতে পারিস |
কিন্তু দেবারুন সেদিন রাজি হয়নি শ্রেষ্ঠার হাত থেকে ফোঁটা নিতে | বলেছিলো ,
--- সবার হাত থেকে ফোঁটা নেওয়া যায়না|
খুব কষ্ট পেয়েছিলো শ্রেষ্ঠা সেদিন | কিন্তু একবারও তার মনে আসেনি কেন দেবারুন তার কাছ থেকে ফোঁটা নেয়নি | আর ঠিক তার পর থেকেই শ্রেষ্ঠা সুরভীদের বাড়িতে যেত যখন ওর দাদা থাকতোনা | সে অনেক বছর আগের কথা | স্বাভাবিকভাবেই দেবারুনের মুখটা তার কাছে ঝাপসা হয়ে গেছে | দেবারুন যখন ডাক্তারী পাশ করে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যায় শ্রেষ্ঠা তখন গ্রাজুয়েশন করছে | ওর সাবজেক্ট ছিল কেমিস্ট্রি | দেবারুন চলে যাওয়ার আগে সুরভী তাকে জানিয়েছিল দাদা তার সাথে দেখা করতে চায় | কিন্তু শ্রেষ্ঠা দেখা করতে যেতে পারেনি কারন সেদিনের অপমান সে ভুলতে পারেনি আর মায়ের শারীরিক কন্ডিশনও ভালো ছিলোনা | কথায় কথায় সুরভী তাকে বহুবার জানিয়েছে দাদা বিয়ে করেনি কারণ সে একটি মেয়েকে ভালোবাসতো আর মেয়েটি তাকে পাত্তাই দিতোনা | আজ এখন মনে হচ্ছে নিশ্চয় বিয়ে করার জন্য তার দাদা এবার দেশে ফিরেছে |
সকালে সুরভীকে ফোন করে জানে তার দাদা মাসখানেকের জন্য দেশে ফিরেছে | দাদা যে মেয়েটিকে ভালোবাসতো ঘটনাক্রমে তারও বিয়ে হয়নি | সে এবার তার মনের কথা তাকে জানাবে বলেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ | দাদা তোর কথা বলছিলো যদি পারিস একবার দেখা করে যাস |
মার্চের মাঝামাঝি সময় | দোল উৎসবের কারনে দুদিন কলেজ ছুটি | যে দেবারুনের অপমান আজও শ্রেষ্ঠা ভুলতে পারেনি সেই দেবারুনকে দেখার জন্য এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলো | ফোনেই সুরভীকে ও জানিয়ে দিলো আজই যাবে কারণ আগামীকাল দোল তারপরেই তো কলেজ | সেইমত সকালে দিদিকে বলে সে সুরভীর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো | মাসচারেক আগে সুরভীর সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে | বাচ্চাটিকেও দেখতে যাওয়া হয়নি এতদিনে | সে পুচকেটার জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনলো | সেই সঙ্গে একটা রঙ্গের প্যাকেটও কেনে | কলিংবেল বাজাতে সুরভীর দাদা দেবারুনই এসে দরজা খুলে দেয় |
--- ভিতরে এসো , তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি |
শ্রেষ্ঠা একটু অবাক হয়েই জানতে চাইলো ,
--- আমার জন্য ? বেশ মজা লাগলো শুনে
কথাটা বলে একটু হেসে দিয়ে সুরভীর বেডরুমে ঢুকে গেলো | পিছন পিছন দেবারুনও |
--- কোথায় রে আমার ছোট্ট মামনিটা ?
--- মাসিকে বলো কত্ত বড় হয়ে গেছি আমি আর এখন এসেছো আমায় দেখতে
সুরভী মেয়েকে শ্রেষ্টার কোলে দিতে দিতে কথাটা বলে |
--- নারে বিশ্বাস কর একদম সময় পাইনা |
সুরভী চা করার জন্য উঠে পরে | যাওয়ার সময় বলে যায়
--- আমি আসার আগেই দাদা তোর কাজটা সেরে ফেলিস | এরপর আমরা আবির খেলবো |
কিছুক্ষণ দু'জনেই চুপচাপ | দেবারুনই প্রথম কথা বলে ,
--- সুরভীর কাছে শুনেছি তুমি কলেজে পড়াও | কেমন চলছে তোমার দিনগুলি? ( উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারও বলে ,
অনেক বছর আগে আমার ব্যবহারে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে আমি জানি | তখন তোমার বয়স খুব কম ছিলো তাই হয়তো বুঝতে পারোনি বা বুঝার চেষ্টাও করোনি | কিন্তু এখন চিন্তা করে দেখতো কেন সেদিন আমি তোমার হাত থেকে ফোঁটা নিইনি ? অথচ সুরভীর আর এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোঁটা নিয়েছিলাম | একটা ছেলে কি কারনে একটা সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে ফোঁটা নিতে চায়না ?
দেবারুনের মুখে একথা শুনে শ্রেষ্ঠার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো | লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নিচু করেই বসে থাকলো |
দেবারুন এগিয়ে গেলো ওর সামনে |
--- আজকে কিন্তু চুপ করে থাকবেনা | আজ আমায় উত্তরটা দিতেই হবে |
--- কি উত্তর দেবো সেটাই তো ভাবছি |
--- সেদিন কেন ফোঁটা নিতে চাইনি বুঝতে পেরেছো তো ?
মাথা নাড়িয়ে শ্রেষ্ঠা হ্যাঁ বলে |
--- এখন তো আমার উপর কোন রাগ নেই ?
শ্রেষ্ঠা হেসে ফেলে | এবার দেবারুন শ্রেষ্ঠাকে উঠে আসতে ইশারা করে | শ্রেষ্ঠা বাচ্চাটার কাছ থেকে উঠে আসার সাথে সাথে দেবারুন পকেট থেকে আবির বের করে শ্রেষ্ঠার গালে মাখিয়ে দেয় | আর বলে ,
--- এবার কিন্তু সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছি |
লাল আবির আর লজ্জা মিলেমিশে শ্রেষ্ঠা আজ দেবারুনের কাছে আরও মোহনীয় হয়ে উঠলো | মুখটা তুলে দেবারুন বললো
--- আমায় আবির দেবে না ?
--- আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা -- সেই কখন আমার চা হয়ে গেছে | তোদের কথাই শেষ হয়না | নে এবার চা খেয়ে নে তারপর বাকি কথা আর যত খুশি তোরা একে অপরকে রং মাখা (--- সুরভীর কথা বলার ধরণে ওরা দুজনেই হেসে ওঠে |) শোন আগে তুই ছিলি আমার বন্ধু এখন হবি আমার বৌদি | আমি কিন্তু বৌদি তৌদি বলতে পারবোনা | নাম ধরেই ডাকবো | কেন বলতো আমার দাদাটাকে এতদিন ধরে কষ্ট দিলি ? আসলে তোরও ঠিক দোষ না | আমার দাদাটাই বোকা | আরে ভালোই যখন বাসলি মুখ ফুঁটে তাকে বলতে পারলি না ? বিয়েই করবেনা বলে ধনুকভাঙ্গা পণ করে থাকলো | মা মাথার দিব্যি দেওয়াতে আর আমি শিওরিটি দেওয়াতে যে আমার বন্ধুকে তোর বৌ করবোই তবেই উনি ফিরলেন | অবশ্য এটাও গ্যারান্টি দিতে হয়েছে যে তুই এখনো কাউকে ভালোবাসিস না | তবে ও হরি আমি তো কোন কাজেই লাগলামনা |
এবার দেবারুন চেঁচিয়ে উঠলো ,
--- তুই থামবি ? তোর কিন্তু বড় কাজটা করতে হবে | তবে তোকে কথা দিচ্ছি ঘটকের ছাতাটা তোকে দিয়ে দেবো | ওরা তিনজনেই হেসে ওঠে আর সুরভী হাসতে হাসতে চায়ের ট্রেটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় আর এই সুযোগে শ্রেষ্টা কিছুটা আবির নিয়ে দেবারুনের গালে মাথায় লাগিয়ে দেয় | দেবারুন দুইহাতে শ্রেষ্ঠাকে বুকের সাথে চেপে ধরে |
No comments:
Post a Comment