শেষ পর্যন্ত
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
বহুদিন পর সুপমের সাথে রাস্তায় দেখা বৈশাখীর | সেই সুপম যে উচচমাধমিক পাশ করেই রেলে চাকরি পেয়ে গেছিলো | পোষ্টিং হয়েছিল কলকাতার বাইরে ভুবনেশ্বরে | তারিখটা ছিল ১২ই ফেব্রুয়ারি | ফোন করে বৈশাখীকে ধর্মতলা মেট্রোর কাছে দাঁড়াতে বলে | নিদৃষ্ট সময় ধরে সুপম কি বলতে পারে সেসব চিন্তাভাবনা না করেই বৈশাখী ওখানে পৌঁছে যায় | সুপম আসে | হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ | দুজনে গিয়ে ময়দানে বসে | কোন ভনিতা না করেই সুপম বলে ,
--- আজ রাতের ট্রেন | পড়াশুনা শেষের আগেই চাকরিটা পেয়ে গেলাম | প্রাইভেটে গ্রাজুয়েশনটা করে নেবো | নুতন চাকরি | হয়তো তাড়াতাড়ি আসতে পারবোনা | তাই আজ তোমায় আমার মনের কথাটা জানাতেই এখানে আসতে বললাম |
বলেই প্লাস্টিক ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটি টকটকে লাল গোলাপ বৈশাখীর সামনে ধরে | ঘটনার আকস্মিকতায় বৈশাখী পাথর হয়ে যায় | কারন তার মনে কোনদিন সুপমকে নিয়ে এসব কোন চিন্তা আসেনি | মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে | তাছাড়া বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে অনেক আগেই বাবা বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন | বাবা তাকে কোনদিন একথা না জানালেও মাধ্যমিক পাশ করার পর মা তাকে বলেছিলেন ,
-- তোমাকে একটা কথা বলে রাখি শিখু , এখন বড় হয়েছো | তাই কথাটা বলা | তোমার বাবা কিন্তু তার বন্ধুকে কথা দিয়েছেন তার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেবেন তুমি গ্রাজুয়েশন করার পর | এমন কিছু কোরোনা যাতে তুমিও কষ্ট পাও আর আমাদেরকেও কষ্ট দাও |
সেদিনই সে নিজের পায়ে নিজেই শিকল পরে নিয়েছিল | সুপমের সাথে বৈশাখীর পরিচয় কচিনসেন্টারে | খুব ভালো বন্ধু ওরা | অন্তত বৈশাখী তাই জানতো | কিন্তু আজ সুপমের এই পাগলামি দেখে বৈশাখী কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে হা করে সুপমের দিকে তাকিয়ে থাকে | সুপম গোলাপটা বৈশাখীর মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলে ,
--- আমি ভেবেছিলাম তুমিও বুঝি আমায় ভালোবাসো | চল আমরা উঠি | আর হয়তো কোনদিনও তোমার সাথে দেখা হবেনা | আজকের দিনটার জন্য আমি সরি |
সুপমই প্রথম দেখতে পায় বৈশাখীকে | একটা ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রজনীগন্ধার মালা কিনছে | কাছে এগিয়ে যায় |
--- ভ্যালেন্টাইন ডে তে মানুষ গোলাপ কেনে আর তুমি কিনছো রজনীগন্ধার মালা ?
-- সুপম তুমি ?কবে এলে কলকাতায় ?
--- এই দুদিন আগে | কেমন আছো বলো? শেষবার তোমার সাথে দেখা হয়েছিল ঠিক ১২ফেব্রুয়ারী আর আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী | মনেহচ্ছে ঠিক দুদিন আগেই তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে | বাড়ির সবাই কেমন আছেন ?
--- কেউ নেই | সবাই আমায় ছেড়ে চলে গেছে |
--- কি করছো এখন ?
--- আমি একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়াই |
--- বিয়ে করোনি কেন ?
--- সে এক ইতিহাস | এসো একদিন বলবো | তুমি বিয়ে করেছো ?
সন্তর্পনে কথাটা এড়িয়ে যায় সুপম |
--- কোথায় থাকো এখন আগের বাড়িতেই নাকি ---|
কথাটা শেষের আগেই বৈশাখী বলে ওঠে ,
--- তুমি আমার ফোন নম্বরটা রাখো | যেদিন আসবে ফোন কোরো ঠিকানা বলে দেবো |
রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুজনে প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট কথা বলে | পুরনো দিনগুলির কথায় যেন বেশি | দুদিন পর ছিল রবিবার | সকালে সুপম বৈশাখীকে ফোন করে |
ছোট্ট একটা ফ্লাট | কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজানো | সুপম এসে ড্রয়িংরুমে বসলো | বৈশাখী চা করে আনতে গেলো | সুপমের নজরে আসে সেনাবাহিনীর পোশাক পরে একজন জওয়ানের সুন্দর ফ্রেমে বড় করে বাঁধানো একটি ছবিতে রজনীগন্ধার মালা পরানো | শোকেসের উপরে বৈশাখীর বাবা , মায়ের একসাথে আর একটি ছবি তাতেও একটি ছোট মালা দেওয়া | কিন্তু এই জওয়ানের ছবিটার মানুষটা কে নিজের মনের মধ্যেই প্রশ্ন জাগে সুপমের |
বৈশাখী চা নিয়ে এসে দাঁড়ায় | অনেককথা হতে থাকে দুজনের মধ্যে | সুপম হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বসে ,
--- এই ছবিটা কার বৈশাখী ?
ছবিটার দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে বৈশাখী উত্তর দেয়, " আমার স্বামীর |"
ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলেও মনেহয় সুপম এতটা কেঁপে উঠতোনা | সে বৈশাখীর দিকে তাকিয়ে দেখে তার দুচোখ জলে ভর্তি |
--- এসব কি করে হল ?
-- অনেক কথা সুপম | তোমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে বাবার বাধ্য মেয়ে হয়ে বাবার বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করি | সে আর্মিতে চাকরী পেয়েছিলো | ছেলেবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল দেশের জন্য সে কাজ করবে | নেতাজির ভক্ত , তার আদর্শে অনুপ্রাণিত | রেলে চাকরি পাওয়ার দুমাসের মধ্যে আর্মিতে এই চাকরিটা পেয়েছিলো | বাড়ির সকলের শত অনুরোধ অগ্রাহ্য করে রেলের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে আর্মিতে জয়েন করে | তার ছমাস পরে আমার বিয়ে হয় | বিয়ের সময় ছুটি নিয়েছিল দশদিন | আমায় রেখে দশদিন পর চলে গেলো কর্মস্থলে | যাওয়ার সময় কথা দিয়ে গেলো কিছুদিন পরে এসে আমায় তার কাছে নিয়ে যাবে |
এটুকুন বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বৈশাখী চুপ করে গেলো | সুপমও কিছুটা সময় চুপ থেকে ফের জানতে চাইলো
--- তারপর কবে আসলো ?
চোখ ভর্তি জল নিয়ে সুপমের দিকে তাকিয়ে বললো ,
--- ফিরে এসেছিলো তবে কফিন বন্দি হয়ে --- হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো |
--- আমার বিবাহিত জীবন দশদিনেই শেষ |
সুপম নিশ্চুপ | বৈশাখী কেঁদেই চলেছে | সুপম জানেনা এইসময় কি বলে শান্তনা দিতে হয় | অনেকক্ষণ পর বৈশাখীই বললো ,
--- অতর্কিত জঙ্গী হানায় সেদিন একদম সামনে থেকে ওকে বুলেটে ঝাঁজরা করে দিয়েছিলো |
চোখ দুটি মুছে সুপমের দিকে তাকিয়ে বেশ কঠিনভাবে বৈশাখী বললো ,
--- জানো সুপম সেদিন তিন তিনটে জঙ্গীকে ও খতম করেছিল |
--- তুমি বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাওনি কেন ?
--- কেউ নেই | খবরটা শুনেই বাবার হার্টএটাক হয় | হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি ফেরেননি | মায়ের কাছে কদিন থেকে যখন শ্বশুরবাড়ি এলাম আমার শ্বাশুড়িমা আমাকে ঘরে ঠাঁই দিলেননা তার ছেলেকে নাকি আমি খেয়েছি | আর শ্বশুরমশাই চুপ করে দাঁড়িয়ে শুধু মজা দেখলেন | মায়ের কাছে ফিরে গেলাম | স্বামীকে হারিয়ে তিনি যতটা না শেষ হলেন জামাইকে হারিয়ে সবসময় বিধবা মেয়েকে সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখে তার থেকে বেশি ভিতরে ভিতরে ক্ষয় হয়ে যেতে থাকলেন | বছর দেড়েকের মাথায় মস্তবড় পৃথিবীতে আমায় একা করে দিয়ে তিনিও চলে গেলেন | স্বামীকে বিয়ের পর দশটা দিন কাছে পেয়েছিলাম | মাত্র অল্প কয়েকদিনের চাকরী | কিন্তু জানো আমি ক্ষতিপূরণবাবদ সরকারী প্রাইমারী স্কুলে এই চাকরীটা পেয়েছি | তাইতো আজও বেঁচে আছি | বৌভাতের দিনে আমায় বলেছিলো ," তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম |"সে নেই কিন্তু সে দায়িত্ব সে আজও পালন করে চলেছে | কারন তার জন্যই আমার এই চাকরিটা পাওয়া |
সুপম কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছিলোনা | তাই চুপচাপ ই বসে ছিল | বৈশাখী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো ,
--- তুমি একটু বোস আমি আর একবার চা করে নিয়ে আসি |
--- আজ আর চা খাবোনা | কাল আবার আসবো | আজ উঠি |
সারাটা রাস্তা সুপম বৈশাখীর এই চরম পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে আসে | কিছুতেই এই ঘটনাটা সে মানতে পারেনা | বাড়িতে ফিরে বাবা মাকে সে তার অতীত জীবন ও বর্তমানে বৈশাখীর সমস্ত কথা খুলে বলে | বাবা তার কাছে জানতে চান ,
-- তুই কি চাস খুলে বল | মেয়েটিকে কি বিয়ে করতে চাস?
কোন ভনিতা না করেই সুপম তার বাবা মাকে জানায় ,
--- এতো অল্প বয়সে একটা মেয়ে সমস্ত পৃথিবীতে যার কেউ নেই সে কিভাবে থাকবে ? আর তাছাড়া আমি তো সেই কলেজ লাইফ থেকেই মেয়েটিকে ভালোবাসি | তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমি বৈশাখীকে জীবনসঙ্গী করতে চাই |
স্বামী , স্ত্রী দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরেই কোন আপত্তি করলেন না | পরদিন সন্ধ্যায় সুপম আবার বৈশাখীর বাড়ি আসে | নানান কথাবার্তার পর সুপম তাকে তার মনের কথাটা জানায় |
--- তুমি জানো বৈশাখী আমি তোমায় ভালোবাসতাম শুধু বাসতাম কেন আজও বাসি | এই বিশাল পৃথিবীতে আজ তুমি সম্পূর্ণ একা | জীবনের চলার পথটা ভীষণ দুর্গম | একা একজন নারীর পক্ষে নিজ সম্মান অক্ষুন্ন রেখে বেঁচে থাকাটা আরও ভয়ঙ্কর | আজ যদি আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকার অঙ্গীকার করি তাহলে এবার তুমি আমায় ফিরিয়ে দেবে নাতো ?
বৈশাখী সুপমের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মুখটা নিচু করে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে | সুপম এগিয়ে গিয়ে বৈশাখীর হাতদুটো ধরে বলে ,
--- চুপ করে থেকোনা | আমায় কিছু বলো অন্তত | আমি পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে তোমায় নিয়ে যাবো | আমার বাবা মায়ের সম্মতি নিয়েই আজ এসেছি |
সুপমের হাতের মধ্য থেকে আস্তে আস্তে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বৈশাখী তার স্বামীর ছবির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলে ,
--- কে বললো তোমায় আমি একা এই পৃথিবীতে ? সবসময় আমার স্বামী আমার সাথে আছে | মাত্র সামান্য কটাদিনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও আমায় কতটা ভালোবাসে | এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আমি আমার মনের কথাগুলো ওর কাছেই ব্যক্ত করি | আমার হৃদয় দিয়ে সেই কথাগুলোর উত্তর আমি ওর কাছ থেকে পাই | আমি জানি সুপম তুমিও আমায় খুব ভালোবাসো | কিন্তু সব ভালোবাসা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়না বা বলতে পারো নিয়ে যাওয়া যায়না | তাতে আমার মতে প্রবিত্র ভালোবাসার অমর্যাদা করা হয় | সত্যি বলতে কি তোমার প্রতি আমার কোনদিনও কোন দুর্বলতা আমি অনুভব করিনি | কিন্তু এটাও সত্যি তোমার প্রতি আমার একটা ভালোলাগা কাজ করে | সেটা কোন অবস্থাতেই ভালোবাসা নয় | তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু | আমার জীবনে কোথাও তোমার জায়গা নেই তা কিন্তু নয় | আর সেই কারণেই তোমায় আমি ঠকাতে পারবোনা | তোমার আমার মাঝখানে রিতেশ থেকেই যাবে আমি কোনদিনও সম্পূর্ণভাবে তোমার হয়ে উঠতে পারবোনা | তোমার সাথে বিয়ে হলে তোমার ছোঁয়া প্রতিটা মুহূর্তে আমায় মনে করিয়ে দেবে রিতেশকে | হয়তো বলবে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে | কিন্তু জীবনের প্রথম পরশ আজীবন মানুষের মনে একটা দাগ রেখে যায় যা শত চেষ্টা করেও ভুলা যায়না | মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে তাকে অনুভব করা যায় | একাকী নির্জনে মনেমনে মানুষটার সঙ্গ পাওয়া যায় | আমায় তুমি ভুল বুঝোনা - তুমি ফিরে যাও একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করো ; আমার সাথে শুধু তোমার বন্ধুত্বটুকুই থাক | আমি জীবনের সামনের এই সুবিশাল পথটা অনুভবে রিতেশকে নিয়েই কাটিয়ে দেবো |
সুপম আজও ভাবতে পেরেছিলোনা সেই আগের মতই বৈশাখী তাকে ফিরিয়ে দেবে | কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো ,
--- আমি সারাজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করবো | যদি কোনদিন কোন সময় আমার কথা তোমার মনে পড়ে বা কোন দরকার লাগে আমায় জানিও আমি ঠিক হাজির হয়ে যাবো |
বেরিয়ে যায় সুপম | তারপর সে আর বৈশাখীর বাড়ি আসেনি | কিন্তু মাঝে মাঝে ফোন করে বৈশাখীর খবর নেয় | সে এটাও জানে বৈশাখী এখন কলকাতায় নেই | তার স্কুল এখন হুগলী | ওখানেই সে থাকে | কিন্তু বৈশাখী তাকে কোনদিনও ফোন করেনি আজ পর্যন্ত |
পাঁচ বছর বাদে -
বৈশাখীর ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি সুপম হুগলিতে তার বাড়ি উপস্থিত হয় | কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিয়ে সুপমকে নিয়ে বৈশাখীর বেডরুমে নিয়ে যায় | সুপমকে দেখে বৈশাখী উঠে বসার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা | সুপম দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে বসিয়ে দেয় |
--- একি চেহারা করেছো ? কি হয়েছে তোমার ?
--- জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি | আমার তো কেউ নেই এই বিশাল প্রথিবীতে তাই শেষ সময়ে তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো |
--- কি হয়েছে তোমার ?
--- আমার দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গেছে | ডায়ালিসিস চলছে | চেষ্টা করেছিলাম ডোনার জোগাড় করতে কিন্তু পাইনি |
কাজের মেয়েটি এসে সুপমকে চা জলখাবার দিয়ে গেলো | সুপম তার কাছে বৈশাখীর ট্রিটমেন্টের কাগজপত্রগুলো চাইলো | সেটা দেখতে পেয়ে বৈশাখী বললো ,
--- কোন লাভ নেই সুপম | ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন কিডনি ট্রান্সফার ছাড়া আর কোন পথ নেই |
--- চুপ করো তুমি ---| এতদিন কেন জানাওনি আমায় তুমি | নিজে তো সারাজীবন কষ্ট করলে আমাকেও কষ্ট দিলে | কি এমন অপরাধ করেছিলাম আমি তোমায় ভালোবেসে ?
কথাগুলো শুনে বৈশাখী একটু ম্লান হাসলো |
সেদিন রাতে সুপম ড্রয়িং রুমে সোফার উপরে ঘুমালো | পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বৈশাখীর চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো | কাজের মেয়েটি বৈশাখী ঘুম থেকে উঠলে জানালো ," কাল যে দাদাটা এসেছিলো সে চা না খেয়েই কোথায় বেরিয়ে গেছে |" বৈশাখী সুপমকে ফোন করলে সুপম ফোন ধরে জানালো সে কাজে বেরিয়েছে কাজ শেষ করে তবে ফিরবে | সারাটা দিন পাগলের মত বৈশাখীর ডক্টরের সাথে কথা বলে কিডনির আশায় সম্ভাব্য জায়গাগুলি ঘুরে বেরিয়ে অনেক রাতে বৈশাখীর বাড়িতে ফেরে | বৈশাখীকে জোর করে ওর কাজের মেয়ে শোভা খাইয়ে দিয়েছে | সুপমকে উদ্ভ্রান্তের মত দেখতে পেয়ে বৈশাখী বলে ,
--- কেন এতো ভাবছো বলো তো ?আমি চলে গেলে পিছনে কেউ কান্নার থাকবেনা | আমি তো সারাজীবন শুধু তোমায় দুঃখই দিলাম | তবুও তুমি --- কথাটা শেষ করার আগেই সুপম একটু রেগেই বললো ,
--- একদম বাজে বকবেনা | কেউ কান্নার থাকবেনা? নিজের মনের কথা তুমি নিজেই বুঝতে পারোনা | আবেগের বশে থেকে নিজেকে আস্তে আস্তে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছো | আমার কথা যদি তুমি নাই ভাববে তবে এই সময়ে কেন তোমার আমার কথা মনে পড়লো ?
--- সেতো তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই বলে |
--- কে আমি তোমার ? কি সম্পর্ক আমার সাথে তোমার ?
বৈশাখী এ কথার কোন উত্তর দেয়না | শোভাকে ডেকে সুপমকে খেতে দিতে বলে |
পরদিনও ভোরে উঠে সুপম বেরিয়ে যায় | পরপর এইভাবে প্রায় কুড়ি পঁচিশদিন | এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বৈশাখীকে নিয়ে ডায়ালিসিসও করিয়ে নিয়ে এসেছে |
--- সুপম , অনেকদিন হল তোমার অফিস কামাই হচ্ছে তুমি এবার ফিরে যাও|
--- তুমি কি আমাকে এতটাই স্বার্থপর ভাবো? কি করে তুমি ভাবলে এইসময় আমি তোমায় ফেলে চলে যাবো ?
--- কিন্তু তোমার বাড়ির লোকজন তোমায় নিয়ে ভাবছে |
--- আমারও যে এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই বৈশাখী | মা বাবা দুজনেই গত হয়েছেন |আর কখনো আমায় চলে যেতে বোলোনা | আমি দু দুবার তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছি দুবারই তুমি আমায় ফিরিয়ে দিয়েছো আর আমি তোমায় একা ফেলে কোথাও যাবোনা |
বৈশাখীর চোখ দুটি জলে ভিজে গেলো | পাছে দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাই নিজেকে সামলে নেয় | সত্যিই তো সে সারাটা জীবন ধরে সুপমকে শুধু ফিরিয়েই দিয়েছে | কিন্তু সুপম আজও তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে | সুপমকে ফিরিয়ে দিয়ে একটা মৃত মানুষের মাত্র দশদিন একসাথে কাটানো স্মৃতিকে সম্বল করে পুরো জীবনটা কাটানো যে কতটা কষ্টকর তা এ কটা বছরে বৈশাখী হাড়েহাড়ে বুঝেছে | যতই বুঝতে পেরেছে ততই যেন সে সুপমকে ভালোবাসতে শুরু করেছে | তাই তো জীবনের শেষ সময়ে সে সুপমকে ডেকে এনেছে মনের কথাগুলো জানিয়ে যাবে বলে | কিন্তু সুপমের সাথে কথা বলার সময়ই তো সে পাচ্ছেনা | এখানে এসে সে সকাল থেকে রাত অবধি কি কাজ করে বেড়াচ্ছে তা একমাত্র সে আর ঈশ্বরই জানেন | জিজ্ঞাসা করে কোন সদুত্তর সে পায়না | এরই মাঝে সুপম একদিন সন্ধ্যার সময় হাসি হাসি মুখে ফিরে বৈশাখীর ঘরে গিয়ে বলে ,
--- আর চিন্তা নেই | একজন ডোনার জোগাড় করা গেছে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে | এ কটাদিন এই ছুটাছুটিটা আমার সার্থক হয়েছে | উনার সবকিছু টেষ্ট কমপ্লিট | একদম ম্যাচিং | আগামীকাল তোমায় ভর্তি হতে হবে হাসপাতাল |
--- আমার একাউন্টে বেশ কিছু টাকা আছে |
--- ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবেনা | তুমি সুস্থ্য হয়ে এসে আমায় সব শোধ করে দিও | কাল ভর্তি আর পরশু অপারেশন | তবে কাল আমি তোমায় ভর্তি করে দিয়ে একটু কলকাতা যাবো | আমার অফিস এখন ওখানেই | আজ একটা জরুরি ফোন এসেছিলো | পরশু অফিসে যেতেই হবে | তুমি চিন্তা কোরোনা | আমি সব ব্যবস্থা করেই যাবো |
--- তাহলে তুমি ফেরার পর অপারেশন হবে |
--- না আর দেরি করা ঠিক হবেনা | ডাক্তার বলেছেন এখনই অপারেশন করতে হবে | আরে কোন ভয় নেই আমি দু তিনদিনেই ফিরে আসবো | আমি এসে তোমায় হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনবো |
বৈশাখী চোখ ভর্তি জল নিয়ে বললো ,
--- আমার তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল সুপম |
--- সব কথা অপারেশনের পরে হবে | এখন কোন কথা না | খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পর | কাল দশটার মধ্যে বেরোবো |
বৈশাখীকে ভর্তি করে তার কাছ থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য বিদায় নিয়ে এসে নিজেও এক কেবিনে ভর্তি হল | ডাক্তারবাবুর হাত ধরে অনুরোধ করেছে কে তাকে কিডনি দিচ্ছে একথা যেন বৈশাখীকে বলা না হয় | অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর সে নিজেই তাকে জানাবে |
ভালোভাবেই অপারেশন হয়ে গেলো | দুই কেবিনে দুজন শায়িত | সুপমের জ্ঞান ফিরলেই সে ডাক্তার বাবুর কাছে বৈশাখীর খবর নিয়েছে | বৈশাখীর জ্ঞান ফিরেছে সুপমের জ্ঞান ফেরার আরও বেশ কয়েক ঘন্টা বাদে | পুরোপুরি জ্ঞান ফিরতে আরো কয়েকঘন্টা লাগবে | কিন্তু ওই ঝাপসা চোখেই সে তার পরিচিত একটি মানুষকেই খুঁজছে | ডাক্তারবাবু কিছুটা আন্দাজ করে বললেন ,
--- সুপমবাবুকে খুঁজছেন ? উনার ফিরতে আরও দুদিন লাগবে | আপনি একদম ভাববেননা | ঠিক সময়ে তিনি ফিরে আসবেন | সব বন্দোবস্ত করে দিয়েই গেছেন | আমরা আছি তো আপনার সাথে | কোন ভয় নেই |
এর ঠিক দুদিন পরে সুপম এসে চোখ বুজে থাকা বৈশাখীর মাথায় হাত রাখে | বৈশাখী সুপমকে দেখেই কাঁদতে লাগে | সুপম চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে ,
--- সব ঠিক হয়ে যাবে | তুমি পুরো সুস্থ্য হয়ে উঠবে | একদম চিন্তা কোরোনা |
--- এটা তুমি কেন করলে ?
--- আমি আবার কি করলাম ?
--- এভাবে নিজেকে শেষ করে আমাকে বাঁচানোর কোন দরকার ছিল কি ? আমি সব জানি | ডাক্তারবাবু আর সিস্টারের সবকথা আমি শুনেছি | উনারা ভেবেছিলেন আমি ঘুমাচ্ছি | আসলে আমি জেগেই ছিলাম |
--- কেন করলাম তুমি জানোনা ?আর আমাকে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে পারবেনা | তোমার মধ্যেই আমি সারাজীবন থাকবো |( কথাটা বলে সুপম মৃদু হাসলো )
--- কেন আমরা কি এক ছাদের তলায় থাকতে পারিনা ? (এই কথাটি বলে ঠোঁটের কোনে বৈশাখী হাসিটা ধরে রাখলো |)
--- আমি তো পা বাড়িয়েই আছি ---
ডাক্তার ও সিস্টার এসে সেখানে উপস্থিত হলেন | ডাক্তারবাবু সুপমের উর্দ্যেশ্যে বললেন ,
--- আপনি কিন্তু এখনো দুর্বল | এবার আপনার কেবিনে যান | সিস্টারকে হুইল চেয়ারটা নিয়ে আসার জন্য বললেন |( যেটা করে সুপম বৈশাখীর দরজা পর্যন্ত এসে সেখান থেকে হেঁটেই তার কাছে আসে |)
নিজের কেবিনে যাওয়ার আগে সুপম হাতটা বাড়িয়ে দেয় বৈশাখীর দিকে | বৈশাখী তার হাতটা ধরে | সুপম একটা মৃদু চাপ দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়ে আলতো করে ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বলে , " খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে ওঠো | এখনো জীবনের অনেকটা পথ বাকি |" সুপম হুইল চেয়ার করে বেরিয়ে যায় আর বৈশাখীর দুচোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে | মনেমনে বলে , " হেরে গেলাম আজ আমি নিজের কাছে ; তোমার ভালোবাসারই জয় হল শেষ পর্যন্ত |"
No comments:
Post a Comment