পারিবারিক বন্ধন
তমিস্রা যখন প্রথম এই বাড়িতে বৌ হয়ে আসে তখন স্বামী , শ্বাশুড়ি বা আত্মীয়স্বজন কেউই তাকে মেনে নিতে পারেনি | তার মস্তবড় দোষ তার গায়ের রং কালো যার জন্য সে নিজে দায়ী নয় কিন্তু অপমান বা অত্যাচার তার কপালের দোষ | সর্বগুনের অধিকারী হওয়া সর্ত্বেও এই পঁচিশ বছরের সংসার জীবনে সে কোনদিনও কারও কাছেই কোন ভালো ব্যবহার বা তার গুনের কদর পায়নি | এমনকি তার পঁচিশ বছরের ছেলে তপময়ের কাছ থেকেও না | তপময় জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছে এই বাড়িতে সর্বকাজের দায়িত্ব একজনের উপর যে সকাল থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মুখ বুঝে সকলের সব ফারফরমাস শুনে সবকিছু পালন করে চলেছে | সেও তার বাপ ঠাকুমার মত অর্ডারটাই শিখেছে |
বিশাল রাশভারী মানুষ অরুনাভ চ্যাটার্জী আক্ষরিক অর্থে ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত ভদ্রলোক | এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে আর এক বন্ধুর সাথে গেছিলেন পবনপুর গ্রামে | কিন্তু বিয়ের আসরে শুভদৃষ্টির সময় বাধে এক ঝামেলা | শুভদৃষ্টি করতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে বরটি | কিছু পরে জানা যায় বর আসলে পাগল | কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার তখন মাথায় হাত | আত্মীস্বজনেরা বরযাত্রীদের সাথে কলহ এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত মারামারি শুরু হয়ে যায় | ঘটনা সামাল দিতে না পেরে অরুনাভ চ্যাটার্জী গ্রামের একটি ছেলের সাহায্যে পুলিশে খবর দেন | পুলিশ এসে ঘটনা সামাল দেয় | তমিস্রার বাবা অপমান আর দুঃখকষ্টে বুকের বামদিকের ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়েন | কিন্তু অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত থাকে তমিস্রা | অরুনাভ চ্যাটার্জীর গাড়ি করে যখন বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বধূবেশে তমিস্রা সকলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে ," আমিও সাথে যাবো |" না সে একটুও ভেঙ্গে পড়েনি | এমনটা ঘটবে এটা যেন তমিস্রা জানতো | তবে সে ভেবেছিলো বিয়ের আসরে বিয়েটা ভাঙ্গবে তার গায়ের রঙ্গের কারণে | তার নিজের কাকা এই সম্বন্ধটা করেছিলেন | আর কাকা যে ভালো মানুষ নয় তার আত্মভোলা বাবা এটা না বুঝলেও সে বুঝতে পারতো | কিন্তু তার বাবা ছিলেন ভাই অন্ত প্রাণ | এটা সে বুঝতে পেরেছিলো ছেলের বাড়িতে কাকা যা বলেছেন তা যেমন সত্যি নয় আবার কাকা বাবাকে ছেলের বাড়ি সম্পর্কে যা বলেছেন সেটাও সত্যি নয় | কাকার ছিল বাবার সম্পত্তির উপরে লোভ | কাকার একটিমাত্র ছেলে | কাকা মনেমনে ভাবতেন যেনতেন প্রকারে তমিস্রার একটা বিয়ে দিতে পারলেই দাদা তার সম্পত্তির কিছুটা হলেও তার ছেলেকে দান করবেন | ছেলের বাড়িঘর তমিস্রার বাবা দেখে এসেছিলেন | অবস্থা খারাপ নয় | কিন্তু ছেলে তখন বাড়িতে ছিলোনা তাই তাকে তিনি দেখতে পাননি | তমিস্রা পরে বুঝেছিলো পাগল ছেলেকে দেখাবেনা বলেই কাকার পরামর্শে তাকে বাড়ি থেকে অন্যকোথাও সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল | কিন্তু বাবার হাতে তারা ছেলের একটি ছবি দিয়েছিলো | সুন্দর সুপুরুষ ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে পাগল |ওই বাড়ি থেকে শুধুমাত্র তার শ্বাশুড়ি ও ননদ এসেছিলো তাকে দেখতে | আজ পর্যন্ত যত লোকে তাকে দেখতে এসেছে প্লেট ভর্তি মিষ্টি খেয়েই বিদায় নিয়েছে পরে খবর পাঠাবে বলে | তারপরে কেউ কেউ চুপ হয়ে যেত আর বাকিরা খবর দিতো ' বড্ড কালো'| তাই তমিস্রার প্রথম থেকেই এই বিয়েটা নিয়ে একটু সন্দেহ ছিল | আর এরজন্য যে তার বিয়েটা ভেঙ্গেও যেতে পারে এ ব্যাপারে সে যেন প্রায় নিশ্চিতই ছিল | তাই বিয়ে ভাঙ্গার এ ঘটনা তার মনে কোন প্রভাব বিস্তার করেনি | চিৎকার , চেঁচামেচি, মারামারি সবই সে ঘরের ভিতরে থেকে টের পেলেও বেরিয়ে আসেনি | কিন্তু বাবা অসুস্থ্য হয়েছেন শুনেই সে দৌড়ে বেরিয়ে আসে |মা মরা মেয়ে তমিস্রা | বাবাকে যেমন সে ভালোবাসে ঠিক তেমনই ভয়ও পায় | তবুও সাহস সঞ্চয় করে বাবাকে বলেছিলো ,"আমি বিয়ে করতে চাইনা বাবা | আমি চলে গেলে তোমায় কে দেখবে " সব বাবারা যা বলেন এক্ষেত্রে তিনিও তাই বলেছিলেন | নিজের অনিচ্ছা সর্ত্বেও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বিয়েতে রাজি হয়েছিল | গাড়ি যখন হাসপাতালের পথে তখনই তার বাবার ঘন শ্বাস পড়তে থাকে | তিনি তার বন্ধু অরুনাভর হাতদুটি শক্ত করে ধরে মেয়ের দিকে তাকান | বন্ধু অরুনাভ বুঝতে পারেন মৃত্যুপথযাত্রী বাবার আকুল প্রার্থণা তার লগ্ন ভ্রষ্ট হওয়া মেয়েটির জন্য | তিনি দুইহাত দিয়ে বন্ধুর হাতদুটি ধরে বলেছিলেন , " আজ থেকে ওর সকল চিন্তা আমার | আমি ওকে আমার ছেলের বৌ করে নিয়ে যাবো |" সেকথা তখন তমিস্রার কানে না পৌঁছালেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে তার বাবা একথা শুনে ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসি এনেছিলেন |
সেদিন রাতেই বন্ধুর শেষকৃত্য সম্পাদন করে পাশের বাড়িতে তমিস্রাকে দেখাশুনার কথা বলে তিনি ও তার বন্ধু বিদায় নেন | বাড়িতে গিয়ে সবকথা স্ত্রী ও ছেলেকে জানিয়ে তিনি আসল কথাটি বলেন যে তমিস্রাকে তিনি তার প্রফেসার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চান | বাড়িতে আগুন জ্বলে ওঠে | কিন্তু মেয়েটির গায়ের রং যে কালো সে কথাটা তিনি চেপে যান | লিপিকাদেবী কিছুতেই লগ্নভ্রষ্টা মেয়েকে ছেলের বৌ করে আনবেননা সাফ জানিয়ে দেন | কিন্তু অরুণাভবাবুর বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে শেষপর্যন্ত তিনি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন | তপোময়ের অবশ্য খুব একটা আপত্তি ছিলোনা | কারণ বাবার প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস | সে স্বপেও ভাবেনি আবেগের বশে বাবা তারজন্য একটি এইরূপ মেয়ে পছন্দ করে বসবেন | তমিস্রার বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদনের সাতদিনের মাথায় তিনি রেজিস্ট্রি করে ছেলের বিয়ে দেন | কিন্তু বাড়িতে বৌভাতের বিশাল আয়োজনের কোন ত্রুটি তিনি রাখেননা | তপোময় আর তার মা রেজিস্ট্রির দিনে মেয়েটিকে দেখে তো থ | কিভাবে এই মেয়ের সাথে সুদর্শন তপুর সাথে তার স্বামী বিয়ে ঠিক করলেন তা নিয়ে প্রচুর জলঘোলা করেন লিপিকাদেবী | আর তপোময় যেন মূক হয়ে গেছে | সে স্বপ্নেও ভাবেনি বাবা তার এতবড় সর্বনাশ করবেন | রাগে দুঃখে রেজিস্ট্রি পেপারে সই করার সময় নিজের অজান্তেই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে | যা তমিস্রার নজর এড়ায়না | ছোটবেলা থেকেই বাবার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে সে বড় হয়ে উঠেছে | জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে বাবাকে কখনো কোন অন্যায় করতে দেখেনি | বাবার ন্যায়নীতি আর মানুষকে ভালোবাসার যে অসীম ক্ষমতা সে দেখেছে সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই বাবার সিদ্ধান্তের প্রতি তার ছিল অন্ধ বিশ্বাস | সেই বিশ্বাকেই সম্বল করে মেয়েটিকে পূর্বে দেখতেও সে চায়নি | কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সে যদি বেঁকে বসে তাহলে অপমান আর লজ্জায় বাবা আত্মঘাতী হতে দুবার হয়তো ভাববেননা | তাই বাবার ইচ্ছাই নিজেকেই সে বলি দেয় |
বৌভাতের দিনে প্রচুর আত্মীয়স্বজনের আগমন আর তাদের কটাক্ষের জবাব সে দিয়েছিলো একটা কথাতেই -- " এটা আমার কপালে ছিল |" মাকেও সে সেটাই বুঝিয়েছিল | আর বলেছিলো আত্মীয়স্বজনের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি যেন কোন কথা তমিস্রার সম্পর্কে না বলেন | ঘরের অশান্তি বাইরে যেন না যায় | তাতে বাবাকে অসম্মান করা হবে | কিন্তু অনুষ্ঠান বাড়িতে মহিলা মহলকে কোনভাবেই চুপ করানো যায়নি | কেউ তাকে বলেছেন ," হ্যাগো দিদি তোমার এই রাজপুত্র ছেলের জন্য কালো কুচকুচে এই মেয়েটাকে কোথার থেকে ধরে আনলে ?" আবার কেউবা বলেছেন ," এই মেয়েকে পার করার জন্য ওর বাপ প্রচুর টাকা ক্যাশ দিয়েছে নাকি ?" আবার কেউবা "লগ্নভ্রষ্ট এই এই কালিন্দিরের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য কে তোমাদের মাথার দিব্যি দিয়েছিলো দিদি ?" কিন্তু দাঁতে দাঁত দিয়ে তিনি সকল কথা হজম করেছেন স্বামীর সম্মান আর ছেলের কথা রাখতে গিয়ে | চোখের কোলদুটি সবসময়ের জন্য তার ভিজেই থেকে গেছে | বুকের ভিতরের হাহাকারের শব্দ কেউ টের পায়নি |
ফুলশয্যার খাটে নববধূর সাজে সজ্জিত তমিস্রাকে দেখে ক্ষণিকের জন্য হলেও তার খুব মায়া হয় | তার মনেহয় এই মস্তবড় পৃথিবীতে এই মেয়েটির তো কেউ নেই | আর সেতো জোর করে নিজের থেকে তাদের বাড়িতে আসেনি | তবে ওর কি দোষ | কিন্তু তমিস্রার কাছে সে ফ্রি হতে পারেনি | শুধু তার কাছে দাঁড়িয়ে বলেছিলো ," খুব টায়ার্ড আজ | ঘুমিয়ে পর | পরে কথা হবে |" এর আরো বেশি কিছু যেন তমিস্রা আশা করেছিল | সে ভেবেছিলো ঘরে ঢুকেই তার স্বামী তার উদ্দেশ্যে কিছু বাক্যবান নিক্ষেপ করবে আর সেগুলি বুকের মধ্যে সেলের মত বিঁধবে | কিন্তু এসব কিছুই হলনা দেখে সে নিজেও একটু অবাক হল | স্বস্তির একটা নিশ্বাস তার অজান্তেই তার বুকটা ভরিয়ে দিলো | সে বালিশ নিয়ে খাট থেকে নেমে যেতে লাগলে তপোময় তাকে বলে ," খাটটা অনেক বড় আমরা দুজনে দুপাশে অনায়াসে শুতে পারবো " তপোময়ের কথা শুনে আবারও একপ্রস্ত অবাক হল নববিবাহিতা বধূটি |
পরদিন খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান করে সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পরে রান্নাঘরে ঢুকে যায় | তখনও তার শ্বাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে পারেননি | অগোছালো রান্নাঘরটিকে সুনিপুন হাতে সুন্দর করে গুছিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে দেয় সকলের জন্য | তখন তপোময় ছাড়া বাড়ির বাকি দুজনে উঠে পড়েছেন | আত্মীয়রা কেউই আর থেকে যাননি গতকাল | লিপিকাদেবী মুখ ধুয়ে এসেই টেবিলের উপরে চায়ের কাপপ্লেটটা দেখে খুশি হলেও সেটা প্রকাশ করেননা | আর অরুণাভবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গিন্নির উদ্দেশ্যে বলেন ," খেয়ে দেখো চা টা লিপি | খেলেই বুঝতে পারবে রূপ দিয়ে নয় গুন দিয়েই মানুষের বিচার করতে হয় |" কটাক্ষ দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করলেও স্বামীর কথার তিনি কোন উত্তর না দিয়ে শূন্যে কথা ছেড়ে দেন ," সকালের চা টা তপু বিছানার মধ্যেই খায় |" শ্বশুর ও বৌমা একথা শুনে চোখ চাওয়াচাহনি করে | চা নিয়ে গিয়ে তমিস্রা দেখে তপোময় তখনও ঘুমাচ্ছে | কিন্তু কি করে তাকে ঘুম থেকে ডাকবে এটা কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারেনা | তখন চায়ের কাপটা খুব জোরে টেবিলের উপর রাখে | কিন্তু কোন কাজ হয়না | রাতে একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে সে শুয়েছিল যা আলমারি থেকে বের করে তার বালিশের পাশেই তপোময় রেখে দিয়েছিলো | সকালে তাড়াহুড়োতে সেটা গুছিয়ে রেখে যেতে ভুলে গেছিলো | চেয়ে দেখে তার অর্ধেকটা তপোময়ের পিঠের তলে | সে চাদরটা ধরে ঈষৎ টান দিলো | আর তাতেই তপোময়ের ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো | তখন চায়ের কাপটা খাটের পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলটার উপর থেকে নিয়ে তার স্বামীর সামনে দেয় | তপোময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তার চা খাওয়ার সময়ের অনেক আগেই আজ চা তার সামনে হাজির | মাকে একটু সকাল সকাল চা টা দিতে বলে | কিন্তু মায়ের ওতো বয়স হয়েছে | তিনি পেরে ওঠেননা | চা খেয়ে তবে সে বিছানা ছাড়ে | আর এই কারণে অফিসে যাওয়াটা সময় তার হুড়োহুড়ি পরে যায় | ঠিক সময়ে চা টা পেয়ে মনেমনে খুশি হলেও মুখে সে কিছুই বলেনা | তমিস্রা বেরিয়ে যায় |
আবার এসে ঢোকে সে রান্নাঘরে | রান্নাঘরের কোথায় কি আছে শ্বাশুড়ির কাছে জিজ্ঞাসা না করেই কৌটো খুলে খুলে দেখে নিয়ে সুদক্ষ হাতে সে রান্নার জোগাড় করতে থাকে | ফ্রিজ খুলে মাছ বের করে বেসিনের উপর রাখে জলে ভিজিয়ে | ইতিমধ্যে তপোময় ঘুম থেকে উঠে পরে | মুখ ধুতে গেলে লিপিকাদেবী রান্নাঘরে যান এই সময়ে তার তপু আর এককাপ চা খায় বলতে | রান্নাঘরে ঢুকে তো তার চক্ষু চড়কগাছ | একদিনেই মাত্র কিছুসময়ের মধ্যেই রান্নাঘর ফিটফাট | কিন্তু মুখে কোন প্রকাশভঙ্গিমা নেই |তমিস্রা নিচুতে বসে তরকারি কুটছিলো | তিনি এবারও শূন্যে কথাটা ছেড়ে দেন ," তপু মুখ ধুয়ে আবারও এককাপ চা খায় |" বলেই তিনি বেরিয়ে যান | স্ত্রীকে রান্নাঘর থেকে ফিরে আসতে দেখে পেপার থেকে মুখটা সরিয়ে তারই উদ্দেশ্যে বলেন ," কিগো আজকের থেকেই রিটায়ার করলে ?রূপ নয় গুনের কদর করো |" এবার ছেলে মায়ের মুখের দিকে একটু তাকিয়ে আবার খবরের কাগজে মনোনিবেশ করে | কিন্তু রোজ এই সময় চা খেতে খেতে বাপ্ ছেলের দেশের খবর নিয়ে যে আলোচনা হত আজ তা আর হয়না | দুজনে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত আর একজন চুপচাপ বসে|
সেই যে বৌভাতের পরেরদিন তমিস্রা রান্নাঘরে ঢুকেছে আজ পঁচিশ বছর তার শ্বাশুড়ি আর ওদিক মাড়াননি বা তার প্রয়োজন পড়েনি | কি রান্না হবে কার কখন কোনটা প্রয়োজন তা যেন সে সেই মানুষটির নিজের আগেই বুঝে যায় | কথাবার্তা একমাত্র শ্বশুরবাবার সাথেই | খাওয়ার টেবিলে রান্না মুখে দিয়ে সকলেই এ ওর মুখের দিকে তাকায় ঠিকই কিন্তু একমাত্র বাবা ছাড়া কেউ কোন প্রশংসা করেনা | এতগুলো বছর ধরে সকলে এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে |
লিপিকাদেবী ও অরুণাভবাবুর এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে | একটু বেলাতেই দুজনে ঘুম থেকে ওঠেন | সেই হিসাবেই তাদের চা টেবিলে আসে | সেদিন লিপিকাদেবী ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে টেবিলে এসে চা না দেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাপ ,ছেলে , নাতিকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন | তারা হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে তমিস্রা মেঝেতে পরে আছে আর লিপিকাদেবী তার ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে পায়ের ব্যথা অগ্রাহ্য করে তার চোখেমুখে জল ছিটাচ্ছেন | উদ্বিগ্ন হয়ে "বৌমা বৌমা" করে কাঁদতে কাঁদতে ডাকছেন |
হাসপাতালের বেডে যখন তার জ্ঞান এসেছে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে দেখে তার পরিবারের সকলে সেখানে উপস্থিত | এমনকি শারীরিক অসুস্থ্যতা নিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ি ও | শ্বাশুড়ি এসে তার বেডের কাছে একটা টুলের উপর বসে বৌমার মাথায় হাত বুলাতে থাকেন , চোখের থেকে অবিরাম জল পরে চলেছে ,
--- বৌমা , আমাদের উপর রাগ করে এতগুলো বছর ধরে শুধু নিজের শরীরকেই কষ্ট দিয়ে গেছো ? একবারও ভাবোনি আমরা সকলে তোমার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল | তুমি সুস্থ্য না থাকলে আমরা যে কেউ ভালো থাকবোনা |
বিয়ের পঁচিশ বছর বাদে শ্বাশুড়ির মুখে বৌমা ডাকটা শুনতে পেয়ে তমিস্রার বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে | আনন্দ আর খুশিতে তার চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে | তিনি এতদিন ধরে তার না বলা কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই চলেছেন | তিনি এও বলেন " তোমার বাবা আমাকে বলেছেন রূপ নয় গুনের কদর করো - একটা একটা করে দিন গেছে আর একটু একটু করে তোমার গুন আমার কাছে প্রকট হয়েছে | কিন্তু বিশ্বাস করো বৌমা কেন যে নিজেকে তোমার কাছে মেলে ধরতে পারিনি আমি জানিনা | তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী এ কথাটা বহুবার বলবো ভেবেছি কিন্তু তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই বলতে পারিনি | কিন্তু তুমি এটা কি করেছো ? দিনের পর দিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে আমাদের সকলকে সেবাসুশ্রষা করে গেছো | একবারও ভাবোনি তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা চারটে প্রাণী কতটা অসহায় ?
--- ও ঠাম্মা তুমি এবার একটু ওঠো দাদুকে একটু সুযোগ দাও --- হাসতে হাসতে নাতি কথাগুলো বলে |
শ্বশুর এসে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলেন ,
--- এ বাড়ির সবাই তোকে খুব ভালোবাসে রে --- কিন্তু কি জানিস ইগো ছেড়ে কেউ বেরিয়ে এসে তোকে সেকথা বলতে পারেনি | তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে বাড়ি আয় মা | তোকে ছাড়া আমার সংসার যে অচল --- | চোখ মুছতে মুছতে তিনিও বেরিয়ে যান | ছেলে দূর থেকেই দাঁড়িয়ে বললো ,
--- মা , আমি তো তোমার একটা অবাধ্য ছেলে | তবে আজকে সকলের সামনে কথা দিচ্ছি এখন থেকে তোমার খাবারের তদারকির দায়িত্ব আমার |
তমিস্রা ওর কথা শুনে শুকনো মুখেও একটু হেসে দিলো |
সকলে এক এক করে বেরিয়ে যাওয়ার পর তপোময় টুলটায় এসে বসে | কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে তমিস্রার একটা হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলে ওঠে ,
--- মুখ ফুটে আমার ভালোবাসার কথা কোনদিনও বলতে পারিনি তোমায় | তোমাকে মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়েছে এটা ঠিক কিন্তু আমি কোনদিনও তো তোমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করিনি | তোমার গুনে কবে থেকে যে তোমায় ভালোবাসতে শুরু করেছি তা হয়তো নিজেই বুঝতে পারিনি | আমি বড্ড ভুল করে ফেলেছি একই ছাদের তলায় থেকেও তোমার খোঁজখবর না রেখে | তার শাস্তি তুমি আমাদের এইভাবে দেবে ? তোমার হিমোগ্লোবিন এতটাই কম যে দুবোতল রক্ত দিতে হয়েছে | প্রেসার একদম কম তাইতো মাথা ঘুরে পরে গেছো |কেন নিজেকে একটু একটু করে এইভাবে শেষ করেছো ? আমাদের ভালো খাওয়া , ভালো রাখার জন্য সবসময় পরিশ্রম করে গেছো কিন্তু এইভাবে নিজেকে অবহেলা করে সকলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে আমাদেরকে কাঁদিয়ে নিজেও কষ্ট পাচ্ছ তো ---- ?দেখলে তো বাড়ির সকলের অবস্থা | খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে ওঠো | তোমাকে ছাড়া বাড়ি পুরো অন্ধকার | কাল সকালে তোমায় ছেড়ে দেবে | একদম বেডরেস্ট আর ভালো ভালো খাওয়া দাওয়া | আমি একটা রান্নার লোক রেখে দেবো এবার | আর কোন ভুল আমি করতে চাইনা --- |
হা করে সকলের কথা শুনছিলো তমিস্রা | তাকে যে বাড়ির সকলে এতো ভালোবাসে কোনদিনও সে বুঝতে পারেনি | "না আর নিজেকে অবহেলা নয় ---- সকলের জন্যই এবার সুস্থ্য থাকতে হবে | ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ এই অসুস্থ্য না হলে আমি তো জানতেই পারতামনা বাড়ির সকলে আমায় এতো ভালোবাসে | আজ বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন | "
একটা নুতন সকালে অপেক্ষায় অসুস্থ্য শরীরে মনের খুশিতে নানান কথা ভাবতে ভাবতে সে কখন যে ঘুমিয়ে পরে নিজেই টের পায়না | এক ঘুমেই সকাল | এখন অপেক্ষা কখন বাপছেলে তাকে নিতে আসে |
No comments:
Post a Comment