সত্যের সন্ধানে
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ডাক্তারখানা থেকে শ্রীতমা যখন স্বামীর সাথে বেরিয়ে আসলো তখনই অতীশ দেখেছে তার চোখের কোনদুটি ভেজা | গাড়িতে উঠে বাড়ি পৌঁছানো অবধি কোন কথায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আর হয়নি | অতীশও কোন কথা বলেনি কারন এখন কিছু বললেই শ্রী হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করবে |
সাত বছরের বিবাহিত জীবনে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার আশায় ভারতবর্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেরিয়েছে শুধু ডাক্তার দেখানোর জন্যই নয় - মন্দির, মসজিদ, মাদুলী, জলপড়া কোনকিছুই বাধ দেয়নি | কিন্তু কোল তার শূন্যই রয়ে গেছে| শেষ আশা নিয়ে এসেছিলো ডক্টর আগরওয়ালের চেম্বারে | যিনি জন্মসূত্রে একজন ভারতীয় | জীবনের পঞ্চাশটা বছর কাটিয়েছেন লন্ডনে | লোকে বলে তিনি নাকি ভগবান | তিনি চাইলেই নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভ হয় | দীর্ঘদিন লন্ডনে সুনামের সাথে প্রাক্টিস করে সেখানকার পাঠ চুকিয়ে শুধুমাত্র শেকড়ের টানে অজপাড়াগাঁয়ে সামান্য জমি কিনে এক বেড়ার ঘর করে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন | দুই মেয়ের ওখানেই বিয়ে দিয়েছেন | তার মনের ইচ্ছা তার জন্মস্থান এই গ্রামেই তিনি একটি বড় হাসপাতাল খুলবেন | তার জম্ম দিতে গিয়ে তার গর্ভধারিনী মা বিনা চিকিৎসায় মারা যান | সন্তানের মুখ দেখতে গিয়ে তার জন্মভুমির আর কেউ যাতে এভাবে অকালে চলে না যায় তারজন্য তার ফিরে আসা | তিনি তার সংসার জীবনে সকল কর্তব্য শেষ করেই স্ত্রী এমিলাকে নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন | লোকমুখে তাঁর কথা শুনে শেষ আশা নিয়ে শ্রীতমা এসেছিলো ডক্টর আগরওয়ালের কাছে |
এতোবড় একজন গায়নোকোলোজিস্ট সামান্য কয়েকটি চেস্ট করেই বলে দিলেন শ্রীতমার কোন সম্ভবনাই নেই মা হওয়ার | যে কথা গত সাতবছর ধরে সে শুনে আসছে তবুও প্রতিটা মুহূর্তে সে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে গেছে ক্ষীণ আশা নিয়ে | কিন্তু আজ যেন সে একদম ভেঙ্গে পড়েছে | ঘরে ঢুকে পরনের পোশাক না খুলেই সোফার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে | অতীশ জানে এই সময় তাকে শান্তনা দিতে যাওয়া মানে তার কান্নার বেগকে আরও ধাবিত করা | চুপচাপ নিজে ফ্রেস হয়ে দুকাপ কফি করে নিয়ে এসে সোফার উপর বসে সে শ্রীর মাথায় হাত রাখে | শ্রী অতীশকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে | নীরবে তার শ্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে | কিছুক্ষন পর শ্রীতমা একটু শান্ত হলে কফি কাপটা তার সামনে ধরে বলে ,
--- এটা খেয়ে একটু শান্ত হয়ে আমার কথাগুলি শোনো |
কফি খাওয়া হয়ে গেলে উৎসুক চোখে শ্রীতমা তার স্বামীর মুখের দিকে তাকায় |
--- আমি ঠিক করেছি আমরা একটি বাচ্চা দত্তক আনবো - এবার আমি তোমার কোন কথায় শুনবোনা |
শ্রী কিছু বলতে যায় কিন্তু অতীশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ,
--- এখন বিশ্বের কেউই নিঃসন্তান থাকেনা | চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি , মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন , আবার অনেক নারী নিজে কষ্ট করতে না চাইলে বা সন্তান ধারনে অক্ষম থাকলে তারজন্য গর্ভ ভাড়াও পাওয়া যায় যাকে সারোগেট মাদার বলে --- | তুমি কোনটা চাও বলো? সারোগেট মাদার নাকি ভালো কোন জায়গা থেকে কোন বাচ্চাকে দত্তক নেবে? আরও শোনো যে সব প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত এই বাচ্চাগুলির দেখভাল করে চলেছে তারা কিন্তু সকলেই রাস্তাঘাটে ফেলে দেওয়া বাচ্চা নয় | কিছু প্রতিষ্ঠান এমনও আছে যারা অত্যন্ত গরীব পরিবারে বছর বছর জম্ম হওয়া কিছু বাচ্চাকেও তারা কিনে আনে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে |ওই বাচ্চাগুলি আমাদের মত নিঃসন্তান দম্পতির হাতে তুলে দিয়ে তাদের একটি সুন্দর ভবিৎষত গড়ে তোলার জন্য | আমরা পৃথিবীর কতটুকু খবর রাখি ? এখনো এই পৃথিবীতে অনেক ভালো মানুষ আছে যারা নিঃস্বার্থভাবে প্রতিনিয়ত মানুষের জন্য কাজ করে চলেছেন | আমরাও নাহয় তাদের কাজের একটু শরিক হই - বাপ মা হারা একটি শিশুকে একটি সুন্দর পরিবার দিই আর নিজেরাও হয়ে উঠি ওর বাবা মা | ওই বাচ্চাটির সুন্দর জীবনের সাথে সাথে আমরাও পাবো একটি পরিপূর্ণ সুন্দর জীবন |
পরদিনই শ্রীতমা আর অতীশ সল্টলেকের একটি অফিসে যায় দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে | প্রাথমিক একটা ফর্ম পূরণ করে তারা চলে আসে | কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেয় প্রায় বছর দুয়েক সময় লাগবে তাদের বাচ্চা হাতে পেতে | অগত্যা শুধুই দিনগোনা | দুবছর পরে অতীশের মেলে একটি দুমাসের বাচ্চার ছবি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠায় | মাথা ভর্তি চুল , ছবিতেই বোঝা যাচ্ছে ফর্সা টুকটুকে একটি বাচ্চা | প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী তিনদিনের মধ্যে তাদের জানাতে হবে অথাৎ বাচ্চার ছবিটা লক করে দিতে হবে | তারপর নানান আইনি জটিলতা | কয়েকদিন পরে স্বামী , স্ত্রী দুজনে মিলে ওই প্রতিষ্ঠানের কথানুযায়ী বাচ্চাটিকে দেখতে যায় | সদ্য প্রস্ফুটিত একটি ফুলের মত বাচ্চাটিকে এনে যখন শ্রীতমার কোলে দেয় সে তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে | কেউই তাকে শান্ত করতে পারেনা | প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী অতীশকে জানান পঁচিশ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে আমি আছি কিন্তু আজ পর্যন্ত এই দিদির মত কাউকে আমি দেখিনি | আপনাদের এই বাচ্চা পেতে এখনো মাসদুয়েক সময় লাগবে | আপনারা বরং আমাদের বসের সাথে কথা বলুন | উনি এখানে সপ্তাহে দুদিন আসেন শুধুমাত্র এখানকার পরিস্থিতি অথাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা , বাচ্চাদের শরীর - স্বাস্থ্য ইত্যাদি দেখার জন্য | বেশিদিন এখানে উনি আসেননি | আগে বছরে একবার কি দুবার আসতেন | এখন সপ্তাহে দুতিনদিন করে আসেন | যেখানে অসহায় ও আর্ত মানুষের সেবা সেখানেই তিনি | শুনেছি গ্রামে উনি একটি হাসপাতালও করছেন | যেখানে উনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা করাবেন | খুব দয়ালু মানুষ | কোন বাচ্চা মারত্মক অসুস্থ্য হলে তিনি সেই মুহূর্তেই সেই বাচ্চাকে নিয়ে ছুঁটে যান কলকাতার বড়বড় হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে | এই প্রতিষ্ঠানের বাচ্চা শুনলে অনেক নার্সিংহোমগুলো টাকা নেয়না ঠিকই কিন্তু যদিবা নেয় সেটা তিনি নিজের পকেট থেকেই ব্যয় করেন | আপনারা তাকে গিয়ে অনুরোধ করতে পারেন দু একদিনের মধ্যে শিশুটিকে দিয়ে দেওয়ার জন্য |
অতীশ ও শ্রীতমা যখন সেই মহান পুরুষটির সাথে দেখা করতে যান তখন তাকে দেখে শ্ৰীতমা চমকে ওঠে |
--- মিস্টার আগরওয়াল আপনি ?
এক গাল হেসে পরে তাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন |
--- হ্যাঁ আমি | আগে আপনাদের কথা শুনি আমি কেন এখানে পরে বলছি |
শ্ৰীতমা বলে ,
--- আমরা যে বাচ্চাটা নিতে চাই তাকে আজ কালের মধ্যে পাওয়া যাবে ডক্টর ?
-- আজ তো হবেনা তবে কাল আপনারা সকাল দশটার মধ্যে কোর্টে চলে আসুন | আইনি কাগজপত্রগুলো সব রেডি আছে শুধু সইগুলিই বাকি |
--- আপনি আগে থাকতেই রেডি করলেন কি করে ? আমরা তো আজই এলাম |
ডক্টর আগরওয়াল একটু হেসে দিলেন | অতীশ বলে বাড়ি যেতে যেতে সব বলবো |
--- শোনো শ্রী এই আগরওয়ালার জীবনে কিছু ঘটনা যা গল্প উপন্যাস থেকেও কম নয় | হতদরিদ্র এক মুসলিম পরিবারে উনি জম্মগ্রহণ করেছিলেন | জম্মের সাথে সাথে উনি উনার মাকে হারান | তখন উনার দরিদ্র দিনমজুর বাবা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে সদ্যজাত শিশুটিকে বিক্রি করে দেন | আগরওয়ালার বয়স যখন দুবছর ওই দম্পতির বিয়ের দশ বছর বাদে একটি পুত্রসন্তান হয় | তারা তখন ওই শিশুপুত্রটিকে নিয়ে আসেন এখানে মানে আমরা যেখান থেকে বাচ্চাটিকে দত্তক নিতে চাইছি | মাস ছয়েক পরে প্রবাসী এক দম্পতি আগরওয়ালকে আইনিভাবে দত্তক নিয়ে বাইরে চলে যান | তাদের কাছেই উনি মানুষ | তারাই তাকে ডাক্তারি পড়ান | তাদের পদবি ছিল আগরওয়াল | তারা তাদের সন্তান স্নেহেই তাকে মানুষ করেন | কিন্তু ঈশ্বরের লীলা বুঝা বড় দায় | সেই দম্পতির মৃত্যুর পর বাড়ির পুরানো কাগজপত্রের মধ্যে কয়েকযুগ আগে তাকে দত্তক নেওয়ার কাগজপত্র তিনি খুঁজে পান | শেকড়ের সন্ধানে তিনি চলে আসেন ভারতবর্ষে | তখন তিনি দুই সন্তানের পিতা | তিনি ওই কাগজের সূত্র ধরে আসেন এই প্রতিষ্ঠানে | রেকর্ড বের করে তিনি জানেন তার গ্রামের নাম | একটা কথা বলা হয়নি | এই প্রতিষ্ঠান থেকে কোন বাচ্চা দত্তক নিলে ভবিৎষতে ওই বাচ্চাটি বড় হয়ে যদি কখনো কাগজপত্র নিয়ে এখানে এসে সে তার উৎস জানতে চায় তা জানিয়ে দিতে এখানকার লোকেরা বাধ্য | কারণ যেহেতু কাগজগুলি আইনি কাগজ | যা বলছিলাম , গ্রামে এসে তিনি প্রথমে যাদের কাছে তাকে বিক্রি করা হয়েছিল সেখানে যান | সেখান থেকে নিজ বাড়িতে | তার ভাইবোনদের মধ্যে মাত্র দুজনে বেঁচে ছিল | তিনি তার পরিচয় দেন | কিন্তু তার দরিদ্র ভায়েরা তা বিশ্বাস করেনা | তখনকার মত ফিরে গেলেও তিনি বছরে একবার করে ওই প্রতিষ্ঠানে আসা শুরু করেন এবং প্রচুর অর্থ সাহায্য করতে থাকেন | এইভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের অলিখিতভাবে তিনি বিশেষ একজন হয়ে ওঠেন | সেদিন যখন তুমি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলে উনি উনার কার্ডটি দিয়ে আমায় ফোন যোগাযোগ করতে বলেছিলেন | উনার কাছ থেকেই সবকিছু জানতে পারি পরবর্তীতে | আর এই দুই বছরে তোমাকে না জানিয়ে আমি বহুবার উনার সাথে হয় গ্রামে নাহয় এই প্রতিষ্ঠানে দেখা করেছি | সবকিছু উনার মুখ থেকেই আমি শুনেছি | ভীষণ ভালো মানুষ | এতো বড় একজন মানুষ হয়েও মনটি শিশুর মত সরল | গড়গড় করে নিজের অতীতের কথা আমায় বলে গেলেন | আবার সতর্কও করলেন আমাদের মেয়েটি বড় হওয়ার আগেই যেন আমরা আইনি কাগজপত্রগুলো অন্য কোথাও সেরে ফেলি | সে যেন কোন অবস্থাতেই জানতে না পারে আমরা ওকে দত্তক নিয়েছি |
সবকিছু মন দিয়ে শোনার পর শ্রীতমা বললো ,
--- আমরা বাড়িটা বিক্রি করেই অন্যকোথাও চলে যাবো | ওর চার পাঁচ বছর বয়সেই আমরা কাগজগুলো পুড়িয়ে ফেলবো বুঝলে |
অতীশ একটি হাত তার শ্রীর মাথার উপর রেখে বললো ,
--- কাল তো আমরা ওকে নিয়ে আসবো | এখন চলো ওর কিছু জামাকাপড় , দুধের বোতল , তোয়ালে কিনে নিয়ে যাই |
--- হ্যা তাই চলো | কাল আমরা বাবা মা হচ্ছি ---- | খুব আনন্দ হচ্ছে |
No comments:
Post a Comment