ভাইবোন
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
বিষাদের সুর বেজে উঠেছে | কনকাঞ্জলি শেষ | এবার মেয়ের বিদায়ের পালা | মেয়ে জামাইকে ভিড় করে বাড়ির লোকজন , পাড়াপ্রতিবেশি ও বন্ধুস্বজন | কিন্তু তৃষার চোখদুটি এই ভিড়ের মধ্যে খুঁজে চলেছে অন্যদুটি চোখকে | কেউ সেটা খেয়াল না করলেও তার বাবা পিনাকী ব্যানার্জী ঠিক বুঝতে পেরেছেন সে কাকে খুঁজছে | তাই মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন ," একটু অপেক্ষা কর আমি দেখছি |" একতলা দুতলার সমস্ত ঘর ঝখন বিতানকে তিনি পেলেননা তখন তিনি বুঝতে পারলেন সে কোথায় আছে | দ্রুতপায়ে তিনি উঠে গেলেন চিলেকোঠায় | এখন সেখানে পুরনো জিনিসপত্রে বোঝাই | যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই | পুরনো লোহার বাক্সটা খুলে নিয়ে দুই ভাইবোনের ছেলেবেলার ভাঙ্গা খেলনাগুলো নিয়ে সেগুলো নাড়িয়ে চারিয়ে দেখছে তার টুয়েলভ পাঠরত ছেলে | যেগুলো নিয়ে দুই ভাইবোনে সবসময় সময় কাটাতো | বিতানের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে | পিনাকীবাবু আস্তে আস্তে গিয়ে তার মাথায় হাত রাখেন | বিতান ছেলেমানুষের মত কেঁদে ওঠে |
" বাবা , দিদিয়া শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে আমরা কি করে থাকবো ?
-- তাইবলে তুই এখানে লুকিয়ে থাকবি তার বিদায়ের মুহূর্তে ?
--- এই কথাটাতে আমার আপত্তি আছে বাবা | বিদায় ? কিসের বিদায় ? এটা দিদিরও বাড়ি | নিজের বাড়ি থেকে কেউ বিদায় নেয় ?
--- দূর বোকা ? এটা দিদির বাপের বাড়ি | আজ সে নিজের বাড়িতে যাচ্ছে |
--- লোকে কেন এসব কথা বলে আমি বুঝিনা | যে বাড়িতে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে --- যে বাড়ির আনাচেকানাচে ছোট থেকে বড় হয়ে উঠার স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে --- বিয়ের সাথে সাথে সেই বাড়িটা পরের বাড়ি হয়ে গেলো ? এ কেমন ধরণের নিয়ম ?
--- আদিকাল থেকে যে এটাই চলে আসছে রে ---
--- এ নিয়ম আমি মানিনা ---
--- মানিনা বললেই কি হয় রে --- ?মেয়ের জম্মের সাথে সাথেই তাকে বড় করা হয় , শিক্ষা দেওয়া হয় সবই সেই পরের ঘরের জন্য | বাবা মা তাকে বুকে আগলে রেখে বড় করে , সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষা করে --- সবকিছুই করে সে জেনেবুঝে যে একদিন তার মায়ের আঁচলে তিনমুঠো চাল ফেলে দিয়ে সব ঋণ শোধ করে দিয়ে চলে যাবে বলে | আর ঠিক এই বিদায়ের মুহূর্তে বাবা মায়ের বুকে ওঠে ঢেউ , কেউ যেন জোরে জোরে বুকের ভিতর হাতুড়ির আঘাত করে --- সেই মুহূর্তে বাবা মা যে কতটা অসহায় হয়ে পরে তা যার মেয়েসন্তান নেই সে কোনদিনও বুঝতে পারবেনা | তুই নিচুতে চল ওদের দেরি হয়ে যাচ্ছে |
--- এতকাল ধরে এই বাড়িটা আমাদের চারজনের ছিল | হঠাৎ করে দিদিয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে বাড়িটায় দিদির কোন অধিকার নেই --- এটা কিছুতেই হতে পারেনা বাবা | এই বাড়িটা আমাদের চারজনের ছিল চারজনেরই থাকবে |
--- বাবা মা মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তারজন্য উপযুক্ত ছেলে খুঁজে তার বিয়ে দেয়, সাধ্যমত প্রচুর খরচ করে | আর তার যদি ছেলে থাকে বাড়িটা নিজের থাকে বাবা মায়ের অবর্তমানে বাড়িটা ছেলেই হয় | কিন্তু আইন এখন পাল্টে গেছে | বিয়ের পরে মেয়েরা যদি ক্লেম করে তাহলে সেই সম্পত্তি বিয়েদাড়ি মেয়েরাও পায় | আবার মা বাবা ইচ্ছা করলেই তাদের সমস্ত সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে দিতে পারেন |
--- এসব আমি সবকিছুই জানি বাবা | আমার একটাই প্রশ্ন --- বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা বলে ," বাপেরবাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি "-- আপত্তিটা আমার এখানেই | এই বাড়িটাকে বিয়ের আগে দিদিয়া বলতো ' নিজের বাড়ি ' এখন তবে কেন বলবে 'বাপের বাড়ি' এটা দিদিয়ারও বাড়ি|
--- আসলে কি জানিস বিতান আগেকার দিনে মেয়েকে একটু বড় করেই টাকাপয়সা খরচ করে মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিত | তখনকার দিনে তো মেয়েদের লেখাপড়া শেখার চল ছিলোনা আর আজকের দিনের মত মানুষের এতো টাকাপয়সাও ছিলোনা | আমি জানিনা হয়তো তারা ভাবতেন মেয়ের বিয়ে তো টাকাপয়সা খরচ করেই দিয়েছি আর বাড়িটা ছেলের জন্যই থাক | কিন্তু এটাও ঠিক মেয়েটি যদি স্বামী পরিত্যাক্তা হত বা স্বামী মারা যেত অধিকাংশ শ্বশুরবাড়িতে ওই মেয়েটির কোন জায়গা হতনা | সেক্ষেত্রে সে কিন্তু তখন বাপের বাড়িতেই ঠাঁই পেতো | সবক্ষেত্রে সেটা সুখের হয়তো হতনা কিন্তু মাথা গোজার আশ্রয়টা পেতো|
--- সে তুমি যাইই বলো বাবা মেয়েদের জীবন খুব কষ্টের | বিয়ের পর এই যে সকলকে ছেড়ে একটা অপরিচিত বাড়িতে সে চলে যায় নিজের লোকদের ছেড়ে এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে ? আবার দেখো মেয়েদের মধ্যে আছে এক অসীম ক্ষমতা --- আপনজনদের ছেড়ে গিয়ে অপরিচিত মানুষগুলিকে কেমন মায়া মমতায় বেঁধে ফেলে তাদের সুখদুঃখের সাথী হয়ে ওঠে | মেয়েরা খুব কষ্টসহিষ্ণুও | নিজের কষ্টের কথা সহজে মুখ ফুটে কাউকে বলেনা | একবার আমি আর দিদিয়া মাঠে খেলতে গিয়ে দুজনেই পরে গেছিলাম | দিদিয়ার পা কেটে রক্ত বেরোচ্ছিল | অথচ দিদিয়া সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে দৌড়ে এসে আমাকে তুলে বারবার জানতে চাইছিলো 'ভাই তোর কোথাও লাগেনি তো'? আমি তো তখন চিৎকার করে কাঁদছি | অথচ আমার কিন্তু কেঁটেছিলোনা |
হঠাৎ করেই পিনাকীবাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন | ফিরে গেলেন তিনি কুড়ি বছর আগের একটি দিনে | তিন বছরের মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়ি থেকে নিজের গাড়ি করে ফিরছিলেন | সাথে ড্রাইভার ছিল | খুব ভোর ভোর রওনা দিয়েছিলেন | বাবা মা তখন মারা গেছেন | বয়স্ক কাকু কাকিমার অনুরোধে তিনি তার মেয়েকে তাদের দেখাতে নিয়ে যান | গ্রামের মেঠো পথ ধরে যখন গাড়ি চলছে তখন হঠাৎই প্রকৃতির ডাকে তিনি গাড়ি থেকে নেমে একটু ঘন বাগানের দিকে এগিয়ে যান | এইসময় তিনি একটি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখেন একটি সদ্যজাত শিশু একটা শত ছেড়া কাঁথায় মুড়িয়ে ওই বাগানের ভিতর কেউ ফেলে গেছে | কিছুটা সময় হতভম্ব হয়ে তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন | ভাবতে থাকেন বাচ্চাটিকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যেই এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে কাকভোরে | তারপর তিনি পরম মমতায় তাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ফিরে আসেন গাড়ির কাছে | স্ত্রীকে সব খুলে বলেন | স্ত্রীও কোন আপত্তি করেননা | তবুও তিনি বলেন দুটি বাচ্চাকে নিয়ে তুমি পেরে উঠবেনা | আমি একটি আয়া রেখে দেবো | আসলে বাচ্চাটিকে যদি আমি না নিয়ে আসতাম কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো ও মারায় যেত | সবকিছু ঈশ্বরের লীলা | আর সেই কারণেই তিনিই হয়তো আমাকে ওই বাগানের ভিতর নিয়ে গেছেন | ছোট্ট তৃষা তখন জানতে চেয়েছিলো ' ইতা কে ?' দুজনে একসাথেই বলে উঠেছিলেন ' তোমার একটা ছোট্ট ভাই '|
সেই থেকে ভাই অন্ত প্রাণ ছিল তৃষার | বিতান যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছে তখন থেকেই দিদিয়াই তার সব | যখন তৃষা নিজেই ভালোভাবে হাতে খেতে শেখেনি তখন থেকেই বিতান দিদিয়ার হাতে ছাড়া খাবেনা | ছোট্ট ছোট্ট হাতে মায়ের মেখে দেওয়া ভাত সে ভায়ের মুখে দিচ্ছে আর ওর মা তৃষার মুখে দিচ্ছে | এইভাবেই তারা বড় হয়ে উঠেছে | বিতানের ডাকে ভাবনার জাল ছিড়ে যায় পিনাকীবাবুর ---
--- বাবা এবার চলো নীচে যাই --- আমি কিন্তু দিদিয়াকে বলবো এই বাড়িটা সারাজীবন দিদিয়ারও থাকবে |
চোখের জলটাকে আটকে পিনাকীবাবু ছেলের মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলিকে একটু নাড়িয়ে দিয়ে হেসে পরে বললেন ," আচ্ছা ঠিক আছে তাই বলে দিস|"
No comments:
Post a Comment