Saturday, March 7, 2020

ভাইবোন

ভাইবোন  

   নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  
  
   বিষাদের  সুর  বেজে  উঠেছে  | কনকাঞ্জলি  শেষ  | এবার  মেয়ের  বিদায়ের  পালা  | মেয়ে  জামাইকে  ভিড়  করে  বাড়ির  লোকজন  , পাড়াপ্রতিবেশি  ও  বন্ধুস্বজন  | কিন্তু  তৃষার  চোখদুটি  এই  ভিড়ের  মধ্যে  খুঁজে  চলেছে  অন্যদুটি  চোখকে  | কেউ  সেটা  খেয়াল  না  করলেও  তার  বাবা  পিনাকী  ব্যানার্জী  ঠিক  বুঝতে  পেরেছেন  সে  কাকে  খুঁজছে  | তাই  মেয়ের  কাছে  এগিয়ে  গিয়ে  বললেন ," একটু  অপেক্ষা  কর  আমি  দেখছি  |" একতলা  দুতলার  সমস্ত  ঘর  ঝখন  বিতানকে  তিনি  পেলেননা  তখন  তিনি  বুঝতে  পারলেন  সে  কোথায়  আছে  | দ্রুতপায়ে  তিনি  উঠে  গেলেন  চিলেকোঠায়  | এখন  সেখানে  পুরনো জিনিসপত্রে  বোঝাই  | যা  ভেবেছিলেন  ঠিক  তাই  | পুরনো লোহার  বাক্সটা  খুলে  নিয়ে  দুই  ভাইবোনের  ছেলেবেলার  ভাঙ্গা খেলনাগুলো  নিয়ে  সেগুলো  নাড়িয়ে  চারিয়ে দেখছে  তার  টুয়েলভ  পাঠরত   ছেলে  | যেগুলো  নিয়ে  দুই  ভাইবোনে  সবসময়  সময়  কাটাতো | বিতানের  দুচোখ  বেয়ে  জল  গড়িয়ে  পড়ছে  | পিনাকীবাবু  আস্তে  আস্তে  গিয়ে  তার  মাথায়  হাত  রাখেন  | বিতান  ছেলেমানুষের  মত  কেঁদে  ওঠে  |
" বাবা , দিদিয়া  শ্বশুরবাড়ি  চলে  গেলে  আমরা  কি  করে  থাকবো  ?
-- তাইবলে  তুই  এখানে  লুকিয়ে  থাকবি  তার  বিদায়ের  মুহূর্তে  ?
--- এই  কথাটাতে  আমার  আপত্তি  আছে  বাবা  | বিদায় ? কিসের  বিদায় ? এটা দিদিরও  বাড়ি  | নিজের  বাড়ি  থেকে  কেউ  বিদায়  নেয়  ?
--- দূর  বোকা ? এটা দিদির  বাপের  বাড়ি  | আজ  সে  নিজের  বাড়িতে  যাচ্ছে  |
--- লোকে  কেন  এসব  কথা  বলে  আমি  বুঝিনা  | যে  বাড়িতে  ছোটবেলা  থেকে  বড়  হয়েছে  --- যে  বাড়ির  আনাচেকানাচে  ছোট  থেকে  বড়  হয়ে  উঠার  স্মৃতি  ছড়িয়ে  রয়েছে  --- বিয়ের  সাথে  সাথে  সেই  বাড়িটা  পরের  বাড়ি  হয়ে  গেলো ? এ  কেমন  ধরণের নিয়ম  ?
--- আদিকাল  থেকে  যে  এটাই  চলে  আসছে  রে  ---
--- এ  নিয়ম  আমি  মানিনা  ---
--- মানিনা  বললেই  কি  হয়  রে  --- ?মেয়ের জম্মের  সাথে  সাথেই  তাকে  বড়  করা  হয়  , শিক্ষা  দেওয়া  হয়  সবই  সেই  পরের  ঘরের  জন্য  | বাবা  মা  তাকে  বুকে  আগলে  রেখে  বড়  করে  , সমস্ত  ঝড়ঝাপটা  থেকে  রক্ষা  করে  --- সবকিছুই  করে  সে  জেনেবুঝে  যে  একদিন  তার  মায়ের  আঁচলে  তিনমুঠো  চাল  ফেলে  দিয়ে  সব  ঋণ শোধ  করে  দিয়ে  চলে  যাবে  বলে  | আর  ঠিক  এই  বিদায়ের  মুহূর্তে  বাবা  মায়ের  বুকে  ওঠে  ঢেউ  , কেউ  যেন  জোরে  জোরে  বুকের  ভিতর  হাতুড়ির  আঘাত  করে  --- সেই  মুহূর্তে  বাবা  মা  যে  কতটা  অসহায় হয়ে  পরে  তা  যার  মেয়েসন্তান  নেই  সে  কোনদিনও  বুঝতে  পারবেনা  | তুই  নিচুতে  চল  ওদের  দেরি  হয়ে  যাচ্ছে  |
--- এতকাল  ধরে  এই  বাড়িটা  আমাদের  চারজনের  ছিল  | হঠাৎ  করে  দিদিয়ার বিয়ে  হয়ে  যাওয়াতে  বাড়িটায় দিদির  কোন  অধিকার  নেই  --- এটা কিছুতেই  হতে  পারেনা  বাবা  | এই  বাড়িটা  আমাদের  চারজনের  ছিল  চারজনেরই  থাকবে  |
--- বাবা  মা  মেয়েকে  সুশিক্ষায়  শিক্ষিত  করে  তারজন্য  উপযুক্ত  ছেলে  খুঁজে  তার  বিয়ে  দেয়, সাধ্যমত  প্রচুর  খরচ  করে  | আর  তার  যদি  ছেলে  থাকে  বাড়িটা  নিজের  থাকে  বাবা  মায়ের  অবর্তমানে  বাড়িটা  ছেলেই  হয়  | কিন্তু  আইন  এখন  পাল্টে  গেছে  | বিয়ের  পরে  মেয়েরা  যদি  ক্লেম করে  তাহলে  সেই  সম্পত্তি  বিয়েদাড়ি মেয়েরাও  পায় | আবার  মা  বাবা  ইচ্ছা  করলেই  তাদের  সমস্ত  সন্তানদের  মধ্যে  সম্পত্তির  ভাগ  বাটোয়ারা  করে  দিতে  পারেন  | 
--- এসব  আমি  সবকিছুই  জানি  বাবা  | আমার  একটাই প্রশ্ন  --- বিয়ে  হয়ে  গেলে  মেয়েরা  বলে  ," বাপেরবাড়ি  আর  শ্বশুরবাড়ি "-- আপত্তিটা আমার  এখানেই  | এই  বাড়িটাকে  বিয়ের  আগে  দিদিয়া  বলতো  ' নিজের  বাড়ি  ' এখন  তবে  কেন  বলবে  'বাপের  বাড়ি' এটা দিদিয়ারও বাড়ি|  
--- আসলে  কি  জানিস  বিতান  আগেকার  দিনে  মেয়েকে  একটু  বড়  করেই  টাকাপয়সা  খরচ  করে  মেয়েটির  বিয়ে  দিয়ে  দিত  | তখনকার  দিনে  তো  মেয়েদের  লেখাপড়া  শেখার  চল  ছিলোনা  আর  আজকের  দিনের  মত  মানুষের  এতো  টাকাপয়সাও  ছিলোনা  | আমি  জানিনা    হয়তো  তারা  ভাবতেন  মেয়ের  বিয়ে  তো  টাকাপয়সা  খরচ  করেই  দিয়েছি  আর  বাড়িটা  ছেলের  জন্যই থাক | কিন্তু  এটাও  ঠিক  মেয়েটি  যদি  স্বামী  পরিত্যাক্তা  হত বা  স্বামী  মারা  যেত  অধিকাংশ  শ্বশুরবাড়িতে  ওই  মেয়েটির  কোন  জায়গা  হতনা | সেক্ষেত্রে  সে  কিন্তু  তখন  বাপের  বাড়িতেই  ঠাঁই পেতো | সবক্ষেত্রে  সেটা  সুখের  হয়তো  হতনা কিন্তু  মাথা  গোজার  আশ্রয়টা  পেতো|
--- সে  তুমি  যাইই বলো  বাবা মেয়েদের  জীবন  খুব  কষ্টের  | বিয়ের  পর  এই  যে  সকলকে  ছেড়ে  একটা  অপরিচিত  বাড়িতে  সে  চলে  যায়  নিজের  লোকদের  ছেড়ে  এর  থেকে  কষ্টের  আর  কি  হতে  পারে ? আবার   দেখো  মেয়েদের  মধ্যে  আছে  এক  অসীম  ক্ষমতা  --- আপনজনদের  ছেড়ে  গিয়ে  অপরিচিত  মানুষগুলিকে  কেমন  মায়া মমতায়  বেঁধে  ফেলে  তাদের  সুখদুঃখের  সাথী  হয়ে  ওঠে  | মেয়েরা  খুব  কষ্টসহিষ্ণুও  | নিজের  কষ্টের  কথা  সহজে  মুখ  ফুটে  কাউকে  বলেনা | একবার  আমি  আর  দিদিয়া  মাঠে  খেলতে  গিয়ে  দুজনেই  পরে  গেছিলাম  | দিদিয়ার   পা  কেটে  রক্ত  বেরোচ্ছিল  | অথচ  দিদিয়া  সেদিকে  ভ্রূক্ষেপ  না  করে  দৌড়ে  এসে  আমাকে  তুলে  বারবার  জানতে  চাইছিলো  'ভাই  তোর  কোথাও  লাগেনি  তো'? আমি  তো  তখন চিৎকার  করে  কাঁদছি  | অথচ  আমার  কিন্তু  কেঁটেছিলোনা  |
  হঠাৎ  করেই  পিনাকীবাবু  একটু  অন্যমনস্ক  হয়ে  গেলেন  | ফিরে  গেলেন  তিনি  কুড়ি  বছর  আগের  একটি  দিনে  | তিন  বছরের  মেয়ে  ও  স্ত্রীকে  নিয়ে  তিনি  গ্রামের  বাড়ি  থেকে নিজের  গাড়ি  করে   ফিরছিলেন  | সাথে  ড্রাইভার  ছিল  | খুব  ভোর  ভোর  রওনা  দিয়েছিলেন | বাবা  মা  তখন  মারা  গেছেন | বয়স্ক  কাকু  কাকিমার  অনুরোধে  তিনি  তার  মেয়েকে  তাদের  দেখাতে  নিয়ে  যান  | গ্রামের  মেঠো  পথ  ধরে  যখন  গাড়ি  চলছে  তখন  হঠাৎই  প্রকৃতির  ডাকে  তিনি  গাড়ি  থেকে  নেমে একটু  ঘন  বাগানের  দিকে  এগিয়ে  যান  | এইসময়  তিনি  একটি  বাচ্চার  কান্নার  আওয়াজ  পেয়ে  আরও কিছুটা  এগিয়ে  গিয়ে  দেখেন  একটি  সদ্যজাত  শিশু  একটা  শত  ছেড়া কাঁথায় মুড়িয়ে  ওই  বাগানের  ভিতর  কেউ  ফেলে  গেছে  | কিছুটা  সময়  হতভম্ব  হয়ে  তিনি  সেখানেই  দাঁড়িয়ে  থাকেন  | ভাবতে  থাকেন  বাচ্চাটিকে  মেরে  ফেলার  উদ্দেশ্যেই  এখানে  ফেলে  দেওয়া  হয়েছে  কাকভোরে  | তারপর  তিনি  পরম মমতায়  তাকে  কোলে  তুলে  বুকে  জড়িয়ে  ফিরে  আসেন  গাড়ির  কাছে  | স্ত্রীকে  সব  খুলে  বলেন  | স্ত্রীও  কোন  আপত্তি  করেননা  | তবুও  তিনি  বলেন  দুটি  বাচ্চাকে  নিয়ে  তুমি  পেরে  উঠবেনা  | আমি  একটি  আয়া রেখে  দেবো | আসলে  বাচ্চাটিকে  যদি  আমি  না  নিয়ে  আসতাম  কিছুক্ষণের মধ্যে  হয়তো  ও  মারায় যেত | সবকিছু  ঈশ্বরের  লীলা  | আর  সেই  কারণেই  তিনিই  হয়তো  আমাকে  ওই  বাগানের  ভিতর  নিয়ে  গেছেন  | ছোট্ট  তৃষা  তখন  জানতে  চেয়েছিলো  ' ইতা কে ?' দুজনে  একসাথেই  বলে  উঠেছিলেন  ' তোমার  একটা  ছোট্ট  ভাই '| 
 সেই  থেকে  ভাই  অন্ত  প্রাণ  ছিল  তৃষার  | বিতান  যখন  একটু  একটু  করে  বড়  হচ্ছে  তখন  থেকেই  দিদিয়াই তার  সব  | যখন  তৃষা  নিজেই  ভালোভাবে  হাতে  খেতে  শেখেনি  তখন  থেকেই  বিতান  দিদিয়ার হাতে  ছাড়া  খাবেনা | ছোট্ট  ছোট্ট  হাতে  মায়ের  মেখে  দেওয়া  ভাত সে  ভায়ের  মুখে  দিচ্ছে  আর  ওর  মা  তৃষার  মুখে  দিচ্ছে  | এইভাবেই  তারা  বড়  হয়ে  উঠেছে  | বিতানের  ডাকে  ভাবনার  জাল  ছিড়ে যায়  পিনাকীবাবুর  ---
--- বাবা  এবার  চলো  নীচে  যাই  --- আমি  কিন্তু  দিদিয়াকে  বলবো  এই  বাড়িটা  সারাজীবন  দিদিয়ারও  থাকবে  |
  চোখের  জলটাকে  আটকে  পিনাকীবাবু  ছেলের  মাথায়  হাত  দিয়ে  চুলগুলিকে  একটু  নাড়িয়ে  দিয়ে  হেসে  পরে  বললেন ," আচ্ছা  ঠিক  আছে  তাই  বলে  দিস|"

No comments:

Post a Comment