#সাম্য_সবার_জন্য
#আমার_লেখনীতে
সোনার সংসার
বৌভাতের পরেরদিন সুপ্তা মায়ের কথামত খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে নিজেকে সুন্দরভাবে পরিপাটি করে যখন দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন বেশ কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে তার পুরো শরীরটাকে যে মাপছে এটা তার দৃষ্টি এড়ায়না | সে নিজের গায়ের ওড়নাটা একটু নাড়াচাড়া করে যখন রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় ঠিক তখনই এ বাড়ির সবথেকে বয়স্ক মানুষটি খাটে শায়িত অবস্থায় ( কারণ কয়েক সেকেন্ড আগেই এ বাড়ির কোন এক সদস্য তার কানে নূতন বৌ চুড়িদার পড়েছে কথাটা দিয়ে এসেছে ) নাতবৌকে তার ঘরে ডেকে নেন |
-- শোনো নাতবৌ আমাদের বাড়িতে বৌ হয়ে থাকতে গেলে এসব পোশাক পরা চলবেনা |
--- কিন্তু দাদু শাড়ির থেকে তো চুড়িদার অনেক মার্জিত পোশাক |
--- মুখে মুখে তর্ক করবেনা | যেটা বললাম সেটা করো | এই পোশাক খুলে শাড়ি পরে আসো |
কিছুটা সময় থমকে গেলো নববিবাহিতাটি | মা অনেক করে বলে দিয়েছেন শ্বশুরবাড়িতে বড়দের মুখে মুখে তর্ক করবেনা | একবার ভাবলো না কিছু বলবেনা কিন্তু পরমুহূর্তে চিন্তা করে দেখলো কয়েকদিন পরে যখন সে অফিসে বেরোবে তখন তো তাকে চুড়িদার পরেই বেরোতে হবে কারণ অতো ভিড় বসে সে তো নিত্য শাড়ি পরে বেরোতে পারবেনা | কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলো তার শ্বাশুড়ি মা সেই ঘরে এসে ঢুকে তাকে চোখের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন | সুপ্তা চোখভর্তি জল নিয়ে কি হতে চলেছে কিছুই না বুঝে একদৌড়ে দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো |
শ্বাশুড়ি শোভাদেবী তার পঁচাশি বছরের শ্বশুরের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন | আজও শ্বশুরের সামনে এলে তাকে ঘোমটা দিয়েই আসতে হয় | তা নাহলেই তিনি বেহায়া বৌ হয়ে যান |
--- বাবা আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল |
--- কি কথা বল |
--- আজ ত্রিশবছর আমি এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছি | আজও আমি আপনার কথার বা যতদিন মা বেঁচে ছিলেন তার কথা অমান্য করিনি | যা বলেছেন মুখ বুজে সেই কাজ করে গেছি আমার যতই কষ্ট হোকনা কেন | এখন আমি নিজেই শ্বাশুড়ি | দুনিয়ার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বাবা | আজকের যুগের মেয়েরা তখনকার যুগের মেয়েদের মত ঘোমটা দিয়ে শুধু ঘরসংসার সামলায়না | পুরুষের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে তারা অফিস এবং বাইরের কাজগুলিও করে | সুতরাং ওই শাড়ি পরে দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করতে পারেনা | আর আমার মতে শাড়ির থেকে চুড়িদার , নাইটি অনেক ভদ্র ও মার্জিত পোশাক |
-- এতো বড় বড় কথা আমার সামনে দাঁড়িয়ে কি করে বলছো তুমি ?
--- তিল তিল করে নিজেকে তৈরী করেছি এই দিনটির জন্য | আমি যেদিন বৌ হয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছিলাম সেদিন আপনাদের বলা কথাগুলি আমি মেনে নিয়েছিলাম | কিন্তু বাবা, মা আজ বেঁচে নেই আর এই সংসারটি এখন আমার | এর ভালোমন্দ সবকিছু আমার | আমি আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছি --- আমি বৌ হয়ে এসে আমার ভালোলাগা মন্দলাগা সব বিসর্জন দিয়ে আপনাদের ভালোলাগা মন্দলাগাগুলোকে নিজের করে নিয়েছি | কষ্ট পেয়েছি , চোখের জল ফেলেছি কিন্তু প্রতিবাদ করিনি | আপনার এখন বয়স হয়েছে | চোখেও ভালো দেখতে পাননা , হাঁটাচলাও করতে পারেননা --- কে আপনাকে কি বলে গেলো তাই নিয়ে আপনি বাচ্চা মেয়েটাকে তার সংসারে প্রথম দিনেই কাঁদিয়ে দিলেন?আজ বাদে কাল সে যখন অফিস যাওয়া শুরু করবে সেতো এই ধরনের পোশাক পরেই অফিসে যাতায়াত করবে | আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আমার ছেলে আর ছেলেবৌকে নিয়ে আপনাকে কিছু ভাবতে হবেনা | শ্বশুর হয়ে আপনার ছেলের যখন কোন আপত্তি নেই তখন আপনি দাদাশ্বশুর হয়ে কেন আপত্তি করবেন ? আমার কথাগুলো শুনতে হয়তো আপনার ভালো লাগছেনা --- একটু কটু মনে হচ্ছে কিন্তু আমি নিরুপায় | যে কষ্ট আমি পেয়েছি তা আমি আমার একমাত্র ছেলের বৌকে পেতে দেবোনা |
বৃদ্ধশ্বশুর চোখ বুজেই থাকলেন কারণ তিনি এতগুলো বছরে তার ছেলের বৌকে কোনদিন এভাবে কথা বলতে দেখেননি আর তিনি কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে বেশকিছু আত্মীয়স্বজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সম্মুখ হতে দোতলায় ছেলের বৌয়ের কাছে চলে গেলেন |
--- যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই | বোকা মেয়ে একটা | সেই থেকে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে নিয়েছিস ? আর তুই ( ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন ) শুয়ে শুয়ে বৌ এর কান্না দেখছিস ?
-- কি যে হয়েছে আমি সেটা বুঝার চেষ্টা করছি |
শোভাদেবী সুপ্তার মাথায় হাত রেখে হেসে পরে বললেন ,
--- তোর যা খুশি তুই তাই পরবি | যাতে তুই আরাম পাবি সেই পোশাক পরবি | আর তোকে কেউ কিছু বলবেনা | জীবনে আমি যেগুলি কম্প্রোমাইজ করেছি তোকে তা কিচ্ছু করতে হবেনা | জীবন তো একটাই | আর সেই জীবনে শুধু মেয়েরাই সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে কেন ? তখন আমি নূতন বৌ ছিলাম তাই কোন প্রতিবাদ করতে পারিনি কারণ আমার পাশে কেউ ছিলোনা | কিন্তু তোর পাশে আমি আছি --- কোন আঘাত তোকে ছুতে পারবেনা |
--- ব্যাস হয়ে গেলো | আমি বেঁচে গেলাম | আমাকে আর কিছু করতে হবেনা |
কথাগুলি এমনভাবে বিতান বললো শ্বাশুড়ি বৌ দুজনেই হেসে দিলো | আর সুপ্তা পরম নিশ্চিন্তে শ্বাশুড়িমায়ের বুকে মুখ লুকালো | মনেমনে ভাবতে লাগলো তোমার মত বটবৃক্ষ যে সংসারে আছে সে সংসারকে আমি সোনার সংসার করে গড়ে তুলবো |
No comments:
Post a Comment