পারতেই হবে
বাবার মৃত্যুর পর পড়াশুনাটা মাঝপথেই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো | বাবা যখন অসুস্থ্য অবস্থায় সরকারি হাপাতালে ভর্তি অনন্যার তখন উচ্চমাধ্যমিক দরজায় কড়া নাড়ছে | মা প্রতিদিন দুবেলা হাসপাতাল ছুটছেন | জীবনে এতো অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে সে আর কখনো পড়েনি | পড়াশুনায় অনন্যা চিরদিনই খুব ভালো | বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে | অনন্যাকে নিয়ে তার বাবার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন | রাজ্যসরকারী কর্মচারী তার বাবা | মোটা মাইনের চাকরি না হলেও ভালোভাবেই তিনটি প্রাণীর চলে যায় | তার ইচ্ছা মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন | তাই প্রফিডেন্টফান্ডে তিনি একটু বেশিই টাকা কাটান | হাতে করে বাড়িতে যা নিয়ে আসেন সবই তো সেই সংসারেই ঢুকে যায় | আলাদা করে ব্যাঙ্কে কিছুই সেভিংস করতে পারেননা | মেয়ের জন্য বেশ কয়েকজন ভালো শিক্ষকও রেখেছেন | সবসময় মেয়েকে বলেন, "মানুষের জীবনে যদি স্বপ্ন না থাকে তাহলে জীবন অর্থহীন হয়ে পরে | জীবনে স্বপ্ন ছাড়া লক্ষ্য পূরণ হয়না | জীবনে লক্ষ্য না থাকলে জীবনটা হয়ে পরে মাঝিহীন নৌকার মত | তাই যতদিন বাঁচবি স্বপ্ন দেখবি এমন স্বপ্ন যা তুই পূরণ করতে পারবি সে স্বপ্ন যেন আকাশকুসুম না হয় |"
বাবার কাছে বারবার তার জীবনের লক্ষ্য শুনতে শুনতে সেও নিজেকে ভবিৎষতে একজন ডাক্তার হিসাবেই কল্পনা করতে থাকে | কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত অনন্যার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মাত্র তিনদিন আগে তার বাবা লান্চে সংক্রমণজনিত কারণে চিরদিনের মত অজানার উদ্দেশ্যে পারি দেন | কিন্তু অনন্যা জানে পরীক্ষায় সে যদি না বসে তাহলে তার বাবার আত্মা শান্তি পাবেনা | বাবার মৃত্যুর পর বই ধরার আর মানসিক পরিস্থিতি তার আসেনি | তাই পূর্বের প্রস্তুতি নিয়েই সে ফাইনাল পরীক্ষায় বসে | আশানুরূপ রেজাল্ট না হলেও ভালো রেজাল্টই সে করে | কিন্তু জয়েন্টে সে 350 রাঙ্ক করে | সুযোগ পায় বড় সরকারি মেডিকেল কলেজে |
কলেজ হোস্টেলে অতি সাধারণ অনন্যার সাথে কেউই সেভাবে মিশতোনা | সে ছিল সকলের কাছে অচ্ছুৎ | সেখানে সকলেই ছিল বড়ঘরের সন্তান | তাদের পোশাকআশাক , আচারআচরণ কোনকিছুর সাথেই সে খাপ খাওয়াতে পারতোনা | কিন্তু মনে ছিল অদ্ভুত এক জেদ ' আমাকে পারতেই হবে'- | আর এই জেদের কাছে সমস্ত রকম প্রতিকূলতা তার কাছে নগন্য মনে হোত |
প্রফেসর ডক্টর সম্বরণ ব্যানার্জী | অনন্যাকে প্রথম থেকেই একটু অন্য চোখে দেখেন | একদিন ক্লাস নিতে নিতে অনন্যাকে ডেকে তার সাথে অফিস রুমে দেখা করতে বলেন | সেদিন কলেজ ছুটির পর ভয়ে ভয়ে সে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় |
--- স্যার আমায় ডেকেছিলেন ---
--- পড়াশুনা কেমন চলছে ? হোস্টেলে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে নাতো ? আমার কাছে না লুকিয়ে পরিষ্কার করে বলো |
অনন্যার চোখদুটি জলে ভরে যায় | সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে |
--- তোমায় একটা কথা বলি মা , হোস্টেলে তোমার কোনরমকম অসুবিধা হলে আমায় বলো | আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো তা দূরীকরণের | হয়ত তুমি ভাবছো এত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে তোমাকেই কেন কথাগুলো বলছি --- | তার উত্তর যদি কোনদিন আমার বাড়িতে যাও নিজেই পাবে | হোস্টেলে থেকে যদি মনে করো তোমার পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে আমায় জানিও আমি ব্যবস্থা করবো |
অনন্যা নিচু হয়ে ডক্টর ব্যানার্জীকে একটা প্রণাম করে চুপচাপ বেরিয়ে আসলো | এর কয়েকদিন পরেই কিছুটা কৌতূহলী হয়েই সে ডক্টর ব্যানার্জীর বাড়িতে যায় | দরজা খোলা পেয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দাঁড়ায় | কিন্তু ঘরে ঢুকেই বেশ বড় করে বাঁধানো তার সমবয়সী একটি মেয়ের ছবি দেখে সে পুরো হা হয়ে যায় | অবিকল যেন সে নিজেই --- কি করে এটা সম্ভব ? এ ছবি তবে কার ? সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে সে -- তার সম্বিৎ ফেরে ডক্টর ব্যানার্জীর আগমনে |
--- আমার মেয়ে | 22 বছর বয়সে মারা যায় | যেদিন প্রথম তোমায় কলেজে দেখি সেদিন খুব চমকে উঠেছিলাম | একজন মানুষের সাথে আর একজনের এতো মিল যে থাকতে পারে তোমায় না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতামনা |
--- কি হয়েছিল ?
--- ডাক্তারি পড়তে বাইরে গিয়ে হোস্টেলে থাকতো | একটু নরম স্বভাবের মেয়ে ছিল | ৱ্যাগিং এর শিকার | তিনতলা থেকে একতলা পর্যন্ত একসিঁড়ি বাদে বাদে লাফিয়ে নামতে হবে | এটাই ছিল হোস্টেলের দিদিদের আদেশ |এইভাবে নামতে গিয়েই সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পরে মাথায় চোট পায় | আমরা যখন খবর পাই তখন সব শেষ |
অনন্যার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে তখন |
--- এইটুকুন শুনেই কাঁদছো ? এর পরেও আছে | এসো আমার সাথে --
ডক্টর ব্যানার্জী অনন্যাকে নিয়ে তার বেডরুমে গেলেন | খাটের উপর শায়িত স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন ,
--- আমার স্ত্রী | মেয়ের খবর শুনেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন | কিন্তু তারপরে আর হাঁটাচলা করতে যেমন পারেননা কথাও বলতে পারেননা | আজ দশ বছর ধরে চিকিৎসা করেও কোন ফল হয়নি | আশা ছেড়ে দিয়েছি |
--- কিন্তু আপনারা কোন একশন নেই নি কেন হোস্টেলের বিরুদ্ধে ?
--- কি হবে ? মেয়েটিকে তো আর ফিরে পাবোনা | আর এদিকে তখন ওর মাকে নিয়ে সে এক বিশাল পরিস্থিতি | তবে হ্যা কাউকে শাস্তি না দিলেও সেই সময় ৱ্যাগিং কিছুটা বন্ধ করতে পেরেছিলাম | তারপর বেশ কয়েক বছর আর কোন খবর নেওয়া হয়নি |
অনন্যা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় খাটের কাছে | দিনে রাতে সবসময়ের জন্য দুজন নার্স কুসুমদেবীকে দেখাশুনা করে | নার্স একটু সরে গিয়ে তাকে একটা চেয়ার এনে বসতে দেয় | কিন্তু অনন্যা চেয়ারে না বসে কুসুমদেবীর কাছে গিয়ে খাটের উপর বসে | সে কুসুমদেবীর মাথায় একটা হাত রাখে | তিনি চোখ খুলে অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে | চোখের কোণ বেয়ে জল পড়তে লাগে | নার্স ডক্টর ব্যানার্জীকে ইশারায় দেখায় কুসুমদেবীর ঠোঁটদুটি কাঁপছে তিনি কথা বলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন | নার্স এবং ডক্টর ব্যানার্জী দুজনেই যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন | বুদ্ধিমতী অনন্যা কুসুমদেবীকে চোখের জল মুছিয়ে একদম নিজের মায়ের মত জানতে চাইলো ,
--- তুমি কাঁদছো কেন মা ? আমি এসেছি তো তোমার কাছে | এবার তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যাবে |
কুসুমদেবী উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগলেন তাকে নার্স ও অনন্যা ধরে বসিয়ে দিলো | তিনি অনন্যাকে বুকের সাথে চেপে ধরে নিঃশব্দে কেঁদেই গেলেন কিছুক্ষণ আর অনন্যা তার মাথায় আর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো | সম্বরণ বাবু এ দৃশ্য দেখে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলেননা | রাত হচ্ছে অনন্যা হোস্টেলে ফিরবে কিন্তু কুসুমদেবী তাকে কিছুতেই ছাড়বেননা | অগত্যা ডক্টর ব্যানার্জী ফোন করে হোস্টেলের সুপারকে জানিয়ে দেন অনন্যা রাতে হোস্টেলে ফিরবেনা |
আজ প্রায় বছর খানেক হয়ে গেলো অনন্যা ডক্টর সম্বরণ ব্যানার্জীর বাড়ি থেকেই যাতায়াত করছে | কুসুমদেবীর শারীরিক অবস্থারও অনেক উন্নতি হয়েছে | এখন তিনি খাটের উপর নিজেই বসতে ও শুয়ে পড়তে পারেন | জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বললেও অনন্যা তার সব কথায় বুঝতে পারে | অনন্যাকে তিনি নিজের মেয়ে তৃষা ই ভাবেন | ভুলে গেছেন তিনি তার জীবনের সেই মর্মান্তিক সত্যিটা | তাই মেডিকেল পাঠরত প্রায় মেয়ের বয়সী একজন ভবিৎষত ডক্টরের কথানুযায়ী ডক্টর ব্যানার্জী কোন কথায় তার স্ত্রীকে আর খুলে বলেননি | খুলে ফেলেছেন ড্রয়িংরুমে মেয়ের বড় করে বাঁধানো ছবিটা | ডাক্তারী পড়তে পড়তেই অনন্যার জীবনে আসা এই ঘটনাটাকে তার লক্ষ্য পূরণের চ্যালেঞ্জ হিসাবে সে নিয়েছে | কুসুমদেবীকে তৃনা সেজে সুস্থ্য করে তুলতেই হবে --- বাবার স্বপ্নকে পূরণ করতেই হবে ---- | এটাই এখন অনন্যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য |
সবকিছুর জন্য চাই কিছুটা সময় | আমরা নাহয় এই সময়টুকু অনন্যাকে দিয়ে অপেক্ষা করে থাকি তার লক্ষ্য পূরণের জন্য | আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করি পৃথিবীর সব অনন্যায় যেন তাদের স্বপ্ন সফল করার জন্য বন্ধুর পথও অতিক্রম করতে পারে |