Saturday, December 28, 2019

 কিছু  প্রিয়জন  ছাড়া  
আরও একটা  বছর  কেটে  গেলো,
 যখন  কাছে  ছিল  তারা  
 তাদের  ছাড়া  বাঁচতে  পারবো  ভাবিনি  |
 অথচ  হাসি  আনন্দেই  দিব্যি আছি -
 তবে  কখনও কখনও মনের মাঝে  
 একরাশ  শূন্যতা  আষ্ঠেপৃষ্ঠে  জড়িয়ে  থাকে|

                মানবী  

Friday, December 27, 2019

কিছু সম্পর্কের নাম হয়না



  কিছু  সম্পর্কের  নাম  হয়না  

     নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

    আটটা পাঁচের  বনগাঁ  লোকাল  ট্রেনটা  ধরে  রোজ  অফিস  আসা সায়নের| কত  চেনা  অচেনা  মানুষের  সাথে  রোজ  দেখা| জীবিকার  প্রয়োজনে, রোগের সাথে  যুদ্ধের  কারনে, স্কুল  কলেজের ছাত্রছাত্রী  শিক্ষক  শিক্ষিকা   নিত্য  অফিসযাত্রী  --- কত  কত  হাজার  লোক  নিত্যদিন  ট্রেন  বা  বাসে যাতায়াত  করছে| কেউ  কারোই  মনের  খবর  জানেনা| রোজ ঘড়ি  ধরে  যাতায়াতের  কারনে  অনেক  অপরিচিত  মানুষও পরিচিত  হয়ে  যায়| একসাথে  পাশাপাশি  বসে  কখনও রাজনীতি, কখনও পারিবারিক  সমস্যা  আবার  কখনোবা  সামাজিক--- ইত্যাদি  নানান  ধরণের  আলোচনা ---- পারিবারিক  নানান  সমস্যায়  " প্রয়োজন  হলে  বলবেন  "-- কথাটা  সামান্য  হলেও  মানসিক  বল  পাওয়ার  জন্য  যথেষ্ট-- হয়তো  সেভাবে  কাউকেই  পাশে  পাওয়া  যায়না  কিন্তু  সাময়িক  পরিচয়ের  সূত্র  ধরে  অনেকের  বিপদের  দিনে  এই  কথাটুকুই  অনেক  পাওয়া  | আজও পৃথিবীতে  যে  ভালো  মানুষ  আছে  আমরা  প্রত্যেকেই  কিন্তু  কোন  না  কোন  সময়  নিজেরাই  টের  পাই| হয়তো  এই  ভালো  মানুষের  সংখ্যাটা  খারাপ  মানুষের  তুলনায়  খুবই  নগন্য  কিন্তু  সংখ্যাটা  যতই  নগন্য হোকনা  কেন  তাদের  জন্যই পৃথিবীটা  আজও এতো  সুন্দর  | প্রতিটা  মুহূর্তেই  আমরা  টের  পাচ্ছি  অর্থের  লোভে  নিজের  স্বার্থ  চরিতার্থ  করার  জন্য  মানুষ  আস্তে  আস্তে  কত  হিংস্র  আর  ভয়ঙ্কর  হয়ে  উঠছে  | কিন্তু  তবুও  আজও কিছু  কিছু  মানুষ  নিজের  কথা  না  ভেবে  অন্যের  বিপদে  নিজেকে  সপে  দিতে  এক  মুহূর্তও ভাবেননা | 
    সায়নের সাথে  প্রায়ই  দেখা  হয়  নীলিমা  নামের  এক  ভদ্রমহিলার  | ভদ্র  , শিক্ষিত  , মার্জিত  | বয়স  প্রায়  পঁয়ত্রিশের  মধ্যেই  হবে  | মধ্যমগ্রাম  থেকে  ওঠেন  আর  শিয়ালদহ নামেন  | স্কুল  শিক্ষিকা | দেখা  হলেই  একগাল  হেসে  পরে  সায়নের সাথে  কুশল  বিনিময়  করেন  | মাঝে  মধ্যে  বসার  জায়গা  পেলে  নানান  বিষয়ে  কথা  হয়  | নীলিমাদেবীর  একটি  মাত্র  ছেলে  রহড়া রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়ে  পড়াশুনা  করে  | স্বামী  ব্যাংকের  উচ্চপদস্থ  কর্মচারী  | তিনজনের  সুখী  পরিবার  | 
   সায়নের বয়স এই  আঠাশ  কি  ঊনত্রিশ  বছর  | বছর  খানেক  হোলো বিয়ে  করেছে  | সংসারে  মা  , বাবা  সে  ও  তার  বৌ  | নীলিমাদেবীর  সাথে  অধিকাংশ  দিন  দেখা  হওয়ার  সুবাদে  অসম  বয়সী  হওয়া স্বর্তেও  দুজনের  মধ্যে  বেশ  একটা  বন্ধুত্ব্যর সম্পর্ক  গড়ে  ওঠে  | ভালো  একটা  মাল্টিন্যাশনাল  কোম্পানিতে  চাকরি  করে  সে  | ইচ্ছা  করলে  গ্রামের  বাড়ি  ছেড়ে  দিয়ে  সে  তার  পরিবার  নিয়ে  কলকাতা  শহরে  ঘর  ভাড়া  করে  থাকতেই  পারে  এবং  আর্থিক  সে  ক্ষমতা  তার  আছে  | কিন্তু  কোনদিনও তার  সে  রকম  কোন  ইচ্ছা  জাগেনি  | শহরের  মানুষগুলোর  মন  মানসিকতার  চাইতে  গ্রামের  সহজ  সরল  মানুষগুলোর  মন  মানসিকতা  অনেক  ভালো  | তাদের  দুচোখে  যেন  সর্বদা  সরলতা  প্রকাশ  পায় | ছুটির  দিনগুলোতে  বছরভর  মাইনে দেওয়া  মাঠে  কাজ  করা  নিধুকাকুর  সাথে  হাতে  হাত  লাগিয়ে  কাজ  করতে  তার  আজও ভালো  লাগে  | ভালো  লাগে  ঝুড়ি  ভর্তি  করে  জমি  থেকে  তুলে  আনা সব্জিগুলি  দেখে  মা  বাবার  হাসি  হাসি  মুখটা  দেখতে  | তাই  বাড়ি  ছেড়ে  শহরে  যাওয়ার  ইচ্ছা  তার  কোনদিনও ছিলোনা  আজও নেই  | গ্রামে  সকলের  কাছে  ভালো  ছেলে  বলেই  পরিচিত  সে  | যে  কোন  মানুষের  বিপদে  আপদে  ঝাঁপিয়ে  পড়া  তার  মজ্জাগত  | 
   একদিন  অফিস  ছুটির  পর  বাড়ি  ফেরার  ট্রেন  ধরবার  জন্য  শিয়ালদা  স্টেশনে  এসে  জানতে  পারলো  কি  এক  গন্ডগোলের  কারনে  পরপর  বেশ  কয়েকটি  ট্রেন  বাতিল  হয়েছে  | বসে  বসে  তাই  স্মার্টফোনটা নিয়ে  ফেসবুক  করে  চলেছে  | সকলের  কথাবার্তায়  যা  তার  মনে  হল  বাস  ও  বন্ধ  | বাসে  করে  যারা  যাবে  ভেবেছিলো  তারা  বাস  স্টপেজ  থেকে  ফিরে আসছে  | তাদের  মধ্যে  দেখতে  পেলো  নীলিমাদেবী  ও  আছেন  | তিনি  সেই  দুপুর  থেকে  একবার  বাসস্টপেজ  আর  একবার  স্টেশন  চত্ত্বর  করে  বেড়াচ্ছেন  | অনেকের  মতই তারা  দুজনেও  অথই সমুদ্রে  পড়েছেন  | স্টেশন  চত্ত্বরে  হাজার  হাজার  লোক  গিজগিজ  করছে  | অনেকে  আবার দল বেঁধে  বেঁধে  আশেপাশের  হোটেলগুলোর  দিকে  সকলে  মিলে ভাগাভাগি  করে  থাকার  ব্যবস্থা  করতে  ছুটছেন  | সে  এক  অসহনীয়  পরিস্থিতি  | যার  যার  বাড়িতে  ফোন  করে  জানিয়ে  দিয়েছে  সায়ন ও  নীলিমাদেবী  | নীলিমাদেবীর  উদ্ভিগ্ন  স্বামী  তাকে  বারবার  অনুরোধ  করেছেন  একটা  ট্যাক্সি  ডেকে  তার  বোনের  বাড়ি  গড়িয়া  চলে  যাওয়ার  জন্য  | নীলিমাদেবীর  শত অনুরোধ স্বর্তেও  সায়ন তার  সাথে  যেতে  রাজি  হয়না  | কিন্তু  সে  ট্যাক্সি  ধরে  দেওয়ার  জন্য  নীলিমাদেবীকে  নিয়ে  স্টেশন  ছেড়ে  রাস্তায়  এসে  দাঁড়ায়  | রাত তখন  প্রায়  বারোটা  | হঠাৎ  একটি  প্রাইভেট  গাড়ি  এসে  তাদের  সামনে  দাঁড়ায়  আর  কিছু  বুঝে  ওঠার  আগেই তিনটি  ছেলে  নীলিমাদেবীকে  জোর  করে  গাড়ির  ভিতর  উঠাতে চেষ্টা  করতে  থাকে  | ঘটনার  আকস্মিকতায়  সায়ন প্রথম  অবস্থায়  কিছুটা  ঘাবড়ে  গেলেও  মুহূর্তেই  সে  সম্বিৎ  ফিরে পেয়ে  ছেলেগুলির  উপর  ঝাঁপিয়ে  পরে  | ছেলেগুলি  তখন  নীলিমাদেবীকে  ছেড়ে  দিয়ে  সায়নের উপর  চড়াও  হয়  | এলোপাথাড়ি  চড়, ঘুসি  , লাথি মারতে  থাকে  | আর  ঠিক  এই  ফাঁকে  নীলিমাদেবী  একটু  সরে  গিয়ে  চিৎকার  করতে  থাকেন | ছুটে আসে  অগণিত  রেলযাত্রী  আর  রেলপুলিশ  | পালিয়ে  যায়  তিন  দুষ্কৃতী  | সায়নের কাছে  এগিয়ে  এসে  দেখে  সে  জ্ঞান  হারিয়েছে  | সকলের  সহায়তায়  তার  জ্ঞান  ফিরে আসলে  সকলে  ধরাধরি  করে  স্টেশনে  নিয়ে  গিয়ে  একটি  বেঞ্চে তাকে  শুইয়ে  দেয় | নীলিমাদেবীর  ব্যাগেই ছিল  প্যারাসিটামল  650 | তিনি  একটি  ওষুধ  তাকে  খাইয়ে  দেন  | পরদিন  ট্রেনের  সমস্যা  মেটার  পর  প্রথম  ট্রেন  ধরেই  নীলিমাদেবী  সায়নের সমস্ত  রকম  আপত্তিকে  অগ্রাহ্য  করে  তাকে  বাড়িতে  পৌঁছে  দিয়ে  তারপর  তিনি  নিজের  বাড়িতে  যান  | 

 দিনপনের  পরে  একদিন  রবিবার  দেখে  নীলিমাদেবী  ও  তার  স্বামী  সায়নদের  বাড়িতে  আসেন  | অবশ্য  এর  আগেই  সায়ন কিছুটা  সুস্থ্য  হয়ে  অফিসে  যাতায়াত  শুরু  করলে  তাদের  আবারো  নিত্য  দেখা  সাক্ষাৎ  হতে  থাকে  | দুটি  পরিবারের  মধ্যে   এখন  নিকট  আত্মীয়ের  মতই সম্পর্ক  | মানুষের  বিপদে  সত্যিকারের  মানুষ  যে  পাশে  দাঁড়ায়  আজও তার  প্রমান  পাওয়া  যায়  |


  #আমার_লেখনীতে  তোমায়_মনে  রাখবো... সময়  

Sunday, December 22, 2019

পাশে আছি

 
পাশে  আছি  

      নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

    প্রায়  বছর  পাঁচেক  পরে  গ্রামে  ফেরা  সুশোভনের| আসবার  ইচ্ছা  মোটেই  ছিলোনা| কিন্তু  মা  বারবার  করে  বাবার  শরীর  খারাপের  কথা  বলছেন  | তাই  আসতে বাধ্য  হওয়া| গ্রামের  ছেলে  সুশোভন  ভালোবেসেছিলো  গ্রামেরই  মেয়ে  অর্পিতাকে| দুক্লাস  উঁচুতে  পড়তো  সুশোভন| মাধ্যমিক  পাশ  করার  পরই অর্পিতার  বিয়ে  দিয়ে  দেয় তার  বাড়ির  লোক| তখন  সুশোভন  উচ্চমাধ্যমিক  দিয়েছে| কিছুই  করার  ছিলোনা  তখন  সুশোভনের| অসহায়ের  মত  দেখেছিলো  মা, বাবা  আর  বোন  খুব  সেজেগুজে  অর্পিতার  বিয়ের  নিমন্ত্রণ  খেতে  যাচ্ছেন| আর  সে  নিজে  শরীর  খারাপের  অজুহাতে  দরজা  বন্ধ  করে  চোখের  জলে  বালিশ  ভিজিয়েছে| বিয়ের  কথাবার্তা  যখন  চলছে  তখন  অর্পিতা  একদিন  এসে  সুশোভনের  কাছে  খুব  কান্নাকাটি  করেছিলো| কিন্তু  সুশোভনের তখন  কিছুই  করার  ক্ষমতা  ছিলোনা| অসহায়, নিরুপায়  দুটি  তরুণ  তরুণী  বুকে  পাথর  চাপা  দিয়ে  সবকিছু  মেনে  নেওয়ার  চেষ্টা  করেছিলো মাত্র| 
  গ্রামের  পথে  বাড়ির  উর্দ্যেশ্যে  হাঁটতে হাঁটতে সেই  সব  কথা  ভীষণভাবে  মনে  পড়ছিলো  সুশোভনের| গ্রামের  স্কুল  থেকে  পাশ  করে  উচচতর  শিক্ষা  লাভের আশায়  কলকাতা  চলে  আসার  পর  আজ  এই পাঁচ  বছর  সুশোভন  আর  গ্রামে  ফেরেনি| বারবার  মা, বাবা  আর  বোনের  অনুরোধ  উপেক্ষা  করে  বলেছে সে  আর  কোনোদিনও  গ্রামে  ফিরবেনা |
  বিটেক পড়া  শেষ  করে  কলেজ  ক্যাম্পাস  থেকেই  একটা মোটা  মাইনের  চাকরি  পেয়ে  যায়| প্রতিমাসে  বেতনের  অর্ধেক  টাকা  সে  মা  বাবার  একাউন্টে  পাঠিয়ে দেয় যদিও  তার  টাকা  তারা  খরচ  করেননা | নানান  কথা  ভাবতে  ভাবতে  সে  বাড়ির  দোরগোড়ায়  এসে  দাঁড়ালো| 
  বাবার  শরীরটা  সত্যিই  খুব  খারাপ  হয়েছিলো| বাবার  ঘরেই  সে  বসে  সকলের  সাথে  কথা  বলছিলো| খাওয়াদাওয়ার  পর  যখন  শুতে  যাবে  সে  তখন  মা  তাকে  এমন  একটা  কথা  বলে  বসলেন  যা  সে  স্বপ্নেও  কল্পনা  করেনি|
--- তোর  অর্পিতার  কথা  মনে  আছে  ?
--- কেন  বলো তো  ?
--- মেয়েটার  কপালটা  সত্যিই  খুব  খারাপ  রে -
--- কেন  কি  হয়েছে  অর্পিতার  ?
--- সে  এক  ইতিহাস| ভালো  চাকরি  ভালো  বাড়ি  দেখে  মা  মরা  মেয়েটার  বিয়ে  দিলো  ওর  বাবা  কিন্তু  মেয়েটার  কপালে  বিধাতা  সুখ  লেখেননি  | বিয়ের  পর  মদ্যপ  স্বামীর  অত্যাচারে  অতিষ্ট  হয়ে  একবার  সুইসাইডও
 করতে  গেছিলো  |  
--- তারপর  ?
--- তুই  তোর  নিজের  ঘরে  যা  আমি  এক্ষুণি আসছি  |
--- আরে তুমি  বলোনা  আমার  এখানে  দাঁড়িয়ে  শুনতে  কোন  অসুবিধা  হচ্ছেনা|
 মনের  ভিতর  তখন  তার  তোলপাড়  করছে | অর্পিতা  বিয়ের  পর  ভালো  ছিলোনা,   অর্পিতা  বেঁচে  আছে  তো? নানান  প্রশ্ন  তখন  তার  মনের  মধ্যে  উঁকি  দিচ্ছে |
--- মা  বলো তারপর  কি  হয়েছে  অর্পিতার? 
--- নিজের  হাতের  শিরা  কেটে  বাড়িতে তার  স্বামী না  থাকাকালীন  সময়ে  বেশ  কয়েকঘন্টা  নিজের  ঘরে  পড়ে ছিল| ভাগ্যিস  সেদিনই  ওর  ভাই  পুজোর  জামাকাপড়  দিতে  ওর  বাড়ি  গেছিলো | অনেক  ডাকাডাকির  পরও যখন  দরজা  কেউ  খুলতে  আসেনা  ওর  ভাই  তখন  ক্লাবের  ছেলেদের  ডেকে  দরজা  ভেঙ্গে ঘরে  ঢুকে  ওই  পরিস্থিতি  দেখে | যমে  মানুষে পনেরদিন  টানাটানির  শেষে  আবার  ওর  স্বামী  ওকে  বাড়িতে  নিয়ে  যায় | ওর  বাবা , ভায়ের  ইচ্ছা  ছিল  কয়েকটা  দিন  অন্তত  ওদের  কাছে  এসে  থাকুক | কিন্তু  কিছুতেই  ওর  স্বামী  সে  কথা  শোনেনা | হাসপাতালে  থাকার  সময়  অর্পিতার  বাড়ির  লোকেরা  ইচ্ছা  থাকলেও  ওর  কাছ  থেকে  কিছু  জানার  চেষ্টা  করেনি  কারণ  ডক্টরের  নিষেধ  ছিল | বাড়িতে  নিয়ে  গিয়ে  আবার  সেই  একই  অত্যাচার  শুরু  করে | চুপচাপ  সবকিছু  মেনে  নিতে  নিতে  পরিস্থিতি  এমনই দাঁড়ায়  আস্তে  আস্তে  নিজের  ভিতরে  নিজেকে  গুটিয়ে  নিতে  থাকে |শেষে  একদিন  ওর  ভাই  ও  বাবা  গিয়ে  ওর  স্বামীর  বিরুদ্ধাচারণ  করেই  ওকে  নিয়ে  আসতে বাধ্য  হয়  | অনেক  ডাক্তার  দেখিয়েও  কোন  লাভ  হয়নি  | সবসময়  চুপচাপ  ঘরের  মধ্যেই  বসে  থাকে  | কারো  সাথেই  কোন  কথা  বলেনা | ওর  বাবারও বয়স  হয়েছে  | অর্পিতার  চিন্তায়  চিন্তায়  তার  শরীরও ঠিক  নেই  | এদিকে  ওর  ভায়েরও  বিয়ের  বয়স  হয়েছে  | কিন্তু  অর্পিতা  সুস্থ্য  না  হওয়া পর্যন্ত  ওর  ভাই  বিয়ে  করতে  চায়না  |
--- আমাকে  কি  করতে  বলছো  ?
  মা  একটু  আমতা  আমতা  করে  বললেন,
--- ওই  যে  তোর  বন্ধু  বিপিন  আছে  না  ও  বলছিলো  ------ আসলে  আমি  তোর  বাবা  মেয়েটাকে  খুব  ভালোবাসি  --
--- বিপিন  কি  বলছিলো  ?
--- না  সে  রকম  কিছু  না  ওই  আর  কি--- তুই  একটু  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  চেষ্টা  করে  দেখ  না  যদি  মেয়েটাকে  সুস্থ্য  করা  যায়  --
--- মা, বিপিন  কি  বলেছে  ?
  সুশোভনের  মা  আমতা  আমতা  করে  কয়েকবার  ঢোক  গিলে  বলেই  ফেললেন  কথাটা  | কারণ  তিনি  যখন জানতে    পেরেছেন  তার  শুভ  কেন  গ্রামে  আসতে চায়না  তখন  তো  তাকে  বাড়িমুখো  করার  আপ্রাণ  চেষ্টা  তিনি  করেই  যাবেন  |
--- বলছিলো  তোরা  তো  একই  স্কুলে  পড়তিস  যদি  তোকে  দেখলে  ওর  কোন  পরিবর্তন  হয়  নুতবা  তুই  যদি  ওকে  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  বড়  ডাক্তার  দেখাস  ----
--- সেতো ওর  ভাইও  করতে  পারে  |
--- হ্যাঁ তা  পারে  কিন্তু  তুই  তো  ওকে  ভালোবাসতিস---
--- আচ্ছা  এখন  যা  তোর  ঘরে  বাকি  কথা  কাল  বলবো  |
  সুশোভনের  মাথায়  তখন  নানান  চিন্তা| মা  কি  ঠিক  এই  কারণেই  ওকে  গ্রামে  ডেকে  পাঠিয়েছেন? বাবার  এখন  বয়স  হয়েছে  নিত্য  শরীর  খারাপ  লেগেই  আছে  - তবে  কি  এবার  জোর  করেছেন  অর্পিতার  জন্যই? আসলে  মা  কি  ভাবছেন? 
    পরদিন  সকাল  হতেই  সুশোভন  অর্পিতাদের  বাড়িতে  হাজির  হয়  | অর্পিতার  ঘরে  ঢোকার  আগেই  সে  তার  বাবার  কাছ কাছ  থেকে  জেনে  যায়  অর্পিতা  কারও সাথেই  কথা  বলেনা| চুপচাপ  সবসময়  ঘরের  মধ্যে  শুয়ে  বসে  থাকে  | পরিবারের  কেউ  ছাড়া  তার  ঘরে  ঢুকলে  সেদিন  রাগে সে  সেই  বেলার  খাবার  হাত  দিয়ে  ছুঁয়েও  দেখেনা  | কিছু  জানতে  চাইলে  মাথা  নেড়ে  হ্যাঁ না  তেই জবাব  দেয়| দেখো  গিয়ে  তোমার  সাথে  কথা  বলে  কিনা  ?
  সুশোভন  দরজা  ঠেলে  ঘরে  ঢোকে  | অন্য দিকে  মুখ  করে  খাটের উপর  অর্পিতা  শোয়া  | সুশোভন  গিয়ে  খাটের উপর  বসে  | অর্পিতা  ফিরেও  দেখেনা  | সুশোভন  আস্তে  আস্তে  ডাকে  ,
--- অর্পিতা  আমি  শুভ  -- এদিকে  একটু  ফেরো 
  অর্পিতা  উঠে  বসে  শুভর মুখের  দিকে  ফ্যালফ্যাল  করে  তাকিয়ে  থাকে  | শুভ  জানতে  চায়,  
----  আমায়  চিনতে  পারছো  ?
 অর্পিতা  ঘাড় নেড়ে  হ্যাঁ জানায়  |
--- কি  হয়েছে  তোমার? আমায়  বলো সব  ঠিক  হয়ে  যাবে  আমি  এসে  গেছি  তো  --
   শুভ  হাত  বাড়িয়ে  অর্পিতার  একটা  হাত  ধরে  বলে, 
--- আমি  তোমাকে  কলকাতা  নিয়ে  গিয়ে  ডক্টর  দেখাবো  কিন্তু  তার  আগে  তো  আমায়  জানতে  হবে  তোমার  কোথায়  কষ্টটা  --- 
   অর্পিতা  এবার  হাউহাউ  করে  কেঁদে  উঠে  শুভর বুকের  উপর  ঝাঁপিয়ে  পরে| ঠিক  এইরূপ  একটি  পরিস্থিতির  জন্য  সুশোভন  মোটেই  প্রস্তুত  ছিলোনা  | ধাতস্ত  হতে  তার  কিছুটা  সময়  নিলো  তারপর  সে  আস্তে  আস্তে  অর্পিতার  মাথায়  হাত  বুলিয়ে  দিতে  লাগলো  | অর্পিতার  কান্নার  আওয়াজে  তার  বাবা  ও  ভাই  ঘরে  ঢুকে  এসে  এ  দৃশ্য  দেখে  দুজনেই  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  যান  | এবং  দুপুর  গড়িয়ে  গেলেও  তারা  কেউই  আর  এঘরে  আসেননা  কারণ  বাইরে  থেকে  দুজনেই  শুনতে  পান  অর্পিতার  গলার  আওয়াজ  |




     

Friday, December 20, 2019

বিভ্রান্ত

বিভ্রান্ত  
       নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী

কাঁধে  হাত  দিয়ে  ভরসা  দেওয়ার  হাতটা
 কিশোরীবেলায়  ফেললাম  হারিয়ে,
 পাশে  থাকবে  বলে  কথা  দিয়েছিলো  যে  
 সেও গেলো  যে  পালিয়ে  |
 কতশত  বন্ধু  হল   
 কেউ  দেয়না  বিশ্বাসের  মর্যাদা | 
 স্নেহ, শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,   
 সবকিছু  আজ  দুরাশা |
 মনের  মাঝের  যন্ত্রণাগুলো  
 কুড়েকুড়ে  শুধু  খায়,
 চারিদিকে  আজ  শুধুই  আঁধার
 পালাবার  পথ  নাই  |

Wednesday, December 18, 2019

জানি আছিস

জানি  আছিস  
           নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

 বয়সের  ভারে  ভুলেছি  সবকিছু,
 ভুলিনি  তোকে  আজও|
 স্মৃতির  খাতায়  জমেছে  ময়লা,
 স্পষ্ট  অক্ষরগুলো |
 বাদলের  দিনে  বৃষ্টিতে  ভেজা,
 শরতে শিউলি  তলায়, 
 সময়ের  কোন  ছিলোনা  হিসাব,
 পড়লে  মনে হৃদয়  দোলায়|
 স্মৃতির  ঝাঁপি  যতই  হাতড়াই,
 তোর ছবি  চোখে  ভাসে,
 জানি মরনের ওপার হতে   
 আজও তুই  আছিস  পাশে| 

 

Saturday, December 14, 2019

বুঝতে শিখেছি



  বুঝতে  শিখেছি  
    নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

    স্বামীর  মৃত্যুর  পর  ছোট  ছোট  ছেলেমেয়ে  দুটিকে  মানুষ  করতে  অতসীর  কালঘাম  ছুটে গেছে  | দেবদূতের  মত সেদিন  যদি  গৌরীদি  পাশে  এসে  না  দাঁড়াতো  তাদের  নিয়ে  রাস্তায়  হয়তো  ভিক্ষা  করে  খেতে  হত | নুতন  বৌ  হয়ে  এ  বাড়িতে  আসার  পর  থেকেই  পাশের  বাড়ির  গৌরীদির  সাথে  অতসীর  ভাবটা  যেন  একটু  বেশিই  বলা  চলে  | নিজের  জীবনের  বিনিময়ে  গৌরীদি  তার  পুরো  পরিবারটাকে  যক্ষের ধনের মত  যেন  আগলে  রেখেছে  | গৌরীদির  বাবা  সামান্য  একটা  প্রাইভেট  ফার্মে  চাকরি  করতেন  | শ্বাসকষ্ট  জনিত  কারনে  তার  দুটো  লাঞ্ছই ব্লক  হয়ে  যায়  | দারিদ্রতার  কারণে  একবার  টিবিও হয়েছিল  | পরবর্তীতে  উত্তরাধিকার  সূত্রে  পেয়েছিলেন  এজমা | চিকিৎসা  সেভাবে  কোনদিনও করতে  পারেননি | অল্প  বয়সে  যখন  বাবাকে  হারান  তখন  মা  ছাড়াও  আরও দুটো  ছোট  ছোট  ভাইবোনের  দায়িত্ব  তার  উপর  এসে  পরে  | লেখাপড়া  বেশিদূর  করতে  পারেননি | বাবা  যখন  মারা  যান  গৌরীদির  তখন  সবে মাধ্যমিক  পরীক্ষাটা  শেষ  হয়েছে  | ব্যস পড়াশুনার  ওখানেই  ইতি  | সেলাইয়ের  দোকানে  ঘুরে  ঘুরে  প্রথম  অবস্থায়  জামাকাপড়ে  হেম সেলাই  করে  পয়সা  রোজগার  শুরু  | তারপর  ভালোভাবে  কাটিং  আর  সেলাই  শেখা | এরপর  এমব্রয়ডারি | ভাইবোন  দুটিকে  লেখাপড়া  শিখিয়ে  সংসারী  করেছে  | নিজের  দিকে  তাকানোর  আর  সময়  হয়নি  কোনদিন  | আজ  তার  বিশাল  বুটিকের  দোকান  | গৌরীদি  আজ  সম্পূর্ণ  একা | ভাই  আর  তার  বৌ  আছে  ঠিকই  কিন্তু  গৌরীদিকে তাদের  লাগে  শুধুমাত্র  টাকার  যোগান  দেওয়ার  জন্যই | 
   অতসী  তার  স্বামীকে  হারিয়ে  যখন  অথৈ  সমুদ্রে  হাবুডুবু  খাচ্ছে  ঠিক  তখনই গৌরীদি  একদিন  অতসীর  বাড়িতে  এসে  বলে  ,
--- কিরে  এইভাবে  ঘরে  বসে  থেকে  শুধু  চোখের  জল  ফেললে  চলবে?  ওদের  মানুষ  করতে  হবেনা  খেয়েপরে  বাঁচতে  হবেনা  ?
--- কিন্তু  আমার  পেটে তো  বিদ্যের  জোর  কতটুকু  সেতো তুমি  জানো দিদি  | আমি  এখন  কি  করবো  বলো এই  ছোট  ছোট  দুটি  বাচ্চাকে  নিয়ে  |
--- দূর  পাগলী  , জীবনে  ভালোভাবে  বাঁচতে  গেলে  বুদ্ধির  দরকার  , শুধু  লেখাপড়া  জানলেই  হয়না  | অনেক  বড়  বড়  শিক্ষিত  মানুষ  বেকার  হয়ে  ঘুরে  বেড়াচ্ছে  | চাকরি  ছাড়াও  এই  পৃথিবীতে  করার  অনেক  কিছু  আছে  - যেখানে  শুধু  বুদ্ধি  দিয়েই  কাজ  হাসিল  করতে  হয়  | আমার  জীবনের  গল্প  তো  সব  তোকে  বলেছি  | তুই  আমার  দোকানে  এসে  কাজ  করতে  শুরু  কর  , তারপর  আস্তে  আস্তে  আমি  তোকে  সব  শিখিয়ে  দেবো| 
   অতসীর  সেই  শুরু  সামান্য  কিছু  রোজগার  করা  | দিনে  দিনে  সে  যেমন  তার  গৌরীদির  দোকানের  মান উন্নত  করেছে  ততই  তার  আরও কাছের  প্রিয়  মানুষ  হয়ে  উঠতে  পেরেছে  আর  গৌরীদির  তত্বাবধানে  কাটিং  থেকে  শুরু  করে  এমব্রয়ডারি সবটাতেই  আজ  সে  পারদর্শী  | 
   ছেলেমেয়ে  দুটিকে  গ্রাজুয়েট  করে  বিয়েও  দিয়েছে  | ছেলে  এখন  বেশ  ভালো  চাকরি  করে  | মেয়ে  সুখেই  আছে  | মাঝে  মধ্যে  মায়ের  কাছে  এসে  দু  একদিন  করে  থেকেও  যায়  | কিন্তু  সমস্যা  শুরু  হল  ছেলের  বিয়ের  ছমাসের  মাথাতেই  | ছেলেবৌয়ের  কথামত  তাদের  বাড়িটা  লিখে  দিতে  হবে  | কিন্তু  অতসী  তাতে  বিন্দুমাত্র  রাজি  নয়  | অশান্তির  সূত্রপাত  এখান থেকেই  | সব  কথায়  সে  তার  দিদিকে  এসে  বলে  | পৃথিবীটা  যে  কত  স্বার্থপর  হতে  পারে , স্বার্থের  জন্য  খুব  কাছের  মানুষগুলো  যে  কত  ভয়ঙ্কর  হতে  পারে  আজ  অতসী  ও  গৌরী  ভালোভাবেই  তা  বুঝে  গেছে  | গৌরীর  পরামর্শ  মত  অতসী  তার  কিছু  প্রয়োজনীয়  জিনিসপত্র  নিয়ে  চলে  আসে  গৌরীর বাড়িতে  একটা  ঘরের  ভাড়াটিয়া  হয়ে  | অবশ্য  নামেই  ভাড়াটিয়া  ভাড়া  গৌরী কোনদিনও নিতোনা  | নিজের  বাড়ি  হওয়া স্বর্তেও  এই  মিথ্যার  আশ্রয়টুকু  তাকে  নিতে  হয়েছিল  তার  ভাই  ও  ভাইবৌয়ের  কারণে  | মাস গেলে  কিছু  টাকা  সে  নিজেই  তার  ভাইবৌয়ের  হাতে  গুঁজে  দিতো  অতসীর  ঘরভাড়া  বাবদ  | ব্যাস  তাতেই  ছিল  শান্তি  বজায়  | দুটি  নারী  তাদের  জীবনের  সমস্ত  আশাআকাঙ্খা জলাঞ্জলি  দিয়ে  কেউ  নারী  ছেড়া সন্তানের  জন্য  আর  কেউi  সন্তানসম  ভাইবোনের  জন্য  সমস্ত  জীবন  উজাড়  করেও  তাদের  কাছ  থেকে  বিন্দুমাত্র  সম্মান  টুকুও  পায়নি  | যতদিন  তাদের  প্রয়োজন  ছিল  ততদিনই  তারা  একটা  ভালোবাসার  মুখোশ  পরে  ছিল  | যখন  তাদের  প্রয়োজন  মিটে গেছে  ঠিক  তখনই অতি প্রিয়  কাছের  মানুষগুলোর  মুখোশও  খুলে  গেছে  | অতসী  ও  গৌরীও  বুঝতে  শিখে  গেছে  জীবনে  তারা  আর  যে  কটাদিন বাঁচবে  তাদের  শখ  আহ্লাদগুলো  মিটিয়ে  নেওয়ার  চেষ্টা  করবে  | এবার  আর  অন্যের  জন্য  নয়  বাঁচবে  সম্পূর্ণ  নিজেদের  জন্যই | পিছনের  কথা  ভেবে  আর  কাঁদবেনা  | তাই  তো  তারা  সাপ্তাহিক  দোকান  বন্ধের  দিনে  সেজেগুজে  বেরিয়ে  পরে  কোনদিন  সিনেমা  তো  কোনোদিন  বড়  কোন  পার্কে  আর  ফেরার  পথে  বড়  কোন  হোটেলে  ডিনার সেরে  | এই  বাঁধনহারা জীবনে  দুজনেই  খুব  খুশি  | অন্যদের  কথা  ভাবতে  গিয়ে  দুজনেই  ভুলে  গেছিলো  তাদের  নিজেদেরও একটা  জীবন  আছে  | আর  সেই  জীবনে  আছে  কিছু  চাহিদা  যা  এতদিন  তারা  সেই  চাহিদাগুলোকে  মর্যাদার  আসনে  বসাতে  পারেনি  বিবেকের  তাড়নায়  | এখন  অন্যের  জন্য  নয়  তারা  ভাববে  শুধু  নিজেদের  নিয়েই  | জীবন  তো  একটাই  | জীবনের  অর্ধেক  সময়  কেটে  গেছে  | বাকি  জীবনটা  মুক্ত  বিহঙ্গের  মত  কাটিয়ে  দেওয়ার  মানসিকতা  নিয়েই  এগিয়ে  চলে  মধ্যবয়সী  দুটি  নারী  |

#আমার_লেখনীতে  " অন্যের  প্রশংসার  জন্য  নয়, নিজেকে  ভালোবেসে  বদলেছি  আমি |"

Monday, December 9, 2019

পাথর চাপা

 পাথর  চাপা  
           নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

 এখন  আমার  আর  কান্না  আসেনা  
 চোখের  জল  শুকিয়ে  গেছে  
 বা  হয়তো  কাঁদতেই  ভুলে  গেছি| 
 অনুভূতিগুলো  মৃয়মান হয়ে  যাচ্ছে
 মনের  বা  শরীরের  যন্ত্ৰণা
 কোনোটাই  বুকে  আর  চেপে  বসেনা|
 চারিদিকের  সমাজের  এই  অবক্ষয়  
 আমার  সকল  অনুভূতিকে  
 দুমড়ে  মুচড়ে  ভেঙ্গে দিয়ে  
 আমাকে  বোবা  ও  কালা  করেছে|

গহীনে

    #আমার_লেখনীতে  নবরূপে  আমি    .....
  
 গহীনে  

        নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী

       মাত্র  ছাব্বিশ  বছরের  সংসারে  বাড়ির  ভিতরটা  ছাড়া  বাইরের  জগৎ  সম্পর্কে  আমি  ছিলাম  সম্পূর্ণ  আনাড়ী| কেন  জানিনা  মানুষটির  উপর  নির্ভর  করে  থাকতেই  আমার  ভালো  লাগতো| আমি  আমার  সংসার  আর  ছেলেমেয়ে  নিয়েই  ভালো  থাকতাম| তবে  ছেলেমেয়ে যখন  থেকে  স্কুল  যাওয়া  শুরু  করলো ওদের   বাবার  উপর  আর  একটু  দায়িত্ব  বর্তালো| ওদের  লেখাপড়া  ব্যাপারে  আমার  সাহায্য  বলতে  স্কুল  ও  কোচিনে দিয়ে  আসা  নিয়ে  আসা| ওদের  বাবা  সরকারী চাকরী করার  সুবাদে  এবং পোস্টিং কলকাতার  বাইরে  হওয়ায়  বিয়ের  পর  অষ্টমঙ্গলা  সেরে  আসার  পরদিনই  শিলিগুড়ির  উর্দ্দেশ্যে  রওনা  দিতে  হয়েছিলো| এসব  আমি  বিয়ের  আগে  থেকেই  জানতাম| তখন  আমার  গ্রাজুয়েশনের  ফল  বের  হয়নি| বিয়েতে  আপত্তি  জানিয়েছিলাম| পড়াশুনায়  খুব  একটা  খারাপ  ছিলামনা| ইচ্ছা  ছিলো রোজগারের  একটা  রাস্তা  খুঁজে  নেবো| কিন্তু  বাবার  অকালমৃত্যু নিজের  সুপ্ত  ইচ্ছাগুলোকে  জলাঞ্জলি  দিতে  বাধ্য  করেছিলো| বিয়ের  আগে  আমাদের  পরিবারের  রোজগার  বলতে  আমার  বড়দির  সাধারণ  একটি  সরকারী চাকরী| সেও  তার  সমস্ত  আশাআকাঙ্খা অনেক  আগেই  গলা  টিপে  মেরে  ফেলেছিলো  বাবার  পাশে  দাঁড়িয়ে  সংসারে  আরও একটু   সচ্ছলতা  আনার  জন্য| বিয়ের  পিঁড়িতে  তাকে  বসানো  যায়নি  এই  একটিমাত্র  কারণের জন্যই| 
     যে  কথা  বলছিলাম| স্বামীর  সাথে  চলে  এলাম  সম্পূর্ণ  আমার  নিজের  সংসারে একটি  ভাড়া  বাড়িতে  যা  আমার  স্বামী  অথাৎ  প্রলয়  নিজের  হাতে  খুব  সুন্দর  করে  গুছিয়ে  রেখে জাঁকজমক  করে  আমায়  আনতে কলকাতায়  ছুটেছিল| প্রথম  সন্তান  আমার  মেয়ে| জম্মের  একমাসের  মধ্যেই  প্রলয়ের  প্রমোশন  হয়| এমনিতেই  মেয়ে  হওয়াতে  প্রলয় এবং  তার  পরিবার  ছিলো ভীষণ  খুশি  তার  উপর  একমাসের  মধ্যে  পদন্নোতি| চার  পুরুষ  পরে  তাদের  সংসারে  আমার  মেয়ে  প্রিয়াঙ্কার  আগমনকে   তারা  মা  লক্ষ্মীর  কৃপা  বলেই  মনে  করে| তারপর  ছবছর  পরে  আসে  আমার  ছেলে  প্রিয়ম| রান্নাবান্না, ওদের  দেখভাল  আর  স্বামীর  সেবাযত্ন  নিয়েই  আমার  সময়  কেটে  যেত| এরপর  প্রলয়  শিলিগুড়িতেই জমি  কিনে  মনের  মত  করে  বাড়িও  তৈরী  করে| আমাকে  কোন  ব্যাপারেই  কোন  হ্যাপা  পোহাতে  হয়নি এই  বাড়ির  ব্যাপারে| নিজে  অফিস  ছুটি  নিয়ে  দাঁড়িয়ে  থেকে  সবকিছু  তদারকি  করেছে| অবশ্য  মাঝে  মধ্যে  তার  সাথে  আমাকে  যেতেই  হয়েছে  আমার  পছন্দ  মতো  মত  প্রকাশ  করার  জন্য| এহেন  মানুষটা  রিটায়ারমেন্টের  দুবছর  আগে একদিন  অফিস  থেকে  বাড়ি  ফিরলো  প্রচন্ড  জ্বর  নিয়ে| রক্ত  পরীক্ষায়  ধরা  পড়লো  ম্যালেরিয়া| হাসপাতালে  সাতদিন  ধরে যমে মানুষে  টানাটানি  করে  আমি  হেরে  গেলাম| চলে  গেলো  সবকিছু  আমার  দায়িত্বে  ফেলে  রেখে| ছেলেমেয়ে  প্রচন্ড  ভেঙ্গে পড়লো  বিশেষত  মেয়ে  পিয়া| এদের  শান্তনা  দিতে  দিতে  প্রলয়ের  জন্য  চোখের  জল  ফেলতেও  যেন  ভুলে  গেলাম| অল্প বয়সে  বাবাকে  হারিয়ে  তারাও  কেমন  থম  মেরে  গেলো আর  আমি  পড়লাম  অথৈ  সমুদ্রে| আমার  মাথায়  তখন  আকাশ  ভেঙ্গে পড়েছে | ব্যাঙ্ক, এলআইসি, বাড়ির  খাজনা--- আমি  তো  কিছুই  চিনিনা  কিছুই  জানিনা| 
   শুরু  হল  আমার  জীবনের  আর  এক  অধ্যায়| পড়াশুনার  শেষে  খেয়েদেয়ে  যখন  প্রিয়া, প্রিয়ম  ঘুমিয়ে  পড়তো  আমি  বসতাম  আলমারী খুলে  প্রলয়ের  সুন্দর  করে  গুছিয়ে  রাখা  সব  ফাইলগুলো  নিয়ে| তারউপর  আছে  রোজ  ছুটাছুটি  প্রলয়ের  অফিসে  পেনশনের  জন্য| কাউকেই  চিনিনা  কিভাবে  কোথায়  এগোবো  কিছুই  না  বুঝে  নিজের  পেটের বিদ্যের  দৌলতে  আস্তে  আস্তে  বাইরের  কাজের  সাথে  নিজেকে  ঠিক  মানিয়ে  নিতে  সক্ষম  হলাম| কাজগুলি  একটা  একটা  করে  গুটিয়ে  নিয়ে  আসতে লাগলাম| যত সহজে  আমি  কথাগুলো  বলতে  পারছি  এই  কাজগুলি  কিন্তু  তত  সহজ  ছিলোনা| সরকারী চেয়ার  দখল  করে  যেসব  কর্মচারীরা  আছেন  তাদের  মধ্যে  কেউ  কেউ  নিজেদেরকে  এক  একজন  কেউকেটা  মনে  করেন| কোন  কথা  জানতে  চাইলে  একবার  থেকে  দুবার  বলতে  যেন  তাদের  আত্মসম্মানে  লাগে| তারা  ভুলে  যায়  এই  কাজগুলি  করার  জনই  সরকার  তাদের  মাসে  মাসে  মাইনে দিয়ে  রেখেছে| কিছু  কিছু  কর্মচারীর  দুর্ব্যবহার  যেন  মজ্জাগত| সমস্ত  অপমান  সহ্য করে  লাগাতার  এ  টেবিল থেকে  অন্য টেবিল  করে  বেড়িয়েছি| কিন্তু  হাল  ছাড়িনি  একমুহূর্তের  জন্যও | আমাকে  পারতেই হবে  , প্রলয়ের  অসমাপ্ত  কাজগুলিকে  সমাপ্ত  করে  ছেলেমেয়ে  দুটিকে  আমার  মানুষের  মত  মানুষ  করতে  হবে  এই  অদম্য  ইচ্ছাশক্তিই  আমাকে  সামনের  দিকে  এগিয়ে  নিয়ে  গেছে| 
  দুবছরের মধ্যে  নিজেকে  ভেঙ্গেচুরে নুতন  করে  গড়েছি| যে  আমি  কোনদিনও বাইরে  একা বেরোতে  সাহস  পেতামনা  সেই  আমি  আমার  সংসার  এবং  সন্তানদের  জন্য  ঘর  বার  যেকোনো কাজেই  আজ  সমান  পারদর্শী| আয়নার  সামনে  দাঁড়িয়ে  নিজেকে  নিজেই  মাঝে  মধ্যে  প্রশ্ন  করি  " আজকের  আমি  আর  সেদিনের  আমির  মধ্যে  আজ  বিস্তর  ফাঁরাক| আমার  মধ্যে  যে  আর  একটা  আমি  ঘুমিয়ে  ছিলো প্রলয়  থাকাকালীন  সময়ে  তার  উপর  সম্পূর্ণ  নির্ভরশীল  হয়ে  কোনদিনও  টের  পাইনি| প্রলয়  চলে  গিয়ে  আমায়  যেন  নবরূপে  সংসারের  দায়িত্ব  পালনের  জন্য  তৈরী  করে  দিয়ে  গেলো|"

পাথর চাপা

 পাথর  চাপা 
           নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী 

 এখন  আমার  আর  কান্না  আসেনা 
 চোখের  জল  শুকিয়ে  গেছে 
 বা  হয়তো  কাঁদতেই  ভুলে  গেছি|
 অনুভূতিগুলো  মৃয়মান হয়ে  যাচ্ছে
 মনের  বা  শরীরের  যন্ত্ৰণা
 কোনোটাই  বুকে  আর  চেপে  বসেনা|
 চারিদিকের  সমাজের  এই  অবক্ষয় 
 আমার  সকল  অনুভূতিকে 
 দুমড়ে  মুচড়ে  ভেঙ্গে দিয়ে 
 আমাকে  বোবা  ও  কালা  করেছে|

Tuesday, December 3, 2019

মনেপড়ে

মনে পড়ে 
                নন্দা মুখার্জী রায় চেধুরী 

 মনে পড়ে তোমার কথা ,
যখন থাকি একলা ঘরে ,
স্মৃতিরা সব ভিড় করে ,
বুকে বাজে না পাওয়ার ব্যথা |

স্বপ্ন দেখা কিশোরবেলা -
আজও আছে অন্তরালে ,
নাইবা পেলাম তোমায় আমি !
নিজের করে কোনো কালে |

একলা যখন থাকি আমি ,
সেই স্বপ্ন রঙ্গিন করি -
নেই সেখানে কোনো বাঁধা ,
থাকনা  জমে বুকে ব্যথা !

শেষ বয়সে ভাবি বসে ,
সারাজীবন দিলাম পাড়ি, শুধুই হেসে ,
বুকের মাঝেই থাকলে ঘুমিয়ে ,
এই বয়সেও দেখি স্বপন, তোমায় নিয়ে |

আর হবেনা মোদের দেখা ,
তোমার ভালোবাসা থাকবে মনে ,
মন যে আমার আজও চায় ,
কিছুটা সময় কাটাতে তোমার সনে |

নন্দা  27.11.16  10.40pm.

পেরেছি

#পেরেছি  
        
    নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

     বাবার  মৃত্যুর  পর  কিছু  কাজের  আশায়  পাড়ার  মাথা  হরেনকাকার  কাছে  গিয়ে  সতেরো বছর  বয়সেই  নিজের  জীবনের  চরম  মূল্য  দিতে  হয়েছিল  রীতাকে |মাকে হারিয়েছে  সেই  ছেলেবেলায় | একটি  এনজিও  সংস্থার  সাথে  যুক্ত  পাড়ার  বেলাদি  এসে  নিজে  থেকে  রীতাকে সেখানে  যুক্ত  করে  নেয়| খাওয়াপড়া  আর  সামান্য  কিছুর  টাকার  বিনিময়ে  রীতা ভালোই  থাকে  সেখানে | তবে  ভিতরে  ভিতরে  তার  একটা প্রতিশোধস্পৃহা  জম্ম  নিতে  থাকে| কয়েকবছর  পরে  এনজিও  সংস্থার  একটি  অনুষ্ঠানে  কিছু  গন্যমান্য  ব্যক্তি  উপস্থিত হন | তাদের  মধ্যে  হরেনকাকাও  ছিলেন | একটা  কাটারি  জোগাড়  করে  সোজা  স্টেজে  উঠে  পরপর  কয়েকটা  কোপ মারে  লোকটির  কাঁধে  | স্টেজেই  লুটিয়ে  পড়েন  তিনি | অট্টহাসিতে  ফেঁটে  পরে  রীতা | ঠাঁই হয়  পাগলাগারদে  |

Monday, December 2, 2019

ব্লাকবেল্ট

অণুগল্প
 
 ব্লাকবেল্ট  

      নন্দা  মুখার্জী  রায়  চৌধুরী  

     নিজে  একজন  নামকরা  নৃত্যশিল্পী  হওয়া স্বর্তেও  সকলের  অমতে  মেয়েকে  নিজের  নাচের  স্কুলে  ভর্তি  না  করে  যখন  ক্যারাটে  স্কুলে  ভর্তি  করলো  মহুয়া  তখন  শাশুড়ি  ও  স্বামী  তার  সাথে  প্রচন্ড  অশান্তি  করেছিলেন| কিন্তু  একরোখা  মহুয়া  কারও কথায়  সেদিন  কর্ণপাত  করেনি| মেয়ে  আজ  ব্লাকবেল্ট  পাওয়ায়  সে  ভীষণ  আনন্দিত| 
   শহর  থেকে  একটু  দূরে  নিজের  নাচের  স্কুলের  মেয়েদের  নিয়ে  অনুষ্ঠান  করে  ফেরার  পথে  রাস্তার  মাঝখানে  গাড়ি  খারাপ  হয়ে  যায়| শুনশান  রাস্তা  তার উপর  অধিক  রাত অল্পবয়সী  মেয়েগুলোকে  নিয়ে  সে  তখন  অথই সমুদ্রে| ড্রাইভার  আপ্রাণ  চেষ্টা  চালিয়ে  যাচ্ছে  গাড়িটিকে  তাড়াতাড়ি  সারাবার  জন্য| ঠিক  সেই  মুহূর্তে  একটি  বাইকে  করে  তিনটি  ছেলে  এসে  অযাচিতভাবে  সাহায্য  করার  জন্য  গল্প  জুড়ে  দিলো| মহুয়া  তখন  ভয়ে  ঠকঠক  করে  কাঁপছে| মহুয়ার  মেয়ে  তখন  গাড়ি  থেকে  নেমে  মহুয়ার সামনে গিয়ে  ছেলেগুলিকে বলে তাদের  কোন  সাহায্যের  দরকার  নেই| অট্টহাসিতে  তারা  ফেটে  পরে| আর  ঠিক  তখনই একটি  ছেলে  মহুয়ার  মেয়ে  মনামীর  হাত  ধরে  টান দেয়| মহুয়া  চিৎকার  করে  ওঠে| বাকি  মেয়েগুলোও  ভয়ে  তখন  জড়সড়| 
   বাড়িতে  ফিরে মেয়ের  গর্বে  গরবিনী  মা স্বামী এবং তার মাকে ডেকে  হাসতে হাসতে গল্প  করতে  লাগলো  কিভাবে  তার  ব্লাকবেল্ট  পাওয়া  মেয়ে  তিন  তিনটি  ছেলেকে  ধরাশায়ী  করেছে| "ভ্যাগিস  আজ  মনা আমাদের  সাথে  ছিলো| ও  একাই আজ  আমাদের  এতগুলো  মেয়ের  সম্মান  বাঁচিয়েছে| আজ  তোমরা  নিশ্চয়ই  বুঝতে  পারছো  প্রত্যেকটা  মেয়ের  ক্যারাটে  শেখা কতটা  দরকার| শুধু  নিজেকে  বাঁচাতেই  নয়  অন্য মেয়েদের  সম্মান  রক্ষার্থেও প্রত্যেকটা   মেয়ের  ক্যারাটে  শিক্ষাটা  জরুরি|"

Sunday, December 1, 2019

একেই বলে ভাগ্য




একেই বলে ভাগ্য 

     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

   -- একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো?কয়েক মাসের মধ্যে সাহাবাবুদের কেমন হালচাল পাল্টে গেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ঢুকতে কর্তার উর্দেশ্যে কথাগুলি বললেন ঘোষগিন্নী। 

বাজার করে এসে এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সবেমাত্র পেপারটা নিয়ে বসেছেন বিমলঘোষ।বয়স ষাটের উপরে।পেটানো শরীর।লম্বা ছ'ফুটের উপরে।দেখলে কে বলবে যে তার এতো বয়স।অপরিচিত মানুষজন পঞ্চাশের নীচে বলেই চালিয়ে দেবে।খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে সোফার উপর গাটা এলিয়ে দিয়ে  ঘোষবাবু বললেন, 

---এটা যে আমিও ভাবিনা তা নয়।শুধু আমি কেন পাড়ার অনেকেই এই  ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা করেই চলেছে।কিছু একটা তো ঘটেছে কিন্তু সেটা কি এটাই জানার বিষয়।ওই তো সামান্য একটা মুদির দোকান।জিনিসপত্র সেখানে নেই বললেই চলে।অভাবের সংসার।এখন তো বাজারের সেরা মাছটা তরকারিটাই কেনেন।আগের থেকে ভালো আছেন এটা ভালো কথা।কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব হোল সেটাই ভাবাচ্ছে। 

  গিন্নী এতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, 

---আচ্ছা কোন দিক থেকে কোন বিষয় সম্পত্তি বা টাকা পয়সা পেলেন নাকি। 

---আরে না,বহুবার সাহাবাবু বলেছেন তাদের দুইপক্ষেরই কোন আত্মীয়স্বজন নেই।ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে।তবে প্রতিবেশি ভালো আছে এটাই সবথেকে বড় কথা। 

---আমাকে ব্যাপারটা খুঁজে বের করতেই হবে।একটা কথা মনে আছে তোমার?বছর খানেক আগে একজন ভদ্রলোক যাকে আগে কোনদিনও ওনাদের বাড়ীতে দেখিনি অথচ হঠাৎ করেই তিনি এসে ওই বাড়িতেই মারা গেলেন।তার সৎকারও করলেন পাড়ার ছেলেদের সহায়তায়।আমরা যখন জানতে চাইলাম বললেন,'ছেলেবেলার বন্ধু।'ক'দিন বেড়াতে এসেছিলেন।হঠাৎ স্ট্রোক করেছে।'তারপর থেকেই কিন্তু দু'জনেই নিজেদের পাড়ার থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।তুমি যাই বলোনা কেন আমার মনেহয় গ্যাড়াকলটা ওখানেই। 

স্বামী একমনে পেপার পড়ে যাচ্ছেন তার কথার কোন উত্তর দিলেননা দেখে তিনিও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

   বিকাল হলেই ঘোষগিন্নীদের পাড়ার বটতলায় একটা পিএনপিসির আড্ডা বসে।ঘোষগিন্নী হলেন তার মধ্যমণি।কার মেয়ে কি করলো,কার ছেলে কোথায় মারপিট করলো,কোন মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরে বেরালো,কার ছেলের বউ সংসারে কতটা কাজ করলো---এগুলোই তাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয়।কিন্তু আজ কিছুদিন ধরে আরও প্রাধান্য পেয়েছে সাহাবাবুর পরিবার।হঠাৎ তাদের এই বড়লোকী চালটা।সেদিন আবার রাজমিস্ত্রীকেও বাড়ীতে ঢুকতে দেখেছেন ঘোষগিন্নী।সাহাগিন্নীকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন, 

---কি গো দিদি ছাদ দেবেন বুঝি?কথাটার মধ্যে যে একটু ব্যঙ্গ মিশ্রিত ছিলো সেটা সাহাগিন্নীও বুঝেছিলেন।তিনিও হাসি হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, 

---দেবো দিদি।তবে ক'দিন পর।কর্তা বলেছেন আগে তিনি দোকানটাকে সাজাবেন।তাই দোকানে আগে মিস্ত্রী কাজ করবে।এই দেখুন না দোকানের সবকিছু এনে বাড়ীতে জমা করেছে।হিমশিম খাচ্ছি সবকিছু সামলাতে।

  না,ঘোষগিন্নী আর কিছু বলার সুযোগ পাননি কারণ কাজ সামলানোর অজুহাতে তিনি দ্রুতবেগে সেখান থেকে সরে পড়েন।আর ঘোষগিন্নী অপেক্ষা করতে থাকেন তাদের বিকালের মজলিসের। 

  দোকানের ছাদ , রং,ফার্নিচার হয়ে দোকান নূতনভাবে সেজে উঠলো।পাড়াপ্রতিবেশিরা এখন প্রায় সবাই সাহাবাবুর মুদিখানার দোকান থেকেই জিনিসপত্র কেনে।কেউ একটু সস্তার আশায় আবার কেউ তার এই হঠাৎ বড়লোক হয়ে উঠার কোন গন্ধ পেতে।না -সাহাবাবু বা তার গিন্নী এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এটেই থাকলেন।আর তাদের তো একটিমাত্র মেয়ে বহুদিন আগেই সেই বিহারে বিয়ে হয়ে গেছে।বছরে একবার আসে সেই জামাইষষ্ঠীতে।

    দোকান সাজানোর ঠিক ছ'মাসের মাথায় সাহাবাবু তার ঘরের টালি সরিয়ে ছাদ দিলেন সিঁড়ি সমেত।পাড়াপ্রতিবেশীরা আরও যেন চক্ষু ছানাবড়া করে তাদের না জানা কথাগুলি জানার জন্য দোকানে মাল কিনতে যাওয়া আর তাদের নূতন বাড়ি দেখতে যাওয়ার প্রতিযোগীতা শুরু করলেন।কিন্তু তারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। 

  কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর।সাহাবাবু ও তার গিন্নীর বয়সের ভারে অনেক কাজই নিজেরা আর করতে পারেননা।দোকান এখন রমরমিয়ে চলে।বিহার থেকে বিশ্বস্ত দুটি ছেলেকে মেয়ে জামাই এনে দিয়েছে।থাকা,খাওয়া আর সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছে।বাড়ীতেও একজন রান্নার লোক রেখেছেন।সাহাগিন্নীর এখন পুরো বিশ্রাম।কিন্তু সময় পেলেই দুজনে সেই রাতের কথা আস্তে আস্তে আলোচনা করেন।সেদিন যদি ঝড় জলের রাতে ওই অপরিচিত লোকটাকে আশ্রয় না দিতেন তাহলে এতো আরাম আয়েশে তাদের শেষ বয়সটা কাটতোনা।সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়।ঘনঘন বাজ পড়ার শব্দ।এতো জোরে ঝড় হচ্ছিলো দুজনের মনেই আশঙ্কা ছিলো টালি উড়িয়ে নিয়ে যাবে।একটা ছোট বাল্ব জ্বালিয়ে স্বামী,স্ত্রী দুজনে খাটের উপর বসে ছিলেন।হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ।প্রথমে তারা ভেবেছিলেন হাওয়ার দাপট।কিন্তু কিছুক্ষণ পরে শুনতে পান, 

---একটু দরজাটা খুলুন না।আমি খুব বিপদে পড়েছি।

  গিন্নী নিষেধ করলেও সাহাবাবু দরজা খুলে লোকটিকে ঘরে আনেন।কাকভেজা অবস্থায় তিনি ঘরে ঢোকেন।পিঠে একটা বড় ব্যাগ।সাহাবাবু তার একটা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরতে দিলেন।সাথে একটি গামছা।ভদ্রলোক তখন ঠকঠক করে শীতে কাঁপছেন।সাহাবাবু তাকে নিয়ে পাশের ঘরটাতে গেলেন।গিন্নির অনেক মুখঝামটা সর্ত্বেও নিজেদের খাবার থেকে দুটো রুটি আর একটু আলুর তরকারী নিয়ে ভদ্রলোককে দিলেন।কিন্তু সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভদ্রলোকের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসাতে তিনি কিছুই খেতে পারেননা।সাহাবাবু তখন কি আর করবেন?গরীব মানুষ ঘরে কোন ওষুধপত্র ও নেই।বাইরে প্রবল ঝড়জল।এই অবস্থায় বাইরে বেরোনোও মুশকিল।কোথার থেকে কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেননা।তবুও ভাবলেন কাল সকালে ঝড়বৃষ্টিটা কমলে যদি একটা ডাক্তার ডাকা যায়। 

   কিন্তু সে সুযোগ তিনি আর পেলেননা।সকালে আগন্তুকের কাছে গিয়ে কোন সারাশব্দ না পেয়ে তিনি ডাক্তার ডেকে আনেন।ডাক্তার এসে জানান তিনি ভোর রাতেই মারা গেছেন।তারপর থানা পুলিশ ক্লাব অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।ইতিমধ্যে সাহাগিন্নি আগন্তুক মারা যাবার পর তার ব্যাগটি খুলে দেখতে যান কোন মোবাইল বা ঠিকানা পাওয়া যায় কিনা।ব্যাগ খুলে তো তিনি হতবাক।ব্যাগ ভর্তি টাকার বাণ্ডিল।তিনি তার স্বামীকে ডেকে দেখান।দুজনেই ঠিক করেন এ কথা তারা গোপন রাখবেন।এমনকি মেয়েকেও এ কথা জানাবেন না।নাম ধাম গোত্রহীন একজন এক ব্যাগ টাকা নিয়ে এসে তার বাড়ীতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা থেকে চিরজীবনের জন্য চলে গেলেন একে তারা মা লক্ষ্মীর কৃপা বলেই মেনে নিলেন।পুলিশের সহায়তা নিয়ে পাড়ার ছেলেদের মাধ্যমে তিনি ভদ্রলোকের দাহকাজ সম্পন্ন করেন। 

  তারপরই তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।আর তাদের এই হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনী সকলের অগোচরেই ঠেকে যায়।