Sunday, October 21, 2018


বন্ধন 
     নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী 

---এই মেজদি তুই কি করছিস এতক্ষণ বাথরুমে?মেয়েটার ক্ষিদে পেয়েছে তো!
     বাথরুমের কাছে দাঁড়িয়ে রেখা চিৎকার করতে থাকে।কিন্তু ভিতর থেকে কোন সারা না পেয়ে সে ভয় পেয়ে যায়।কাল রাত থেকেই মেজদি শরীরটা খারাপ বলছিলো।জোরে জোরে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে রেখা।না,কোন সারা নেই।দুই বোনই বাপের বাড়ি এসছে এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে।দুজনেরই দুটি মেয়ে।রেখা ছোট হলেও রেখার মেয়েটি তার মেজদি শিখার মেয়ের থেকে একবছরের বড়।বড়দির শ্বশুরবাড়ি চেন্নাই।বড়দির কোন ছেলেমেয়ে হয়নি।রেখা ও শিখার শ্বশুরবাড়ি কলকাতাতেই।যখন বাপের বাড়িতে তারা আসে দুজনে একসাথেই আসে যাতে দেখা হয়।কথায় বলে,"গাঙ্গে গাঙ্গে দেখা হয় তো বোনে বোনে দেখা হয়না।"কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এই দুই বোনের খুব মিল।তারা সবসময় ফোন করে একদিনেই আসে।আর এর ফলে ওই দুটি বাচ্চার মধ্যেও খুব মিল।একজনের বয়স চার আর একজনের পাঁচ।  
    সেই মুহূর্তে বাড়িতে অন্য কেউই ছিলোনা।রেখাদের বাড়ির সামনেই রাস্তার ওপারে ছিলো ক্লাব।সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেয়ে ক্লাবের ছেলেদের ডেকে আনে।ছেলেগুলো এসে বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ফেলে।কিন্তু ততক্ষণে যা অঘটন ঘটা ঘটে গেছে। 
       সঙ্গে সঙ্গেই শিখাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু ডাক্তার জানান প্রায় ঘন্টা খানেক আগেই শিখার মৃত্যু হয়েছে।
        রেখার বাবা নেই।বৃদ্ধা মা ও অবিবাহিত ভায়ের সংসার।বাচ্চাটিকে নিয়ে রেখা অথই সমুদ্রে পড়ে।এদিকে ভগ্নিপতিও একা মানুষ।তার ওফিস রয়েছে।সেও বাচ্চাটিকে নিয়ে যেতে পারবেনা।বাড়িতে কে দেখবে তাকে?শেষমেষ রেখা ঠিক করে সেই ওকে মানুষ করবে।আজ থেকে না হয় ভাববে তার দুটি মেয়ে।ছোট্ট রিয়া বুঝতেও পারলোনা সে জীবনে কি হারিয়ে ফেললো।খবর পেয়েই চেন্নাই থেকে চলে আসেন ওদের বড়দি বিশাখা।তিনি এসেই মা হারা মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,"ঈশ্বর তোমার কাছে আমি যে ভাবেই হোক একটি সন্তান চেয়েছিলাম কিন্তু আমি তো এভাবে মা হতে চাইনি।এটা তুমি কেন করলে?তুমি সব আগে থাকতেই ঠিক করে রাখো সবাই বলে।তাই কি তুমি আমার কোল এতদিন রিয়ার জন্যই ফাঁকা রেখেছিলে?কেন করলে এটা?এই ছোট্ট বয়সে কেন ওকে মাতৃহারা করলে?"বিশাখা জ্ঞান হারালো।নানানভাবে তখন সবাই চেষ্টা করে তার জ্ঞান ফেরালো।রিয়াকে কোলে নিয়ে সে তার মেজ ভগ্নিপতিকে ডেকে বললো,"অনল তোমার বয়স কম। পুরো জীবন তোমার পড়ে রয়েছে। কিছুদিন পড় তুমি পূনরায় বিয়ে করবে হয়তো। তখন এই মা হারা শিশুটির কি হবে বলতে পারো?মেয়েটিকে দেখাশুনা করারও কেউ নেই তোমার বাড়িতে এখন ।বিয়ের পর ওর সৎমা ওকে দেখবে কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই । আমি ওকে দত্তক নিতে চাই।তোমার কোন আপত্তি নেই তো?"        
           বিশাখা রিয়াকে দত্তক নিয়ে পূনরায় তার শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলো।বিশাখার সংসারে অর্থের কোন অভাব নেই অভাব ছিলো শুধু একটি বাচ্চার।রিয়া তার ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় আর বিশাখার চোখের থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে তা আনন্দ আর ছোট বোনকে হারানোর বেদনার।রিয়ার সবকিছুতেই সে খুঁজে পায় তার বোন শিখাকে।
       নিজের মনের মত করে সে রিয়াকে মানুষ করে।আজ রিয়ার বিয়ে।রিয়া জানে সে বিশাখার মেয়ে নয়।কিন্তু মায়ের অভাব সে কোনদিনও অনুভব করেনি। 
        হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী মেয়েকে প্রথম শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় কাঁধের উপর থেকে চাল দিয়ে মাতৃ ঋণ শোধ করতে হয়।কিন্তু রিয়া তা করেনি।সে বলেছে,"যে ঋণ বুকের তাজা রক্ত দিয়েও শোধ করা যায়না সে ঋণ আমি কিছুতেই এভাবে লোক দেখানো কথা বলে নাটক করতে পারবোনা।"
        বিশাখার এখন অনেক বয়স।স্বামী বেশ কয়েক বছর গত হয়েছেন।এখন তিনি তার আদরের রিয়ার বাড়িতে তার দুই নাতি নাতনীকে নিয়ে সবসময় আনন্দে মেতে থাকেন।কারন মাকে রিয়া একা রাখতে ভয় পায়।জামাই বাড়িতে থাকতে না চেয়ে যতবারই নিজের ঘরে বিশাখা ফিরতে চেয়েছেন রিয়া তার কোন আপত্তিই কানে তোলেনি। 
                                 (শেষ)



No comments:

Post a Comment