Sunday, October 21, 2018

  একটি সত্য ঘটনা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

   সেদিনটি ছিলো কুয়াশাচ্ছন্ন শরতের সকাল।পূর্বদিকের জানলাটা আমি খুলেই ঘুমাই।আমার বাড়ির ঠিক পূর্বদিকেই মন্দিরার নিজ হাতে লাগানো শিউলি গাছটি বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে।সারাবছরই গাছটাতে দু'চারটি ফুল ফুটলেও পুজোর সময় শিউলিতলা ফুলে ভর্তি হয়ে থাকে।আর তার মিষ্টি সুবাস  পুবের জানলা দিয়ে আমার ঘরে ঢুকে রোজ সকলে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়।
      সেদিন ছিলো অষ্টমীর সকাল।ঘুম ভেঙ্গে আমি এসে আমার সাধের ছোট্ট ব্যালকনিতাতে দাঁড়ালাম।রাস্তার পারে প্রাচীরের গা গেষে একটি নারকেল গাছে বেশ কয়েকটি পাখি বসে আপনমনে তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় মগ্ন।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই এই সময়টা আমি একটু প্রাণায়াম করি।আমি আমার নিত্য কর্মে মন দিলাম।হঠাৎ একটি কোলাহল কানে এলো।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সামনের রাস্তা দিয়ে একটি শববাহী গাড়ি আসছে আর তার পিছনে পরিচিত মানুষের ঢল।মুহূর্তে সবকিছু ভুলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসি।কে চলে গেলো?অকালেই কি অঘটন ঘটে গেলো?এই কোলাহল আনন্দউৎসবের দিনে কার বাড়িতে এতো বড় অঘটন ঘটলো?শরীর মন শিউরে উঠলো।মৃত্যু মানুষের জীবনে এমন একটা পরিণতি মানুষ সেখানে দম দেওয়া পুতুল মাত্র।প্রেমপ্রীতি দিয়ে গড়া এই সংসার,সবথেকে কাছের মানুষগুলো,আত্মীয়স্বজন সব কিছু ছেড়ে একদিন চিরতরে চলে যেতেই হবে।এটাই বিধাতার লিখন।যাওয়ার সময় হলে কেউ তাকে ধরে রাখতে পারবেনা।সংসার সমুদ্রের একপাড়ে জীবন অপর পাড়ে মৃত্যু।বিশ্বজয়ী শক্তি,অতুল সম্পদ আকাশচুম্বী কীর্তি -কোনকিছুই মৃত্যুকে জয় করতে পারেনি।কবি তো বলেই গেছেন,
"মরণ কি টেনে দেবে আঁখিকোণে অন্ধ আবরণ,
এপার ওপার মাঝে রবেনাকো' স্মৃতির বন্ধন।
      পরিচিত একজনকে দেখে জানতে চাইলাম ঘটনার বিবরণ।যা শুনলাম তাতে মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো।এতো অল্প বয়সে এমন দুটি তাজা প্রাণ চলে গেলো?নিজের অজান্তেই চোখের থেকে জল বেরিয়ে আসলো।
   'পরিবার মানবজীবনে সব চাইতে বড় শিক্ষাকেন্দ্র আর মাতাপিতা সবচাইতে বড় শিক্ষক,-কিন্তু সত্যিই কি আজকের যুগে সে কথা খাটে? পরিবারের সব শিক্ষা কি সব সন্তানেরা নিতে পারে?দেখা যায় একই পরিবারের তিনটি সন্তান একই শিক্ষা পেয়েও তিন রকম ভাবে বেরে ওঠে।কোনটি খুব ভালো আবার কোনটি খুব খারাপ।বাবা মায়ের শিক্ষা কি সব সময় কাজে আসে?কোনো বাবা মা কি চান তার সন্তান কূপথে যাক?অল্প বয়সী ছেলেমেয়ের মধ্যে দোষ দেখলেই আমরা অধিকাংশই বাবা মায়ের কোন শিক্ষা নেই বলে চেঁচাতে শুরু করি।কিন্তু কেন করি?নিজের সন্তানটিকেই কি নিজের মনের মত করে মানুষ করতে পারি?তবে অন্যের সন্তানের ক্ষেত্রে তার মাতা পিতাকে কেন টেনে আনি?
      রবীন সেনের দুই ছেলে।বড়টি ইঞ্জিনিয়ার।ছোটটিও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।বাড়ির থেকেই কলেজে যাতায়াত করে।একটু ত্যাঁদড় গোছের।কিন্তু বড় ছেলেটি খুবই ভালো।ভদ্র, বিনয়ী এবং অমায়িক।ছোট ছেলে অসিত এই পুজোর সময়ে সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত বন্ধুদের সাথেই রোজ কাটাচ্ছে।বাড়িতে এ নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও পুজোর সময় বিশেষ কোন বাঁধা ছিলোনা।অষ্টমী পুজোর রাতে পাড়ার প্যান্ডেলেই ছিলো।কয়েকজন বন্ধু এসে পড়ায় ছ সাতজন মিলে তিনটি বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।রাতে সেদিন একটু বৃষ্টিও হয়েছিলো।চাকা পিছলে যেয়ে অসিত সহ বাকি দুটি ছেলে বাইক থেকে পড়ে যায়।ঘটনাস্থলেই অসিত সহ আর একটি ছেলের মাথা পুরো থেঁতলে যায়।স্পট ডেড।ভোর রাতেই বাড়িতে খবর আসে।জানা যায় প্রত্যেকটি ছেলে ড্রিংক করেছিলো।অল্প বয়সে অধঃপতন যাওয়ার ফল ভুগতে হোল বাবা মা ও পরিবারের বাকি সদস্যদের।
     মৃত্যু অবধারিত।কিন্তু এ কেমন মৃত্যু?ফুল ফোঁটবার আগেই যে ঝরে যায়!তাকে কি মেনে নেওয়া যায়?এটা একটা দুর্ঘটনা ঠিক কিন্তু তাই বলে এই অল্প বয়সী ছেলেটির মৃত্যুর পরেও তার বাবা মায়ের কষ্টের কথা না ভেবে তাদের শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে হবে?আর যারা সেটা করেন বা এই ঘটনার পর করছেন তাদের মানুষ ভাবতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।বেশিক্ষণ আর পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওইসব কথা শোনার মত মনের অবস্থা আমার ছিলোনা।আস্তে আস্তে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।হঠাৎ করেই শরতের নীলাকাশটা আমার কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠলো।
   

No comments:

Post a Comment