মাধবীর লড়ায়
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
মাধবীর যখন অনিন্দ্যর সাথে বিয়ের কথা হচ্ছিলো তখন অনেকেই মাধবীর ভাগ্যকে হিংসার চোখে দেখেছিলো।পাড়াপ্রতিবেশী মুখে কেউ কিছু না বললেও যাদের ঘরে বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে তাদের অনেকেই ঘটনাটিকে ভালো চোখে মেনে নেননি।
দুর্গাপদ সাহার মেয়ের বিয়েতে শহরের এক আত্মীয়ের আগমন ঘটেছিলো।সেখানেই মাধবীকে দেখে ওই আত্মীয়ের পছন্দ হয়।তিনি তার একমাত্র ডক্টর ছেলের জন্য একটি ঘরোয়া মেয়ে খুঁজছিলেন।বাপ আর ছেলের সংসারে প্রয়োজন ছিলো একটি লক্ষীমন্ত মেয়ের।মাধবীকে দেখে নীলকান্তবাবুর খুব পছন্দ হয়।মাধবীর বাবা-মাকে সে কথা জানাতে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন।তারা যে স্বপ্নেও কল্পনা করেননি এমন একটি ছেলের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে হতে পারে।গ্রামের স্কুল থেকে মাধবী উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে।সে কথা নীলকান্তবাবুকে জানাতে তিনি বলেন,"আমার ঘরের লক্ষ্মী তো চাকরী করতে যাবেনা।ওই টুকুতেই আমার চলবে।"
শুভ দিন দেখে মাধবী ও অনিন্দ্যর বিয়ে হয়ে গেলো।কিন্তু মাধবীর ভাগ্যকে লোকে হিংসা করলেও বিধাতা পুরুষ তার কপালে লিখেছিলেন অন্যকিছু।খুব ধুমধাম করে বৌভাত মিটে গেলো।শুধু অনিন্দ্যর ঘরটিকেই নয় পুরো বাড়িটাই নীলকান্তবাবু সাজিয়েছিলেন টাটকা ফুল দিয়ে।কোন কাগজের বা প্লাস্টিকের ফুল নয়। তাজা ফুলের গন্ধে বাড়িটা ম ম করছিলো।ফুলশয্যার ঘরে আনুসঙ্গিক কাজ মিটিয়ে আত্মীয়স্বজনেরা যে যার ঘরে চলে যান।অনিন্দ্যও দরজা বন্ধ করে খাটে এসে বসে।নানান কথাবার্তার মাঝে সে মাধবীকে বোঝাতে চাইলো বাবা ই তার জীবনের সব।বাবাকে সে ঈশ্বর জ্ঞানে ভক্তি করে।মাধবীর ব্যবহারে তিনি যেন কোনদিন কখনোই কোন কষ্ট না পান।মাধবীও ফুলশয্যার রাতে তার স্বামীকে কথা দেয় তার জীবন থাকতে সে কোনদিন তার শ্বশুরমশাইকে কষ্ট দেবেনা।
(2)
ঘটনার দশ বছর পর আবারও সে রোগশয্যায় শায়িত শ্বশুরমশাই এর হাতদুটো ধরে কথা দেয় সে তার জীবনটাকে নূতনভাবে শুরু করবে।ফুলশয্যার রাতেই নিওরো সার্জন অনিন্দ্য হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কলে সদ্য বিবাহিতাকে ছেড়ে ছুটে যেতে বাধ্য হয়েছিলো সরকারী দায়িত্ব পালনের জন্য।কিন্তু রোগীকে সে বাঁচাতে পারলেও নিজেকে সে বাঁচাতে পারেনি।নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিলো।হাসপাতালে সেদিন তার আন্ডারে থাকা রোগীর জরুরী অপারেশান করতে হয়েছিলো।সারাদিনে বাড়িতে অথিতি সমাগমের ধকল,হাসপাতালের রোগীকে নিয়ে টেনশান, অপারেশান -সব মিলিয়ে সে ছিলো প্রচন্ড টায়ার্ড।সেই অবস্থায় ড্রাইভিং সিটে বসে একটা পাঞ্জাব লরির সাথে প্রচন্ড ধাক্কায় পূরো শরীরটা তার পিষে যায়।আর পরিণতি ঘটনাস্থলেই মৃত্যু।
(3)
আত্মীয়স্বজনেরা মাধবীকে অপয়া আখ্যা দিলেও নীলকান্তবাবু কিন্তু তাকে বুকের ভিতর চেপে রেখে শান্তনা দিয়ে গেছেন।মাধবীর জন্য তিনি তার ছেলেকে হারিয়েছেন এ কথা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন না।তিনি তার ভবিতব্যকে মেনে নিয়েছেন।তিনি মেনে নিয়েছেন তার অনিন্দ্যর ওই পর্যন্ত আয়ু ছিলো।মাধবীকে ভালো রাখতে তিনি আস্তে আস্তে আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ পর্যন্ত করেন।কারন সকলেই মাধবীকে কুনজরে দেখে;অলক্ষ্মী,অপয়া বলে।মাধবী নীলকান্তবাবুর পরিবারে ছেলের বৌ নয় আদরের কন্যা।মাধবীর বাবা মা তাকে জানিয়েই দিয়েছিলেন ওই অ লক্ষ্মী মেয়েকে গ্রামে তারা আর ফিরিয়ে নেবেননা।
নীলকান্তবাবু মাধবীকে পূণরায় পড়াশুনা শুরু করান।বছর পাঁচেকের মধ্যে মাধবী কলেজে ইংরাজীর প্রফেসার পদে নিযুক্ত হয়।তিনি মেয়েকে বারবার বিয়ের কথা বললেও মাধবীর সেই এক কথা,
---তোমায় ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা।
---কিন্তু মা আমি যখন থাকবোনা তখন তোকে দেখবে কে ?
---তখনকার কথা নাহয় তখন ভাববো বাবা।এখন এসব ভেবে তুমি তোমার শরীর খারাপ কোরনা।আমার ভাগ্যকে পরাজিত করে তুমি আমায় বাঁচার রাস্তা দেখিয়েছ।তুমি আমার কাছে ঈশ্বর।সেই ঈশ্বরকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবোনা।
(5)
মাধবী তার ঈশ্বরকে ছেড়ে না গেলেও মাধবীর ঈশ্বর মাধবীকে ছেড়ে চিরদিনের মত পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তাকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে।মাধবীর তখন পঁয়ত্রিশ বছর বয়স।আজ পর্যন্ত সে কোন ছেলের সন্ধান সে পায়নি যাকে সে ভালবাসতে পারে।একটা রাতের জন্য হলেও স্বামীকে সে কোনদিনও ভুলতে পারেনি।ফুল শয্যার রাতে তার মনে হয়েছিলো বহু জনমের তপস্যার পূণ্যফলে সে অনিন্দ্যর মত স্বামী পেয়েছে।কিন্তু নিয়তি বুঝি তার এই ভাবনা বুঝতে পেরে অলক্ষ্যে হেসেছিলেন।মাত্র কয়েকটা ঘন্টা অনিন্দ্যর সাথে কাটিয়ে সে তার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো।কিন্তু তার কপালে ভালোবাসা সইলোনা।অনিন্দ্যকে দেওয়া কথা সে পালন করতে পেরেছে কিন্তু তার শ্বশুরকে দেওয়া কথা সে এই বয়সে এসে রাখবে কেমন করে?চাকরী আর শ্বশুরের মস্তবড় বাড়ি এই হোল আজ মাধবীর জীবন।
# নন্দা