দায়বদ্ধতা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
সমস্ত মেলা ও গ্রাম তোলপাড় করেও যখন মেলাতেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে অবিনাশ খুঁজে পেলোনা তখন সে ঠিক করে কলকাতা যাবে ছেলেকে খুঁজতে।কারন এই মেলায় কলকাতা থেকেও অনেক মানুষ আসে।যদি তাদের কেউ নিয়ে যেয়ে থাকে!অন্যের জমিতে চাষ করে দিন আনি দিন খাওয়া অবিনাশ সাহা একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে উন্মাদ প্রায়। স্ত্রী কল্পনাদেবীরও একই অবস্থা। হতদরিদ্র পরিবারে পাঁচ বছরের ছেলে হেমন্তই ছিলো ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো। ছেলেকে মেলা দেখাতে নিয়ে যেয়ে বিনা মেঘে বজ্র পাতের মত বাবা অবীনাশের হাত ফস্কে কখন যে ছেলে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো অবিনাশ তা বুঝতেই পারলোনা। সমস্ত মেলায় পাগলের মত হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ালো।কোথায় ছেলে? মধ্য রাতে সে খালি হাতে বাড়িতে ফিরে আসে।
এত বড় শহর কলকাতায় কোথায় খুঁজে পাবে সে তার হারানো মানিক হেমন্তকে!তবুও সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস এগলি ওগলি,এ রাস্তা ও রাস্তা ছেলেকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো।জীবনটা যদি সিনেমার মত হত হয়ত অনায়াসেই সে তার ছেলেকে খুঁজে পেত।ছ'মাস ধরে রাস্তা ঘাটে, রেলস্টেশনে কুলিগিরি করে কখনও মুড়ি,রুটি আবার কোনদিন বা শুধু বিস্কুট জল খেয়েই যেখানে সেখানে রাত কাটিয়ে শেষমেষ যখন সে ছেলেকে পেলোনা তখন তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে গ্রামের বাড়ির উর্দেশ্যে রওনা হোল।
কিংতু বাড়িতে তার জন্য আরও ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করে ছিলো তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।সে তার বৌকে কথা দিয়ে গেছিলো ছেলেকে নিয়েই সে ফিরবে।কিনতু শূন্য হাতে তাকে ফিরতে হোল তাই মনের মধ্যে বৌকে বলার জন্য অনেককিছুই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল।প্রশ্নকর্তা নিজে হয়ে উত্তরদাতাও নিজেই হচ্ছিল কারন কি প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে সে নিজেই বুঝতে পারছিলো না।
গ্রামের মানুষের উৎসুক দৃষ্টি এড়িয়ে যখন সে তার বেড়ার ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ালো;তখন তার বুকটা ধপাস করে কেঁপে উঠলো।পুরো বাড়ি আগাছায় ভর্তি। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ভিতরে কিছু নেই বললেই চলে-মানুষ তো দূরহস্ত!ঘরের ভিতর তক্তপোষটা শুধু পরে আছে।তার বুঝতে বাকি রইলোনা জীবনের আর একটা দিকও সে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছে।
গ্রামে সামান্য যা জমিজমা ছিলো অবিনাশ মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু বিক্রি করে কলকাতার উর্দেশে পূনরায় রওনা দেয় সেই একই আশা নিয়ে যদি ছেলেকে সে খুঁজে পায়!
কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়।না-ছেলেকে সে খুঁজে পায়নি।সে এখন রমেন চৌধুরীর বাগানের মালি।সকাল ও বিকালে সে বাগানে কাজ করে। রমেন চৌধুরীর গাড়ির ড্রাইভারের পাশের ঘরেই তার থাকার জন্য একটি ঘর।খাবার স্টোভে নিজের হাতে রান্না।দু'বছর ধরে এখানে সে আছে;একমাত্র বাড়ির মালিক ও ড্রাইভার নির্মল ছাড়া আর কারও সাথেই তার কথা হয়না,দেখা হয়না বললেও চলে। শুনেছে মালিকের একটি মাত্র ছেলে।পড়াশুনায় খুবই ভালো।বাগানে কাজ করবার সময়ে কখনো সখনো মালকিন বা তার ছেলেকে দূর থেকে সে একটু দেখলেও সামনাসামনি কোনদিন দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি।
গত কয়েকদিন ধরে সে লক্ষ্য করছে দিন নেই রাত নেই ড্রাইভার নির্মল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আর রাতে কখন ফিরছে অনেক সময় তাও সে জানতে পারছেনা। একদিন সকালে নির্মলের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াতে নির্মলের কাছে অবিনাশ জানতে চায়,
----কি ব্যপার বলো তো?বাড়িতে কারও কিছু হয়েছে?
--- সাহবের ছেলের শরীর খুবই খারাপ!
---কেন কি হয়েছে?
---শুনেছি দু'টি কিডনীই নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।এখন কিডনী ট্রান্সফার না করলে নাকি ছেলেটাকে বাঁচানোই যাবেনা।সাহেব ও মালকিন দু'জনেই কিডনী দিতে চেয়েছিলেন।কিনতু কি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবুরা বলেছেন উনারা দিলে হবেনা।যদি রক্তের সম্পর্কের কোন আত্মীয় দেয় তাহলে হলেও হতে পারে।কিনতু কোথায় পাবেন ওই ছেলের রক্তের সম্পর্কের কোন আত্মীয়?
---কেন ? উনাদের রক্তের সম্পর্কের কোন আত্মীয় নেই?
---থাকবেনা কেন?অনেকেই আছেন।তুমি জানোনা অবিনাশদা,কাউকে কোনদিনও বোলোনা;উনারা আমাকে খুব বিশ্বাস করেন আর আমার কেউ নেই বলেই আজ বহু বছর ধরে আমি উনাদের সাথে আছি।ছেলেটি তো উনাদের নিজের নয়।
---সেকি?
---তবে শোন-সে এক ইতিহাস।প্রথমে সাহেবরা থাকতেন দুর্গাপুরে।বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরও যখন কোন বাচ্চা তাদের হলোনা তখন শুরু হোল মালকিন ও সাহেবের দেবতার দরজায় দরজায় ঘুরে মাথা খোটা।যেখানেই শুনেছেন মন্দিরের দেবতা খুব জাগ্রত সেখানেই ছুটে গেছেন তাদের সঙ্গে আমি। একবার কারও কাছ থেকে জানতে পারেন হাওড়ার প্রত্যন্ত শিউলিপুর গ্রামে রাসমেলা উপলক্ষে বিশাল মেলা হয়।মেলা চলে সাতদিন ধরে।ওখানে প্রতিদিন মা কালির পূজা হয়।
এটুকু বলেই নির্মল অবীনাশের দিকে তাকিয়ে দেখে অবিনাশ প্রচন্ডভাবে ঘামছে!
---কি হোল তোমার অবিনাশদা? শরীর খারাপ লাগছে?
---থামলে কেন?আমার কিছু হয়নি তুমি বলো।
---হ্যাঁ যা বলছিলাম।একথা শুনে সাহেব ও মালকিন মেলার সময়ে সেখানে যেয়ে পুজো দিয়ে ফেরার জন্য গাড়িতে উঠতে যাবেন ঠিক তখনই দেখেন ছোট্ট ফুটফুটে একটি ছেলে এই সাড়ে চার কি পাঁচ বছর বয়স হবে গাড়ি থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।সাহেব তার সাথে অনেক্ষন কথা বলেন।সে তার বাবার নামটাও তখন পরিস্কার করে বলতে পারেনি।তারপর তিনি তাকে কোলে নিয়ে মেলার মধ্যে অনেক্ষন তার বাড়ির লোকের সন্ধান করেন।বহুক্ষন ঘোরাঘুরি করেন ওই এক রত্তি ছেলেটিকে নিয়ে।কিনতু তার বাড়ির লোকের সন্ধান পাননা।শেষমেষ তিনি ছেলেটিকে কোলে নিয়েই পুনরায় গাড়ির কাছে ফিরে আসেন। ছেলেটিকে একা ফেলে রেখেও আসতে পারছেন না। অবশেষে ছেলেটিকে দেবতার আশীর্বাদ বলে মনে করে তাকে নিয়েই বাড়ি ফেরেন। নিজের ছেলের মত তাকে মানুষ করতে লাগেন। পাড়ার লোকের কথা এড়াতে দুর্গাপুরের বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় এই বিশাল বাড়ি কেনেন।ছেলেটিকে কাছে পাওয়ার পর তারা সব দুঃখ ভুলে যান।
আর কখনো তারা সন্তান লাভের আশায় পাগলের মত মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়াননি। এখন কি ভয়ানক বিপদের মধ্যে তারা পড়েছেন!এখন কে এই বিপদ থেকে তাদের উদ্ধার করবে বলতো?
অবিনাশ অন্যমনস্ক ভাবেই বলে,"আমি"।
কিছুক্ষন স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে নির্মলের ঘরে বসে থেকে নিজেকে সংযত করে আস্তে আস্তে সে এই প্রথম সাহেবের ড্রয়িংরুমে এসে পৌঁছালো।রমেন চৌধুরী তখন ছেলের কাছে নার্সিংহোম যাবেন বলে বেরোতে যেয়ে অবিনাশকে দেখে জানতে চাইলেন,
---কিছু বলবে অবিনাশ?
---আপনি আমার কিডনী দু'টি নিয়ে ছেলেটিকে বাঁচান।আমি নির্মলের কাছে শুনলাম ও খুব অসুস্থ্য তাই এই কথাটি বলতেই আমি এসেছি।
---কিডনী একটা দিলেই হয়।আর বললেই তো আর কিডনী দেওয়া যায়না।অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে।যদি সে সব ঠিকঠাক মিলে যায় তবেই কিডনী দেওয়া যায়।মানুষ একটা কিডনী নিয়েই বেঁচে থাকতে পারে।তাতে কোনই অসুবিধা নেই। কিনতু তোমার সাথে সবকিছু মিলে যাবে তারও তো কোন গ্যারান্টি নেই।
---মিলবে স্যার।আপনি দেখবেন সব মিলে যাবে।আমার মন বলছে।আপনি এখনই আমায় সাথে নিয়ে চলুন।
ছেলের অসুস্থ্যতায় পাগল প্রায় রমেনবাবু অবিনাশকে সাথে নিয়েই নার্সিংহোম আসেন।অবিনাশ সাহেবের ছেলেকে একটু দেখতে চায়।অবিনাশকে নিয়ে যান রমেনবাবু ছেলের কাছে।অবীনাশের তখন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে, এতো কাছে থেকেও নিজের ছেলেকে সে কেন চিনতে পারেনি এই ভেবে।ছেলের মাথার উপর হাত রাখতেও সে সাহস পায়নি!কারন সে এখন মনিবের ছেলে আর সে ওই বাড়ির সামান্য এক মালি মাত্র।তার হেমন্তের বয়স এখন চব্বিশ বছর।ছোট বেলার মুখের সাথে কোনই মিল নেই।ভ্রুরুর কাছে কাটা দাগটা এখনো মিলায়নি।জলভর্তি পিতলের কলসির উপর পরে যেয়ে কেটে গেছিলো।উফ্ফ কি রক্ত বেরিয়েছিলো।গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেয়ে তিনখানা সেলাই দিয়ে তবে রক্ত বন্ধ হয়।আজ এতগুলো বছর বাদে নিজের সেই হারানো মানিককে চোখের সামনে দেখেও তাকে ছোঁয়ার কোন অধিকার তার নেই।শুধু জলভরা চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো,"বাবা হয়ে তোর জন্য কোনদিন কিছুই করতে পারিনি। উল্টে তোর মায়ের বুক থেকে তোকে আলাদা করে দিয়েছি।তুই সুস্থ্য হয়ে উঠবি একটুও ভাবিসনা।নিজের জীবন দিয়েই তোকে আমি সুস্থ্য করে তুলবো।তোর সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্ট আমার রিপোর্টের সাথে মিলবেই -আমি যে তোর বাবা।" ধীর পায়ে অবিনাশ ছেলের কাছ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।
তিন মাসের মাথায় বাবার দেওয়া কিডনী ছেলের দেহে প্রতিস্থাপন হোল।ছেলে ভালো আছে জানতে পেরে অপারেশনের তিনদিন পর রাতের আঁধারে সকলের অলক্ষে শরীরের যত জায়গায় নল লাগানো ছিলো অবিনাশ একে একে সব খুলে ফেললো।বেঁচে থাকলে কখনো যদি তার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় যে আজকের সৌম্য চৌধুরী তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে হেমন্ত!অবিনাশ নিজের জীবন দিয়ে তার হেমন্তের জীবন রক্ষা করে নিশ্চিন্ত মনে হেমন্তের মায়ের কাছে চলে গেলো।সে তার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছে আর তার মা কোনো প্রশ্নবানে অবিনাশকে জর্জরিত করতে পারবেনা।এটাই তার চরম শান্তি।
শেষ
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
সমস্ত মেলা ও গ্রাম তোলপাড় করেও যখন মেলাতেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে অবিনাশ খুঁজে পেলোনা তখন সে ঠিক করে কলকাতা যাবে ছেলেকে খুঁজতে।কারন এই মেলায় কলকাতা থেকেও অনেক মানুষ আসে।যদি তাদের কেউ নিয়ে যেয়ে থাকে!অন্যের জমিতে চাষ করে দিন আনি দিন খাওয়া অবিনাশ সাহা একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে উন্মাদ প্রায়। স্ত্রী কল্পনাদেবীরও একই অবস্থা। হতদরিদ্র পরিবারে পাঁচ বছরের ছেলে হেমন্তই ছিলো ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো। ছেলেকে মেলা দেখাতে নিয়ে যেয়ে বিনা মেঘে বজ্র পাতের মত বাবা অবীনাশের হাত ফস্কে কখন যে ছেলে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো অবিনাশ তা বুঝতেই পারলোনা। সমস্ত মেলায় পাগলের মত হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ালো।কোথায় ছেলে? মধ্য রাতে সে খালি হাতে বাড়িতে ফিরে আসে।
এত বড় শহর কলকাতায় কোথায় খুঁজে পাবে সে তার হারানো মানিক হেমন্তকে!তবুও সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস এগলি ওগলি,এ রাস্তা ও রাস্তা ছেলেকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো।জীবনটা যদি সিনেমার মত হত হয়ত অনায়াসেই সে তার ছেলেকে খুঁজে পেত।ছ'মাস ধরে রাস্তা ঘাটে, রেলস্টেশনে কুলিগিরি করে কখনও মুড়ি,রুটি আবার কোনদিন বা শুধু বিস্কুট জল খেয়েই যেখানে সেখানে রাত কাটিয়ে শেষমেষ যখন সে ছেলেকে পেলোনা তখন তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে গ্রামের বাড়ির উর্দেশ্যে রওনা হোল।
কিংতু বাড়িতে তার জন্য আরও ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করে ছিলো তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।সে তার বৌকে কথা দিয়ে গেছিলো ছেলেকে নিয়েই সে ফিরবে।কিনতু শূন্য হাতে তাকে ফিরতে হোল তাই মনের মধ্যে বৌকে বলার জন্য অনেককিছুই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল।প্রশ্নকর্তা নিজে হয়ে উত্তরদাতাও নিজেই হচ্ছিল কারন কি প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে সে নিজেই বুঝতে পারছিলো না।
গ্রামের মানুষের উৎসুক দৃষ্টি এড়িয়ে যখন সে তার বেড়ার ঘরটির সামনে এসে দাঁড়ালো;তখন তার বুকটা ধপাস করে কেঁপে উঠলো।পুরো বাড়ি আগাছায় ভর্তি। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ভিতরে কিছু নেই বললেই চলে-মানুষ তো দূরহস্ত!ঘরের ভিতর তক্তপোষটা শুধু পরে আছে।তার বুঝতে বাকি রইলোনা জীবনের আর একটা দিকও সে চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছে।
গ্রামে সামান্য যা জমিজমা ছিলো অবিনাশ মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু বিক্রি করে কলকাতার উর্দেশে পূনরায় রওনা দেয় সেই একই আশা নিয়ে যদি ছেলেকে সে খুঁজে পায়!
কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়।না-ছেলেকে সে খুঁজে পায়নি।সে এখন রমেন চৌধুরীর বাগানের মালি।সকাল ও বিকালে সে বাগানে কাজ করে। রমেন চৌধুরীর গাড়ির ড্রাইভারের পাশের ঘরেই তার থাকার জন্য একটি ঘর।খাবার স্টোভে নিজের হাতে রান্না।দু'বছর ধরে এখানে সে আছে;একমাত্র বাড়ির মালিক ও ড্রাইভার নির্মল ছাড়া আর কারও সাথেই তার কথা হয়না,দেখা হয়না বললেও চলে। শুনেছে মালিকের একটি মাত্র ছেলে।পড়াশুনায় খুবই ভালো।বাগানে কাজ করবার সময়ে কখনো সখনো মালকিন বা তার ছেলেকে দূর থেকে সে একটু দেখলেও সামনাসামনি কোনদিন দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি।
গত কয়েকদিন ধরে সে লক্ষ্য করছে দিন নেই রাত নেই ড্রাইভার নির্মল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আর রাতে কখন ফিরছে অনেক সময় তাও সে জানতে পারছেনা। একদিন সকালে নির্মলের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াতে নির্মলের কাছে অবিনাশ জানতে চায়,
----কি ব্যপার বলো তো?বাড়িতে কারও কিছু হয়েছে?
--- সাহবের ছেলের শরীর খুবই খারাপ!
---কেন কি হয়েছে?
---শুনেছি দু'টি কিডনীই নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।এখন কিডনী ট্রান্সফার না করলে নাকি ছেলেটাকে বাঁচানোই যাবেনা।সাহেব ও মালকিন দু'জনেই কিডনী দিতে চেয়েছিলেন।কিনতু কি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবুরা বলেছেন উনারা দিলে হবেনা।যদি রক্তের সম্পর্কের কোন আত্মীয় দেয় তাহলে হলেও হতে পারে।কিনতু কোথায় পাবেন ওই ছেলের রক্তের সম্পর্কের কোন আত্মীয়?
---কেন ? উনাদের রক্তের সম্পর্কের কোন আত্মীয় নেই?
---থাকবেনা কেন?অনেকেই আছেন।তুমি জানোনা অবিনাশদা,কাউকে কোনদিনও বোলোনা;উনারা আমাকে খুব বিশ্বাস করেন আর আমার কেউ নেই বলেই আজ বহু বছর ধরে আমি উনাদের সাথে আছি।ছেলেটি তো উনাদের নিজের নয়।
---সেকি?
---তবে শোন-সে এক ইতিহাস।প্রথমে সাহেবরা থাকতেন দুর্গাপুরে।বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরও যখন কোন বাচ্চা তাদের হলোনা তখন শুরু হোল মালকিন ও সাহেবের দেবতার দরজায় দরজায় ঘুরে মাথা খোটা।যেখানেই শুনেছেন মন্দিরের দেবতা খুব জাগ্রত সেখানেই ছুটে গেছেন তাদের সঙ্গে আমি। একবার কারও কাছ থেকে জানতে পারেন হাওড়ার প্রত্যন্ত শিউলিপুর গ্রামে রাসমেলা উপলক্ষে বিশাল মেলা হয়।মেলা চলে সাতদিন ধরে।ওখানে প্রতিদিন মা কালির পূজা হয়।
এটুকু বলেই নির্মল অবীনাশের দিকে তাকিয়ে দেখে অবিনাশ প্রচন্ডভাবে ঘামছে!
---কি হোল তোমার অবিনাশদা? শরীর খারাপ লাগছে?
---থামলে কেন?আমার কিছু হয়নি তুমি বলো।
---হ্যাঁ যা বলছিলাম।একথা শুনে সাহেব ও মালকিন মেলার সময়ে সেখানে যেয়ে পুজো দিয়ে ফেরার জন্য গাড়িতে উঠতে যাবেন ঠিক তখনই দেখেন ছোট্ট ফুটফুটে একটি ছেলে এই সাড়ে চার কি পাঁচ বছর বয়স হবে গাড়ি থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।সাহেব তার সাথে অনেক্ষন কথা বলেন।সে তার বাবার নামটাও তখন পরিস্কার করে বলতে পারেনি।তারপর তিনি তাকে কোলে নিয়ে মেলার মধ্যে অনেক্ষন তার বাড়ির লোকের সন্ধান করেন।বহুক্ষন ঘোরাঘুরি করেন ওই এক রত্তি ছেলেটিকে নিয়ে।কিনতু তার বাড়ির লোকের সন্ধান পাননা।শেষমেষ তিনি ছেলেটিকে কোলে নিয়েই পুনরায় গাড়ির কাছে ফিরে আসেন। ছেলেটিকে একা ফেলে রেখেও আসতে পারছেন না। অবশেষে ছেলেটিকে দেবতার আশীর্বাদ বলে মনে করে তাকে নিয়েই বাড়ি ফেরেন। নিজের ছেলের মত তাকে মানুষ করতে লাগেন। পাড়ার লোকের কথা এড়াতে দুর্গাপুরের বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় এই বিশাল বাড়ি কেনেন।ছেলেটিকে কাছে পাওয়ার পর তারা সব দুঃখ ভুলে যান।
আর কখনো তারা সন্তান লাভের আশায় পাগলের মত মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়াননি। এখন কি ভয়ানক বিপদের মধ্যে তারা পড়েছেন!এখন কে এই বিপদ থেকে তাদের উদ্ধার করবে বলতো?
অবিনাশ অন্যমনস্ক ভাবেই বলে,"আমি"।
কিছুক্ষন স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে নির্মলের ঘরে বসে থেকে নিজেকে সংযত করে আস্তে আস্তে সে এই প্রথম সাহেবের ড্রয়িংরুমে এসে পৌঁছালো।রমেন চৌধুরী তখন ছেলের কাছে নার্সিংহোম যাবেন বলে বেরোতে যেয়ে অবিনাশকে দেখে জানতে চাইলেন,
---কিছু বলবে অবিনাশ?
---আপনি আমার কিডনী দু'টি নিয়ে ছেলেটিকে বাঁচান।আমি নির্মলের কাছে শুনলাম ও খুব অসুস্থ্য তাই এই কথাটি বলতেই আমি এসেছি।
---কিডনী একটা দিলেই হয়।আর বললেই তো আর কিডনী দেওয়া যায়না।অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে।যদি সে সব ঠিকঠাক মিলে যায় তবেই কিডনী দেওয়া যায়।মানুষ একটা কিডনী নিয়েই বেঁচে থাকতে পারে।তাতে কোনই অসুবিধা নেই। কিনতু তোমার সাথে সবকিছু মিলে যাবে তারও তো কোন গ্যারান্টি নেই।
---মিলবে স্যার।আপনি দেখবেন সব মিলে যাবে।আমার মন বলছে।আপনি এখনই আমায় সাথে নিয়ে চলুন।
ছেলের অসুস্থ্যতায় পাগল প্রায় রমেনবাবু অবিনাশকে সাথে নিয়েই নার্সিংহোম আসেন।অবিনাশ সাহেবের ছেলেকে একটু দেখতে চায়।অবিনাশকে নিয়ে যান রমেনবাবু ছেলের কাছে।অবীনাশের তখন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে, এতো কাছে থেকেও নিজের ছেলেকে সে কেন চিনতে পারেনি এই ভেবে।ছেলের মাথার উপর হাত রাখতেও সে সাহস পায়নি!কারন সে এখন মনিবের ছেলে আর সে ওই বাড়ির সামান্য এক মালি মাত্র।তার হেমন্তের বয়স এখন চব্বিশ বছর।ছোট বেলার মুখের সাথে কোনই মিল নেই।ভ্রুরুর কাছে কাটা দাগটা এখনো মিলায়নি।জলভর্তি পিতলের কলসির উপর পরে যেয়ে কেটে গেছিলো।উফ্ফ কি রক্ত বেরিয়েছিলো।গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেয়ে তিনখানা সেলাই দিয়ে তবে রক্ত বন্ধ হয়।আজ এতগুলো বছর বাদে নিজের সেই হারানো মানিককে চোখের সামনে দেখেও তাকে ছোঁয়ার কোন অধিকার তার নেই।শুধু জলভরা চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো,"বাবা হয়ে তোর জন্য কোনদিন কিছুই করতে পারিনি। উল্টে তোর মায়ের বুক থেকে তোকে আলাদা করে দিয়েছি।তুই সুস্থ্য হয়ে উঠবি একটুও ভাবিসনা।নিজের জীবন দিয়েই তোকে আমি সুস্থ্য করে তুলবো।তোর সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্ট আমার রিপোর্টের সাথে মিলবেই -আমি যে তোর বাবা।" ধীর পায়ে অবিনাশ ছেলের কাছ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো।
তিন মাসের মাথায় বাবার দেওয়া কিডনী ছেলের দেহে প্রতিস্থাপন হোল।ছেলে ভালো আছে জানতে পেরে অপারেশনের তিনদিন পর রাতের আঁধারে সকলের অলক্ষে শরীরের যত জায়গায় নল লাগানো ছিলো অবিনাশ একে একে সব খুলে ফেললো।বেঁচে থাকলে কখনো যদি তার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় যে আজকের সৌম্য চৌধুরী তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে হেমন্ত!অবিনাশ নিজের জীবন দিয়ে তার হেমন্তের জীবন রক্ষা করে নিশ্চিন্ত মনে হেমন্তের মায়ের কাছে চলে গেলো।সে তার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছে আর তার মা কোনো প্রশ্নবানে অবিনাশকে জর্জরিত করতে পারবেনা।এটাই তার চরম শান্তি।
শেষ
No comments:
Post a Comment