"মামার কীর্তি" (নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী )
বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন | অমিতবাবু অনেকক্ষন আগেই এসে গেছেন তার আদরের বোন রোহিণীর বাড়ি | বোনঝির বিয়ে ঠিক হয়েছে ,আজ ছেলের আশীর্বাদ | তিনি যাবেন | একমাত্র মামা তিনি | তার বোনের ইচ্ছা তার দাদাই তার হবু জামাইকে আশীর্বাদ করুক | অমিতবাবুদের আদিবাড়ি ছিলো বাংলাদেশের খুলনা জেলার পিলজঙ্গ গ্রামে | একদম খাঁটি বাঙাল তারা | বোনটির বিয়েও দিয়েছেন বাঙ্গাল ঘরেই | বলতে গেলে যেহেতু তিনি নিজে বাঙ্গাল তাই তিনি নিজেও বাঙ্গালদের একটু পছন্দ করেন বেশি এবং দাদা ,বোন দুজনেই মা ,ঠাকুমাদের মতো দেশের গায়েঁর নিয়ম ,নীতি এক কথায় বলতে গেলে সংস্কার মেনে চলেন | মামার হাতে ভাত খাওয়া ,মামার হাতে হাতে খড়ি দেওয়া ,মামার হাতে বোনঝি জামাই এর আশীর্বাদ ,মামার হাতে সম্প্রদান - তাহলে নাকি ছেলেমেয়ে মেধাবী ও সুখী হয় | খুলনা জেলার মানুষের মধ্যে এরূপ একটি ধারণা প্রচলিত আছে | তাই অমিত ব্যানার্জী একেবারে কুঁচানো ধুতি ,পাঞ্জাবী আর গলায় মোটা সোনার চেনে নিজেকে সাজিয়ে সকাল সকাল বোনের বাড়ি এসে হাজির ভাগ্নি জামাই আশীর্বাদের প্রস্তূতি নিয়ে | কিন্তু ভাগ্নির মুখটা তিনি আবিষ্কার করেন একটু থমথমে | আলাদা করে অন্য ঘরে তাকে ডেকে নিয়ে যান | দরজা বন্ধ করে কাছে টেনে তাকে জিজ্ঞেস করেন ," কিরে রিঙ্কু , তোর কি এই বিয়েতে মত নেই ?" রিঙ্কু মুখ নীচু করে থাকে আর চোখের থেকে তার টপটপকরে তার জল পড়তে থাকে | তিনি রিংকুকে বলেন ," আরে এখনো সময় আছে তো ! আমাকে সব কিছু খুলে বল ,দেখি কিছু করা যায় কিনা ?"রিংকু কাঁদতে কাঁদতে তার মামাকে জানালো - যে ছেলেটার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে ,তার ছোট ভাইকে সে ভালোবাসে | যেহেতু সে চাকরিতে পার্মানেন্ট হয়নি তাই যিনি সম্মন্ধ এনেছেন তার কথামতো তার দাদার সাথেই বিয়ে ঠিক করেছেন | কিন্তু মা ,বাবা জানে না যে সে অজয়কে ভালোবাসে | ভয়ে কোনো কথা সে মা ,বাবাকে বলতেও পারেনি | অমিত বাবু সব শুনে একপ্রস্ত হাসলেন |রিংকু তাকে বললো, "তুমি হাসছো মামা ?" " দূর পাগলী তুই আগেই আমাকে সব জানালিনা কেন ?"
---কেমন করে সব বলতাম তোমায় বলো ?
---আচ্ছা তুই এক কাজ কর , অজয়কে ফোন করে বল আমি কথা বলবো |
---মানে ? কি বলবে তুমি ?
---যখন বোলবো তখন শুনবি | ফোনটা করে বল ,মামা কথা বলবে | রিংকু মামার স্বভাব জানে | এখুনি যদি সে কাজটা না করে তাহলে ক্ষেপে বোম হয়ে যাবে |সে অজয়কে ফোনটা করে মামাকে ধরিয়ে দিলো | ছেলের বাড়িতে সবাই এসে হাজির হলেন |শাঁখ ,উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে সকলে যেয়ে ঘরে ঢুকলেন | শুরু হলো অতিথি আপ্যায়ন | অজয়ের দাদা ইশারায় অমিতবাবুকে জানিয়ে দিলো সে বিজয় | ইশারায় অনেক কথায় অমিতবাবু ও বিজয়ের মধ্যে হলো ঘরে কেউ কিছ্ছুটি টের পেলেন না | আশীর্বাদের জন্য আসন পাতা হলো | বিজয়কে সকলে আসনে বসতে বলছেন | কিন্তু বিজয় কিছুতেই বসে না | অমিতবাবু তখন বললেন ," কি হলো বাবা বস "| "কিন্তু আমি তো এ বিয়ে করতে পারবো না |" ঘরের ভিতরে যেন বজ্রপাত হলো | সকলে চম্কে উঠলো | বিজয়ের মা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন ," এ তুই কি বলছিস বাবা ? বিয়ের মাত্র সাতদিন দেরী | কার্ড চাপানো ,নিমন্ত্রণ করা ,সব কিছু অর্ডার করা পর্যন্ত হয়ে গেছে | পরিবারের মান, সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে ; এ রকম করিসনা সোনা |"বিজয় বললো ," কেনো তোমরা ভায়ের বিয়ে দাও এখানে ,ভাই ও তো চাকরী পেয়েছে | কয়েকমাসের মধ্যেই ওর ও তো পার্মান্যান্ট হয়ে যাবে | কোনো অসুবিধা নেই তো | " কিন্তু ওরা কেন রাজি হবে?" বিজয়ের মা বললেন | অমিতবাবু তার ভগ্নিপতিকে আঁড়ালে ডেকে বললেন,"রমেন তুমি রাজি হয়ে যাও | মেয়ে তোমার সুখী হবে | এই পরিস্থিতিতে আমাদের আর কিছুই করার নেই |" রমেনবাবু ভগ্নিপতির কথায় সায় দিলেন | কারণ তিনি এই মুহুর্ত্বে অন্য কিছুই ভাবতে পারছিলেন না | অজয় এসে আসনে বসলো | শুরু হলো আশীর্বাদ | অমিতবাবু তাঁর আশীর্বাদ শেষ করে আস্তে আস্তে বললেন , " কেমন ম্যানেজ করলাম সব ! খুব তো ভয় পাচ্ছিলে , তোমার দাদাকে বুঝিয়ে বললাম , তোমার হবু বৌ তোমার ভাইকে ভালোবাসে | বিয়ের পর তুমি যদি জানতে পারো - তোমার বৌটি তোমার ভায়ের প্রেমিকা ছিলো ,তখন তোমার কেমন লাগবে ? ব্যস বাজিমাত ! " অজয় ফিসফিসকরে মামাশ্বশুরের কানেকানে বললো ," কিন্তু মামা দাদার নামে তো কার্ড ছাপা হয়ে গেছে ,আপনি তো তখন দাদার ই-মেল আই .ডি . টা নিলেন ,দিদির ছবি পাঠিয়ে দেবেন বললেন ,পাঠিয়েছেন কি ? দাদা কিছু জানিয়েছে ?" "আমি তো পাঠিয়েছি বাবা কিন্তু তার মতামত এখনো জানতে পারিনি | কি করি বলতো বাবা ?"
রমেনবাবু দু'জনের এই ফিসফিসানি শুনে বললেন ," মনে হচ্ছে মামাশ্বশুর ,জামাই দু'জন দু'জনকে আগে থাকতেই চেনে ; সে চিনুক ক্ষতি নেই কিন্তু দাদা তুমি এখন ওঠো এবার আমরা আশীর্বাদ করবো |"
অমিতবাবু ফোনে বিজয়ের সাথে কথা বলে তার মেয়ের ছবিটা ই-মেলে পাঠিয়ে দিলেন | এও বললেন ,"যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে ছবিটা দেখো আর তোমার মতামতটা জানিও | এই কারণে বলছি বাবা ,তোমার বন্ধু বান্ধব মহলে সকলেই তো জানে তোমার বিয়েরদিন স্থির হয়ে গেছে ;তাই যদি তোমার আপত্তি না থাকে ,আমার মেয়েটিকে তুমি ওই দিনেই বিয়ে করতে পারো ; যদি তোমার পছন্দ হয় | মেয়ে আমার খারাপ দেখতে নয় ,লোকে তাকে সুন্দরীই বলে | মাস ছয়েক হলো সে বাংলা বিভাগে অধ্যাপিকা হিসাবে কাজে যোগদান করেছে | "
অমিতবাবু ছবিটা পাঠান ঠিকই কিন্তু বিজয় খুলে আর দেখে না | ভায়ের যখন আশীর্বাদ হচ্ছে কিছুটা কৌতূহল বশতঃই সে মেলটা খোলে | খুলেই চমকে উঠে | "একি এতো নিবেদিতা"- নিজের মনেই বলে ওঠে | একই কলেজে দু'জনে পড়তো | বিজয়ের থেকে এক বছরের জুনিয়র ছিল নিবেদিতা | খুব ভালো লাগতো নিবেদিতাকে বিজয়ের | কথাবার্তাও বলতো | কিন্তু বিজয় যেদিন নিবেদিতাকে প্রপোজ করে ,নিবেদিতা সেদিন তাকে বলেছিলো ,"সব ছেলেরাই একই ধরণের ! একটু হেসে কথা বললেই মনে করে তার প্রেমে পরে গেছি | প্রেম করে বিয়ে করার ইচ্ছা আমার নেই | আমার মা ,বাবা যাকে পছন্দ করে আমার সামনে এনে দাঁড় করবেন বিনা দ্বিধায় আমি তার গলায় মালা পড়াবো |" এরপর যতদিন দু'জনে কলেজে পরস্পরকে দেখেছে হাই ,হ্যালোতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে | সে বছর ছয়েক আগের কথা | পাশ করে বেড়োনোর পর আর দেখা হয়নি | ছবিটা দেখে কথাগুলি ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলো বিজয় | হঠ্যাৎ মায়ের গলার আওয়াজে তার চমক ভেঙ্গে ,
---কি রে ,ভাইকে আশীর্বাদ করতে যাবিনা ?
---হ্যাঁ চলো -
---বাবা ,হঠ্যাৎ করে বিয়েতে বেঁকে বসলি কেন ?দাদা থাকতে আগে ছোট ভায়ের বিয়ে দিলে লোকে কি বলবে ?
---কি আর বলবে ? বিজয় হাসতে হাসতে বলে , তা মা এক কাজ করো ওই একই দিনে একটা মেয়ে দেখে আমার বিয়েটাও দিয়ে দাও |
---এ আবার কি কথা ! তা তুই এই বিয়েটাই করতে চাইলিনা কেন ?
---মা ,মেয়েটি আমার থেকে খুব ছোট | ওকে ভায়ের সাথেই মানাবে | এতদিন বলবো বলবো করেও বলা হয়নি | আজ তো আর না বললেই নয় | তাই আজ বলতে বাধ্য হলাম |
---এখন আমি ভালো মেয়ে তোর জন্য কোথায় পাই বলতো ? দেখি ওখানে যেয়ে কথাটা পাড়ি | উনাদের সন্ধানে যদি কোনো ভালো মেয়ে থাকে |
স্বামী ,স্ত্রী দু'জনেপরামর্শ করে অজয়ের আশীর্বাদ হয়ে গেলে কথাটা পারলেন | সঙ্গে সঙ্গেই অমিতবাবু কথাটা লুফে নিলেন | তিনি বললেন ," আমার একটি কন্যা আছে ,প্রফেসারী করে | আমার মোবাইলে তার ছবিও আছে | দেখতে পারেন |" অমিতবাবুর মোবাইল সকলের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াতে লাগলো | শেষে বিজয়ের মা মোবাইলটা নিয়ে এসে ছবিটা বিজয়কে দেখতে বললেন | বিজয় ছবিটার দিকে না তাঁকিয়েই বললো ,"তোমরা যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি সেটাই মেনে নেবো |" অমিতবাবু তার গলার মোটা সোনার চেন দিয়ে বিজয়কে আশীর্বাদ করে গেলেন | কথা স্থির হলো ওই একই দিনে একই বাড়িতে দু'টি বিয়ের অনুষ্ঠানই হবে | নিবেদিতা বাবার এই সিদ্ধান্তকে হাসি মুখে মেনে নিলো | মা একটু অসন্তুষ্ট হলেও নিবেদিতাই মাকে বুঝালো ,"বাবা কখনোই আমার খারাপ চাইতে পারেন না | তিনি নিশ্চয় বুঝেছেন ছেলে ভালো এবং আমি সেখানে সুখী হবো |"
---তুই আজকের যুগের মেয়ে হয়েও বিয়ের আগে ছেলেটিকে একটু দেখবি না ? ---বাবার প্রতি সে বিশ্বাস আমার আছে | আর কি করবো আমি তাকে দেখে ? আমার পছন্দ না হলেও বাবার মুখের উপর আমি না বলতে পারবো না | বাবা যেটা ভালো বুঝেছেন ,সেটাই করেছেন | তুমি মন খারাপ করোনা | তোমার মেয়ে সুখিই হবে | বিয়ের দিন দেখতে দেখতেই এসে গেলো | একই বাড়িতে দুটি বিয়ে | সুতরাং লোকসমাগমও একটু বেশী | শুভ দৃষ্টির সময়ে নিবেদিতা বিজয়ের মুখের দিকে যখন তাঁকালো তখন মনে মনে ভাবলো ,বাবা তো তার জন্য রাজপুত্র ঠিক করে গেছেন | কিন্তু ছেলেটিকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন ? মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি | কিছুতেই মনে পড়ছে না | কারণে অকারণে সে বিজয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে অনেকবার মনে করবার চেষ্টা করেছে | কিন্তু মনে করতে পারেনি | ফুলশয্যার রাতে সকলে বেড়িয়ে যাওয়ার পর বিজয় এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ কোরে খাঁটের উপর যেয়েপা ঝুলিয়ে চুপ করে বসে থাকলো | নিবেদিতায় প্রথম কথা বলে ,
--- মুখটা এত চেনা ,চেনা লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছি না -
---বিজয় হেসে দিয়ে বলে ,মনে রাখবার মত কোনোদিন তোমার জীবনে কোনো রেখাপাত তো আমি করতে পারিনি ; আমার জীবনে প্রথম ভালবাসা তুমি ,স্বপ্নেও ভাবিনি সেটাই ঘুরে ফিরে শেষ ভালোবাসা হয়ে আসবে | একমাত্র তোমাকেই আমি আমার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম | কিন্তু ভাগ্য দেখো ,সেই আমাকেই তুমি তোমার বাবার পছন্দ করা পাত্র হিসাবে চোখ বন্ধ নয় ,চোখ খুলেই মালা পড়ালে |
নিবেদিতার আর বুঝতে বাকি থাকলো না , কার সাথে সে জীবনের গাঁটছড়া বেঁধেছে |
--- আমি চিনতেই পারিনি | আসলে সেই তুমি আর আজকের তুমির মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ ! তখনকার তুমি ছিলে -রোগা ,চ্যাংড়া আর এখন .........
নিবেদিতা চুপ করে গেলো , " কি হলো ? বললে না তো ,এখন কি ?
নিবেদিতা সলজ্জ হেসে বলল ," এখন তুমি অনেক সুন্দর !"
---আমার ভালোবাসা ছিল নিষ্পাপ ,তোমায় আমি খুব ভালোবেসেছিলাম হয়তো ওই বয়সে প্রথম ভালোবাসা এরূপই হয় | তুমি আমায় প্রত্যাখান করেছিলে ,কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করো - তোমার বাবার প্রতি তোমার ভালোবাসা ,শ্রদ্ধা দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম ।তোমাকে জীবনসাথী হিসাবে পাওয়া ,পুরোটাই কাকতালীয় | এজন্য তোমার বাবার কাছে আমি চিরঋণী |
---আমি জ্ঞান হওয়া থেকে বাবাকে কখনো কোনো অন্যায় করতে দেখিনি | কারও কাছে কথা দিয়ে কথা রাখেননি - এমনটা কখনোই হয়নি | ভীষণ এক কথার মানুষ । তাই যাতে কষ্ট না পাই নিজের মনের দুর্বলতাগুলোকে কোনোদিন প্রশ্রয় দিইনি | আজ বলতে কোনো লজ্জা নেই ; কলেজে থাকাকালীন সময়ে তোমার প্রতি যে আমার দুর্বলতা গ্রো করেছিলোনা ,তা কিন্তু নয় | কিন্তু আমি সেই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতে পারিনি আমার বাবার কথা ভেবে | নিজে যেমন কষ্ট পেতে চাইনি ,বাবাকেও কষ্ট দিতে চাইনি ; তাই শুরুতেই সব শেষ করে দিয়েছিলাম | কিন্তু কি অদ্ভুত দেখো বাবা কিন্তু সেই তোমাকেই আমার সামনে এনে দাঁড় করলেন |
---আর তুমি বিনা বাক্যে চোখ দু'টি খুলেই আমাকে মালা পরিয়ে দিলে | একেই বলে ভাগ্য !
এবার বিজয় এগিয়ে যেয়ে নিবেদিতার দু'টি হাত ধরে বলল , " আজ আমি খুব খুশি ,ভীষণ সুখী - জীবনে যাকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম ,তাকেই পেয়েছি | নিবেদিতা আস্তে আস্তে বিজয়ের বুকে মাথা রাখে |
~~~~~~~~~~~~~~শেষ ~~~~~~~~~~~~~~
নন্দা 25.11.16