কেউ পায় কেউ পায়না
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
সানাইয়ের সুর একটু আগেই থেমে গেছে। লাল বেনারসী, কপালে চন্দনের কারুকার্য শোভিত কলকে দেওয়া, এক গা ভর্তি গয়না পরে সেই সন্ধ্যা থেকে কনে সেজে জয়ীতা অপেক্ষা করে আছে কখন অরূপ আসবে।এখন রাত এগারোটা।এখনো অরূপের দেখা নেই! লগ্ন চলে গেছে অনেক আগেই। লগ্নভ্রষ্টা মেয়েকে কেউ বিয়েও করবেনা। আর তাছাড়া যা অরূপ ছাড়া আর কেউই জানেনা সে যে অরূপের সন্তানের মা হতে চলেছে! তাই দু'মাসের মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে এই বিয়ের আয়োজন। কিনতু অরূপ তো সবই জানতো তাহলে ও এরকম করলো কেন? কোন খারাপ কিছু ঘটেনিতো!ভালো আছে তো অরূপ? যদি ভালোই থাকে তাহলে এভাবে ঠকালো কেন?না, আর ভাবতে পারছেনা জয়ীতা! যা করার এক্ষুনিই করতে হবে। একটু আগেও বাড়ি ভর্তি লোক গমগম করছিলো।এখন পুরোই ফাঁকা। গয়নাগুলো একটি একটি করে খুলে খাটের উপর রাখলো জয়ীতা। বাবা, মা অনেক কষ্ট করে অভাবের সংসারে এগুলি তৈরি করেছিলেন। জীবনটাই যখন রাখবেনা তখন এগুলি সাথে নিয়ে যাওয়ারও কোন অর্থ হয়না।
বাড়ির পিছনের দরজা খুলে জয়ীতা বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। মফস্বল শহর। এতো রাতে রাস্তায় লোকজনও নেই। এ মুখ আর বাবা মাকে সে দেখাবেনা।তারা যখন জানতে পারবেন যে সে মা হতে চলেছে তারা দু'জনেই তো এই চরম পথ বেছে নেবেন।না -তা কিছুতেই হতে পারেনা!আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো সে একটা ঝিলের কাছে। ঝিলটা ভীষন বড় আর গভীর। একসময় এখান থেকেই মাটি তুলে ইটভাটার কাজ চলতো। এখন ইটভাটাটা নেই কিনতু ইটভাটার স্বাক্ষী হিসাবে ঝিলটা পরে আছে।
না, সেদিন জলে ডুবে আর মরতে পারেনি জয়ীতা। দেবদূতের মত পিছন থেকে কেউ একজন ঝাঁপটে ধরেছিলেন। বাইরের সকল লোকের কাছে জয়ীতা ও সাইকিয়াটিস্ট ডক্টর অশোক রায় স্বামী, স্ত্রী আর মানসিক দিক থেকে তারা একে অপরের বন্ধু। পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে তাদের দু'জনের জীবনের চেপে রাখা সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। সে অবশ্য ডক্টর রায়কে বাবা বলেই জানে।
ডক্টর রায়ের জীবনটাও একটি এ্যাকসিডেন্টের পর সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়। বাবা, মায়ের সাথে নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছিলেন। ব্রেক ফেল করে গাড়িটি এ্যাকসিডেন্ট করে। ঘটনাস্থলেই ডক্টর রায়ের মা ও বাবা দুজনেই মারা যান আর মরতে মরতে বেঁচে যান ডক্টর রায়।কিনতু সুন্দর পৃথিবীর অনেককিছুই থেকে তিনি বঞ্চিত হন। ডক্টর তাকে জানিয়ে দেন তিনি কোনদিন বাবা হতে পারবেননা!
জয়ীতাকে সেদিন অনেক বুঝিয়ে তিনি নিজের বাড়ি কলকাতা টালিগঞ্জে এনে তোলেন। টালিগঞ্জ চত্বরে নামকরা নার্সিংহোম 'মানবী'র মালিক ডক্টর অশোক রায়। বছর চারেক ধরে পরিচয়হীন মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক তার হেফাজতে চিকিৎসাধীন। আজকের দিনে যেখানে নার্সিংহোমগুলি অসৎ পথে টাকা রোজগারের ধান্ধায় মৃত মানুষকেও ভেন্টিলেশনে রেখে অর্থ উপার্জন করছে;সেখানে ডক্টর রায় রাস্তাঘাট থেকে অসুস্হ্য মানুষকে তুলে এনেও বছরের পর বছর বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে যাচ্ছেন।
যে যুবকটিকে তিনি গত চার বছর ধরে চিকিৎসা করে চলেছেন;তার নামটি পর্যন্ত সে বলতে পারেনি।হাসপাতালে তার নাম সাতাশ নম্বর বেডের পেসেন্ট।প্রতিবছর নার্সিংহোমের প্রতিষ্টা দিবসে ডক্টর অশোক প্রত্যেক রোগীকে নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করেন! এবার তিনি জয়ীতা ও ছেলে অর্পণকেও সাথে নিয়ে আসেন।
জয়ীতা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সাতাশ নম্বর বেডে একমাথা ঝাঁকড়া চুল নিয়ে বসে আছে অরূপ।হাত বাড়িয়ে জয়ীতার হাত থেকে খাবারের প্যাকেট নেয়, একটু মুখের দিকে তাকায় পরক্ষণে চোখ নামিয়ে প্যাকেটটা খোলার বৃথা চেষ্টা করতে লাগে।জয়ীতা একদৃস্টিতে তাকিয়ে থাকে অরূপের দিকে।ছোট্ট অর্পণ এগিয়ে যায় অরূপের কাছে।তার গায়ে হাত দিয়ে ডাকে, "আঙ্কেল, তুমি প্যাকেট খুলতে পারছোনা?" চারবছর পর ডক্টর নার্সদের অবাক করে দিয়ে অরূপ বলে ওঠে,"তুমি খুলে দেবে আমার প্যাকেট? "
বাড়িতে ফিরে জয়ীতা সবকিছুই ডক্টর রায়কে জানায়।তিনি চুপ করে সব শুনে শুধু বলেন,"আমার সমস্ত রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও অরূপকে সুস্থ্য করে তুলবো। "
এরপরেই ডক্টর রায় মাঝে মাঝেই অর্পণকে সাথে নিয়ে যেতেন অরূপের চিকিৎসার ওষুধ হিসাবে।বেশ কয়েকদিনের মধ্যে তিনি তার ফলও পান। অরূপ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই তার ছুটি হওয়ার মতই সে সুস্থ্য হয়ে ওঠে।
ডক্টর রায় অনেক ভেবে অরূপকে জয়ীতা সম্পর্কে সব জানান এবং এও বলেন যে জয়ীতা আজও তারই আছে।সে জয়ীতা ও অর্পণকে নিয়ে নূতন করে জীবন শুরু করুক। কথাগুলি বলতে হয়তো তার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল কিনতু সত্য ও ন্যায় ধর্মের পূজারী ডক্টর রায়ের কাছে এ ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিলোনা।
জয়ীতা ও অর্পণকে পরদিন হাসপাতালে নিয়ে আসেন ডক্টর অশোক রায়।কিনতু তিনি তার উর্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জয়ীতাকে জানাননা।নিজের চেম্বারে ওদের নিয়ে বসে তিনি সিস্টারকে বলেন, সাতাশ নম্বর বেডের পেসেন্টকে ডেকে আনতে।সিস্টার এসে জানান তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা , তিনি একটা চিঠি ডক্টর রায়ের হাতে ধরিয়ে দেন।উপরে ডক্টর রায়ের নাম লেখা দেখে তিনি চিঠিটা খুলে দেখেন জয়ীতাকেই উর্দেশ্য করে সেটি লেখা।তিনি জয়ীতার হাতে খামটি তুলে দেন।
চিঠিতে অরূপ জয়ীতাকে জানায়, পাঁচ বছর আগে বিয়ের দিনে তিন বন্ধু সমেত গাড়িতে করে আসবার সময় ব্রীজের উপরে একটা বড়লড়ির সাথে ধাক্কা লেগে গাড়িটা ব্রীজের নীচে পরে যায়। তারপর তার আর কিছুই মনে নেই।এখন সে বুঝতে পারছে এই পাঁচ বছর তার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিলো।ডক্টর রায় যেভাবে তাকে দেবতার মত সারিয়ে তুলেছেন ঠিক সেই একইভাবে জয়ীতা ও তার সন্তান অর্পণকে বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়া হয়ে আগলে রেখেছেন।সে কিছুতেই পারবেনা দেবতার কাছ থেকে তাদের আলাদা করতে!তবে একবার জয়ীতাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু তাকে দেখে সে যদি দুর্বল হয়ে পরে তাই সেই লোভ সে সংবরণ করেই চলে যাচ্ছে।অর্পণ যে তারই ছেলে তা ডক্টর রায় না বললে সে জানত না।এহেন মানুষকে সে কিছুতেই দুঃখ দিতে পারবেনা।
জয়ীতা চিঠিটা পড়া শেষ করে ডক্টর রায়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। ডক্টর রায় সেটি পড়া শেষ করে জয়ীতার মাথায় একটি হাত রেখে বলেন, "ভেবোনা আমি ঠিক ওকে খুঁজে আনবো"।জয়ীতা এই প্রথম ডক্টর রায়ের কোমড় দু'টি জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে।
No comments:
Post a Comment