চুপ
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ভোরের বেলা কাক না ডাকতেই শুরু হোল রাস্তার মাঝে হৈ,চৈ, ।বাস রাস্তার উপরেই আমাদের বাড়ি।দোতলার ব্যালকনি দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম নীচের একটি চায়ের দোকান ঘিরে জটলা।দোকানের সাথে বাঁশের বেড়া দেওয়া একটি ঘর ছিলো;এখন সেটা ভেঙ্গেচুরে গেছে। মাস ছ'য়েক আগেও ওখানে ছিলো আনিসের থাকার আস্তানা। খুব ভালো ছেলে আনিস। সারাদিন চায়ের দোকানে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অন্য দোকান থেকে কিনে আনা রুটি, তরকারি খেয়ে রাত এগারো সাড়ে এগারোটাই কবিতা লিখতে বসে। ছেলেবেলা থেকেই এই কবিতা লেখা তার একটা নেশা। গ্রামের ছেলে, দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছে। বাবা লোকমান রহমান গ্রামের সামান্য এক ভ্যানচালক। সামান্য রোজগার;অর্থাভাবে ছেলের পড়াশুনা বন্ধ। মা সাহেলা খাতুনের খুব ইচ্ছা ছিল ছেলেকে পড়াশুনা শিখিয়ে মানুষ করা।সম্ভব হয়নি! বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দারিদ্রতা! আনিসকে বাধ্য হতে হয়েছে পেটের দায়ে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে কলকাতা এসে চায়ের দোকানে কাজ নিতে। মাস গেলে সামান্য যা হাতে পায় সাপ্তাহিক দোকান বন্ধের কোন একদিন গ্রামের বাড়িতে যেয়ে মায়ের হাতে টাকাক'টি দিয়ে পরদিন খুব ভোরের ট্রেন ধরে আবার কলকাতায় তার নিজের কাজের জায়গায় ফেরা। খুব সুন্দর কবিতা লিখতো আনিস।হাতের লেখাটাও ছিল ঠিক যেন ছাপার অক্ষরের মত। আনিস আমারই সমবয়সী। আমি মাঝে মাঝে দোকানে চা খেতে গেলে অনেক গল্প হত ওর সাথে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার সাথে কথা বলতো। একদিন আনিস আমাকে বলে,"দাবাবু, আজ দোকান বন্ধ হওয়া অবধি তুমি একটু বসোনা"। "কেনোরে?" "দোকান বন্ধ করে তোমায় আমি আজ আমার ঘরে নিয়ে যাবো। তোমায় একটা জিনিস দেখাবো।"
মায়ের ডাকে পিছন ফিরি। হন্তদন্ত হয়ে মা বলেন,"জানিস সোনা আনিস সুইসাইড করেছে!" আমি আকাশ থেকে পড়ি!
---কিনতু সেতো অনেকদিন এখান থেকে চলে গেছে।
---জানি তো! কিনতু সবাই বলছে ওই ভাঙ্গাচোরা বেড়ার ঘরেই আনিসের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
---কি করে সম্ভব এটা?
মা চিৎকার করে বললেন,"তুই নীচুতে নেমে একটু দেখনা!
মার কথা শুনে উদভ্রান্তের মত ছুটে ঘরে ঢুকে আলনা দিয়ে একটা জামা টেনে নিয়ে দু'তিনটি করে সিঁড়ি লাফ দিয়ে দিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে দৌঁড়াতে লাগলাম। মা পিছন থেকে চিৎকার করতে লাগলেন,"আস্তে যা বাবা, সাবধানে নাম।"কথাগুলি কানে আসলেও মাথায় ঢুকলো না।
না-মা যা বলেছেন সেটাই ঠিক। আনিস বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে! কেউই বুঝতে পারছেনা কেন? যে ছেলেটা ছ'মাস আগে এখান থেকে চলে গেছে সে সেই গ্রাম থেকে এসে এখানে সুইসাইড করলো কেন? বিষয়টি নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলতেই লাগলো। কিনতু যেহেতু চায়ের দোকানের এক সামান্য কর্মচারীর মৃত্যু আর লাশেরও কোন দাবিদার নেই তাই এ নিয়ে কারও কোনই মাথাব্যথা ছিলোনা!পুলিশ বডি পোষ্টমর্টেম করতে পাঠিয়ে দিলো তারাই যা করার করলো।
(2)
পরদিন সকালবেলা মা একটা চিঠি নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন।আমারই নাম লেখা খামের উপর। সাধারনত বাবার নামেই চিঠি আসে বাড়িতে। এই প্রথম আমার নামে কোন চিঠি এলো। একটু অবাকই হয়ে গেছিলাম চিঠিটি মা এনে দিলে। স্কুল ড্রেস পড়ছিলাম তখন। চিঠিটা হাতে নিয়ে নাড়িয়ে চারিয়ে বুঝলাম বাইপোষ্টে চিঠিটা আসেনি। কেউ লেটার বক্সে চিঠিটা ফেলে দিয়ে গেছে। মুক্তোর মত ঝকঝকে হাতের লেখা। ছিড়ে ফেললাম খামটি। সম্ভোধনটা দেখেই চমকে উঠলাম! 'দাবাবু'-আনিস তো এই নামেই আমায় ডাকতো!চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার গলাটা চেপে ধরেছে। স্কুল টাইটা হাত দিয়ে খুলে ফেললাম। প্রচন্ডভাবে ঘামছি। খাটটার উপর ধপাস করে বসে পড়লাম।আমার স্কুল বেরোনোর দেরী দেখে মা ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে চিৎকার করে বাবাকে ডাকলেন। বাবা এসে কি হয়েছে আমার কাছে জানতে চাইলে আমি আনিসের চিঠিটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিলাম।
(3)
কেটে গেছে এর পর চার বছর।গাম্য সরল কিশোর আনিসের কথা কেউ মনেও রাখেনি!কিনতু আমি আজও তাকে ভুলতে পারিনি।মাঝে মাঝে একা হলেই মনে পড়ে তার কথা তার লেখা কবিতার কথা। সুন্দর একটা প্রতিভা অকালেই হারিয়ে গেলো ভেবে মনের ভিতর চাপা একটা কষ্ট মাঝে মাঝেই অনুভূত হয়।চায়ের দোকানটা আজও আছে সেখানে এ কয়েক বছরে অনেক ছেলেই কাজে এসছে কিনতু আনিসের মত অত সুন্দর ব্যবহার কারোই না।আনিস চলে যাওয়ার পর থেকে ওই দোকানে আর চা খেতে যাইনি।
কবিতা গল্প পড়ার নেশা আমার ছেলেবেলা থেকেই। এখন নূতন নূতন কত কবি লেখকেরা কেউ কেউ খুব সুন্দর লেখেন।ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকের লেখায় পড়ি। কিছু কিছু বেশ ভালোই লাগে। এখনও হায়ারস্টাডি শেষ হয়নি।সুতরাং নিজস্ব কোন রোজগারও নেই।বাবার কাছ থেকেই টাকা চেয়ে আমার এই বই কিনে পড়ার শখ মেটানো।এবার সাহিত্যে একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন কবি অমল চৌধুরী।বেশ কয়েকদিন অনেক সংবাদ পত্রিকায় ও টিভির নানান চ্যানেলে ভদ্রলোককে দেখা গেছে সম্বধনার বন্যায় ভাসছেন! চোখে দামী ফ্রেমের চশমা দেখলে মনেহয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেননা।তার জীবনে প্রথম প্রকাশিত বই এইটি।আর প্রথম প্রকাশিত বইটিতেই একাডেমী পুরস্কার!
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে পড়ার বই এর দিকে আর না এগিয়ে কবিতার বইটি নিয়ে বসলাম।বইটি যেন আমাকে চুম্বকের মত টানছে। প্রথম দু'টি কবিতা পড়ে মন খুশিতে নেচে উঠলো। কি সুন্দর লেখা!খেটে খাওয়া মানুষের জীবন কি সুন্দরভাবে ছন্দের মাদকতায় ছবির মত তুলে ধরেছেন। তিন নম্বর কবিতাটা পড়তে যেয়েই থমকে গেলাম।এ কবিতা আমার আগের পড়া।তারপর যতই পাতা উল্টাচ্ছি বুঝতে পারছি সেদিন আনিসের লেখা ঠিঠির মমার্থ! বাবা, মাকে ঘুম থেকে ডেকে সব বললাম।
(4)
আনিস সেদিন যা চিঠিতে লিখেছিলো সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়;এক ভদ্রলোক সে যে দোকানে কাজ করতো সেখানে মাঝে মাঝে চা খেতে আসতেন। কোন কোনদিন অনেকক্ষন বসে গল্পও করতেন দোকানের মালিক আর আনিসের সাথে। ভদ্রলোক একটু আধটু সাহিত্যচর্চা করতেন। আনিস কথায় কথায় বলেছিলো যে সেও কবিতা লেখে। আনিসের লেখা কবিতার খাতা তিনি দেখতে চান।সরল কিশোর তার কবিতা লেখা খাতাটি অমলবাবুকে দেখতে দেয়। আনিসের লেখা কবিতা দেখে তিনি বুঝতে পারেন-'এ অমূল্য রতন'। তিনি আনিসকে তার কার্ড দিয়ে যান আর বলেন, আনিসের কবিতা তিনি নিজে টাকা খরচ করে ছাপাবেন।এর কিছুদিন পরে আনিস অমলবাবুর সাথে দেখা করে তার প্রানের চেয়েও প্রিয় কবিতার খাতাটি তার হাতে তুলে দিয়ে আসে।তিনি আনিসকে জানান বই বের করতে মাস চারেক সময় লাগবে। সে যেন চার মাস পরে এসে আবার দেখা করে।এরপরে আনিস বাড়িতে যায় মাসের টাকা দিতে মাকে।কিনতু বাড়িতে যেয়ে সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে।আনিসের বাবা পুকুরে স্নান করতে যেয়ে বিষধর সর্পের কামড়ে মারা যান।মাকে একা ফেলে আনিস বাড়ি থেকে আসতে পারেনা।কয়েক মাস পরে আনিস কলকাতায় এসে অমলবাবুর সাথে দেখা করতে যেয়ে দেখা পায়না।চায়ের দোকানে যেয়ে দেখে নূতন ছেলে নেওয়া হয়েছে।সে পুনরায় গ্রামে ফিরে যায়।
আনিসের মা ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ একদিন মারা যান। ডাক্তার জানান 'স্ট্রোক'!গ্রামের পাট চুকিয়ে সে কলকাতায় ফিরে আসে অন্য কোন কাজের আশায়। আর দু'চোখে স্বপ্ন নিয়ে তার কবিতার বই ছাপানো হবে।যেদিন সে সুইসাইড করে সেদিন তার অমল চৌধুরীর সাথে দেখা হয়।তিনি সম্পূর্ণই অস্বীকার করেন যে আনিস তাকে কোন কবিতার খাতা দেয়নি!ভীষন ভেঙ্গে পড়ে সে!কবিতাগুলো ছিলো তার প্রাণ।তাই সে বেঁচে থাকার অর্থটাই হারিয়ে ফেলে।তারপরই তার এই চরম সিদ্ধান্ত!
আমায় সে খুবই ভালোবাসতো। এত বড় শহরে আমি ছাড়া আর কাউকেই সে সেভাবে চিনতো না।তাই সমস্ত ঘটনা সে আমায় জানিয়ে রাতের আঁধারে চুপি চুপি এসে লেটার বক্সে চিঠিটা রেখে যায়। যে বেড়ার ঘরটায় সে থাকতো সেখানে পরে আর কেউই থাকতোনা।ওই ভাঙ্গা ঘরেই ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে তার সন্তানসম কবিতাগুলি হারানোর দুঃখ ভুলে থাকতে চেয়েছে আনিস!
হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। মা,বাবাকে যেয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম।সব শুনে বাবা আমায় বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে লাগলেন, "মানুষ বড় সার্থপর রে!নিজেকে উপরে তুলতে যে কোন রকম নোংরা কাজ সে করতে পারে।আগেকার দিনে গদির লোভে রাজাকে খুন করে আর একজন গদিতে বসতেন।আজও তার ব্যতিক্রম নয়।অর্থ, যশ, আর ক্ষমতার লোভে আজও মানুষ কত যে নীচুতে নামতে পারে আমরা সাধারণ মানুষ তা চিন্তাও করতে পারিনা। প্রতিবাদ করতে গেলেই হয় খুন হতে হবে নুতবা একপেশে হয়ে থাকতে হবে।তাই নিজেদেরকে বাঁচাতে অন্যায় দেখে সব বুঝেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হই ;বাঁচার তাগিদে।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী ।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ভোরের বেলা কাক না ডাকতেই শুরু হোল রাস্তার মাঝে হৈ,চৈ, ।বাস রাস্তার উপরেই আমাদের বাড়ি।দোতলার ব্যালকনি দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম নীচের একটি চায়ের দোকান ঘিরে জটলা।দোকানের সাথে বাঁশের বেড়া দেওয়া একটি ঘর ছিলো;এখন সেটা ভেঙ্গেচুরে গেছে। মাস ছ'য়েক আগেও ওখানে ছিলো আনিসের থাকার আস্তানা। খুব ভালো ছেলে আনিস। সারাদিন চায়ের দোকানে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অন্য দোকান থেকে কিনে আনা রুটি, তরকারি খেয়ে রাত এগারো সাড়ে এগারোটাই কবিতা লিখতে বসে। ছেলেবেলা থেকেই এই কবিতা লেখা তার একটা নেশা। গ্রামের ছেলে, দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছে। বাবা লোকমান রহমান গ্রামের সামান্য এক ভ্যানচালক। সামান্য রোজগার;অর্থাভাবে ছেলের পড়াশুনা বন্ধ। মা সাহেলা খাতুনের খুব ইচ্ছা ছিল ছেলেকে পড়াশুনা শিখিয়ে মানুষ করা।সম্ভব হয়নি! বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দারিদ্রতা! আনিসকে বাধ্য হতে হয়েছে পেটের দায়ে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে কলকাতা এসে চায়ের দোকানে কাজ নিতে। মাস গেলে সামান্য যা হাতে পায় সাপ্তাহিক দোকান বন্ধের কোন একদিন গ্রামের বাড়িতে যেয়ে মায়ের হাতে টাকাক'টি দিয়ে পরদিন খুব ভোরের ট্রেন ধরে আবার কলকাতায় তার নিজের কাজের জায়গায় ফেরা। খুব সুন্দর কবিতা লিখতো আনিস।হাতের লেখাটাও ছিল ঠিক যেন ছাপার অক্ষরের মত। আনিস আমারই সমবয়সী। আমি মাঝে মাঝে দোকানে চা খেতে গেলে অনেক গল্প হত ওর সাথে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার সাথে কথা বলতো। একদিন আনিস আমাকে বলে,"দাবাবু, আজ দোকান বন্ধ হওয়া অবধি তুমি একটু বসোনা"। "কেনোরে?" "দোকান বন্ধ করে তোমায় আমি আজ আমার ঘরে নিয়ে যাবো। তোমায় একটা জিনিস দেখাবো।"
মায়ের ডাকে পিছন ফিরি। হন্তদন্ত হয়ে মা বলেন,"জানিস সোনা আনিস সুইসাইড করেছে!" আমি আকাশ থেকে পড়ি!
---কিনতু সেতো অনেকদিন এখান থেকে চলে গেছে।
---জানি তো! কিনতু সবাই বলছে ওই ভাঙ্গাচোরা বেড়ার ঘরেই আনিসের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
---কি করে সম্ভব এটা?
মা চিৎকার করে বললেন,"তুই নীচুতে নেমে একটু দেখনা!
মার কথা শুনে উদভ্রান্তের মত ছুটে ঘরে ঢুকে আলনা দিয়ে একটা জামা টেনে নিয়ে দু'তিনটি করে সিঁড়ি লাফ দিয়ে দিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে দৌঁড়াতে লাগলাম। মা পিছন থেকে চিৎকার করতে লাগলেন,"আস্তে যা বাবা, সাবধানে নাম।"কথাগুলি কানে আসলেও মাথায় ঢুকলো না।
না-মা যা বলেছেন সেটাই ঠিক। আনিস বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে! কেউই বুঝতে পারছেনা কেন? যে ছেলেটা ছ'মাস আগে এখান থেকে চলে গেছে সে সেই গ্রাম থেকে এসে এখানে সুইসাইড করলো কেন? বিষয়টি নিয়ে চাপা গুঞ্জন চলতেই লাগলো। কিনতু যেহেতু চায়ের দোকানের এক সামান্য কর্মচারীর মৃত্যু আর লাশেরও কোন দাবিদার নেই তাই এ নিয়ে কারও কোনই মাথাব্যথা ছিলোনা!পুলিশ বডি পোষ্টমর্টেম করতে পাঠিয়ে দিলো তারাই যা করার করলো।
(2)
পরদিন সকালবেলা মা একটা চিঠি নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন।আমারই নাম লেখা খামের উপর। সাধারনত বাবার নামেই চিঠি আসে বাড়িতে। এই প্রথম আমার নামে কোন চিঠি এলো। একটু অবাকই হয়ে গেছিলাম চিঠিটি মা এনে দিলে। স্কুল ড্রেস পড়ছিলাম তখন। চিঠিটা হাতে নিয়ে নাড়িয়ে চারিয়ে বুঝলাম বাইপোষ্টে চিঠিটা আসেনি। কেউ লেটার বক্সে চিঠিটা ফেলে দিয়ে গেছে। মুক্তোর মত ঝকঝকে হাতের লেখা। ছিড়ে ফেললাম খামটি। সম্ভোধনটা দেখেই চমকে উঠলাম! 'দাবাবু'-আনিস তো এই নামেই আমায় ডাকতো!চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার গলাটা চেপে ধরেছে। স্কুল টাইটা হাত দিয়ে খুলে ফেললাম। প্রচন্ডভাবে ঘামছি। খাটটার উপর ধপাস করে বসে পড়লাম।আমার স্কুল বেরোনোর দেরী দেখে মা ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে চিৎকার করে বাবাকে ডাকলেন। বাবা এসে কি হয়েছে আমার কাছে জানতে চাইলে আমি আনিসের চিঠিটা বাবার হাতে ধরিয়ে দিলাম।
(3)
কেটে গেছে এর পর চার বছর।গাম্য সরল কিশোর আনিসের কথা কেউ মনেও রাখেনি!কিনতু আমি আজও তাকে ভুলতে পারিনি।মাঝে মাঝে একা হলেই মনে পড়ে তার কথা তার লেখা কবিতার কথা। সুন্দর একটা প্রতিভা অকালেই হারিয়ে গেলো ভেবে মনের ভিতর চাপা একটা কষ্ট মাঝে মাঝেই অনুভূত হয়।চায়ের দোকানটা আজও আছে সেখানে এ কয়েক বছরে অনেক ছেলেই কাজে এসছে কিনতু আনিসের মত অত সুন্দর ব্যবহার কারোই না।আনিস চলে যাওয়ার পর থেকে ওই দোকানে আর চা খেতে যাইনি।
কবিতা গল্প পড়ার নেশা আমার ছেলেবেলা থেকেই। এখন নূতন নূতন কত কবি লেখকেরা কেউ কেউ খুব সুন্দর লেখেন।ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকের লেখায় পড়ি। কিছু কিছু বেশ ভালোই লাগে। এখনও হায়ারস্টাডি শেষ হয়নি।সুতরাং নিজস্ব কোন রোজগারও নেই।বাবার কাছ থেকেই টাকা চেয়ে আমার এই বই কিনে পড়ার শখ মেটানো।এবার সাহিত্যে একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন কবি অমল চৌধুরী।বেশ কয়েকদিন অনেক সংবাদ পত্রিকায় ও টিভির নানান চ্যানেলে ভদ্রলোককে দেখা গেছে সম্বধনার বন্যায় ভাসছেন! চোখে দামী ফ্রেমের চশমা দেখলে মনেহয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেননা।তার জীবনে প্রথম প্রকাশিত বই এইটি।আর প্রথম প্রকাশিত বইটিতেই একাডেমী পুরস্কার!
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে পড়ার বই এর দিকে আর না এগিয়ে কবিতার বইটি নিয়ে বসলাম।বইটি যেন আমাকে চুম্বকের মত টানছে। প্রথম দু'টি কবিতা পড়ে মন খুশিতে নেচে উঠলো। কি সুন্দর লেখা!খেটে খাওয়া মানুষের জীবন কি সুন্দরভাবে ছন্দের মাদকতায় ছবির মত তুলে ধরেছেন। তিন নম্বর কবিতাটা পড়তে যেয়েই থমকে গেলাম।এ কবিতা আমার আগের পড়া।তারপর যতই পাতা উল্টাচ্ছি বুঝতে পারছি সেদিন আনিসের লেখা ঠিঠির মমার্থ! বাবা, মাকে ঘুম থেকে ডেকে সব বললাম।
(4)
আনিস সেদিন যা চিঠিতে লিখেছিলো সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়;এক ভদ্রলোক সে যে দোকানে কাজ করতো সেখানে মাঝে মাঝে চা খেতে আসতেন। কোন কোনদিন অনেকক্ষন বসে গল্পও করতেন দোকানের মালিক আর আনিসের সাথে। ভদ্রলোক একটু আধটু সাহিত্যচর্চা করতেন। আনিস কথায় কথায় বলেছিলো যে সেও কবিতা লেখে। আনিসের লেখা কবিতার খাতা তিনি দেখতে চান।সরল কিশোর তার কবিতা লেখা খাতাটি অমলবাবুকে দেখতে দেয়। আনিসের লেখা কবিতা দেখে তিনি বুঝতে পারেন-'এ অমূল্য রতন'। তিনি আনিসকে তার কার্ড দিয়ে যান আর বলেন, আনিসের কবিতা তিনি নিজে টাকা খরচ করে ছাপাবেন।এর কিছুদিন পরে আনিস অমলবাবুর সাথে দেখা করে তার প্রানের চেয়েও প্রিয় কবিতার খাতাটি তার হাতে তুলে দিয়ে আসে।তিনি আনিসকে জানান বই বের করতে মাস চারেক সময় লাগবে। সে যেন চার মাস পরে এসে আবার দেখা করে।এরপরে আনিস বাড়িতে যায় মাসের টাকা দিতে মাকে।কিনতু বাড়িতে যেয়ে সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে।আনিসের বাবা পুকুরে স্নান করতে যেয়ে বিষধর সর্পের কামড়ে মারা যান।মাকে একা ফেলে আনিস বাড়ি থেকে আসতে পারেনা।কয়েক মাস পরে আনিস কলকাতায় এসে অমলবাবুর সাথে দেখা করতে যেয়ে দেখা পায়না।চায়ের দোকানে যেয়ে দেখে নূতন ছেলে নেওয়া হয়েছে।সে পুনরায় গ্রামে ফিরে যায়।
আনিসের মা ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ একদিন মারা যান। ডাক্তার জানান 'স্ট্রোক'!গ্রামের পাট চুকিয়ে সে কলকাতায় ফিরে আসে অন্য কোন কাজের আশায়। আর দু'চোখে স্বপ্ন নিয়ে তার কবিতার বই ছাপানো হবে।যেদিন সে সুইসাইড করে সেদিন তার অমল চৌধুরীর সাথে দেখা হয়।তিনি সম্পূর্ণই অস্বীকার করেন যে আনিস তাকে কোন কবিতার খাতা দেয়নি!ভীষন ভেঙ্গে পড়ে সে!কবিতাগুলো ছিলো তার প্রাণ।তাই সে বেঁচে থাকার অর্থটাই হারিয়ে ফেলে।তারপরই তার এই চরম সিদ্ধান্ত!
আমায় সে খুবই ভালোবাসতো। এত বড় শহরে আমি ছাড়া আর কাউকেই সে সেভাবে চিনতো না।তাই সমস্ত ঘটনা সে আমায় জানিয়ে রাতের আঁধারে চুপি চুপি এসে লেটার বক্সে চিঠিটা রেখে যায়। যে বেড়ার ঘরটায় সে থাকতো সেখানে পরে আর কেউই থাকতোনা।ওই ভাঙ্গা ঘরেই ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে তার সন্তানসম কবিতাগুলি হারানোর দুঃখ ভুলে থাকতে চেয়েছে আনিস!
হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। মা,বাবাকে যেয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম।সব শুনে বাবা আমায় বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে লাগলেন, "মানুষ বড় সার্থপর রে!নিজেকে উপরে তুলতে যে কোন রকম নোংরা কাজ সে করতে পারে।আগেকার দিনে গদির লোভে রাজাকে খুন করে আর একজন গদিতে বসতেন।আজও তার ব্যতিক্রম নয়।অর্থ, যশ, আর ক্ষমতার লোভে আজও মানুষ কত যে নীচুতে নামতে পারে আমরা সাধারণ মানুষ তা চিন্তাও করতে পারিনা। প্রতিবাদ করতে গেলেই হয় খুন হতে হবে নুতবা একপেশে হয়ে থাকতে হবে।তাই নিজেদেরকে বাঁচাতে অন্যায় দেখে সব বুঝেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হই ;বাঁচার তাগিদে।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী ।
No comments:
Post a Comment