--- নিকিতার সাথে তোর রক্তের সম্পর্ক আছে ঠিকই কিন্তু কি প্রয়োজন ছিল তোর এইভাবে কিছুদিন নিজের পদমর্যাদা ভুলে তার আন্ডারে কাজ করার?
--- জানিনা মা, হঠাৎ করেই কেন জানিনা ওর পরিচয় জানার পর ভীষণভাবে ইচ্ছা করছিলো ওর সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। একেই মনেহয় রক্তের টান বলে।
কথাটা শুনে অতনুর মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।
মাকে নিয়ে অতনু গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলো।সে বহুবার মাকে বলেছিল তার সাথে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার কথ।কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি।অগত্যা তাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলে তার শ্বশুরমশাই আর কয়েকটা দিন ছুটি বারিয়ে পুজোটা কাটিয়ে যেতে বলেন।অতনু তাইই করে।বউ,ছেলে নিয়ে বেশ হৈ হৈ করে তার সময় কেটে যায় বেশ কিছুদিন।
আর এদিকে নিকিতা অতনু সাহার সব পরিচয় জোগাড় করে।প্রতি বছর সে পুজোর সময় ছুটি নিয়ে কলকাতা বাবা,মায়ের কাছে আসে।এবারও তার ব্যতিক্রম হয় না। ষষ্ঠীর দিনে আসা আর লক্ষী পুজোর পর যাওয়া।বছরে একবারই বাড়িতে আসে।যা ছুটি নেওয়ার ওই একবারেই নেয়। এবার লক্ষী পুজোর পরও মেয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে না দেখে ডিনার টেবিলে নিকিতার কাছে জানতে চাইলেন তার বাবা ,
--- হ্যারে তুই এবার কি একটু বেশিদিন ছুটি নিয়ে এসেছিস?
নিকিতা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
-- আচ্ছা বাবা, তুমি তো কোনদিনও তোমার গ্রামের গল্প, আমার ঠাকুমা,ঠাকুরদার গল্প করোনি? তারা কি কেউ বেঁচে নেই এখন ?
সুভাষবাবু খেতে খেতে খাওয়া বন্ধ করে হঠাৎ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
--- কি হল বাবা উত্তর দিলে না? তোমার মুখে তো কোনদিন পিলজঙ্গ নামটাও শুনিনি।
---তুই কি করে জানলি আমার গ্রামের বাড়ি পিলজঙ্গ?
--- আরো অনেককিছুই এখন জানি বাবা।
সুভাষবাবু কোন কথার উত্তর না দিয়ে খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেলেন। নিকিতার মা জানতে চাইলেন,
-- কি ব্যাপার বলতো? হঠাৎ তোর বাবার গ্রামের বাড়ি নিয়ে পড়লি কেন?
--- তোমার এসব না জানাই ভালো মা।এই বয়সে এসে তুমি কোন আঘাত পাও তা আমি চাই না।
--- মানেটা কি?
নিকিতা কোন উত্তর না দিয়ে বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে বললো,
-- মা, আমি কাল খুব ভোরে বেরিয়ে যাবো। ফোন করে জানিয়ে দেবো রাতে ফিরতে পারবো কিনা।অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
নিকিতার মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ততক্ষণ নিকিতা ডাইনিং ছেড়ে বাবার ঘরে ঢুকে বাবাকে বললো,
--- বাবা, কাল আমি তোমার গাড়িটা নিয়ে একটু বেরবো। কখন ফিরবো বলতে পাচ্ছি না। একটু পিলজঙ্গ গ্রামে যাবো। ভয় পেও না, আমি মাকে কোন কথা জানাবো না। পুরোপুরি সব কিছু বুঝতে না পারলেও এইটুকু অন্তত বুঝেছি আমার একটা দাদা আছে। তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই জানতে চাইছি না, ওখানে গিয়েই আমি সব জানবো অন্য কারো কাছে।গ্রামের নাম আর তোমার বাড়ির ঠিকানা একসময় জেনেছিলাম তোমার কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে। এই ঠিকানা আর তার পিতৃপরিচয় থেকে তার পরিচয় জানতে পেরেছি।
সুভাষবাবু যেন কথা বলতেই ভুলে গেছেন।আজ এত বছর পর তার অতীত তার মেয়ে সামনে আনবে তিনি ভাবতেই পারেননি।
ভোরবেলা নিকিতা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো পিলজঙ্গ গ্রামের উদ্দেশ্যে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিকিতা যখন তার শিকড় খুঁজে পেলো সেই বাড়িতে তালা বন্ধ।আশেপাশে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো বাড়ির ছেলে কয়েকটা দিন আগেই তার কর্মস্থলে ফিরে গেছে আর তার মা গ্রামের রায় চৌধুরীদের বাড়িতে।নিকিতা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে অতনুর মায়ের সাথে দেখা করে সব পরিচয় দেয়।অতনুর মা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন।নিকিতা তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়।তিনি জানান,
-- যেহেতু তুমি বললে তোমার মা জানেন না তাই আমিও এই বয়সে এসে কারো সুখের সংসারে কাঁটা হতে চাই না।আমার ভালোবাসা তার সাথে ছিলো আজীবন থাকবে। আমি আজও তাকে ঠিক সেই আগের মতই ভালোবাসি।আমি তোমার ডাকে সারা দেওয়া মানেই একটা সংসারে আগুন জ্বালানো। তা আমি কোনদিনও পারবো না।তুমি ফিরে যাও মা।আমার বিটু তোমার দাদা।ওর সাথে সম্পর্কটা রাখলে আমার জীবনের না পাওয়াগুলো পূর্ণতা পাবে।আমি মরে শান্তি পাবো এই ভেবে অন্তত আমার বিটুর রক্তের সম্পর্কের কেউ আছে।
ভদ্রমহিলা যখন কথাগুলি নিকিতাকে বলছেন সে শুধু অবাক হয়ে শুনছে।একজন নারীই পারে এতটা কষ্টসহিষ্ণু হতে।সে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে মাকে না জানিয়েই আজীবন সে তার দাদার সাথে সম্পর্ক রেখে চলবে।
সারা দুপুর সে তার বড়মার কাছ থেকে তার বাবার সমস্ত কথা শুনে সন্ধ্যায় এই মহীয়সী নারীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আগামীবার আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
শেষ