Saturday, July 30, 2022

মানুষ চেনা বড় দায় (দশম ও শেষ পর্ব)

 অতনু তার মাকে আলমারির ভিতর হতে সেই ছবি বের করা থেকে শুরু করে নিকিতার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা মায়ের কাছে ব্যক্ত করে।তার মা অবাক হয়ে শুধু শুনে যান। অতনুর কথা শেষ হলে জানতে চান,
--- নিকিতার সাথে তোর রক্তের সম্পর্ক আছে ঠিকই কিন্তু কি প্রয়োজন ছিল তোর এইভাবে কিছুদিন নিজের পদমর্যাদা ভুলে তার আন্ডারে কাজ করার?
--- জানিনা মা, হঠাৎ করেই কেন জানিনা ওর পরিচয় জানার পর ভীষণভাবে ইচ্ছা করছিলো ওর সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। একেই মনেহয় রক্তের টান বলে।
 কথাটা শুনে অতনুর মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।
  মাকে নিয়ে অতনু গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলো।সে বহুবার মাকে বলেছিল তার সাথে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার কথ।কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি।অগত্যা তাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলে তার শ্বশুরমশাই আর কয়েকটা দিন ছুটি বারিয়ে পুজোটা কাটিয়ে যেতে বলেন।অতনু তাইই করে।বউ,ছেলে নিয়ে বেশ হৈ হৈ করে তার সময় কেটে যায় বেশ কিছুদিন।
  আর এদিকে নিকিতা অতনু সাহার সব পরিচয় জোগাড় করে।প্রতি বছর সে পুজোর সময় ছুটি নিয়ে কলকাতা বাবা,মায়ের কাছে আসে।এবারও তার ব্যতিক্রম হয় না। ষষ্ঠীর দিনে আসা আর লক্ষী পুজোর পর যাওয়া।বছরে একবারই বাড়িতে আসে।যা ছুটি নেওয়ার ওই একবারেই নেয়। এবার লক্ষী পুজোর পরও মেয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে না দেখে ডিনার টেবিলে নিকিতার কাছে জানতে চাইলেন তার বাবা ,
--- হ্যারে তুই এবার কি একটু বেশিদিন ছুটি নিয়ে এসেছিস?
 নিকিতা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
-- আচ্ছা বাবা, তুমি তো কোনদিনও তোমার গ্রামের গল্প, আমার ঠাকুমা,ঠাকুরদার গল্প করোনি? তারা কি কেউ বেঁচে নেই এখন ?
সুভাষবাবু খেতে খেতে খাওয়া বন্ধ করে হঠাৎ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
--- কি হল বাবা উত্তর দিলে না? তোমার মুখে তো কোনদিন পিলজঙ্গ নামটাও শুনিনি।
---তুই কি করে জানলি আমার গ্রামের বাড়ি পিলজঙ্গ?
--- আরো অনেককিছুই এখন জানি বাবা।
 সুভাষবাবু কোন কথার উত্তর না দিয়ে খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেলেন। নিকিতার মা জানতে চাইলেন,
-- কি ব্যাপার বলতো? হঠাৎ তোর বাবার গ্রামের বাড়ি নিয়ে পড়লি কেন?
--- তোমার এসব না জানাই ভালো মা।এই বয়সে এসে তুমি কোন আঘাত পাও তা আমি চাই না।
--- মানেটা কি?
 নিকিতা কোন উত্তর না দিয়ে বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে বললো,
-- মা, আমি কাল খুব ভোরে বেরিয়ে যাবো। ফোন করে জানিয়ে দেবো রাতে ফিরতে পারবো কিনা।অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
 নিকিতার মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ততক্ষণ নিকিতা ডাইনিং ছেড়ে বাবার ঘরে ঢুকে বাবাকে বললো,
--- বাবা, কাল আমি তোমার গাড়িটা নিয়ে একটু বেরবো। কখন ফিরবো বলতে পাচ্ছি না। একটু পিলজঙ্গ গ্রামে যাবো। ভয় পেও না, আমি মাকে কোন কথা জানাবো না। পুরোপুরি সব কিছু বুঝতে না পারলেও এইটুকু অন্তত বুঝেছি আমার একটা দাদা আছে। তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই জানতে চাইছি না, ওখানে গিয়েই আমি সব জানবো অন্য কারো কাছে।গ্রামের নাম আর তোমার বাড়ির ঠিকানা একসময় জেনেছিলাম তোমার কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে। এই ঠিকানা আর তার পিতৃপরিচয় থেকে তার পরিচয় জানতে পেরেছি।
 সুভাষবাবু যেন কথা বলতেই ভুলে গেছেন।আজ এত বছর পর তার অতীত তার মেয়ে সামনে আনবে তিনি ভাবতেই পারেননি।
 ভোরবেলা নিকিতা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো পিলজঙ্গ গ্রামের উদ্দেশ্যে।

 অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিকিতা যখন তার শিকড় খুঁজে পেলো সেই বাড়িতে তালা বন্ধ।আশেপাশে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো বাড়ির ছেলে কয়েকটা দিন আগেই তার কর্মস্থলে ফিরে গেছে আর তার মা গ্রামের রায় চৌধুরীদের বাড়িতে।নিকিতা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে অতনুর মায়ের সাথে দেখা করে সব পরিচয় দেয়।অতনুর মা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন।নিকিতা তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়।তিনি জানান,
-- যেহেতু তুমি বললে তোমার মা জানেন না তাই আমিও এই বয়সে এসে কারো সুখের সংসারে কাঁটা হতে চাই না।আমার ভালোবাসা তার সাথে ছিলো আজীবন থাকবে। আমি আজও তাকে ঠিক সেই আগের মতই ভালোবাসি।আমি তোমার ডাকে সারা দেওয়া মানেই একটা সংসারে আগুন জ্বালানো। তা আমি কোনদিনও পারবো না।তুমি ফিরে যাও মা।আমার বিটু তোমার দাদা।ওর সাথে সম্পর্কটা রাখলে আমার জীবনের না পাওয়াগুলো পূর্ণতা পাবে।আমি মরে শান্তি পাবো এই ভেবে অন্তত আমার বিটুর রক্তের সম্পর্কের কেউ আছে।
  ভদ্রমহিলা যখন কথাগুলি নিকিতাকে বলছেন সে শুধু অবাক হয়ে শুনছে।একজন নারীই পারে এতটা কষ্টসহিষ্ণু হতে।সে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে মাকে না জানিয়েই আজীবন সে তার দাদার সাথে সম্পর্ক রেখে চলবে।
সারা দুপুর সে তার বড়মার কাছ থেকে তার বাবার সমস্ত কথা শুনে সন্ধ্যায় এই মহীয়সী নারীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আগামীবার আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

     শেষ



  





  

মানুষ চেনা বড় দায় ( নবম পর্ব)

 মায়ের অসুস্থ্যতার খবর পেয়ে হঠাৎ করেই অতনু গ্রামের বাড়িতে চলে যায়।বিয়ের পর বেশ কিছুদিন তার স্ত্রী তার সাথে থাকলেও পরে সেই যে বাচ্চা হতে সে বাপের বাড়িতে গেছে তারপর সে আর অতনুর কাছে ফিরে আসেনি।অতনু মাঝে মধ্যে তার শ্বশুরবাড়িতে যায়।আদরের দুলালী একাএকা তার সময় কাটে না তাই সে বাপের বাড়িতেই ছেলে নিয়ে থাকা সমীচীন মনে করেছে। অতনু বা তার মায়ের এতে কোনো আপত্তিও নেই; আর থাকলেই বা শুনছে কে? বুদ্ধিমত্তা আর কৃতজ্ঞতা বশত তারা এটাকে সানন্দেই মেনে নিয়েছেন।
  মায়ের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ দেখে সে মাকে কলকাতা নিয়ে আসতে চায়।রায় চৌধুরীবাবু তাকে সমর্থন করেন।একটা গাড়ি ভাড়া করে মাকে নিয়ে কলকাতার এক নামী নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে নিজে হোটেলে থাকতে শুরু করে। আস্তে আস্তে মায়ের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।একদিন ভিজিটিং আওয়ারে অতনুর মা অতনুকে বলেন,
--- ছেলেবেলায় বহুবার তুই তোর বাবার কথা জানতে চেয়েছিস তবে বড় হওয়ার পর কোনদিন আর বাবার কথা আমার কাছে বলিসনি। কিন্তু আমি কোনদিন তোকে তার সম্পর্কে কিছুই বলিনি। আজ আমি তোকে তার সম্মন্ধে কিছু জানাতে চাই।
--- আমি সব জানি মা।ঠাম্মা আমায় সব বলেছেন।কিন্তু তুমি কষ্ট পাবে বলে কোনদিন কিছু তোমায় বলিনি।তাকে আমি চিনি।তিনি কলকাতা শহরে কোথায় থাকেন? কি করতেন সব জানি।
  কথা বলতে বলতে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মায়ের দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,
-- আমি জানি তুমি আজও বাবাকে ভালোবাসো।জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময় তো কাটিয়েই ফেলেছো তবে কেন আজ এই চোখের জল ফেলছো?
-- একবার যদি তার সাথে দেখা হত শুধু একটা কথাই জানতে চাইতাম কি ছিলো আমার অপরাধ? তবে একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছি তুই তাকে কিভাবে চিনলি? তার বাড়ি, ঘরের ঠিকানা কিভাবে জানলি?

ক্রমশ 

প্রকৃত বন্ধু

   প্রকৃত বন্ধু   
 
  সদ্য বাবাকে হারানো আর হঠাৎ করেই স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশায় প্রথম অবস্থায় দোলন ভীষণভাবে মুষরে পড়ে। এত বড় সংসারের দায়িত্ব বিশেষত ভাইবোনগুলোকে কিভাবে একা তাদের জীবনে দাঁড় করাবে এই ভেবেই সে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিল না। যদিও মা বেঁচে আছেন কিন্তু তিনি সংসারটা সামলানো ছাড়া আর কিইবা করতে পারবেন? 
  বাবার মৃত্যুর পর সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে দোলনের উপর।দোলন এখন একটা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক।দীপকের সাথে বছর খানেক ধরে পরিচয়।দু'জন দু'জনকে ভালোবাসলেও কেউই মুখ ফুটে কাউকে বলেনি।
  ভালোবাসা যেখানে শুরুর থেকেই গভীর হয় হয়ত সেখানে সত্যিই মুখ ফুটে পরস্পরকে বলার প্রয়োজন হয় না।দোলনের মা, একবোন আর ছোট দুই ভাই। 
  দোলন ও দীপক যখন মনেমনে ভাবছে তারা এবার একই ছাদের তলায় সংসার গুছিয়ে নেবে ঠিক সেই মুহূর্তেই দোলনের পিতৃ বিয়োগ। পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো দোলনের উপর।বাবা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করলেও মাইনে ছিল ভালো। সুতরাং বেশ ভালোভাবেই তাদের সংসার চলে যেত। সঞ্চয় খুব বেশি না হলেও মোটামুটি। কিন্তু সঞ্চয় দিয়ে এতগুলো মানুষের শুধু তো খাওয়াপরাই নয় অসুখবিসুখ সর্বোপরি তিন তিনটে ছোট ছোট ভাইবোনদের পড়াশুনার খরচ।
  মায়ের সাথে পরামর্শ করে সঞ্চয়ে হাত না দিয়ে দোলন তার মাস মাইনের টাকাটা মায়ের হাতে দিয়ে কোনরকমে সংসার চালিয়ে নিয়ে যেতে বলে।দোলনের পাশে প্রকৃত বন্ধু হয়ে দাঁড়ায় দীপক।দীপকের সাথে এতদিন মিশেও দোলন জানতে পারেনি দীপকের মধ্যে বন্ধুত্বের এক সুন্দর রূপ লুকিয়ে আছে।এতদিন দীপককে কাছে পেয়েছে শুধু একজন প্রেমিক হিসেবে আর আজ দীপক তার কাছে সব চেয়ে কাছের এক বন্ধু।
  দীপকের সাথে একান্তে আলাপচারিতায় দীপক দোলনকে জানিয়েছে,
--- ভালোবেসে বিয়ে করে একই ছাদের তলায় থেকে সংসার করার নামই শুধু ভালোবাসা নয়।সুখে-দুখে, বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে থেকে সুখী হওয়া কিংবা সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ দু'জনে মিলে খুঁজে বের করার নামই ভালবাসা, আজীবন দু'টি মন এক হয়ে থাকার নাম ভালোবাসা।তার জন্য একই ছাদের তলায় থাকার কোন দরকারই পড়ে না। মেশমশাইয়ের অবর্তমানে তুমিই এই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার মত করেই সামলাবে। আজীবন আমি তোমার পাশে থাকবো। সব দায়িত্ব, কর্তব্য শেষ হওয়ার পর সকলে যখন যে যার জীবনে দাঁড়িয়ে যাবে তখন নাহয় ভেবে দেখা যাবে আমাদের মাথার উপরের ছাদটা এক হবে কিনা। 
  দীপক যখন এই কথাগুলি বলছে সে দু'হাত দিয়ে দোলনের হাত দু'টিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।দোলনের দু'চোখ বেয়ে নীরবেই অশ্রু পড়ে চলেছে।আজ যেন সে নূতন করে আবার দীপককে আবিষ্কার করলো।
  স্বামী, প্রেমিক, বন্ধু সকলেই পায়।কিন্তু সেই স্বামী কিংবা প্রেমিক অধিকাংশ নারীর কাছে বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না।একজন মানুষ আর একজন মানুষের কাছে যখন প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারে তাহলেই মনেহয় জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে যায়।
 
  

Wednesday, July 20, 2022

মানুষ চেনা বড় দায় (অষ্টম পর্ব)

 বেশ কিছুদিন ধরে নিকিতা অতনুকে আর অফিসে দেখতে পায় না।ভাবে হয়ত ছুটি নিয়েছে।কোন কারণ ছাড়াই লোকটির কথা বারবার কেন তার মনে পড়ছে নিজেও বুঝতে পারছে না।একটু ভালো পোষ্টে থাকার ফলে এদিকওদিক খবর নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সবাই যেন অতনু সাহা সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।
  অতনু ওরফে বিটু বেশ কয়েক বছরের মধ্যেই অফিসের বেশ উচ্চ পদে চলে যায়।নূতন নূতন ছেলেমেয়ে অফিসের নানান ব্রাঞ্চে নিয়োগ হতে থাকে, তাদের কোন ব্রাঞ্চে কখন ট্রান্সফার করতে হবে তা দেখা অতনুর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। 
  একদিন কাজ করতে করতে নিকিতা সাহার পরিচয় সে জানতে পারে যে কিনা তাদেরই অফিসের অন্য ব্রাঞ্চে আছে এবং বেশ ভালো পোষ্টেই আছে।বাবার নাম আর পুরনো ঠিকানা দেখেই সে বুঝতে পারে এ হচ্ছে তার কলেজ অধ্যাপক এস.এস. অর্থাৎ তার বাবা সুভাষ সাহার একমাত্র মেয়ে।
  কি জানি কেন তার মাথায় এ খেয়াল চাপলো।সে কিছু নতুন ছেলেমেয়ের সাথে মাত্র কয়েকটা দিন নিকিতার অফিসে এসে তার আন্ডারে চাকরি করতে চাইলো।
  নিকিতা রোজই খবর নেয় অতনু সাহা অফিসে এসেছে কিনা।কিন্তু হঠাৎ করেই যেন লোকটা অফিস থেকে সকলের অলক্ষ্যে উবে গেছে।এবার সে ঠিক করে ল্যাপটপ ঘেঁটে নতুন যোগদান করা ছেলেমেয়েদের নামের লিস্টটা তাকে বের করতেই হবে।
 লোকটা বয়সে বড়,দেখতেও খুব একটা ভালো নয় কিন্তু তবুও প্রথম দিন থেকেই লোকটার প্রতি অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করছে কেন এটাই নিকিতা বুঝতে পারছে না।

 ক্রমশ -

Thursday, July 14, 2022

ভাগ্যই জীবনের শেষ কথা বলে

ভাগ্যই জীবনে শেষ কথা বলে  

  নিজের জন্য কিছু একটা করা ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছিল।
  একাই বাবুঘাট গঙ্গার পাড়ে বসে এলোমেলো ভাবনার সাথে এই ভাবনাটাই নন্দিনীকে ভাবিয়ে যাচ্ছিল।তখনো সন্ধ্যা হয়নি।অস্তগামী সূর্যের লাল আভা গঙ্গার জলে পড়ে এক মনোরম শোভায় আকৃষ্ট হয়ে বেশ অনেকক্ষণ বসে ছিল নন্দিনী।আজকে আর ঘরে ফেরার কোন তাড়া নেই তার।অনেক কষ্টে গড়ে তোলা সংসারে তার দায়িত্ব আজ ফুরিয়েছে।এলোমেলো ভাবনারা আজ সত্যিই মনটাকে বারবার অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
  বাবা,মায়ের পছন্দ করা সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মানুষকে মেনে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির দরজায় পা রেখেই বুঝে গেছিলো এ বাড়িতে শ্বাশুড়ী মায়ের কথাই শেষ কথা।বাংলায় এম. এ. করা নন্দিনীর ভীষণ ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা করার।কিন্তু বাবার জেদের কাছে বর্ষতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল মায়ের এক কথাই,
--- তুই কি চাস নন্দা? এমনিতেই মানুষটার হাই ব্লাডপ্রেসার,সুগার।আর এই বিয়ে নিয়ে তুই যে তাল শুরু করেছিস তাতে মানুষটাকে তুই আরও অসুস্থ্য করে ছাড়বি। আরে চাকরি করতে হলে বিয়ের পড়ে করিস।এই মানুষটাকে শেষ বয়সে এসে একটু শান্তি দে।
 মায়ের এই স্বার্থপরের মত কথা শুনে দরজা বন্ধ করে আকুল হয়ে সারারাত কেঁদে সকালেই মাকে জানিয়ে দিয়েছে,
-- তোমরা যেখানে আমার বিয়ে দেবে আমি রাজি।
 স্বামী ভালো মনের মানুষ।নন্দিনীকে খুবই ভালোবাসে।কিন্তু মায়ের মুখের উপর একটা কথা বলার সাহস তার নেই।সেই ফুল শয্য্যার রাত থেকে একটি কথাই শুনে যাচ্ছে নন্দিনী, "একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও। মা আমায় অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন।মায়ের কথার অবাধ্য হয়ো না কখনো।"
 বিয়ের মাসখানেক পড়ে স্বামী বিমলেন্দুকে জানিয়েছিল নিজের মনের কথা। বিমলেন্দু তাকে বলেছিল,
-- চাকরি করবে এত খুব ভালো কথা, তবে মায়ের মতটা নিয়ে তবে এগিও।
 না,তিনি রাজি হননি। কিন্তু নন্দিনী তার এই ইচ্ছার মৃত্যুও ঘটাতে পারেনি। মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছাকে লালন করে চলেছে আজ অবধি। বাবা,মা জীবিত থাকাকালীন সময়ে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে দশবারও বাপেরবাড়িতে যেতে পারেনি অর্থাৎ শ্বাশুড়ী যেতে দেননি।এই দশ বছরের মধ্যেই সে বাবা,মা উভয়কেই হারিয়েছে। তাই এখন সেখানে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়েছে।
 ঘুমের মধ্যে হঠাৎ স্ট্রোকে স্বামীর যখন মৃত্যু হয় ছেলে তখন ডাক্তারি পড়ছে।শ্বাশুড়ির সামান্য পেনশনে সংসার চালাতে হয়েছে।তবুও তিনি নন্দিনীকে কিছু রোজগারের জন্য বাইরে বেরোতে দেননি।জমানো পুঁজি শেষ হয়েছে ছেলে রাহুলকে পড়াশুনা শেষ করাতে।
  শ্বাশুড়ী গত হয়েছেন বছর খানেক।ছেলে তার আগেই উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন পাড়ি দেয়।তারপর সেখানেই সেটেল্ড।এখন নন্দিনী সম্পূর্ণ একা।রাহুল প্রবাসী এক বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে করে মাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয় নূতন বাড়ি কিনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে জানিয়ে।বয়স এখন নন্দিনীর পঞ্চান্ন।এই বয়সে চাকরি পাওয়া অসম্ভব।কিন্তু নিজেকে খেয়েপরে তো বাঁচতে হবে।
 পেপারে অ্যাড দেখে একটা কোচিং সেন্টারে গেছিলো বাংলার শিক্ষক হিসাবে পড়ানোর দায়িত্বটা পাওয়ার আশায়।না,তারা তাকে নিরাশ করেননি।সেদিনই সে দশম শ্রেণীর একটি ক্লাস নেয় পরীক্ষা মূলক হিসাবে।তারা তাকে জানিয়েছেন দুদিনের মধ্যে ফোন করে জানাবেন।সেখান থেকেই হাঁটতে হাঁটতে এসে গঙ্গার পাড়ে বসে।
  নন্দিনী গঙ্গার পবিত্র জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে সেই সময় যদি বাপেরবাড়ি কিংবা শ্বাশুড়ীর কাছে চাকরির জন্য বাঁধাপ্রাপ্ত না হতে হত তাহলে আজ এই পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হত না।আসলে মানুষের মেধা আর ইচ্ছা থাকলেই হয় না তার সাথে সাথে ভাগ্যেরও দরকার আছে।ভাগ্যে না থাকলে মানুষের পাওয়া জিনিসও অনেক সময় হাত ফস্কে বেরিয়ে যায়।
 

Saturday, July 9, 2022

সময় মানুষকে বুঝতে শেখায়

সময় মানুষকে বুঝতে শেখায় 

  তিন বছর হল তিয়াসার বিয়ে হয়েছে।বাবা,মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে খুশি মনেই মেনে নিয়েছে।কলেজ লাইফে জয়কে পছন্দ করলেও কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি তিয়াসা।জয়ের নায়কোচিত চেহারা কলেজের সব মেয়েদের পছন্দের প্রথম কারণ ছিলো।সকলেই জয়কে দেখলে কেমন যেন হ্যাংলার মত ঘিরে ধরতো যা তিয়াসা কোনদিন পারেনি।জয়ের ভূত মাথার থেকে সেদিনই নেমেছে তিয়াসার যেদিন সে নিজ চোখে দেখেছে কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতর নিরিবিলি জায়গায় তিয়াসার ক্লাসমেট সুপর্ণাকে জয় জড়িয়ে ধরে কিস করেছে।
  কলেজ লাইফে এরপর শুধু জয় কেন অন্য কোন ছেলের দিকে তিয়াসা আর কোনদিন ফিরেও তাকায়নি।সাধারণ ভাবেই গ্র্যাজুয়েশনের পর বাড়িতে শুয়ে,বসে আর মাঝে মাঝে মাকে রান্না আর ঘরের কাজে সাহায্য করেই সময় কেটে যাচ্ছিল।বাবার রিটায়ারমেন্ট এর দিনে বাবার নির্দেশমত মাকে নিয়েই অফিসে উপস্থিত হয়েছিল।সেখানেই বাবার এক সহকর্মী তিয়াসাকে দেখে পছন্দ করেন তার একমাত্র ছেলের জন্য।
  কথাবার্তা এগোতে লাগে। তিয়াসা ও পলাশ পরস্পরকে চেনে,জানে। দু'জনেরই দু'জনকে ভালো লাগে।
  কিন্তু বিয়ের পর তিয়াসা দেখে, যে পলাশকে সে ছ'মাস ধরে চিনেছে,জেনেছে আর যে পলাশকে সে বিয়ে করেছে সে সম্পূর্ণ আলাদা।বিয়ের আগে ঘুরতে গিয়ে পলাশের যে কেয়ারিং মনোভাব সে দেখেছে বৌভাতের দু'দিন যেতে না যেতেই পলাশের সেই মনোভাব আর সে খুঁজে পায়নি।কিছুটা গায়ে পড়া হয়ে ছ'মাস আগে চেনা পলাশকে খুঁজতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
 প্রথম প্রথম বেশ কটাদিন তিয়াসার মন খারাপ করলেও পড়ে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।সংসারে মানুষ তো তিনজন।সকালে পলাশ অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তার শ্বশুরমশাইও বেরিয়ে যান।সারাটাদিন তিয়াসা একাই।ঘর গুছিয়ে,শুয়ে-বসে তার সময় কাটে।শ্বশুর আগেই ফেরেন অফিস থেকে।তিনি প্রতিদিনই ফেরার পথে কিছু না কিছু খাবার কিনে আনেন।এসেই বাচ্চাদের মত তার আদরের বৌমাকে প্যাকেটটা দিয়ে বলেন,
-- বৌমা,দু'কাপ চা করে আনো তাড়াতাড়ি। পুলু ফেরার আগেই এককাপ খেয়ে নিই ও আসলে আর এক কাপের সাথে তখন তিনজনে মিলে জমিয়ে টিফিন করবো।আমি বেশি চা খেলে ব্যাটা আজকাল বেশ চিল্লায়। 
 কথাটা বলেই হাসতে থাকেন।পলাশ বাড়িতে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বাবার আনা টিফিন খেতে খেতে বলে,
-- বাড়িতে এসে ক'কাপ চা খেলে? রোজ রোজ এত তেলে ভাজা এখন তোমার খাওয়া ঠিক নয় বাবা।
 একথা শুনে অনেক সময় তিয়াসা বলে উঠেছে,
-- সেকথা আমিও বাবাকে বারবার বলেছি।কিন্তু বাবা কথাই শোনেন না।টিফিনটা তো আমিই বানাতে পারি রোজ।
-- বানাতে পারি নয় এখন থেকে তুমিই বানিয়ে রাখবে।
    এইভাবেই চলতে থাকে দিন।বিয়ের পর থেকে পলাশ তিয়াসার ব্যাপারে যেমন উদাসীন ছিলো তার কোন পরিবর্তন হয় না।এরই মাঝে একদিন তিয়াসার শ্বশুর অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন তিয়াসার ভীষণ জ্বর।বাড়িতে ফিরেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ফোন করেন।পলাশ বাড়িতে ফিরে দেখে জ্বরে বেহুস তার স্ত্রী আর বাবা তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন।সে কোনরকমে হাত,মুখ ধুয়ে বাবাকে কিছুটা মুড়ি আর চা করে দিয়ে তিয়াসার কাছে গিয়ে বসে।আগেই তাকে জ্বরের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল।তখন ঘাম দিয়ে জ্বর কমছে। তিয়াসা উঠে বসার চেষ্টা করে।পলাশ তাকে বলে,
-- একদম না।যেমন শুয়ে আছ তেমন ভাবেই শুয়ে থেকো।আমি দু'টি ভাত ফুটিয়ে নিতে পারবো।
-- কিন্তু বাবা তো রাতে রুটি খান।
-- আজ ভাত খেয়ে নেবেন।তুমি আগে সুস্থ্য হও পরে এসব দেখবে।
 সেদিন রাতে যতবার তিয়াসার ঘুম ভেঙেছে সে অনুভব করেছে পলাশের একটা হাত ঘুমের মধ্যেও তার চুলে বিলি কেটে চলেছে। তিয়াসা একটু নড়লেই পলাশ উঠে বসে জানতে চেয়েছে,
-- শরীর খারাপ লাগছে?
 পরদিন শ্বশুর,স্বামী কেউ আর অফিস যায় না।সারাটা দিন বাপ,ছেলে কেউই তাকে বিছানা ছেড়ে নামতে দেয় না।মাথাটাও পলাশ ধরে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে ধুইয়ে নিয়ে আসে।খাবার টেবিলে ভাত গুছিয়ে ঘরে এসে তিয়াসাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসায়।
 তিয়াসা বুঝতে পারে পলাশকে সে যেমন দেখেছিল ঠিক তেমনই সে আছে।সেই তাকে বুঝতে ভুল করেছিল।আসলে মানুষ বিপদে না পড়লে কাছের মানুষগুলিকে ঠিক চিনতে পারে না।মানুষ বিপদে পড়লে কাছের মানুষগুলির ভালো - মন্দ উভয় দিকই জলের মত পরিস্কার হয়ে যায়। তবে এ কথাও মানতেই হবে একটি ছেলে যখন একটি মেয়ের সাথে প্রেম করে তখন পরস্পরকে কাছে পাওয়ার যে অদম্য ইচ্ছা কাজ করে, চার দেওয়ালের মধ্যে তাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে পেয়ে যাওয়ার পর সেই ইচ্ছেটা যখন পূরণ হয়ে যায় তখন কিছুটা হলেও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয়ে থাকে।আর এটাই বাস্তবতা। কারণ ভালোবাসাটা তখন সহবাসে পরিণত হয় আর দায়িত্ববোধটা ভীষণভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

#মানবী

 
    

Thursday, July 7, 2022

মুখোশ

 মুখোশ 
 মাধবী বছর খানেক হল ঘোষবাবুদের বাড়িতে কাজ করছে।ঘোষগিন্নী যতক্ষণ মাধবী কাজ করে ঠিক ততক্ষনই তার পিছনে খিটির খিটির করতে থাকেন।সেই প্রথম দিন থেকে মাধবী ঘোষগিন্নীর মুখে কোনদিন ভালো কথা শোনেনি।মাঝে মাঝে মাধবী ভাবে ঘোষগিন্নীর মা বোধকরি জন্মের সময় তার মুখে মধু দিতে ভুলে গেছিলেন।যতই শরীর খারাপ হোক না কেন মাধবীর এ বাড়িতে কাজে আসা বন্ধ করতে পারবে না।তাহলে ঘোষগিন্নীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।অবশ্য মাধবী চায়ও না ঘোষগিন্নীর বাড়ির কাজ কামাই করতে।স্বামী পরিত্যক্তা মাধবীর দুই সন্তান আর শ্বাশুড়ীকে নিয়ে সংসার।ঘোষবাবুদের বাড়িতে মাইনে ভালো।আর তাছাড়া দু'বেলা কাজে আসলেই টিফিনের জন্য সে যে খাবার ঘোষগিন্নীর কাজ থেকে পায় তা সে কোনদিনও একা খেয়ে পারে না।রোজই সে একটা প্লাস্টিকে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খায়।
   মাধবী কিছুতেই বুঝতে পারে না খিটখিটে ঘোষগিন্নী দু'বেলা তাকে এতটা করে খাবার দেন কেন?তিনি তো রোজই দেখছেন সে খাবার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।দিনকে দিন যেন খাবারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।এই তো সেদিন স্বামী,স্ত্রী দু'জনে মিলে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।বিকালে কাজে আসতে নিষেধ করেছিলেন।হঠাৎ রাত ন'টার দিকে ফোন।"বাড়িতে ফিরেছি কাজে আয়।" খুব রাগ হয়েছিল মাধবীর সেদিন।কিন্তু কিছুই করার নেই।যেতেই হবে।কাজটা যদি চলে যায় তাহলে খুব সমস্যায় পড়বে সে।
  মাধবীর আসতে প্রায় সাড়ে ন'টার মত বেজেছিল।এসে দেখে দু'জনে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছেন।দরজা ভেজানোই ছিল।মুখ গোমড়া করে ঘরে ঢুকেই মাধবী চলে যায় রান্না ঘরে।গিয়ে দেখে সিংকে শুধু চায়ের বাসনটাই পড়ে আছে।মনেমনে ভাবে এই কটা বাসনের জন্য এত রাতে ডেকে পাঠানোর কি দরকার ছিলো?বাসন ক'টা মেজে রেখে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন ঘোষগিন্নী বললেন,
-- এই শোন,এদিকে আয়।ওই যে দেখ টেবিলের উপর দুপ্যাকেট বিরিয়ানী আছে।প্যাকেট দু'টো নিয়ে যা।বাচ্চা দু'টোকে দিস নিজেরাও একটু করে খেয়ে নিস।
  মাধবীর চোখ দু'টো জলে ভরে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা যখন মুচছে ঘোষগিন্নী বলে উঠলেন সেই খ্যারখেরে গলায়,
-- সকাল সকাল আছিস কাজে।দেরি করে এসে আবার কোন অজুহাত দিস না।
  মাধবী মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু সত্যিই পরদিন বেলা দশটা বেজে গেলো মাধবীর পাত্তা নেই দেখে ঘোষগিন্নীর মাথায় আগুন চড়ে গেলো।বেশ কয়েকবার ফোন করলেন কিন্তু ফোন বেজে গেলো কেউ ধরলো না।আরো ক্ষেপে গিয়ে নিজেই একটা ছাতা মাথায় মাধবীর বস্তির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।এরূপ আগে কোনদিনও হয়নি যে ফোন করলে মাধবী ফোন ধরেনি।খুঁজে খুঁজে মাধবীর ঘরের কাছে গিয়ে বেশ রাগানিত্ব স্বরেই "মাধবী" বলে ডাক দিলেন।বছর সত্তরের এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে যা বললেন তা হল - কাল বাবুদের বাড়ি থেকে দূপ্যাকেট বিরিয়ানী দিয়েছিল।সবাই মিলেই ভাগ করে খেয়েছিল তারা।কিন্তু ভোর রাত থেকে বড় ছেলেটির পায়খানা,বমি শুরু হয়।ভোরের দিকে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে।সবাই মিলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে।
  এটুকু শুনে ঘোষগিন্নীর শরীরটা অস্থির অস্থির করতে লাগলো।বৃদ্ধা বলতে পারলেন না কোন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।পাশের একটি ঘর থেকে জেনে তিনি দ্রুত পায়ে বাড়িতে এসে স্বামীকে সব জানালেন।
  ছুটে গেলেন দুজনেই হাসপাতালে।কথা বললেন ডাক্তারদের সাথে।ভয়ের কোন কারণ নেই জেনে তবে নিশ্চিন্ত হলেন।
 দুজনে সেদিন আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খেয়েই ফিরছিলেন।বিকালের যেহেতু বাড়ি ছিলেন না তাই মাধবী এবং তার ছেলেমেয়ে দু'টির টিফিন যায়নি ঘরে ভেবেই দু'জনে ওই বিরিয়ানীর প্যাকেট দু'টি কিনে আনেন।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন নিঃসন্তান এই দম্পতি।
  চারদিন পর মাধবী কাজে ফিরেছে।সেই একই রূপ ঘোষগিন্নীর।এখন আর মাধবীর তার প্রতি কোন রাগ হয় না।রাগটা যে ঘোষগিন্নীর মুখোশ সেটা এখন মাধবী ভালোভাবেই বুঝে গেছে।

মানুষ চেনা বড় দায় (সপ্তম পর্ব)

  বিটু খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারে তাদের এই এস.এস. ই তার বাবা সুভাষ সাহা।এস.এস. ক্লাসে আসলেই বিটু কেমন যেন হয়ে যেত।এত মেধাবী ছেলে হওয়া স্বর্তেও এতটাই অন্য মনস্ক হয়ে পড়ত সে কোন পড়াই তার কর্ণগোচর হত না।দু'একদিন অন্যমস্কতার কারণে ভৎসনার স্বীকারও হয়েছে।কিন্তু বেশিদিন তাকে এই অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি।কলেজে ভর্তি হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যেই এস.এস. রিটায়ার করে যান।
  খোঁজ নিয়ে আগেই জানতে পেরেছিল তার একটি সৎবোন আছে।সে পড়াশুনায় খুবই ভালো।ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মধ্যে বিটু একবারই শুধু বাড়ি গেছিলো তার ঠাকুমা  অত্যন্ত অসুস্থ্য হয়ে তাকে দেখতে চাওয়ার কারণে।মৃত্যুর আগে ঠাকুমা তাকে জানিয়ে গেছিলেন রায় চৌধুরীবাবু তাদের জন্য যথেষ্ঠ করেছেন।ভবিষ্যতে তিনি কিছু বললে তার কথার যেন সে মান্যতা দেয়।বিটু তখন তার ঠাকুমাকে জানিয়ে দেয় যে সে তার বাবার দেখা পেয়েছে।সেকথা জেনে ঠাকুমা তাকে জানান,
-- তার ছেলের কথা জানার কোন ইচ্ছা তার নেই।সে যেন তার মাকে কোনদিন কষ্ট না দেয়।
  মৃত্যুর আগে ঠাকুমার দু'চোখ বেয়ে যে জলের ধারা নামে তাতেই বিটু বুঝে যায় ঠাকুমার চোখের এ জল তার একমাত্র সন্তানের জন্যই!
  কাজ মিটে যাওয়ার পর বিটু ফিরে আসে।দিনরাত এক করে পড়ার ফল সে হাতে হাতেই পায়, ব্যাঙ্গালোরে ভালো চাকরির অফার।মাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলে মা রাজি হন না।রায় চৌধুরীবাবু এবার তাদের মনের কথা জানান। বিটু দু'বছর সময় চেয়ে নেয়। 
  মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিটু অনেক সময় তার পদমর্যাদার কথা ভুলে শ্রমিকদের সাথে সাধারণ একজন শ্রমিক হিসাবেই কাজে হাত লাগিয়েছে।উপর মহলের চোখ রাঙানি তাকে এ কাজ থেকে বিরত করতে পারেনি।নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে তাদের ভালো টিফিনের ব্যবস্থাও করেছে।চাকরি পাওয়ার প্রথম মাস থেকেই মাকে মাইনের চার ভাগের তিনভাগ টাকা পাঠাতে তার কখনোই ভুল হয়নি।
  দু'বছর বাদে সে তার কথা রাখে রায় চৌধুরীবাবুর খোঁড়া মেয়েটিকে বিয়ে করে সসম্মানে সে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়।

 ক্রমশ 

অক্ষমতা

 সংসারে পড়ে রইলো তিনটে প্রাণী।একটি শিশু,একজন বয়স্কা আর পূর্ণ যৌবনা এক নারী।অথচ সংসারে উপার্জনক্ষম কোন মানুষ নেই।কামিনী পড়লো মহা ফ্যাসাদে।
 কামিনী গ্রামের অবস্থাপন্ন রায় চৌধুরীদের বাড়িতে গিয়ে তার দুঃখের কথা জানিয়ে ভীষণভাবে কান্নাকাটি করতে লাগলে রায় চৌধুরী গিন্নী তাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজে বহাল করেন।নামেই কাজ।গিন্নী মায়ের সাথে সাথে থাকা,ঘণ্টায় ঘণ্টায় পান সেজে দেওয়া আর টুকটাক এদিক-ওদিক কিছু সামান্য কাজ।বিনিময়ে যে টাকা এবং খাবার দিতেন তাকে তাতে তিনটে পেট ভালোভাবে না ভরলেও চলে যেত।প্রথম মাসটা একটু কষ্ট হলেও পরের মাস থেকে ঠিক চলে যাচ্ছিল।কামিনীর ছেলের পড়াশুনার ভালো মাথা দেখে রায় চৌধুরীবাবু নিজের থেকেই তার পড়াশুনার দায়িত্ব নেন।ছেলেবেলার থেকেই কামিনীর আদরের বিটু ভীষণ বুদ্ধিমান আর বোঝদার ছেলে।যে সুযোগ সে পেয়েছে জীবনে তার নির্যাস লাভ তাকে করতেই হবে এই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাবে সে দিনরাত এক করে পড়াশুনা শুরু করে। 
 গ্রামের স্কুল থেকে বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে সে মাধ্যমিক পাশ করার পর রায় চৌধুরীবাবুর চেষ্টায় কলকাতায় উচ্চমাধ্যমিকও বেশ ভালো রেজাল্ট করে।
 তখন বিটুর ক্লাস নাইন।ছেলেবেলা থেকেই মা ও ঠাকুমার আলোচনা থেকে বাবার সম্পর্কে সব জেনেই সে বড় হয়েছে।একদিন মায়ের অনুপস্থিতিতে মায়ের আলমারির ভিতর থেকে মায়ের অজান্তে টেনে বের করে আনে বাবা,মায়ের একটি ছবি।
  রায় চৌধুরীবাবুর একটি মাত্র কন্যা সন্তান।জন্ম থেকেই তার পায়ে সামান্য অসুবিধা থাকায় সে একটু খুঁড়িয়েই হাঁটে।গ্রামের স্কুল থেকেই সে মাধ্যমিক পাশ করার পর পড়াশুনা আর তার এগোয়নি।রায় চৌধুরী গিন্নী তাকে সংসারের কাজকর্মে পারদর্শী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিটুর প্রতি চৌধুরী পরিবারের দুর্বলতার আরও একটি কারণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রায় চৌধুরীবাবু বিটুর মধ্যে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখেছেন।যদি তিনি বিটুকে একটু সাহায্য করেন তাহলে ভবিষ্যতে বিটু যে জায়গায় দাঁড়াবে তাতে তার মেয়ে সুখীই থাকবে।
  বিটু তার মেধা শক্তির পরিচয় দিয়ে সরকারিভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুযোগ পায়।
  প্রথম দিন ক্লাসে বিটু যাকে ক্লাস নিতে দেখে তাতে সে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যায়।

  ক্রমশ -

মুখোশ

 মুখোশ (m)
 মাধবী বছর খানেক হল ঘোষবাবুদের বাড়িতে কাজ করছে।ঘোষগিন্নী যতক্ষণ মাধবী কাজ করে ঠিক ততক্ষনই তার পিছনে খিটির খিটির করতে থাকেন।সেই প্রথম দিন থেকে মাধবী ঘোষগিন্নীর মুখে কোনদিন ভালো কথা শোনেনি।মাঝে মাঝে মাধবী ভাবে ঘোষগিন্নীর মা বোধকরি জন্মের সময় তার মুখে মধু দিতে ভুলে গেছিলেন।যতই শরীর খারাপ হোক না কেন মাধবীর এ বাড়িতে কাজে আসা বন্ধ করতে পারবে না।তাহলে ঘোষগিন্নীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।অবশ্য মাধবী চায়ও না ঘোষগিন্নীর বাড়ির কাজ কামাই করতে।স্বামী পরিত্যক্তা মাধবীর দুই সন্তান আর শ্বাশুড়ীকে নিয়ে সংসার।ঘোষবাবুদের বাড়িতে মাইনে ভালো।আর তাছাড়া দু'বেলা কাজে আসলেই টিফিনের জন্য সে যে খাবার ঘোষগিন্নীর কাজ থেকে পায় তা সে কোনদিনও একা খেয়ে পারে না।রোজই সে একটা প্লাস্টিকে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খায়।
   মাধবী কিছুতেই বুঝতে পারে না খিটখিটে ঘোষগিন্নী দু'বেলা তাকে এতটা করে খাবার দেন কেন?তিনি তো রোজই দেখছেন সে খাবার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।দিনকে দিন যেন খাবারের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।এই তো সেদিন স্বামী,স্ত্রী দু'জনে মিলে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।বিকালে কাজে আসতে নিষেধ করেছিলেন।হঠাৎ রাত ন'টার দিকে ফোন।"বাড়িতে ফিরেছি কাজে আয়।" খুব রাগ হয়েছিল মাধবীর সেদিন।কিন্তু কিছুই করার নেই।যেতেই হবে।কাজটা যদি চলে যায় তাহলে খুব সমস্যায় পড়বে সে।
  মাধবীর আসতে প্রায় সাড়ে ন'টার মত বেজেছিল।এসে দেখে দু'জনে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে চা খাচ্ছেন।দরজা ভেজানোই ছিল।মুখ গোমড়া করে ঘরে ঢুকেই মাধবী চলে যায় রান্না ঘরে।গিয়ে দেখে সিংকে শুধু চায়ের বাসনটাই পড়ে আছে।মনেমনে ভাবে এই কটা বাসনের জন্য এত রাতে ডেকে পাঠানোর কি দরকার ছিলো?বাসন ক'টা মেজে রেখে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন ঘোষগিন্নী বললেন,
-- এই শোন,এদিকে আয়।ওই যে দেখ টেবিলের উপর দুপ্যাকেট বিরিয়ানী আছে।প্যাকেট দু'টো নিয়ে যা।বাচ্চা দু'টোকে দিস নিজেরাও একটু করে খেয়ে নিস।
  মাধবীর চোখ দু'টো জলে ভরে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা যখন মুচছে ঘোষগিন্নী বলে উঠলেন সেই খ্যারখেরে গলায়,
-- সকাল সকাল আছিস কাজে।দেরি করে এসে আবার কোন অজুহাত দিস না।
  মাধবী মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।কিন্তু সত্যিই পরদিন বেলা দশটা বেজে গেলো মাধবীর পাত্তা নেই দেখে ঘোষগিন্নীর মাথায় আগুন চড়ে গেলো।বেশ কয়েকবার ফোন করলেন কিন্তু ফোন বেজে গেলো কেউ ধরলো না।আরো ক্ষেপে গিয়ে নিজেই একটা ছাতা মাথায় মাধবীর বস্তির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।এরূপ আগে কোনদিনও হয়নি যে ফোন করলে মাধবী ফোন ধরেনি।খুঁজে খুঁজে মাধবীর ঘরের কাছে গিয়ে বেশ রাগানিত্ব স্বরেই "মাধবী" বলে ডাক দিলেন।বছর সত্তরের এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে যা বললেন তা হল - কাল বাবুদের বাড়ি থেকে দূপ্যাকেট বিরিয়ানী দিয়েছিল।সবাই মিলেই ভাগ করে খেয়েছিল তারা।কিন্তু ভোর রাত থেকে বড় ছেলেটির পায়খানা,বমি শুরু হয়।ভোরের দিকে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে।সবাই মিলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে।
  এটুকু শুনে ঘোষগিন্নীর শরীরটা অস্থির অস্থির করতে লাগলো।বৃদ্ধা বলতে পারলেন না কোন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।পাশের একটি ঘর থেকে জেনে তিনি দ্রুত পায়ে বাড়িতে এসে স্বামীকে সব জানালেন।
  ছুটে গেলেন দুজনেই হাসপাতালে।কথা বললেন ডাক্তারদের সাথে।ভয়ের কোন কারণ নেই জেনে তবে নিশ্চিন্ত হলেন।
 দুজনে সেদিন আত্মীয়ের বাড়ি থেকে খেয়েই ফিরছিলেন।বিকালের যেহেতু বাড়ি ছিলেন না তাই মাধবী এবং তার ছেলেমেয়ে দু'টির টিফিন যায়নি ঘরে ভেবেই দু'জনে ওই বিরিয়ানীর প্যাকেট দু'টি কিনে আনেন।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন নিঃসন্তান এই দম্পতি।
  চারদিন পর মাধবী কাজে ফিরেছে।সেই একই রূপ ঘোষগিন্নীর।এখন আর মাধবীর তার প্রতি কোন রাগ হয় না।রাগটা যে ঘোষগিন্নীর মুখোশ সেটা এখন মাধবী ভালোভাবেই বুঝে গেছে।