Saturday, May 21, 2022

দামহীন চোখের জল

দামহীন চোখের জল 
  কালবৈশাখীর দামাল হাওয়ার মত সব নিমেষেই -- কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু তছনচ হয়ে গেলো।
  
  শিরীষ চোখের চশমাটা নাকের উপর একটু তুলে জয়তীর অনামিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।নিঃশব্দে কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ।
-- কেমন আছো জয়ী?
জয়ী তাকিয়ে দেখে তার পাশেই দাঁড়ানো শিরীষ।
--- সময়ের সাথে ছন্দ মিলিয়ে না হলেও জীবন কেটে যাচ্ছে।সময় তো কারো জন্য বসে থাকে না।তাই জীবনও কারো অপেক্ষায় থাকে না;সে নিজের মতই এগিয়ে চলে।
 প্রায় পঁচিশ বছর বাদে দুজন মুখোমুখি।কলেজের প্রথম বর্ষ থেকেই একে অপরকে চেনে।সেই চেনা থেকেই পরস্পর পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত।অনেক টালবাহানার পর দুই বাড়ির মতামতের ভিত্তিতেই ওদের চারহাত এক হয়।শিরীষ রেলে চাকরি করে আর জয়তী প্রাইমারি স্কুলে।শিরীষ চাকরি পাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে ওর মা মারা যান।আর বাবার কথা তো শিরিষের ভালোভাবে মনেই পড়ে না।
 যেহেতু দু'জনকেই সামান্য সময়ের ব্যবধানে বেরোতে হত তাই ঘুম থেকে উঠেই দুজন মিলেই সংসারের কাজে হাত লাগাতো।জয়ী কোন কোন দিন একটু আগেই বেরিয়ে যেত।কারণ ওর স্কুলে দুটো বাস পাল্টে যেতে হত।বছর দুয়েক এইভাবে বেশ ভালোই চলে।ওরা এবার চিন্তাভাবনা করতে থাকে বাচ্চা নেওয়ার।
  জয়ীতা প্রেগন্যান্ট হয়।শিরীষ তার জয়ীতাকে এখন কোন কাজই করতে দেয় না।জয়ী কোন কাজ করতে গেলেই সে নিজেই ছো মেরে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে কাজ করে।কিন্তু স্কুলে তো জয়ীকে যেতেই হবে।সেক্ষেত্রে আর কিইবা করার আছে।
  জয়ী স্কুলের সিড়ি দিয়ে পড়ে যায়।তার পরেই শিরীষের ভিতর এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে।বাচ্চাটা তাদের থাকে না।শিরীষ জয়ীকে চাকরি ছেড়ে দিতে বারবার অনুরোধ করতে থাকে।কিন্তু জয়ী রাজি হয় না।শিরীষ জয়ীকে জানিয়ে দেয় চাকরি না ছাড়লে পুনরায় সন্তান সে নেবে না।তারপরেই বাড়তে থাকে একটু একটু করে দূরত্ব।শুধু মানসিক নয় শারীরিকও।এক সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় দুজনের শোবার ঘরও আলাদা হয়ে যায়।এক ছাদের তলায় থাকাটাই তাদের আর সম্ভব হয়ে উঠলো না।
 শিরীষ হঠাৎ করেই যেন সবকিছুতেই অতিরঞ্জিত করতে লাগলো।ঝড়ের পূর্বাভাস ছাড়ায় সুখী সংসারে হঠাৎ করেই কাল বৈশাখী শুরু হল।জয়ী বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হয়।শিরীষ যে অকারনেই তার সাথে এরূপ ব্যবহার করছে জয়ী বুঝতে পেরেও কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না।পরিণতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া।পায়ের তলার মাটিতা শক্ত ছিল তাই মানসিক কষ্ট ছাড়া আর কোন বেগ পেতে হয়নি।জয়ীর কাছে শিরীষের এই ব্যবহার তাকে মানসিক রোগী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।জয়ী তাকে সেকথাই বলাতে সে সেদিন জয়ীর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে গেছিলো।কিন্তু পারেনি।জয়ী সে হাত খপ করে ধরে ফেলে।শিরীষ ঘর থেকে চুপ করে সেই মুহূর্তে বেরিয়ে যায়।আর সেই সন্ধ্যাতেই জয়ী তার ব্যাগ গুছিয়ে তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।
  জয়ী এখন দার্জিলিংয়ে পাকাপাকি বাসিন্দা। ওখানেই একটি স্কুলে সে পড়ায়।বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর সবকিছু বিক্রি করে পাহাড় ঘেঁষা এক অঞ্চলে কিছু সহজ সরল মানুষের সাহচর্যে সে খুব ভালো আছে।কোনদিনও আর চেষ্টা করেনি শিরীষের সাথে যোগাযোগ করার।
 জয়ীর মামাত বোনের বিয়েতে ক'দিনের জন্য কলকাতা এসেছে।শপিংমলে হঠাৎ করেই পরিচিত একটি কণ্ঠস্বরে পাশেই দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকিয়ে দেখে শিরীষ।চেহারার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।চুলগুলি পুরো সাদা হয়ে গেছে। যার ফলে তার যা বয়স তার থেকে আরও বেশি মনেহচ্ছে।জয়ীর হাতদুটো ছিল একটি বেরারসী শাড়ির উপর।অনামিকায় ছিল ফুলশয্যায় শিরীষের দেওয়া ডায়মন্ডের সেই আংটিটা।জয়ীর মুখের দিকে তাকিয়েই শিরীষের চোখ চলে যায় সেদিকে।বুকের ভিতর একটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।
-- কোথায় থাকো এখন?কত খুঁজেছি --
 কথা শেষ হওয়ার আগেই জয়ী বলে,
--- কেন খুঁজেছ?ডিভোর্সের পেপার সাইন করাতে?
 শিরীষ হঠাৎ করে জয়ীর মুখে একথা শুনে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- আজও আমায় ক্ষমা করতে পারোনি?
-- প্রশ্নই ওঠে না।আমার ভালোবাসাকেই শুধু খুন করেছো তাতো শুধু নয়।আমার জীবনটাকেও শেষ করে দিয়েছো
--- আজও আমার দেওয়া সেই ফুলশয্যার আংটিটা --
-- হ্যাঁ পরে আছি সেটা তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে নয় ;শুধুমাত্র প্রতিমুহূর্তে যাতে আমি মনে করতে পারি তোমার দেওয়া লাঞ্ছনা,অপমান - এর বাইরে কিছুই নয়।
--- ক্ষমা করে দেওয়া যায় না
জয়ী একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো,
-- আমার ক্ষমা করা বা না করায় কিছু যায় আসে কি এই বয়সে এসে?
  ওদের কথার মাঝখানে চলে আসে জয়ীর মামাত বোন।
--- দিদি,তোর পছন্দ হল বেনারসী?
দু'বোন তাদের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।শিরীষ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জয়ীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- যদি ফোন নম্বরটা ?
 জয়ী হাত জোর করে বললো,
-- মাফ করবেন।
  গাড়িতে জয়ীর বোন তার কাছে জানতে চাইলো
--- দিদি কে ওই ভদ্রলোক?নম্বরটা দিলি না কেন?
--- ফেসবুকে আলাপ।সবাইকে কি মোবাইল নম্বর দেওয়া যায় রে!
  কথাটা বলে জয়ী মুখটা সরিয়ে চোখের জলটা মুছে নিয়ে আংটিটার উপরে হাত বুলাতে থাকে।


No comments:

Post a Comment