বিকেল হলেই বারান্দায় দাঁড়াতাম,তাকে দেখার অপেক্ষায়।মাঝে মধ্যে সেও যে আমার দিকে তাকাতো না তা কিন্তু নয়।অবশ্য সে একা নয়;ওই মাঠে যারা যারা ফুটবল খেলতে আসতো তারা সকলেই রোজ বারান্দায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে একবার দু'বার না তাকিয়ে পারতো না।আমি কিন্তু শুধু ওর দিকেই তাকিয়ে থাকতাম।খেলার সময় ওর প্রত্যেকটা মুভমেন্ট আমার যেন নখদর্পণে চলে এসেছিল।যতক্ষণ ওরা মাঠে ফুটবল খেলতো আমি ততক্ষনই বারান্দায় বসে থাকতাম।
তখন কত আর বয়স হবে আমার এই ধর পনের কি ষোলো।তখনকার দিনে প্রেমট্রেম ওই বয়সে মাথায় আসতো না কারো।আমার ছেলেটিকে দেখতেই ভালো লাগতো।কিন্তু তাই বলে ওকে যে আমি ভালবাসতাম তা কিন্তু নয় বা বলতে পারিস ভালোবাসি নাকি তা বুঝতেও পারিনি।আসলে ভালোবাসার জ্ঞানটাই তখনো আমার ভালো আসেনি।রোজ ওই বারান্দায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকাটাই আমার কাছে একটা নেশার মত হয়ে গেছিলো।
জানতাম না ওর নাম, জানতাম না ও কোন বাড়ির ছেলে।ওকে দেখতে ভালো লাগতো তাই দূর থেকে হলেও ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেই ভালো লাগতো।এই ভালো লাগাটা ভালোবাসা কিনা জানতে পারিনি কোনদিন।তবে আজও যখন একাএকা থাকি তার কথা ভীষণভাবে মনেপড়ে।চোখ বন্ধ করলে আমি যেন আজও দেখতে পাই ওখানে ওই বড় বড় ফ্ল্যাট নয় একটা বিশাল বড় সবুজ মাঠ।মাঠের চারিপাশে শিমুল,কৃষ্ণচূড়া,রাধাচূড়া, বট, আরও কত বড় বড় সব গাছ।আর মাঠের ভিতর একদল কিশোরের বল নিয়ে সমস্ত মাঠে দাপাদাপি।
চুপ করে গেলেন শান্তিদেবী।
শান্তিদেবীর অষ্টাদশী নাতনীও কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল।কিছুক্ষণ পড়ে সে ঠাকুমার হাতটা ধরে বললো,
--- তারপর কি হল ঠাকুমা?
-- তারপর আর কি হবে?একদিন বাবা আমায় ডেকে বলেন,আমার বিয়ে ঠিক করে এসেছেন।তোর দাদু আমার থেকে চৌদ্দ বছরের বড় ছিলেন।আমার বিয়ের সময় ওই মাঠেই প্যান্ডেল হয়েছিল জানিস
--- তারপর আর কখনো তুমি ওই ছেলেটিকে দেখনি?
-- না দিদিভাই।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর মা বলে দিলেন আমি যেন আর বারান্দায় না যাই।ওখানে ছেলেরা ফুটবল খেলে হবু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এসে যদি দেখে তাদের বাড়ির হবু বউ বারান্দায় বসে ফুটবল খেলা দেখছে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
--- তুমি আর কখনো বারান্দায় আসনি?ওই ছেলেটাকে আর দেখনি?
--- দু একদিন যখন বাবা বিকালের দিকে ঘুমাতেন তখন দু একবার কিছুক্ষনের জন্য বারান্দায় এসে দেখেছি বৈকি!
--- এখন কি তুমি বুঝতে পারো যে ওই ছেলেটিকে তুমি ভালোবাসতে?
শান্তিদেবী সে কথার উত্তর না দিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
--- কত যুগ আগের কথা।তবুও এসব মনে করলেই যেন সেই কিশোরীবেলায় ফিরে যাই।তবে কি জানিস দিদি মানুষের বয়সটা শুধু বাইরের দিকেই বারে।মনটা কিন্তু সেই কিশরবেলাতেই পড়ে থাকে।বহু যুগ পড়ে আজ আবার সেই সব ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।মনেহচ্ছে এই তো সেদিনের কথা।
অতীতকে আঁকড়ে মানুষ বাঁচতে পারে না ঠিকই কিন্তু অতীতকে ভুলেও মানুষ বাঁচতে পারে না।অতীত মানুষের অন্তরেই ঘুমিয়ে থাকে।সে তার সময় এবং সুযোগ মত ঠিক জেগে ওঠে।
No comments:
Post a Comment