Sunday, May 8, 2022

সবকিছু কি বোঝা যায়

 সবকিছু কি বোঝা যায়

ভুল বুঝে,আমায় ভুলে ভালো থাকতে পারবে তো?আমি কোনদিনও মাথা নিচু করে এসে তোমার সামনে দাঁড়াবো না কথা দিলাম।কিন্তু যেদিন তুমি বুঝতে পারবে সব তোমার মনগড়া কল্পনা সেদিন পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে?
 উজান তার লাগেজটা গুছিয়েই যাচ্ছিল।এতক্ষন যে বিদিশা তার সাথে কথা বলে যাচ্ছে একটা কথারও কোন উত্তর উজান দেয়নি। ট্রোলি ব্যাগটাকে টেনে নিয়ে বারান্দায় রাখে।বিদিশা সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। আস্তে আস্তে মাথাটাকে পিছনের দিকে এলিয়ে দেয়।উজান ঘরের এদিক ওদিক থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি আর একটি ব্যাগে ভরতে থাকে।
 উজান আর বিদিশা কলেজে প্রথম বর্ষের থেকেই দুজন দুজনকে ভালোবাসে।দুজনেই এমটেক করেছে।উজান খুবই ব্রিলিয়ান্ট।সে কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই চাকরি পেয়ে যায়।উজান এবার বাড়িতে সবকিছু জানাতে চাইলে বিদিশা তাকে জানায় সে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত কোন কিছু তার পরিবারকে জানাবে না।কারণ সে জানে মায়ের কোন আপত্তি না থাকলেও বাবা তার মেয়েকে সাহার ঘরে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।তার প্রধান কারণ হচ্ছে বাবার এক বন্ধু অমিতকাকুর পদবী ছিল সাহা।আমিতকাকু বিদিশার বাবার কাছ থেকে প্রায় লক্ষাধিক টাকা ধার নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।কথা হয়েছিল ছ'মাস পর থেকে কিছু কিছু করে তিনি টাকা শোধ করবেন।বন্ধুত্ব ছিল দু'জনের মধ্যে প্রগাঢ়।কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো ব্যবসার আস্তে আস্তে উন্নতি হতে লাগলো আর অমিতকাকু বিদিশার বাবাকে একটু একটু করে এড়িয়ে যেতে লাগলেন।অর্থ,বৈভব,মানসম্মান কোনটাতেই বিদিশার বাবার অভাব ছিল না।তিনি এক,দু'বার টাকাটার কথা বলেছিলেন।কিন্তু অপরপক্ষ কোন সাড়াশব্দ না করায় বিদিশার বাবা রাগে,অপমানে আর সে টাকা কোনদিনও চাননি।আমিতবাবুও আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের বাঁধন থেকে আলগা হয়ে পড়েন।এরফলে পুরো সাহা পদবিধারি মানুষের প্রতিই তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে।
  কয়েক মাসের মধ্যেই বিদিশাও চাকরি পায়।মাকে দিয়ে বাবাকে সব কথা জানায় বিদিশা।বিদিশা যা ভেবেছিলো ঠিক তাই হল।উজানরা সাহা শুনেই তিনি বেঁকে বসলেন। কিন্তু মেয়ের জিদ আর অর্ধাঙ্গিনীর সওয়াল জবাবে তিনি নাজেহাল হয়ে মত দিতে বাধ্য হলেন।
 বেশ সুখেই চলছিলো বিদিশা আর উজানের সংসার।গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে উজানের বাবা,মা গ্রামেই থাকেন।উজান তাদের বারবার বলা স্বর্তেও গ্রামের খোলামেলা জীবন ছেড়ে তারা কিছুতেই কলকাতার বদ্ধ খাঁচায় আসতে রাজি নয়।সংসারে উজান আর বিদিশা।ভোরবেলায় কাজের লোক এসে রান্না করে দিয়ে যায় দুবেলার।দু'জনের অফিসের টিফিনটা রোজ বিদিশা নিজহাতে করে।বিদিশার অফিসটা একটু দূরে হওয়ায় তার মাঝে মধ্যেই ফিরতে একটু দেরি হয়ে যায়।উজান অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে রোজ অপেক্ষা করে বিদিশা ফিরলে একসাথে কফি খাবে বলে।কফিটা উজান নিজহাতেই করে।
 কিন্তু আজ কটাদিন ধরেই বিদিশার ফিরতে বেশ রাত হচ্ছে।রোজই বিদিশার সেই এক উত্তর "অফিসে প্রচণ্ড চাপ"-।সেদিন বিদিশার ফিরতে বেশ দেরি হচ্ছিল।বারবার ফোন করাতে সুইচ অফ শুনতে শুনতে উজানের মাথাটা গরম হয়েই ছিলো।তারউপর ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার ব্যালকনি থেকে সে দেখেছে মেরুন রঙের একটি গাড়ি থেকে নেমে সে গাড়ির ভিতরের কাউকে টাটা করছে।ব্যাস আগুনে ঘৃতাহুতি!কিছুক্ষণ পরেই বেলের আওয়াজ।চুপচাপ উপর থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিয়ে বেডরুমে ঢুকে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে যা এই একবছরের বিবাহিত জীবনে কোনদিন ঘটেনি।
 বিদিশা দু'কাপ কফি করে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখে উজান ঘুমিয়েই পড়েছে।সারাদিনের অফিসে খাটাখাটনির পর উজানের এই ঘুমিয়ে পড়া মুখটা দেখে বিদিশার খুব কষ্ট হয়।সে উজানের মুখের কাছে নিচু হয়ে আলতো করে উজানের কপালে একটা চুমু করে খুব মিষ্টি স্বরে ডাকে,কিন্তু উজান তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে,
--- বাইরে একজন আর ঘরের ভিতরে একজন
--- মানে?
--- মানেটা না বোঝার মত শব্দ তো বলিনি।রোজ রাত করে বাড়ি ফিরছো তা আবার অন্যের গাড়িতে।
--- সেটাই তো তোমায় আজ বলবো ।আগে তো কোনদিন গাড়িতে আসিনি।আজই প্রথম এলাম।
--- অতশত আমি জানি না। যা নিজের চোখে দেখলাম তাই বললাম। তা ভদ্রলোকটি কে?
--- কোন ভদ্রলোক?
--- আরে বাপরে মনেহচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছো না। যার গাড়ি করে এলে?
-- কি যা তা বলছো তুমি?তুমি কি আমায় অবিশ্বাস করছো?
--- বিশ্বাস করার মত আজকের কাজটা কি তুমি করেছো?
--- উজান,আমি তোমায় চিনতে পারছি না।
-- আমিও তো তোমায় চিনতে ভুল করেছি।
  এইভাবেই সেদিন দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ফলে ঝগড়া চরমে পৌঁছায়।কেউই সেদিন আর রাতে খায় না।উজান বেডরুম থেকে উঠে এসে ড্রয়িংরুমে শুয়ে পড়ে।আর বিদিশা সারাটা রাত বসেই কাটিয়ে দেয়।
  উজান উঠেই চলে যাওয়ার জন্য তোরজোড় শুরু করে।তার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু কথাকটি বলে চুপচাপ বিদিশা সোফায় মাথা পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে।সামান্য কারণে উজান যে সিনক্রিয়েট করেছে তাতে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার ইচ্ছা বিদিশার মন থেকে উড়ে গেছে।এই বিশ্বাস নিয়ে সে যে উজানের সাথে সারাটা জীবন কাটাতে পারবে না এটা বিদিশা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।
  সারাটা রাতের ক্লান্তি আর না ঘুমানোর ফলে বিদিশা সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকার ফলে ঘুমিয়েই পরে।সকালে কাজের দিদি রান্না করতে আসলে উজান তাকে দরজার কাছ থেকেই ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে।
 হঠাৎ মাথায় একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে দেখে উজান তার পাশে বসে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর অদূরে দাঁড়ানো ওদের দুজনের কমন ফ্রেন্ড শ্রেষ্ঠা যার গাড়িতে গতকাল রাতে বিদিশা ফিরেছে। শ্রেষ্ঠা বিদিশার অফিসে গতকালই জয়েন করেছে।বড়োলোকের আদুরে মেয়ে।বাবার কেনা গাড়িতে করেই সে অফিসে যাতায়াত করে।গতকালই সে বদলি হয়ে বিদিশার অফিসে এসেছে।বিদিশার বাড়ি ছাড়িয়ে তাকে যেতে হয়।তাই শ্রেষ্ঠা বিদিশাকে কথা দিয়েছে রোজ তাকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে আর ফেরার পথে নামিয়ে দিয়ে যাবে।সেইমত সে অফিসে যাওয়ার আগে বিদিশাদের গেটের কাছে আসতেই দেখে উজান ব্যাগ নিয়ে উবেরের জন্য অপেক্ষা করছে। শ্রেষ্ঠার মুখ থেকেই সে গতকালের সমস্ত ঘটনা শোনে।দু'হাত জড়ো করে উজান বিদিশার কাছে ক্ষমা চায় শ্রেষ্ঠার সামনেই।বিদিশা উজানকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।
 শ্রেষ্ঠা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
--- আজ আর তোরা কেউ অফিস যাস না।দু'জন দুজনকে একটু সময় দে।আজ আমি চলি। কাল থেকে দুজনেই রেডি হয়ে থাকবি।
 শ্রেষ্ঠা বেরিয়ে যায়।ওরা কোন আপত্তি করে না 
উজান এবার উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে সোফার উপরে এসে বসে শ্রেষ্ঠাকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় ক্ষমা চেয়ে গতকালের সব রাগের প্রায়শ্চিত্ত করে শ্রেষ্ঠার শরীরের সমস্ত জায়গায় চুম্বনে চুম্বনে।রাগ আর অনুরাগ দু'জনের শরীর এক হয়ে মিলেমিশে যায়।
  
    

No comments:

Post a Comment