Wednesday, May 11, 2022

নুপুর

 নুপুর 

সব জিনিসকে মূল্য দিয়ে বিচার করা যায় না।জিনিস নয় মূল্য দিতে হয় ভালোবাসা,আবেগ এই সবের।
  অনসূয়া তার ঘরে শুয়ে ছিলেন।সর্বক্ষণের দেখভালের মেয়েটিকে পাঠিয়েছিলেন তার নাতনী সুমনাকে ডেকে আনবার জন্য।অঙ্কে এম. এ. করা কলেজে সদ্য নিয়োগপত্র পাওয়া সুমনার পাঁচ বছরের প্রেমের পর চারহাত এক করতে চলেছেন দুই পরিবারের সদস্যরা।সুমনা এসে খাটের উপর তার ঠামির পাশে বসে জানতে চায়
--- তুমি আমায় ডেকেছো?
 অনসূয়া তার নাতনীর হাতে বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা দিয়ে বললেন,
--- দিদি,এরমধ্যে সবচেয়ে বড় চাবিটা হচ্ছে আমার আলমারির। যা আলমারিটা খুলে ওর ভিতর থেকে পিতলের বাক্সটা নিয়ে আয় তো।
--- এখন ভরদুপুরে তুমি ওটা দিয়ে কি করবে গো?
--- সে তুই ওটা আনলেই বুঝতে পারবি।
 সুমনা তার ঠাকুমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে তার কথামত আলমারির ভিতর থেকে বাক্সটা নিয়ে এসে ঠাকুমার কোলের কাছে রাখে।বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর সুমনার সাহায্যে তিনি উঠে বসেন।হাত বাড়িয়ে তার সুমিদিদির কাছ থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে তার ভিতর থেকে সবচেয়ে  ছোট্ট চাবিটা দিয়ে তার গয়নার বাক্সটা খুলে প্রচুর গয়নার ভিতর হাত ঢুকিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলেন।কিছুক্ষণ এভাবে খুঁজে না পেয়ে এক একটা করে গয়না বের করে খাটের উপরে রাখতে শুরু করেন।কি নেই তাতে?অনেক গয়নার নাম সুমনা নিজেও জানে না।
-- ঠামী,কি খুঁজছো বলো না ?
--- দেখ তো দিদি,এর ভিতর রুপোর একটা মল আছে।সোনার জল করা ছিল।কিন্তু এতদিন হয়ে গেছে খুব সম্ববত রংটা উঠে গেছে হয়ত।
 সুমনা বাক্সটা নিজের কোলের কাছে এগিয়ে নিয়ে এককোনে একটা মলিন কাগজে মোড়া কিছু একটা পড়ে আছে দেখে সেটি খুলতে শুরু করলো। ঠামি সেটি দেখে কাগজটা সুমনার কাছ থেকে নিয়ে বললেন ,
--- হ্যাঁরে দিদি এটাই খুঁজছিলাম।এটা আমার বিয়ের পর তোর দাদু বানিয়ে দিয়েছিল।সুমনা হাতে নিয়ে দেখে রূপার তৈরি একজোড়া পায়ের মল।গয়নার বাক্সটার ভিতর ভারী ভারী সব গয়নাগুলো তুলে অনসূয়া বললেন,
--- যা দিদি এগুলো নিয়ে তোর মাকে গিয়ে দে।আজ থেকে এগুলো সব তোর।তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম তোর বিয়ের সব গয়না আমি দেবো।
--- কিন্তু ঠামি এত গয়না থাকতে তুমি ওই রুপোর মল জোড়া নিয়েই বসে থাকলে?
--- ওরে দিদি ও তে যে তোর দাদুর প্রথম ভালোবাসার আবেগ,অনুভূতি লেগে আছে।
--- কিন্তু মলজোড়া তো খুবই পাতলা তার উপর আবার রুপোর তৈরি।
 মলজোড়া হাতে নিয়ে অনসূয়া কিছুটা উদাস হয়ে গেলেন।চাকরি পাওয়ার আগেই বিয়ে করেছিলেন প্রলয়বাবু।গ্রামে প্রচুর জমিজমা থাকায় আর অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে হওয়ায় ছেলের চাকরির জন্য বাড়ির কেউই অপেক্ষা করেননি।ফুলসজ্জার রাতে নিজের হাতে নূতন বউয়ের পায়ে মলজোড়া পরিয়ে দিয়েছিলেন প্রলয়বাবু। ছ'মাসের মধ্যেই স্কুল শিক্ষকের চাকরিটা পেয়ে যাওয়ার পর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে অনসূয়াকে নিয়ে কলকাতার ভাড়া বাড়িতে উঠে আসেন।শ্বশুরবাড়িতে একান্নবর্তী পরিবার হওয়ার কারণে ওই মল পরা নিয়ে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল অনসূয়াকে।তাই একসময় তিনি ওটি খুলেই রেখেছিলেন।কলকাতা আসার পর যতদিন স্বামী বেঁচে ছিলেন তিনি মলজোড়া পরে গেছেন।পরবর্তীতে অনেক গয়নায় স্বামী গড়িয়ে দিয়েছেন।কিন্তু ওই মলজোড়ার মূল্য অনসূয়ার কাছে অনেক।সুমনা তার ঠামিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,
-- কিগো তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে?
 সেকথার উত্তর না দিয়ে খুব আস্তে আস্তে তিনি বললেন,
--- দিদি একটা কাজ করতো ;আমাকে একবার ওই মলজোড়া পরিয়ে দে তো কিন্তু কাউকে কিছু বলিস না।বিধবা মানুষ তো।শুনলে কে কি বলবে তার ঠিক নেই।
 মলজোড়া পরে বৃদ্ধা তার স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললেন," দেখো আমি আবার সেই মল পায়ে পড়েছি।কিছু বলছো না যে।" অনসূয়া পরিস্কার দেখলেন ছবির ভিতর তার স্বামী যেন হাসছেন।
 পরদিন সকালে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন হার্ট অ্যাটাকে অনসূয়াদেবীর মৃত্যু হয়েছে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যেটা ঘটলো যে মলজোড়া সুমনা নিজ হাতে তার ঠামিকে পরিয়ে দিয়ে এসেছিল তা পরবর্তীতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।তবে মাঝে মধ্যে অধিক রাতে বাড়িতে একটা নূপুরের আওয়াজ পাওয়া যায়।মনেহয় কেউ যেন নূপুর পরে ছাদের উপর হাঁটছে।কিন্তু কোনদিনও সুমনা এই মলজোড়ার কথা অন্য কাউকেই বলেনি।


  

No comments:

Post a Comment