Saturday, May 7, 2022

ভালোবাসা কারে কয়

 ভালোবাসা কারে কয়
জীবনের সেরা একটা স্মৃতি ছিল সেই ট্রেন যাত্রা --- তিন পরিবারের সকলে মিলে পূর্বস্থির মত সন্ধ্যা ন'টা নাগাদ সবাই শিয়ালদহ স্টেশনে হাজির হলাম। মোট বারোজন আমরা।লাগেজ আমাদের সদস্য সংখ্যার প্রায় চারগুণ।নিদিষ্ট সময়ে ট্রেন দিয়ে দিলো।সকলেই হুটোপুটি বাঁধিয়ে দিলো।অথচ তখনো ট্রেন ছাড়তে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময়।আমার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগের ভিতর হাত চালিয়ে আইডি কার্ডগুলো সকলের একজায়গায় করতে গিয়ে দেখি জ্বলজ্বল করছে এগারোজনের আইডি কার্ডের জেরক্স নেই শুধু আমারটাই।মাথায় হাত!সামনেই আমার অর্ধাঙ্গিনী বসে।আমার মুখের চেহারা দেখে কিছু তো একটা আন্দাজ করতে পেরেছে সে।নিজেকে যথাসম্ভব নর্মাল রাখার চেষ্টা করেও ধরা পড়ে গেলাম তার কাছে।বিয়ে করার সময় জানতাম সে একজন ওসির মেয়ে।কিন্তু তখন এটা বুঝিনি বিয়ের পর সে আমার সংসারের ওসির পদটি গ্রহণ করে আজীবন আমাকে দিয়ে চোখের ইশারায় কাজ করিয়ে নেবে।আমার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
--- কি গো কি হল?আমাদের আইডি কার্ডগুলো এনেছো তো?
বউয়ের এই গলার স্বর শুনে আজ দশ বছর ধরে আমি কেন যে তোতলা হয়ে যাই আজও বুঝলাম না।তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
--- না গো খুঁ জে পাচ্ছি না আমার টা
--- টেবিলের উপর বই দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছিলে।ঢোকাতে ভুলে গেছো?
 আবার সেই বড় বড় চোখ। আট বছরের ছেলে জানতে চাইলো,
--- তাহলে এখন কি হবে বাবা?
--- কি আর হবে ?তোমরা সবাই গিয়ে শিলিগুড়ি অপেক্ষা করবে আমি পরের ট্রেন ধরে আসছি।
ভগ্নিপতি শুনে এগিয়ে এসে বললো,
--- কিন্তু শালাবাবু তুমিই তো আমাদের গাইড।
--- কিচ্ছু করার নেই জামাইবাবু।তোমাদের টিকিট আর আইডি কার্ডগুলো এই তোমার কাছে দিয়ে যাচ্ছি ।কোন অসুবিধা নেই।শিলিগুড়ি স্টেশনে দেখা হচ্ছে।
 বউয়ের মুখের দিকে ভালোভাবে না তাকিয়েই বললাম,
--- চিন্তা করোনা।মাত্র দু'ঘন্টার ডিফারেন্স।আমি এক্ষুনি নেমে যাচ্ছি তোমরা সাবধানে থেকো।
  বাড়ি পৌঁছেই আইডি কার্ড নিয়ে লোকালে ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়লাম।শোয়া তো দুরহস্ত!একটু বসার জায়গা চাই।
    হ্যাঁ বসতে একটু পেরেছিলাম।বসেই ঝিমুতে শুরু করলাম।হঠাৎ পরিচিত একটি গলার স্বরে চমকে তাকিয়ে সামনে যাকে দেখলাম এভাবে তাকে কোনদিন দেখতে পাবো ভাবিনি।সে আমার প্রথম প্রেম,সে আমার প্রথম ভালোলাগা। যার কথা ভাবলে আজও আমার শরীর মন শিহরিত হয়।সেই করুণা।
 তখন আমার ফাস্ট ইয়ার।করুণার তখন উচ্চমাধ্যমিক।ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবেশে দুজনেই তখন আচ্ছন্ন।একদিন আমাদের চিলেকোঠার ঘরে করুণা আমার পিছন থেকে এসে ঝাপটে ধরেছিল।মুহূর্তে নিজের বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে করুণাকে সামনে এনে ওর ঠোঁট দুটি আলতো স্পর্শ করেছিলাম। আট বছরের এক সন্তানের পিতা হয়েও আজও সেই অনুভূতিতে শরীর ও মনে শিহরণ জাগে।তখন আমি বেকার।তাই করুণার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়।অসহায়ের মত দেখা ছাড়া সেই মুহূর্তে আমার কিছু করার ছিল না।
করুণাকে দেখে বললাম,
--- বহুদিন পর তোমার সাথে দেখা হল।কেমন আছো?কোথায় যাচ্ছ?
করুণা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- আরে রজতদা যে!তুমি কোথায় চললে? আমি তো আমার কর্মস্থলে চললাম।
---কর্মস্থল?
--- আমি শিলিগুড়িতে একটা স্কুলে চাকরি করি।মায়ের কাছে এসেছিলাম।
--- আর তোমার স্বামী?
 করুণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।দু'বছর সংসার করেছি।ক্যান্সার ধরা পড়েছিল।অনেক দৌড়াদৌড়ি করে তার চাকরিটাই পেয়েছি।তানাহলে হয়ত না খেয়েই মরতে হত।শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয়নি।কারণ স্বামীর মৃত্যুর জন্য নাকি করুণাই দায়ী।তাই অলক্ষ্মী বউকে বাড়ির বাইরে থাকতে হচ্ছে।
সারাটা রাত করুণা তার দুঃখের কাহিনী বলে গেলো আর রজত চুপ করে শুধু ভেবেই গেলো - বিধাতা কেন এত নিষ্ঠুর?মানুষ যা চায় তা পায় না আর যা পায় তা চায় না।তবে কেন জীবনের প্রথম বেলায় সেই মানুষগুলির সাথে এতটা ভালোবাসায় জড়িয়ে যায় যা আমৃত্যু মানুষ ভুলতে পারে না।


    

No comments:

Post a Comment