অক্ষমতা
মাকে সব কথা বললেও, বলা হয়নি সেই কথাটা।
কেন যে সেদিন মাকে কথাটা জানিয়েছিলাম না আজও বুঝতে পারি না।সেই ছেলেবেলা থেকে স্কুল,কলেজ,রাস্তাঘাটে যখন যা ঘটেছে মাকে জানিয়েছি।আসলে মাকে সবকিছু না বললে আমার যেন ভাতই হজম হত না।বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে যখন যা ঘটতো মাকে বলতাম।একদিন সুজয়ের একটা হাসির কথা বলতে গেছিলাম মাকে।মা অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- শোন সুমি, দয়া করে তোর আর সুজয়ের কোন কথা আমায় বলিস না।
আমি বুঝতে পারছিলাম মা গম্ভীর হয়ে কথাটা বললেও মায়ের মুখের মধ্যে খুব কষ্ট করে হাসি ধরে রেখেছেন।আমি তখন বললাম,
--- কিন্তু মা তুমিই তো আমার বন্ধু।আমার তো সেরকম কোন বন্ধু নেই।তোমাকে ছাড়া কাকে বলবো?
মা আমার কানটা মুলে দিয়ে তখন হাসতে হাসতে বললেন,
--- জড়পদার্থকে বলো গিয়ে।ও আমার জামাই।ওর এসব কথা আমি শুনবো না।
তখন আমার বয়স বছর আটেক।বাবা রোজ আমায় স্কুল পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিস যেতেন।আর মা ছুটির পর গিয়ে নিয়ে আসতেন।মাধ্যমিক পর্যন্ত এটাই চলেছে।বাবা যেহেতু আমায় পৌঁছে দিয়ে অফিস যেতেন স্বভাবতই বাবার তাড়া থাকতো বেশি।কোনরকমে আমায় স্কুল গেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েই দৌড় দিতেন।আমি ছেলেবেলা থেকে এটা দেখেই অভ্যস্ত।অন্যান্য অভিভাবকদের সাথে খুব একটা কথা বলতেন না শুধুমাত্র আমার ক্লাসমেট অদিতির মা ছাড়া।অদিতির মাও চাকরি করতেন।তাই তিনিও অদিতিকে গেটে ছেড়ে দিয়েই চলে যেতেন।
একদিন বাবা আমায় স্কুলে পৌঁছে দিয়ে চলে যেতেই আমার মনে পড়লো ওয়ার্ক এডুকেশনের খাতাটা বাবার হাতের থেকে নিতেই ভুলে গেছি।দৌড়ে গেটের কাছে আসতেই দেখি স্কুল থেকে একটু দূরে বাবা আর অদিতির মায়ের সামনে একটা উবের এসে দাঁড়ালো।দুজনেই তড়িঘড়ি সেটাতে উঠে পড়লেন।আমি খাতার কথা ভুলে গিয়ে অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়েই রইলাম।সেন্ট্রিকাকু আমায় দেখতে পেয়ে আমার সামনে এগিয়ে এসে খাতাটা দিয়ে বললেন,
--- তোমার বাবার তাড়া ছিল তাই খাতাটা আমার কাছে দিয়ে গেছেন।এই নাও।
সেদিন এই কথাটা আমি বাড়ি ফিরে মাকে বলতে পারিনি।কিন্তু পরদিন স্কুলে বাবা আমাকে পৌঁছে দেওয়ার পর আমি আগেরদিনের মত গেটে দাঁড়িয়ে সেই একই জিনিস দেখলাম।কিছু না বুঝলেও ওই আট বছর বয়সে এটুকুন বুঝেছিলাম বাবার সাথে অদিতির মায়ের একটা সম্পর্ক আছে।সেই সম্পর্কটা সেদিন বন্ধুত্বের ভাবলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আসল ঘটনাটা বুঝতে পারি।অদিতির সাথে বন্ধুত্ব করি।ওর কাছ থেকে ওর মা কোন অফিসে চাকরি করে জানতে পারি।বাবার ও অদিতির মায়ের একই অফিস।বাবা মাঝে মধ্যেই অদিতিদের বাড়িতে যান।অদিতির বাবা অন্য কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করে ওকে আর ওর মাকে ছেড়ে চলে গেছেন।এখন অদিতির মা ঠিক করেছেন অদিতিকে শান্তিনিকেতনে রেখে পড়াবেন।শুধু এই বছরটাই সে এই স্কুলে আছে।বাবার সাথে আস্তে আস্তে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে।আমি বুঝতে পারি বাবা অদিতির মাকে ভালোবাসে।কিন্তু এই কথা জানলে মা খুব কষ্ট পাবেন তাই সব কথা বললেও এই কথাটা বলতে পারিনি।
এখন অধিকাংশ সময় বাবা বাড়িতে থাকলে মায়ের সাথে একটা চাপা ঝামেলা যে চলছে বুঝতে পারতাম।প্রথম প্রথম দেখেছি মা খুব কান্নাকাটি করতেন।বাবা,মায়ের শোয়ার ঘর যেদিন থেকে আলাদা হল সেদিন থেকে আমি মায়ের কাছেই শুতাম।বাবা কিন্তু রোজ ঠিক সেই আগের মতই নিয়ম করে আমায় স্কুল পৌঁছে দিতেন।আর আমারও একটা নেশার মত দাঁড়িয়ে গেছিলো দুজনকে একসাথে উবেরে উঠতে দেখা।বাবার সাথে শুধু আমার নয় মায়েরও দূরত্ব বেড়ে গেলো ভীষণভাবে।বাবা বাড়িটা পুরো মায়ের নামে করে দিলেন।আমার নামে কিছু টাকা ফিক্সড করলেন তারপর আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে একদিন শুধুমাত্র একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কোন ঝামেলা মায়ের সাথে বা কোন কথা ছাড়ায়।শুধু আগেরদিন রাতে মা রান্নাঘরে থাকলে আমায় যখন কিছু বলতে শুরু করেছিলেন আমি তখন বাবাকে জানিয়েছিলাম,
--- আমি সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই জানি তুমি অদিতির মাকে ভালোবাসো।আমি মাকে বলিনি কারণ আমার কাছ থেকে মা একথা জানতে পারলে ভীষণ কষ্ট পাবেন।আর মাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।মা কষ্ট পেলে আমিও ভীষণ কষ্ট পাবো।
--- তুই এখন বড় হয়েছিস।তোর সাথে আমি সব কথায় শেয়ার করতে পারি।তোর মায়ের সবগুন আছে আমি স্বীকার করছি।কিন্তু আমি একটা পুরুষ মানুষ।আমার জীবনেও তো কিছু চাওয়ার থাকতে পারে।তোর মায়ের নর্মাল ডেলিভারী ছিলিস তুই।কিন্তু ডাক্তারের ভুলের ফলে আর তোর মায়ের প্রচণ্ড বিপি বেড়ে যাওয়ার ফলে রক্তের চাপে সেলাই ছিঁড়ে গিয়ে কিছুটা নাড়ি বেরিয়ে এসেছিলো।ডাক্তার সেই মুহূর্তে কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে গিয়ে হাত দিয়ে সেই নাড়ি ভিতরে প্রবেশ করায়।ঠিকভাবে সেগুলো প্লেস না হওয়ায় যৌণ জীবনে তোর জন্মের পর তোর মা অক্ষম হয়ে পড়ে।আর সেই থেকে তোর মা কোন ভারী জিনিস তুলতেই পারে না।
আমি মাথা নিচু করে মায়ের দোষ শুনছিলাম আমার বাবার কাছ থেকে।কিছু বলার কোন মুখ আমার কোন পক্ষের হয়েই ছিল না।তখন মায়ের জন্য ভীষণভাবে কষ্ট হলেও পরে নিজের মনে ব্যাখ্যা করে দেখেছি প্রকৃতির নিয়মে বাবাকেও দোষ দেওয়া যায় না।পরদিন বাবা চলে যান তার নতুন জীবনে।
আমার জীবনে এই কথাটা ছাড়া আজ পর্যন্ত কোন কথা মাকে কোনদিনও গোপন করিনি।আমাকে মানুষ করতে বা আমার বিয়ে দিতে মাকে কোন বেগ পেতে হয়নি কারণ সব ব্যবস্থায় বাবা করে বেরিয়েছিলেন।আমার মায়ের একটাই দোষ ছিলো যার জন্য তিনি মোটেই দায়ী ছিলেন না ; যা ভুল ছিল ডাক্তারের তবে ডাক্তারও তো মানুষ দেবতা নয়।ভুল তার হতেই পারে।তবে মা কোনদিন কাউকে একথা জানাতে পারেননি কেন তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন।শুধু কেউ জানতে চাইলে চোখ ভর্তি জল নিয়ে বোকার মত তার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন।কি করে তিনি বলবেন তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন তার একমাত্র কারণ তিনি তার স্বামীকে শারীরিক সুখ দিতে পারেন না।তিনি তার যৌনজীবনে অক্ষম।
No comments:
Post a Comment