কি বললে?আর একবার বলো?আরে চুপ করে গেলে কেন?যে কথা জোরে বলার সৎ সাহস নেই সে কথা বলতে যাও কেন?আর কোনদিন যদি তোমার মুখে ওই কথা শুনেছি তাহলে সত্যি সত্যি আমি এই বয়সে যেখানে দুচোখ যায় সেখানেই চলে যাবো বলে দিলাম তোমায়। বাপেরবাড়ির মুখ তো সেই কবেই ভুলে গেছি।কেউ আজ আর বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা।
কথাগুলো বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক ঝেড়ে নাকের জল আর চোখের জল একসাথে মুছে ফোঁসফোঁস করতে করতে পয়ষট্টি বছরের বিমলাদেবী তার রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।আর বৃদ্ধ নলিনীমোহন মুখের উপর একটি সংবাদ পত্র ধরে অসাবধানতাবশত তার মুখ ফস্কে গিন্নিকে "না পোসালে চলে যাও "- কথাটি কিভাবে চাপা দেওয়া যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মুখের উপর সংবাদপত্রটি চেপে ধরে।
বিমলাদেবী ও নলিনীমোহনের পঞ্চান্ন বছরের সংসার।আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে বিমলা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল প্রামাণিক (তখনকার দিনে নাপিত বলা হত) পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে নলিনীমোহনকে।নলিনীমোহনের পরিবারের ইচ্ছা না থাকলেও তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল কারণ নলিনী ছাড়া পরিবারের ভরণপোষণ বন্ধ হয়ে যেত।সুন্দরী এবং গুণী বিমলা অতি অল্প দিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জয় করে নিলো।শ্বশুর,শ্বাশুড়ী,কুমারী ননদ,বিধবা পিসী সকলের যেন চোখেরমনি হয়ে উঠলো বিমলা। আস্তে আস্তে পুরো পরিবারের সকলের ভালোমন্দ,শরীর-স্বাস্থ্য,পোশাক-আশাক সবকিছুর দেখভালের দায়িত্ব এসে পড়লো বিমলার উপর।বিমলা হাসিমুখে সবকিছু অতি সুনিপুণভাবে সম্পাদন করতো।পরবর্তীতে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ালো নলিনী মাইনেটা পেয়েও বিমলার হাতে এনে তুলে দিত।তবে রেলের উচ্চপদের কর্মচারী হওয়ার ফলে বছরে একবার করে স্বামীর সাথে নানান স্থানে সে ঘুরে বেড়াতো।বিমলা এই যে তার স্বামীর সাথে বাইরে বেড়াতে যেত সে বারবার বাড়ির অন্যান্য সদস্যের বলা স্বর্তেও কেউ কোনদিন যেতে রাজি হয়নি।তার কারণও বিমলার শ্বশুরবাড়ির লোকও চাইতো তারা দুটিতে অন্তত কয়েকটি দিন নিজেদের মত করে কাটাক।
তিন বছরের মাথায় তাদের একমাত্র সন্তান বিশাখা আসে।এই তিনবছর শ্বশুরবাড়ির লোক ছাড়াও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা মনে করেছিল বিমলার পক্ষে মা হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এ বিষয়ে কথা শোনাতেও কেউ বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি।
কনভেন্টে পড়া মেয়ে বিশাখা নিজ বুদ্ধিমত্তায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন হয়ে পরবর্তীতে আমেরিকা পারি দেয়।বিদেশীকে ভালোবেসে বিয়ে করে আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়।পরিবারের মানুষজন কমতে কমতে একদম তলানিতে এসে পৌঁছেছে।এখন সংসারে কর্তা, গিন্নী ছাড়া আর কেউই নেই।দিনরাত দুটির সাথে ঝামেলা আবার একজনকে ছাড়া অন্যজন অচল।
বয়স দুজনেরই হয়েছে।কিন্তু কাজের লোকের কাজ একদম পছন্দ নয় কোনকালে বিমলাদেবীর।একা হাতেই সব কাজ শেষ করেন।ঝামেলার সূত্রপাত এককাপ চা পুনরায় খাবার আবদার করে।
-- বিমু,আমায় আর এককাপ চা দেবে?
--- এই তো সবে চা খেলে?আমি আর পারি না বাপু।এখন তো টিফিনটা করবো ভাবলাম।আমারও তো বয়স হচ্ছে।তোমার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় বয়স যেন তোমার একারই বাড়ছে।
--- আরে বাবা আমিও তো কাজ করি না কি?ঘর ঝাট দেওয়া,তোমার ঐ ডান্ডি দিয়ে ঘর পরিস্কার করা করি তো।আর কি করতে বলো বলো তো?
ব্যাস দু এক কথায় ঝামেলা শুরু হয়ে গেলো।নলিনীমোহনের মুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে গেলো,
--- সেই যে এলো আর একটি দিনের তরেও কোথাও গিয়ে থাকতে পারলো না।একভাবেই ঘাড়ের পড়ে বসে জ্বালিয়ে খাচ্ছে।
কথাটা বলেই নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলেন।তারপর স্ত্রীর চোখের চাউনি থেকে বাঁচতে মুখের উপর পেপারটা চেপে ধরে রাখলেন।হঠাৎ করেই মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে যেতেই তিনিও অনুতপ্ত।বিমলাদেবী রান্নাঘরে চলে যেতেই তিনিও একপা,দুপা করে রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন তার বিমূ গ্যাসে চায়ের জল চাপিয়ে তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।পিছন থেকে এসে তার মাথাটা ধরে আলতো করে নিজের বুকের উপর নিয়ে বললেন
--- বয়স হয়েছে।কি বলতে কি বলে ফেলেছি।ক্ষমা করে দাও গো।তুমি জানো তো তোমার চোখের জল আমি কোনদিন সহ্য করতে পারি না।
স্বামীর বুকে মাথা রাখলেন বিমলাদেবী।পকেট থেকে রুমাল বের করে বিমুর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
--- সেই পাগলীই থেকে গেলে।
-- যাও এই বয়সে আর আধ্যিকেতা করতে হবে না।চা হয়ে গেছে।ওটাকে নামাতে দাও।
-- আজও তোমায় বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলে সেই প্রথম দিনের মত বুকে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে।
খুব হাসতে থাকেন নলিনীমোহন।আর বিমলাদেবী বলে ওঠেন,
-- সারাজীবন তুমি আমার উত্তম কুমার হয়েই থাকলে।
--- আর তুমি আমার সুচিত্রা সেন
তিনিও হাসতে লাগেন খুব জোড়ে।
একই বলে বোধহয় সুখী দাম্পত্য!
No comments:
Post a Comment