Sunday, May 29, 2022

দিতে পারি অগ্নি পরীক্ষা ( কল্পবিজ্ঞান)

দিতে পারি অগ্নিপরীক্ষা (কল্পবিজ্ঞান)


  অনেকদিন পর সজলের সাথে বিপাশার দেখা এক পার্কে।বিপাশা তার নাতিকে নিয়ে পার্কে এসেছে।নাতি রিন্টু মাঠের ভিতর ছুটাছুটি করছে।অনতি দূরে একটি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বিপাশা বসে নাতির তদারকি করছে।হঠাৎ এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক এসে তার পাশে বসে।ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে পড়তে শুরু করেন।বিপাশা তাকিয়ে দেখে ভদ্রলোকের দিকে।বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোকের চুলগুলো সব সাদা।পরনে সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা।অদ্ভুত এক মার্জিত চেহারা।দেখলেই ভিতর থেকে একটা শ্রদ্ধা ভাব জেগে ওঠে।ভদ্রলোক বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বইটি পড়ছিলেন।বিপাশা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তার বা কানে বেশ বড় একটা জরুল।বুকটা এই সাতচল্লিশ বছর বয়সেও কেঁপে ওঠে।হঠাৎ করে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত ত্রিশ বছর আগের ঘটনাগুলো যেন এক নিমেষে চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে খেলে বেড়াতে লাগলো।
  বাড়ির পাশেই বাড়ি ছিলো সজলদের। সজলের তখন প্রথম বর্ষ আর বিপাশার মাধ্যমিক সবে শেষ হয়েছে। পারাতুতো সম্পর্ক বলে বিপাশা সজলকে সজলদা বলেই ডাকতো।পড়াশুনায় সজল,বিপাশা দু'জনেই খুব ভালো ছিল। সজলের পরীক্ষার পর বিপাশা সজলের নোটসগুলো নিজেই গিয়ে নিয়ে এসেছিল।কিন্তু সজল যখন নোটসের খাতাগুলো বিপাশার হাতে দিচ্ছিল তখন বিপাশা লক্ষ্য করেছিলো সজলের শরীরের সেই পরিবর্তন। বিপাশাও নিজেকে সামলাতে নোটস নিয়েই একছুটে বাড়ি চলে এসেছিল।
 রাস্তা-ঘাটে যখন তখন সজলের সাথে বিপাশার দেখা হয়েছে।মামুলি হেসে পড়া ছাড়া তেমন কোন কথা কোনদিনও হয়নি।খুব মার্জিত চেহারা আর পড়াশুনায় খুব ভালো বলে বিপাশার সজলের প্রতি একটা ভালোলাগা কাজ করতো।কিন্তু আজ যখন খাতাগুলো দিতে গিয়ে সজলের সামান্য স্পর্শেই ওর শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায় আর ঠিক তখনই বিপাশা লক্ষ্য করে সজলের হাতের রোমকূপগুলো পুরো দাঁড়িয়ে গেছে, শ্যামলা বর্ণের মানুষটার মুখটা পুরো লাল হয়ে গেছে;তখনই বিপাশা বুঝে ফেলে স্পর্শে বিদ্যুৎ শকটা সে একাই খায়নি।
  এমনিতেই বিপাশা পড়াশুনা আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে সব সময়।বন্ধুবান্ধব যা সবই স্কুলেই। কারো বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া বা গল্প করা ওর ঠিক পোষায় না।কিন্তু সেদিনের পর থেকে বিকেল হলেই বিনা কারণে রাস্তায় একাই একটু ঘোরাঘুরি করতো যদি সজলের সাথে ওর দেখা হয়।একদিন বিপাশা নিজেদের গেট থেকে কিছুটা এগিয়ে গেছে আর ঠিক তখনই কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে ওকেই তাড়া করেছে।পড়িমরি ছুটতে ছুটতে সজলদের গেট খোলা পেয়ে সোজা তাদের বাড়ির ভিতরে।
  সজল একাই বাড়িতে ছিলো।সকলের মা ছিলেন না সেদিন।সজল বেরিয়ে এসে জানতে চায়
--- এত হাঁফাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?
 বিপাশা হাঁপাতে হাঁপাতে তোতলাতে লাগলো কিন্তু কথা কিছুই বলতে পারলো না।সজল বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- ঘরে চলো,একটু জল খাও।তারপর শুনবো সব।
 ওদিকে কুকুরের তাড়া খেয়ে প্রচণ্ড ভয় আর এদিকে সজলের সান্নিধ্যে বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস!সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তখন তার।বিপাশা ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে। সজল তাকে একগ্লাস জল এনে দেয়।জলটা ঢকঢক করে খেয়েই বিপাশা উঠে দাঁড়ায়।সজল এগিয়ে গিয়ে বলে ,
--- বোসো, কথা আছে । 
 কি দেখে এত ভয় পেয়েছিলে ?
--- কুকুর তাড়া করেছিলো।
 সজল হো হো করে হেসে ওঠে।
 হাঁ করে বিপাশা সজলের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,
-- এভাবে হাসলে কেন?আমি ভয় পেয়েছি দেখে তোমার হাসি পেলো ?
সজল খানিকটা এগিয়ে এসে বিপাশার চোখের দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি বলে বসলো,
--- হাসলাম এখন যে কথাটা বলবো শুনলে তুমি যদি আরও ভয় পেয়ে যাও তাই মনেকরে।
--- কি বলবে তুমি আমায়?
--- যদি বলি সারাজীবন আমার হয়ে থাকতে ;রাজি হবে?
 সজল সোজা তাকিয়ে বিপাশার মুখের দিকে বিপাশা চোখটা নামিয়ে নিলেও সজল বুঝতে পারছে বিপাশা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
--- না,চুপ করে থাকলে হবে না।আমার কথার উত্তর মুখেই দিতে হবে।
 বিপাশা উঠে পালিয়ে যেতে চায়।সজল হাত ধরে টেনে তাকে বুকের কাছে নিয়ে আসে। সজলের জামার বোতাম খোলা পেয়ে বিপাশা বুকে আলতো করে চুমু করতে করতে আদর মাখানো গলায় অস্ফুট স্বরে বলে,
-- সব কথা মুখে বলা যায় না।কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।
 সজল বিপাশার মুখটা আলতো করে তুলে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে,
--- এখানকার পড়ার পাঠ চুকিয়ে বিদেশে যাবো।আমার জন্য অপেক্ষা করবে কিন্তু।
  এরপর দেখা,কথা,ঘুরে বেড়ানো আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বহু বহুবার হয়েছে।তারপর একদিন সজলের বিদেশ গমন।
 বিপাশা মুখটা ভদ্রলোকের মুখের কাছে নিয়ে জানতে চায়,
--- সজল না ?
চকিতে সজল মুখ তুলে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- বিপাশা ?তুমি এখানে?কত খুঁজেছি তোমায় বাইরে থেকে এসে।কেউ বলতে পারেনি।শুধু একটাই কথা বলেছে বহরমপুরে বোনের শ্বশুরবাড়ির কাছে থাকে।সেই সূত্র ধরে এখানে আমার ফ্ল্যাট কেনা যদি কখনো তোমার সাথে দেখা হয়।
  ইতিমধ্যে নাতি এসে বললো,
--- দিদি বাড়ি চলো।
 সজল বিপাশার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বিপাশা উত্তর দিলো,
--- আমার নাতি। বিদিপ্তার মেয়ের ঘরের ছেলে।আমার খুব নেওটা।বলতে পারো আমার কাছেই থাকে।যাবে আমার ফ্ল্যাটে?
 সজল মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ,
--- ফ্ল্যাটে কে কে আছেন?
--- গেলেই দেখতে পাবে।তবে হ্যাঁ তোমার বা তোমার বাড়ির লোকের আপত্তি থাকলে --
 কথা শেষ হয় না বিপাশার।সজল উঠে দাঁড়ায়।মনেমনে ভাবে নিজের চোখেই দেখতে চাই কে কে ফ্ল্যাটে আছে।
 কমপ্লেক্সের ভিতর ঢুকলে সজল অবাক হয়।কিন্তু নিজেকে সংযত রাখে।পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটের একটিতে বোন বিদিপ্তা আর পাশেরটাতেই বিপাশা।চুপচাপ এগিয়ে চলে সজল।নাতিকে বোনের জিম্মায় দিয়ে তালা খুলে ভিতরে ঢোকে।সামনেই ড্রয়িং।খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো।বিপাশা সোফা দেখিয়ে বলে, "বোসো"।যাওয়ার সময় এসিটা চালিয়ে দিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে দু'গ্লাস সরবত নিয়ে।
 --- এসব রাখো বিপাশা।অনেক কথা আছে।কিছু জানতে চাই আবার অনেক কিছু বলতেও চাই।
  পাঁচ বছর বাদে দেশে ফিরে জানতে পারলাম তোমাকে বিয়েতে রাজি করাতে না পেরে বিদিপ্তার বিয়ে দিয়ে দেন কাকিমা।বিয়ের বছর খানেকের মধ্যে তোমার মা চলে যান।তারপর ওই বাড়ি বিক্রি করে বিদিপ্তার অনুরোধেই তুমি তার শ্বশুরবাড়ির কাছে বাড়ি কিনে চলে আসো।পড়ে অবশ্য সে বাড়িও বিক্রি করে এই ফ্ল্যাট কেনো।আজকের দিনের মত ফোন না থাকায় যোগাযোগ আমাদের হয়নি ঠিকই কিন্তু আমাদের তো অনেক কমন ফ্রেন্ড ছিল কাউকে একজনকে তো তোমার ঠিকানাটা বলে আসতে পারতে?কেন নিজেদের জীবন থেকে এতগুলো বছর যেতে দিলে?
-- তুমি বিয়ে করোনি ?
--- কি মনেহয় তোমার আমাকে?জীবনের শুরুতেই তোমায় ভালোবেসেছিলাম সেটা এত ঠুনকো ছিলো?তুমিও তো বিয়ে করোনি তাহলে আমি যদি জানতে চাই কেন করোনি? দুটো নিষ্পাপ সরল মনের ভালোবাসা দুটো জীবনকে আজীবন বঞ্চিত করেই রেখে দিলো শুধুমাত্র তোমার ভুলের জন্য।
 চোখ ভর্তি জল নিয়ে বিপাশা সজলের হাতদুটি ধরে বলে,
-- যা শাস্তি দেবে তারজন্য আমি মাথা পেতে সেই শাস্তি মেনে নেবো।
--- ঠিক তো?অনেকটা সময় জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ঠিকই বাকি জীবনটা একসাথে একই ছাদের তলায় থাকতে চাই।আর একটা কথা তোমায় বলি শোনো আজ একবছর হল আমি এই কমপ্লেক্সের ডি-ব্লকে আছি।এটা বিধাতারই ইচ্ছা।বিশ্বাস করো বা না করো ভাগ্য বলে একটা কথা আছে।সময় না হলে ভাগ্যের মিঠা ফল পাওয়া যায় না গো।আমার বাবা,মা অনেক আগেই চলে গেছেন আমি এখন একা। চলো বিদিপ্তার কাছে গিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তটা জানিয়ে আসি।
  মধ্যবয়স্ক দুটি নরনারী অতীতে দেখা স্বপ্নের পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে না পারলেও নূতন করে স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিদিপ্তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

          শেষ
নাম - নন্দা মুখার্জী
ঠিকানা -১০১৭, বেহালা বিজি প্রেস,কল - ৬০
ফোন - 9903518626
মেল - nanda.mukherjee26@gmail.com




 

    

Saturday, May 21, 2022

দামহীন চোখের জল

দামহীন চোখের জল 
  কালবৈশাখীর দামাল হাওয়ার মত সব নিমেষেই -- কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু তছনচ হয়ে গেলো।
  
  শিরীষ চোখের চশমাটা নাকের উপর একটু তুলে জয়তীর অনামিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।নিঃশব্দে কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ।
-- কেমন আছো জয়ী?
জয়ী তাকিয়ে দেখে তার পাশেই দাঁড়ানো শিরীষ।
--- সময়ের সাথে ছন্দ মিলিয়ে না হলেও জীবন কেটে যাচ্ছে।সময় তো কারো জন্য বসে থাকে না।তাই জীবনও কারো অপেক্ষায় থাকে না;সে নিজের মতই এগিয়ে চলে।
 প্রায় পঁচিশ বছর বাদে দুজন মুখোমুখি।কলেজের প্রথম বর্ষ থেকেই একে অপরকে চেনে।সেই চেনা থেকেই পরস্পর পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত।অনেক টালবাহানার পর দুই বাড়ির মতামতের ভিত্তিতেই ওদের চারহাত এক হয়।শিরীষ রেলে চাকরি করে আর জয়তী প্রাইমারি স্কুলে।শিরীষ চাকরি পাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে ওর মা মারা যান।আর বাবার কথা তো শিরিষের ভালোভাবে মনেই পড়ে না।
 যেহেতু দু'জনকেই সামান্য সময়ের ব্যবধানে বেরোতে হত তাই ঘুম থেকে উঠেই দুজন মিলেই সংসারের কাজে হাত লাগাতো।জয়ী কোন কোন দিন একটু আগেই বেরিয়ে যেত।কারণ ওর স্কুলে দুটো বাস পাল্টে যেতে হত।বছর দুয়েক এইভাবে বেশ ভালোই চলে।ওরা এবার চিন্তাভাবনা করতে থাকে বাচ্চা নেওয়ার।
  জয়ীতা প্রেগন্যান্ট হয়।শিরীষ তার জয়ীতাকে এখন কোন কাজই করতে দেয় না।জয়ী কোন কাজ করতে গেলেই সে নিজেই ছো মেরে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সে কাজ করে।কিন্তু স্কুলে তো জয়ীকে যেতেই হবে।সেক্ষেত্রে আর কিইবা করার আছে।
  জয়ী স্কুলের সিড়ি দিয়ে পড়ে যায়।তার পরেই শিরীষের ভিতর এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে।বাচ্চাটা তাদের থাকে না।শিরীষ জয়ীকে চাকরি ছেড়ে দিতে বারবার অনুরোধ করতে থাকে।কিন্তু জয়ী রাজি হয় না।শিরীষ জয়ীকে জানিয়ে দেয় চাকরি না ছাড়লে পুনরায় সন্তান সে নেবে না।তারপরেই বাড়তে থাকে একটু একটু করে দূরত্ব।শুধু মানসিক নয় শারীরিকও।এক সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় দুজনের শোবার ঘরও আলাদা হয়ে যায়।এক ছাদের তলায় থাকাটাই তাদের আর সম্ভব হয়ে উঠলো না।
 শিরীষ হঠাৎ করেই যেন সবকিছুতেই অতিরঞ্জিত করতে লাগলো।ঝড়ের পূর্বাভাস ছাড়ায় সুখী সংসারে হঠাৎ করেই কাল বৈশাখী শুরু হল।জয়ী বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হয়।শিরীষ যে অকারনেই তার সাথে এরূপ ব্যবহার করছে জয়ী বুঝতে পেরেও কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না।পরিণতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া।পায়ের তলার মাটিতা শক্ত ছিল তাই মানসিক কষ্ট ছাড়া আর কোন বেগ পেতে হয়নি।জয়ীর কাছে শিরীষের এই ব্যবহার তাকে মানসিক রোগী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।জয়ী তাকে সেকথাই বলাতে সে সেদিন জয়ীর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে গেছিলো।কিন্তু পারেনি।জয়ী সে হাত খপ করে ধরে ফেলে।শিরীষ ঘর থেকে চুপ করে সেই মুহূর্তে বেরিয়ে যায়।আর সেই সন্ধ্যাতেই জয়ী তার ব্যাগ গুছিয়ে তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।
  জয়ী এখন দার্জিলিংয়ে পাকাপাকি বাসিন্দা। ওখানেই একটি স্কুলে সে পড়ায়।বাবা,মায়ের মৃত্যুর পর সবকিছু বিক্রি করে পাহাড় ঘেঁষা এক অঞ্চলে কিছু সহজ সরল মানুষের সাহচর্যে সে খুব ভালো আছে।কোনদিনও আর চেষ্টা করেনি শিরীষের সাথে যোগাযোগ করার।
 জয়ীর মামাত বোনের বিয়েতে ক'দিনের জন্য কলকাতা এসেছে।শপিংমলে হঠাৎ করেই পরিচিত একটি কণ্ঠস্বরে পাশেই দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকিয়ে দেখে শিরীষ।চেহারার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।চুলগুলি পুরো সাদা হয়ে গেছে। যার ফলে তার যা বয়স তার থেকে আরও বেশি মনেহচ্ছে।জয়ীর হাতদুটো ছিল একটি বেরারসী শাড়ির উপর।অনামিকায় ছিল ফুলশয্যায় শিরীষের দেওয়া ডায়মন্ডের সেই আংটিটা।জয়ীর মুখের দিকে তাকিয়েই শিরীষের চোখ চলে যায় সেদিকে।বুকের ভিতর একটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।
-- কোথায় থাকো এখন?কত খুঁজেছি --
 কথা শেষ হওয়ার আগেই জয়ী বলে,
--- কেন খুঁজেছ?ডিভোর্সের পেপার সাইন করাতে?
 শিরীষ হঠাৎ করে জয়ীর মুখে একথা শুনে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- আজও আমায় ক্ষমা করতে পারোনি?
-- প্রশ্নই ওঠে না।আমার ভালোবাসাকেই শুধু খুন করেছো তাতো শুধু নয়।আমার জীবনটাকেও শেষ করে দিয়েছো
--- আজও আমার দেওয়া সেই ফুলশয্যার আংটিটা --
-- হ্যাঁ পরে আছি সেটা তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে নয় ;শুধুমাত্র প্রতিমুহূর্তে যাতে আমি মনে করতে পারি তোমার দেওয়া লাঞ্ছনা,অপমান - এর বাইরে কিছুই নয়।
--- ক্ষমা করে দেওয়া যায় না
জয়ী একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো,
-- আমার ক্ষমা করা বা না করায় কিছু যায় আসে কি এই বয়সে এসে?
  ওদের কথার মাঝখানে চলে আসে জয়ীর মামাত বোন।
--- দিদি,তোর পছন্দ হল বেনারসী?
দু'বোন তাদের কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।শিরীষ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জয়ীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- যদি ফোন নম্বরটা ?
 জয়ী হাত জোর করে বললো,
-- মাফ করবেন।
  গাড়িতে জয়ীর বোন তার কাছে জানতে চাইলো
--- দিদি কে ওই ভদ্রলোক?নম্বরটা দিলি না কেন?
--- ফেসবুকে আলাপ।সবাইকে কি মোবাইল নম্বর দেওয়া যায় রে!
  কথাটা বলে জয়ী মুখটা সরিয়ে চোখের জলটা মুছে নিয়ে আংটিটার উপরে হাত বুলাতে থাকে।


Sunday, May 15, 2022

কঠোর কর্তব্য (৩০০ +শব্দ)

কঠোর কর্তব্য (সাহিত্যের সৌজন্যে)
  নন্দা মুখার্জী
  পড়ন্ত বিকেলের অস্তগামী লাল আভাটা পশ্চিম দিকের দেয়ালে এসে দেয়ালটাকেও লাল করে দিয়েছে।বিধাতা শুধু জীবনের লাল রংটা মুছে দিয়েছে সুজাতার জীবন থেকে। আটমাসের প্রেগন্যান্ট সুজাতা। বিয়ে হয়েছে মাত্র দুবছর। বিএসএফ এ কর্মরত সুকমলের মৃতদেহ সকালের উড়ানে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দুপুরের আগেই সেনাবাহিনীর লোকেরা সমস্ত কাজ সম্পন্ন করেছে।নিজের লোক বলতে সুজাতার দূর সম্পর্কের এক দাদা ছিল সাথে।সুকমলের মা শয্যাশায়ী। প্রাণটাই শুধু আছে।কথা বলা বা কোনকিছু বোঝার ক্ষমতা বছর খানেক আগেই একটা অ্যাটাকের পর বন্ধ হয়ে গেছে।ঈশ্বর এখানে সুজাতাকে রক্ষা করেছেন যে ছেলের মৃত্যু সংবাদটা অন্তত নিজমুখে ছেলের মাকে দিতে হয়নি।
 তিনমাসের মধ্যেই সেনাবাহিনীর অফিস থেকে সমস্ত টাকাপয়সা সুজাতা পেয়ে যায়।ঠিক আরও তিনমাস পরে সুকমলের অফিসে সুজাতা চাকরি পেয়ে যায়।সুজাতার বিধমা মায়ের কাছেই কমলিকা থেকে যায়।ছমাস ট্রেনিং শেষে সুজাতার পোষ্টিং হয় বর্ডার এড়িয়ায়।মেয়ে কমলিকা তিনবছর বয়স থেকেই দার্জিলিং বোডিংয়ে।
 জীবনতরীর নৌকাটা যাত্রার শুরু হতেই যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভেঙ্গে না পড়ে শক্ত হাতে কষ্টটাকে বুকে চেপে রেখে সুজাতা তার হালটা নিজহাতে ধরেছিল বলেই সে আজ সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী আর মেয়ে কমলিকা সকলের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে মেডিকেল পাশ করেই সেনা ছাউনির একজন তরুণী ডক্টর।
 কয়েক বছর হল সে দিদিমাকে হারিয়েছে।অল্প বয়সেই এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসারেরা মা ও মেয়ের পোষ্টিং একই জায়গায় দিয়েছেন।কিন্তু তা স্বর্তেও কমলিকাকে যখন তখন যে কোন জায়গায় যেতে হয়।
  কমলিকা এখানে আসার পর থেকেই লক্ষ্য করে মায়েরই এক সহকর্মী মায়ের প্রতি বেশ দুর্বল।সে একটু অগ্রণী হয়েই তার সাথে বন্ধুত্ব করে জানতে পারে তিনিও অবিবাহিত।সারাজীবন একাই কাটিয়েছেন।  
 নিজেদের কোয়ার্টারে অধিক রাতে মায়ের একটি ফোন আসায় মা উঠে গিয়ে চাপাস্বরে তার সাথে কথা বলায় বুদ্ধিমতী কমলিকা বুঝে ফেলে মায়েরও সেই চাকরিতে জয়েন করার প্রথম থেকেই তার প্রতি দুর্বলতা রয়েছে।শুধুমাত্র মেয়েকে মানুষ এবং সমাজের ভয়ে একটা পবিত্র প্রেম পূর্ণতা পেলো না এতদিন।
  অনেক ঝড়-ঝাপটা,তর্ক-বিতর্ক আর ঝামেলার পর সে তার মাকে রাজি করাতে সমর্থ হয়।সারাজীবন যে মানুষটা একা একাই কাটিয়েছে এই বয়সে এসে নতুন করে জীবন থেকে কিছু পাওয়ার তার নেই।তবুও শেষ বয়সে শুধুমাত্র একজন সঙ্গী যার সাথে অন্তত দুটো মনের কথা বলা যায়।
 কোনদিন বাবা বলে কাউকে ডাকতে পারেনি সে।তাই মায়ের বিয়ে দিয়ে সাবলীলভাবেই মায়ের স্বামীকে বাবা ডেকে তার সারাজীবনের মনের খিদেটা মেটাতে পেরে আজ সে সত্যিই খুব খুশি।
 এখন তিনজনেই একই কোয়ার্টারে থাকেন।
  
  

Saturday, May 14, 2022

অতীত ফিরে আসে বারবার

অতীত  ফিরে আসে বারবার 
 
বিকেল হলেই বারান্দায় দাঁড়াতাম,তাকে দেখার অপেক্ষায়।মাঝে মধ্যে সেও যে আমার দিকে তাকাতো না তা কিন্তু নয়।অবশ্য সে একা নয়;ওই মাঠে যারা যারা ফুটবল খেলতে আসতো তারা সকলেই রোজ বারান্দায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে একবার দু'বার না তাকিয়ে পারতো না।আমি কিন্তু শুধু ওর দিকেই তাকিয়ে থাকতাম।খেলার সময় ওর প্রত্যেকটা মুভমেন্ট আমার যেন নখদর্পণে চলে এসেছিল।যতক্ষণ ওরা মাঠে ফুটবল খেলতো আমি ততক্ষনই বারান্দায় বসে থাকতাম।
  তখন কত আর বয়স হবে আমার এই ধর পনের কি ষোলো।তখনকার দিনে প্রেমট্রেম ওই বয়সে মাথায় আসতো না কারো।আমার ছেলেটিকে দেখতেই ভালো লাগতো।কিন্তু তাই বলে ওকে যে আমি ভালবাসতাম তা কিন্তু নয় বা বলতে পারিস ভালোবাসি নাকি তা বুঝতেও পারিনি।আসলে ভালোবাসার জ্ঞানটাই তখনো আমার ভালো আসেনি।রোজ ওই বারান্দায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকাটাই আমার কাছে একটা নেশার মত হয়ে গেছিলো।
  জানতাম না ওর নাম, জানতাম না ও কোন বাড়ির ছেলে।ওকে দেখতে ভালো লাগতো তাই দূর থেকে হলেও ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেই ভালো লাগতো।এই ভালো লাগাটা ভালোবাসা কিনা জানতে পারিনি কোনদিন।তবে আজও যখন একাএকা থাকি তার কথা ভীষণভাবে মনেপড়ে।চোখ বন্ধ করলে আমি যেন আজও দেখতে পাই ওখানে ওই বড় বড় ফ্ল্যাট নয় একটা বিশাল বড় সবুজ মাঠ।মাঠের চারিপাশে শিমুল,কৃষ্ণচূড়া,রাধাচূড়া, বট, আরও কত বড় বড় সব গাছ।আর মাঠের ভিতর একদল কিশোরের বল নিয়ে সমস্ত মাঠে দাপাদাপি।
 চুপ করে গেলেন শান্তিদেবী।
 শান্তিদেবীর অষ্টাদশী নাতনীও কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল।কিছুক্ষণ পড়ে সে ঠাকুমার হাতটা ধরে বললো,
--- তারপর কি হল ঠাকুমা?
-- তারপর আর কি হবে?একদিন বাবা আমায় ডেকে বলেন,আমার বিয়ে ঠিক করে এসেছেন।তোর দাদু আমার থেকে চৌদ্দ বছরের বড় ছিলেন।আমার বিয়ের সময় ওই মাঠেই প্যান্ডেল হয়েছিল জানিস 
--- তারপর আর কখনো তুমি ওই ছেলেটিকে দেখনি?
-- না দিদিভাই।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর মা বলে দিলেন আমি যেন আর বারান্দায় না যাই।ওখানে ছেলেরা ফুটবল খেলে হবু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এসে যদি দেখে তাদের বাড়ির হবু বউ বারান্দায় বসে ফুটবল খেলা দেখছে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
--- তুমি আর কখনো বারান্দায় আসনি?ওই ছেলেটাকে আর দেখনি?
--- দু একদিন যখন বাবা বিকালের দিকে ঘুমাতেন তখন দু একবার কিছুক্ষনের জন্য বারান্দায় এসে দেখেছি বৈকি!
--- এখন কি তুমি বুঝতে পারো যে ওই ছেলেটিকে তুমি ভালোবাসতে?
  শান্তিদেবী সে কথার উত্তর না দিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
--- কত যুগ আগের কথা।তবুও এসব মনে করলেই যেন সেই কিশোরীবেলায় ফিরে যাই।তবে কি জানিস দিদি মানুষের বয়সটা শুধু বাইরের দিকেই বারে।মনটা কিন্তু সেই কিশরবেলাতেই পড়ে থাকে।বহু যুগ পড়ে আজ আবার সেই সব ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।মনেহচ্ছে এই তো সেদিনের কথা।
  অতীতকে আঁকড়ে মানুষ বাঁচতে পারে না ঠিকই কিন্তু অতীতকে ভুলেও মানুষ বাঁচতে পারে না।অতীত মানুষের অন্তরেই ঘুমিয়ে থাকে।সে তার সময় এবং সুযোগ মত ঠিক জেগে ওঠে।

Friday, May 13, 2022

সুখী দাম্পত্য

  সুখী দাম্পত্য 
   কি বললে?আর একবার বলো?আরে চুপ করে গেলে কেন?যে কথা জোরে বলার সৎ সাহস নেই সে কথা বলতে যাও কেন?আর কোনদিন যদি তোমার মুখে ওই কথা শুনেছি তাহলে সত্যি সত্যি আমি এই বয়সে যেখানে দুচোখ যায় সেখানেই চলে যাবো বলে দিলাম তোমায়। বাপেরবাড়ির মুখ তো সেই কবেই ভুলে গেছি।কেউ আজ আর বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা।
  কথাগুলো বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক ঝেড়ে নাকের জল আর চোখের জল একসাথে মুছে ফোঁসফোঁস করতে করতে পয়ষট্টি বছরের বিমলাদেবী তার রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।আর বৃদ্ধ নলিনীমোহন মুখের উপর একটি সংবাদ পত্র ধরে অসাবধানতাবশত তার মুখ ফস্কে গিন্নিকে "না পোসালে চলে যাও "- কথাটি কিভাবে চাপা দেওয়া যায় তার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মুখের উপর সংবাদপত্রটি চেপে ধরে।
বিমলাদেবী ও নলিনীমোহনের পঞ্চান্ন বছরের সংসার।আজ থেকে বেশ কয়েক যুগ আগে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে বিমলা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল প্রামাণিক (তখনকার দিনে নাপিত বলা হত) পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে নলিনীমোহনকে।নলিনীমোহনের পরিবারের ইচ্ছা না থাকলেও তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল কারণ নলিনী ছাড়া পরিবারের ভরণপোষণ বন্ধ হয়ে যেত।সুন্দরী এবং গুণী বিমলা অতি অল্প দিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জয় করে নিলো।শ্বশুর,শ্বাশুড়ী,কুমারী ননদ,বিধবা পিসী সকলের যেন চোখেরমনি হয়ে উঠলো বিমলা। আস্তে আস্তে পুরো পরিবারের সকলের ভালোমন্দ,শরীর-স্বাস্থ্য,পোশাক-আশাক সবকিছুর দেখভালের দায়িত্ব এসে পড়লো বিমলার উপর।বিমলা হাসিমুখে সবকিছু অতি সুনিপুণভাবে সম্পাদন করতো।পরবর্তীতে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ালো নলিনী মাইনেটা পেয়েও বিমলার হাতে এনে তুলে দিত।তবে রেলের উচ্চপদের কর্মচারী হওয়ার ফলে বছরে একবার করে স্বামীর সাথে নানান স্থানে সে ঘুরে বেড়াতো।বিমলা এই যে তার স্বামীর সাথে বাইরে বেড়াতে যেত সে বারবার বাড়ির অন্যান্য সদস্যের বলা স্বর্তেও কেউ কোনদিন যেতে রাজি হয়নি।তার কারণও বিমলার শ্বশুরবাড়ির লোকও চাইতো তারা দুটিতে অন্তত কয়েকটি দিন নিজেদের মত করে কাটাক।
 তিন বছরের মাথায় তাদের একমাত্র সন্তান বিশাখা আসে।এই তিনবছর শ্বশুরবাড়ির লোক ছাড়াও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা মনে করেছিল বিমলার পক্ষে মা হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এ বিষয়ে কথা শোনাতেও কেউ বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি।
কনভেন্টে পড়া মেয়ে বিশাখা নিজ বুদ্ধিমত্তায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন হয়ে পরবর্তীতে আমেরিকা পারি দেয়।বিদেশীকে ভালোবেসে বিয়ে করে আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়।পরিবারের মানুষজন কমতে কমতে একদম তলানিতে এসে পৌঁছেছে।এখন সংসারে কর্তা, গিন্নী ছাড়া আর কেউই নেই।দিনরাত দুটির সাথে ঝামেলা আবার একজনকে ছাড়া অন্যজন অচল।
 বয়স দুজনেরই হয়েছে।কিন্তু কাজের লোকের কাজ একদম পছন্দ নয় কোনকালে বিমলাদেবীর।একা হাতেই সব কাজ শেষ করেন।ঝামেলার সূত্রপাত এককাপ চা পুনরায় খাবার আবদার করে।
-- বিমু,আমায় আর এককাপ চা দেবে?
--- এই তো সবে চা খেলে?আমি আর পারি না বাপু।এখন তো টিফিনটা করবো ভাবলাম।আমারও তো বয়স হচ্ছে।তোমার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় বয়স যেন তোমার একারই বাড়ছে।
--- আরে বাবা আমিও তো কাজ করি না কি?ঘর ঝাট দেওয়া,তোমার ঐ ডান্ডি দিয়ে ঘর পরিস্কার করা করি তো।আর কি করতে বলো বলো তো?
  ব্যাস দু এক কথায় ঝামেলা শুরু হয়ে গেলো।নলিনীমোহনের মুখ থেকে আচমকা বেরিয়ে গেলো,
--- সেই যে এলো আর একটি দিনের তরেও কোথাও গিয়ে থাকতে পারলো না।একভাবেই ঘাড়ের পড়ে বসে জ্বালিয়ে খাচ্ছে।
 কথাটা বলেই নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলেন।তারপর স্ত্রীর চোখের চাউনি থেকে বাঁচতে মুখের উপর পেপারটা চেপে ধরে রাখলেন।হঠাৎ করেই মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে যেতেই তিনিও অনুতপ্ত।বিমলাদেবী রান্নাঘরে চলে যেতেই তিনিও একপা,দুপা করে রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন তার বিমূ গ্যাসে চায়ের জল চাপিয়ে তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।পিছন থেকে এসে তার মাথাটা ধরে আলতো করে নিজের বুকের উপর নিয়ে বললেন
--- বয়স হয়েছে।কি বলতে কি বলে ফেলেছি।ক্ষমা করে দাও গো।তুমি জানো তো তোমার চোখের জল আমি কোনদিন সহ্য করতে পারি না।
 স্বামীর বুকে মাথা রাখলেন বিমলাদেবী।পকেট থেকে রুমাল বের করে বিমুর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
--- সেই পাগলীই থেকে গেলে।
-- যাও এই বয়সে আর আধ্যিকেতা করতে হবে না।চা হয়ে গেছে।ওটাকে নামাতে দাও।
-- আজও তোমায় বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলে সেই প্রথম দিনের মত বুকে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে।
 খুব হাসতে থাকেন নলিনীমোহন।আর বিমলাদেবী বলে ওঠেন,
-- সারাজীবন তুমি আমার উত্তম কুমার হয়েই থাকলে।
--- আর তুমি আমার সুচিত্রা সেন
 তিনিও হাসতে লাগেন খুব জোড়ে।
  একই বলে বোধহয় সুখী দাম্পত্য!



    

Wednesday, May 11, 2022

নুপুর

 নুপুর 

সব জিনিসকে মূল্য দিয়ে বিচার করা যায় না।জিনিস নয় মূল্য দিতে হয় ভালোবাসা,আবেগ এই সবের।
  অনসূয়া তার ঘরে শুয়ে ছিলেন।সর্বক্ষণের দেখভালের মেয়েটিকে পাঠিয়েছিলেন তার নাতনী সুমনাকে ডেকে আনবার জন্য।অঙ্কে এম. এ. করা কলেজে সদ্য নিয়োগপত্র পাওয়া সুমনার পাঁচ বছরের প্রেমের পর চারহাত এক করতে চলেছেন দুই পরিবারের সদস্যরা।সুমনা এসে খাটের উপর তার ঠামির পাশে বসে জানতে চায়
--- তুমি আমায় ডেকেছো?
 অনসূয়া তার নাতনীর হাতে বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা দিয়ে বললেন,
--- দিদি,এরমধ্যে সবচেয়ে বড় চাবিটা হচ্ছে আমার আলমারির। যা আলমারিটা খুলে ওর ভিতর থেকে পিতলের বাক্সটা নিয়ে আয় তো।
--- এখন ভরদুপুরে তুমি ওটা দিয়ে কি করবে গো?
--- সে তুই ওটা আনলেই বুঝতে পারবি।
 সুমনা তার ঠাকুমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে তার কথামত আলমারির ভিতর থেকে বাক্সটা নিয়ে এসে ঠাকুমার কোলের কাছে রাখে।বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর সুমনার সাহায্যে তিনি উঠে বসেন।হাত বাড়িয়ে তার সুমিদিদির কাছ থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে তার ভিতর থেকে সবচেয়ে  ছোট্ট চাবিটা দিয়ে তার গয়নার বাক্সটা খুলে প্রচুর গয়নার ভিতর হাত ঢুকিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলেন।কিছুক্ষণ এভাবে খুঁজে না পেয়ে এক একটা করে গয়না বের করে খাটের উপরে রাখতে শুরু করেন।কি নেই তাতে?অনেক গয়নার নাম সুমনা নিজেও জানে না।
-- ঠামী,কি খুঁজছো বলো না ?
--- দেখ তো দিদি,এর ভিতর রুপোর একটা মল আছে।সোনার জল করা ছিল।কিন্তু এতদিন হয়ে গেছে খুব সম্ববত রংটা উঠে গেছে হয়ত।
 সুমনা বাক্সটা নিজের কোলের কাছে এগিয়ে নিয়ে এককোনে একটা মলিন কাগজে মোড়া কিছু একটা পড়ে আছে দেখে সেটি খুলতে শুরু করলো। ঠামি সেটি দেখে কাগজটা সুমনার কাছ থেকে নিয়ে বললেন ,
--- হ্যাঁরে দিদি এটাই খুঁজছিলাম।এটা আমার বিয়ের পর তোর দাদু বানিয়ে দিয়েছিল।সুমনা হাতে নিয়ে দেখে রূপার তৈরি একজোড়া পায়ের মল।গয়নার বাক্সটার ভিতর ভারী ভারী সব গয়নাগুলো তুলে অনসূয়া বললেন,
--- যা দিদি এগুলো নিয়ে তোর মাকে গিয়ে দে।আজ থেকে এগুলো সব তোর।তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম তোর বিয়ের সব গয়না আমি দেবো।
--- কিন্তু ঠামি এত গয়না থাকতে তুমি ওই রুপোর মল জোড়া নিয়েই বসে থাকলে?
--- ওরে দিদি ও তে যে তোর দাদুর প্রথম ভালোবাসার আবেগ,অনুভূতি লেগে আছে।
--- কিন্তু মলজোড়া তো খুবই পাতলা তার উপর আবার রুপোর তৈরি।
 মলজোড়া হাতে নিয়ে অনসূয়া কিছুটা উদাস হয়ে গেলেন।চাকরি পাওয়ার আগেই বিয়ে করেছিলেন প্রলয়বাবু।গ্রামে প্রচুর জমিজমা থাকায় আর অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে হওয়ায় ছেলের চাকরির জন্য বাড়ির কেউই অপেক্ষা করেননি।ফুলসজ্জার রাতে নিজের হাতে নূতন বউয়ের পায়ে মলজোড়া পরিয়ে দিয়েছিলেন প্রলয়বাবু। ছ'মাসের মধ্যেই স্কুল শিক্ষকের চাকরিটা পেয়ে যাওয়ার পর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে অনসূয়াকে নিয়ে কলকাতার ভাড়া বাড়িতে উঠে আসেন।শ্বশুরবাড়িতে একান্নবর্তী পরিবার হওয়ার কারণে ওই মল পরা নিয়ে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল অনসূয়াকে।তাই একসময় তিনি ওটি খুলেই রেখেছিলেন।কলকাতা আসার পর যতদিন স্বামী বেঁচে ছিলেন তিনি মলজোড়া পরে গেছেন।পরবর্তীতে অনেক গয়নায় স্বামী গড়িয়ে দিয়েছেন।কিন্তু ওই মলজোড়ার মূল্য অনসূয়ার কাছে অনেক।সুমনা তার ঠামিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,
-- কিগো তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে?
 সেকথার উত্তর না দিয়ে খুব আস্তে আস্তে তিনি বললেন,
--- দিদি একটা কাজ করতো ;আমাকে একবার ওই মলজোড়া পরিয়ে দে তো কিন্তু কাউকে কিছু বলিস না।বিধবা মানুষ তো।শুনলে কে কি বলবে তার ঠিক নেই।
 মলজোড়া পরে বৃদ্ধা তার স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললেন," দেখো আমি আবার সেই মল পায়ে পড়েছি।কিছু বলছো না যে।" অনসূয়া পরিস্কার দেখলেন ছবির ভিতর তার স্বামী যেন হাসছেন।
 পরদিন সকালে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন হার্ট অ্যাটাকে অনসূয়াদেবীর মৃত্যু হয়েছে।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যেটা ঘটলো যে মলজোড়া সুমনা নিজ হাতে তার ঠামিকে পরিয়ে দিয়ে এসেছিল তা পরবর্তীতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।তবে মাঝে মধ্যে অধিক রাতে বাড়িতে একটা নূপুরের আওয়াজ পাওয়া যায়।মনেহয় কেউ যেন নূপুর পরে ছাদের উপর হাঁটছে।কিন্তু কোনদিনও সুমনা এই মলজোড়ার কথা অন্য কাউকেই বলেনি।


  

Sunday, May 8, 2022

অক্ষমতা

অক্ষমতা

 মাকে সব কথা বললেও, বলা হয়নি সেই কথাটা।
  কেন যে সেদিন মাকে কথাটা জানিয়েছিলাম না আজও বুঝতে পারি না।সেই ছেলেবেলা থেকে স্কুল,কলেজ,রাস্তাঘাটে যখন যা ঘটেছে মাকে জানিয়েছি।আসলে মাকে সবকিছু না বললে আমার যেন ভাতই হজম হত না।বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে যখন যা ঘটতো মাকে বলতাম।একদিন সুজয়ের একটা হাসির কথা বলতে গেছিলাম মাকে।মা অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- শোন সুমি, দয়া করে তোর আর সুজয়ের কোন কথা আমায় বলিস না।
 আমি বুঝতে পারছিলাম মা গম্ভীর হয়ে কথাটা বললেও মায়ের মুখের মধ্যে খুব কষ্ট করে হাসি ধরে রেখেছেন।আমি তখন বললাম,
--- কিন্তু মা তুমিই তো আমার বন্ধু।আমার তো সেরকম কোন বন্ধু নেই।তোমাকে ছাড়া কাকে বলবো?
 মা আমার কানটা মুলে দিয়ে তখন হাসতে হাসতে বললেন,
--- জড়পদার্থকে বলো গিয়ে।ও আমার জামাই।ওর এসব কথা আমি শুনবো না।
  তখন আমার বয়স বছর আটেক।বাবা রোজ আমায় স্কুল পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিস যেতেন।আর মা ছুটির পর গিয়ে নিয়ে আসতেন।মাধ্যমিক পর্যন্ত এটাই চলেছে।বাবা যেহেতু আমায় পৌঁছে দিয়ে অফিস যেতেন স্বভাবতই বাবার তাড়া থাকতো বেশি।কোনরকমে আমায় স্কুল গেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েই দৌড় দিতেন।আমি ছেলেবেলা থেকে এটা দেখেই অভ্যস্ত।অন্যান্য অভিভাবকদের সাথে খুব একটা কথা বলতেন না শুধুমাত্র আমার ক্লাসমেট অদিতির মা ছাড়া।অদিতির মাও চাকরি করতেন।তাই তিনিও অদিতিকে গেটে ছেড়ে দিয়েই চলে যেতেন।
  একদিন বাবা আমায় স্কুলে পৌঁছে দিয়ে চলে যেতেই আমার মনে পড়লো ওয়ার্ক এডুকেশনের খাতাটা বাবার হাতের থেকে নিতেই ভুলে গেছি।দৌড়ে গেটের কাছে আসতেই দেখি স্কুল থেকে একটু দূরে বাবা আর অদিতির মায়ের সামনে একটা উবের এসে দাঁড়ালো।দুজনেই তড়িঘড়ি সেটাতে উঠে পড়লেন।আমি খাতার কথা ভুলে গিয়ে অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়েই রইলাম।সেন্ট্রিকাকু আমায় দেখতে পেয়ে আমার সামনে এগিয়ে এসে খাতাটা দিয়ে বললেন,
--- তোমার বাবার তাড়া ছিল তাই খাতাটা আমার কাছে দিয়ে গেছেন।এই নাও।
 সেদিন এই কথাটা আমি বাড়ি ফিরে মাকে বলতে পারিনি।কিন্তু পরদিন স্কুলে বাবা আমাকে পৌঁছে দেওয়ার পর আমি আগেরদিনের মত গেটে দাঁড়িয়ে সেই একই জিনিস দেখলাম।কিছু না বুঝলেও ওই আট বছর বয়সে এটুকুন বুঝেছিলাম বাবার সাথে অদিতির মায়ের একটা সম্পর্ক আছে।সেই সম্পর্কটা সেদিন বন্ধুত্বের ভাবলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আসল ঘটনাটা বুঝতে পারি।অদিতির সাথে বন্ধুত্ব করি।ওর কাছ থেকে ওর মা কোন অফিসে চাকরি করে জানতে পারি।বাবার ও অদিতির মায়ের একই অফিস।বাবা মাঝে মধ্যেই অদিতিদের বাড়িতে যান।অদিতির বাবা অন্য কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করে ওকে আর ওর মাকে ছেড়ে চলে গেছেন।এখন অদিতির মা ঠিক করেছেন অদিতিকে শান্তিনিকেতনে রেখে পড়াবেন।শুধু এই বছরটাই সে এই স্কুলে আছে।বাবার সাথে আস্তে আস্তে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে।আমি বুঝতে পারি বাবা অদিতির মাকে ভালোবাসে।কিন্তু এই কথা জানলে মা খুব কষ্ট পাবেন তাই সব কথা বললেও এই কথাটা বলতে পারিনি।
  এখন অধিকাংশ সময় বাবা বাড়িতে থাকলে মায়ের সাথে একটা চাপা ঝামেলা যে চলছে বুঝতে পারতাম।প্রথম প্রথম দেখেছি মা খুব কান্নাকাটি করতেন।বাবা,মায়ের শোয়ার ঘর যেদিন থেকে আলাদা হল সেদিন থেকে আমি মায়ের কাছেই শুতাম।বাবা কিন্তু রোজ ঠিক সেই আগের মতই নিয়ম করে আমায় স্কুল পৌঁছে দিতেন।আর আমারও একটা নেশার মত  দাঁড়িয়ে গেছিলো দুজনকে একসাথে উবেরে উঠতে দেখা।বাবার সাথে শুধু আমার নয় মায়েরও দূরত্ব বেড়ে গেলো ভীষণভাবে।বাবা বাড়িটা পুরো মায়ের নামে করে দিলেন।আমার নামে কিছু টাকা ফিক্সড করলেন তারপর আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে একদিন শুধুমাত্র একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কোন ঝামেলা মায়ের সাথে বা কোন কথা ছাড়ায়।শুধু আগেরদিন রাতে মা রান্নাঘরে থাকলে আমায় যখন কিছু বলতে শুরু করেছিলেন আমি তখন বাবাকে জানিয়েছিলাম,
--- আমি সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই জানি তুমি অদিতির মাকে ভালোবাসো।আমি মাকে বলিনি কারণ আমার কাছ থেকে মা একথা জানতে পারলে ভীষণ কষ্ট পাবেন।আর মাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।মা কষ্ট পেলে আমিও ভীষণ কষ্ট পাবো।
--- তুই এখন বড় হয়েছিস।তোর সাথে আমি সব কথায় শেয়ার করতে পারি।তোর মায়ের সবগুন আছে আমি স্বীকার করছি।কিন্তু আমি একটা পুরুষ মানুষ।আমার জীবনেও তো কিছু চাওয়ার থাকতে পারে।তোর মায়ের নর্মাল ডেলিভারী ছিলিস তুই।কিন্তু ডাক্তারের ভুলের ফলে আর তোর মায়ের প্রচণ্ড বিপি বেড়ে যাওয়ার ফলে রক্তের চাপে সেলাই ছিঁড়ে গিয়ে কিছুটা নাড়ি বেরিয়ে এসেছিলো।ডাক্তার সেই মুহূর্তে কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে গিয়ে হাত দিয়ে সেই নাড়ি ভিতরে প্রবেশ করায়।ঠিকভাবে সেগুলো প্লেস না হওয়ায় যৌণ জীবনে তোর জন্মের পর তোর মা অক্ষম হয়ে পড়ে।আর সেই থেকে তোর মা কোন ভারী জিনিস তুলতেই পারে না।
  আমি মাথা নিচু করে মায়ের দোষ শুনছিলাম আমার বাবার কাছ থেকে।কিছু বলার কোন মুখ আমার কোন পক্ষের হয়েই ছিল না।তখন মায়ের জন্য ভীষণভাবে কষ্ট হলেও পরে নিজের মনে ব্যাখ্যা করে দেখেছি প্রকৃতির নিয়মে বাবাকেও দোষ দেওয়া যায় না।পরদিন বাবা চলে যান তার নতুন জীবনে।
 আমার জীবনে এই কথাটা ছাড়া আজ পর্যন্ত কোন কথা মাকে কোনদিনও গোপন করিনি।আমাকে মানুষ করতে বা আমার বিয়ে দিতে মাকে কোন বেগ পেতে হয়নি কারণ সব ব্যবস্থায় বাবা করে বেরিয়েছিলেন।আমার মায়ের একটাই দোষ ছিলো যার জন্য তিনি মোটেই দায়ী ছিলেন না ; যা ভুল ছিল ডাক্তারের তবে ডাক্তারও তো মানুষ দেবতা নয়।ভুল তার হতেই পারে।তবে মা কোনদিন কাউকে একথা জানাতে পারেননি কেন তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন।শুধু কেউ জানতে চাইলে চোখ ভর্তি জল নিয়ে বোকার মত তার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন।কি করে তিনি বলবেন তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন তার একমাত্র কারণ তিনি তার স্বামীকে শারীরিক সুখ দিতে পারেন না।তিনি তার যৌনজীবনে অক্ষম।



সবকিছু কি বোঝা যায়

 সবকিছু কি বোঝা যায়

ভুল বুঝে,আমায় ভুলে ভালো থাকতে পারবে তো?আমি কোনদিনও মাথা নিচু করে এসে তোমার সামনে দাঁড়াবো না কথা দিলাম।কিন্তু যেদিন তুমি বুঝতে পারবে সব তোমার মনগড়া কল্পনা সেদিন পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে?
 উজান তার লাগেজটা গুছিয়েই যাচ্ছিল।এতক্ষন যে বিদিশা তার সাথে কথা বলে যাচ্ছে একটা কথারও কোন উত্তর উজান দেয়নি। ট্রোলি ব্যাগটাকে টেনে নিয়ে বারান্দায় রাখে।বিদিশা সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। আস্তে আস্তে মাথাটাকে পিছনের দিকে এলিয়ে দেয়।উজান ঘরের এদিক ওদিক থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি আর একটি ব্যাগে ভরতে থাকে।
 উজান আর বিদিশা কলেজে প্রথম বর্ষের থেকেই দুজন দুজনকে ভালোবাসে।দুজনেই এমটেক করেছে।উজান খুবই ব্রিলিয়ান্ট।সে কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই চাকরি পেয়ে যায়।উজান এবার বাড়িতে সবকিছু জানাতে চাইলে বিদিশা তাকে জানায় সে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত কোন কিছু তার পরিবারকে জানাবে না।কারণ সে জানে মায়ের কোন আপত্তি না থাকলেও বাবা তার মেয়েকে সাহার ঘরে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।তার প্রধান কারণ হচ্ছে বাবার এক বন্ধু অমিতকাকুর পদবী ছিল সাহা।আমিতকাকু বিদিশার বাবার কাছ থেকে প্রায় লক্ষাধিক টাকা ধার নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।কথা হয়েছিল ছ'মাস পর থেকে কিছু কিছু করে তিনি টাকা শোধ করবেন।বন্ধুত্ব ছিল দু'জনের মধ্যে প্রগাঢ়।কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো ব্যবসার আস্তে আস্তে উন্নতি হতে লাগলো আর অমিতকাকু বিদিশার বাবাকে একটু একটু করে এড়িয়ে যেতে লাগলেন।অর্থ,বৈভব,মানসম্মান কোনটাতেই বিদিশার বাবার অভাব ছিল না।তিনি এক,দু'বার টাকাটার কথা বলেছিলেন।কিন্তু অপরপক্ষ কোন সাড়াশব্দ না করায় বিদিশার বাবা রাগে,অপমানে আর সে টাকা কোনদিনও চাননি।আমিতবাবুও আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের বাঁধন থেকে আলগা হয়ে পড়েন।এরফলে পুরো সাহা পদবিধারি মানুষের প্রতিই তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে।
  কয়েক মাসের মধ্যেই বিদিশাও চাকরি পায়।মাকে দিয়ে বাবাকে সব কথা জানায় বিদিশা।বিদিশা যা ভেবেছিলো ঠিক তাই হল।উজানরা সাহা শুনেই তিনি বেঁকে বসলেন। কিন্তু মেয়ের জিদ আর অর্ধাঙ্গিনীর সওয়াল জবাবে তিনি নাজেহাল হয়ে মত দিতে বাধ্য হলেন।
 বেশ সুখেই চলছিলো বিদিশা আর উজানের সংসার।গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে উজানের বাবা,মা গ্রামেই থাকেন।উজান তাদের বারবার বলা স্বর্তেও গ্রামের খোলামেলা জীবন ছেড়ে তারা কিছুতেই কলকাতার বদ্ধ খাঁচায় আসতে রাজি নয়।সংসারে উজান আর বিদিশা।ভোরবেলায় কাজের লোক এসে রান্না করে দিয়ে যায় দুবেলার।দু'জনের অফিসের টিফিনটা রোজ বিদিশা নিজহাতে করে।বিদিশার অফিসটা একটু দূরে হওয়ায় তার মাঝে মধ্যেই ফিরতে একটু দেরি হয়ে যায়।উজান অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে রোজ অপেক্ষা করে বিদিশা ফিরলে একসাথে কফি খাবে বলে।কফিটা উজান নিজহাতেই করে।
 কিন্তু আজ কটাদিন ধরেই বিদিশার ফিরতে বেশ রাত হচ্ছে।রোজই বিদিশার সেই এক উত্তর "অফিসে প্রচণ্ড চাপ"-।সেদিন বিদিশার ফিরতে বেশ দেরি হচ্ছিল।বারবার ফোন করাতে সুইচ অফ শুনতে শুনতে উজানের মাথাটা গরম হয়েই ছিলো।তারউপর ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার ব্যালকনি থেকে সে দেখেছে মেরুন রঙের একটি গাড়ি থেকে নেমে সে গাড়ির ভিতরের কাউকে টাটা করছে।ব্যাস আগুনে ঘৃতাহুতি!কিছুক্ষণ পরেই বেলের আওয়াজ।চুপচাপ উপর থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিয়ে বেডরুমে ঢুকে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে যা এই একবছরের বিবাহিত জীবনে কোনদিন ঘটেনি।
 বিদিশা দু'কাপ কফি করে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দেখে উজান ঘুমিয়েই পড়েছে।সারাদিনের অফিসে খাটাখাটনির পর উজানের এই ঘুমিয়ে পড়া মুখটা দেখে বিদিশার খুব কষ্ট হয়।সে উজানের মুখের কাছে নিচু হয়ে আলতো করে উজানের কপালে একটা চুমু করে খুব মিষ্টি স্বরে ডাকে,কিন্তু উজান তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে,
--- বাইরে একজন আর ঘরের ভিতরে একজন
--- মানে?
--- মানেটা না বোঝার মত শব্দ তো বলিনি।রোজ রাত করে বাড়ি ফিরছো তা আবার অন্যের গাড়িতে।
--- সেটাই তো তোমায় আজ বলবো ।আগে তো কোনদিন গাড়িতে আসিনি।আজই প্রথম এলাম।
--- অতশত আমি জানি না। যা নিজের চোখে দেখলাম তাই বললাম। তা ভদ্রলোকটি কে?
--- কোন ভদ্রলোক?
--- আরে বাপরে মনেহচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছো না। যার গাড়ি করে এলে?
-- কি যা তা বলছো তুমি?তুমি কি আমায় অবিশ্বাস করছো?
--- বিশ্বাস করার মত আজকের কাজটা কি তুমি করেছো?
--- উজান,আমি তোমায় চিনতে পারছি না।
-- আমিও তো তোমায় চিনতে ভুল করেছি।
  এইভাবেই সেদিন দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ফলে ঝগড়া চরমে পৌঁছায়।কেউই সেদিন আর রাতে খায় না।উজান বেডরুম থেকে উঠে এসে ড্রয়িংরুমে শুয়ে পড়ে।আর বিদিশা সারাটা রাত বসেই কাটিয়ে দেয়।
  উজান উঠেই চলে যাওয়ার জন্য তোরজোড় শুরু করে।তার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু কথাকটি বলে চুপচাপ বিদিশা সোফায় মাথা পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে।সামান্য কারণে উজান যে সিনক্রিয়েট করেছে তাতে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার ইচ্ছা বিদিশার মন থেকে উড়ে গেছে।এই বিশ্বাস নিয়ে সে যে উজানের সাথে সারাটা জীবন কাটাতে পারবে না এটা বিদিশা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।
  সারাটা রাতের ক্লান্তি আর না ঘুমানোর ফলে বিদিশা সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকার ফলে ঘুমিয়েই পরে।সকালে কাজের দিদি রান্না করতে আসলে উজান তাকে দরজার কাছ থেকেই ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছে।
 হঠাৎ মাথায় একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে দেখে উজান তার পাশে বসে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর অদূরে দাঁড়ানো ওদের দুজনের কমন ফ্রেন্ড শ্রেষ্ঠা যার গাড়িতে গতকাল রাতে বিদিশা ফিরেছে। শ্রেষ্ঠা বিদিশার অফিসে গতকালই জয়েন করেছে।বড়োলোকের আদুরে মেয়ে।বাবার কেনা গাড়িতে করেই সে অফিসে যাতায়াত করে।গতকালই সে বদলি হয়ে বিদিশার অফিসে এসেছে।বিদিশার বাড়ি ছাড়িয়ে তাকে যেতে হয়।তাই শ্রেষ্ঠা বিদিশাকে কথা দিয়েছে রোজ তাকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে আর ফেরার পথে নামিয়ে দিয়ে যাবে।সেইমত সে অফিসে যাওয়ার আগে বিদিশাদের গেটের কাছে আসতেই দেখে উজান ব্যাগ নিয়ে উবেরের জন্য অপেক্ষা করছে। শ্রেষ্ঠার মুখ থেকেই সে গতকালের সমস্ত ঘটনা শোনে।দু'হাত জড়ো করে উজান বিদিশার কাছে ক্ষমা চায় শ্রেষ্ঠার সামনেই।বিদিশা উজানকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।
 শ্রেষ্ঠা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
--- আজ আর তোরা কেউ অফিস যাস না।দু'জন দুজনকে একটু সময় দে।আজ আমি চলি। কাল থেকে দুজনেই রেডি হয়ে থাকবি।
 শ্রেষ্ঠা বেরিয়ে যায়।ওরা কোন আপত্তি করে না 
উজান এবার উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে সোফার উপরে এসে বসে শ্রেষ্ঠাকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় ক্ষমা চেয়ে গতকালের সব রাগের প্রায়শ্চিত্ত করে শ্রেষ্ঠার শরীরের সমস্ত জায়গায় চুম্বনে চুম্বনে।রাগ আর অনুরাগ দু'জনের শরীর এক হয়ে মিলেমিশে যায়।
  
    

Saturday, May 7, 2022

ভালোবাসা কারে কয়

 ভালোবাসা কারে কয়
জীবনের সেরা একটা স্মৃতি ছিল সেই ট্রেন যাত্রা --- তিন পরিবারের সকলে মিলে পূর্বস্থির মত সন্ধ্যা ন'টা নাগাদ সবাই শিয়ালদহ স্টেশনে হাজির হলাম। মোট বারোজন আমরা।লাগেজ আমাদের সদস্য সংখ্যার প্রায় চারগুণ।নিদিষ্ট সময়ে ট্রেন দিয়ে দিলো।সকলেই হুটোপুটি বাঁধিয়ে দিলো।অথচ তখনো ট্রেন ছাড়তে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময়।আমার কাঁধে ঝুলানো ব্যাগের ভিতর হাত চালিয়ে আইডি কার্ডগুলো সকলের একজায়গায় করতে গিয়ে দেখি জ্বলজ্বল করছে এগারোজনের আইডি কার্ডের জেরক্স নেই শুধু আমারটাই।মাথায় হাত!সামনেই আমার অর্ধাঙ্গিনী বসে।আমার মুখের চেহারা দেখে কিছু তো একটা আন্দাজ করতে পেরেছে সে।নিজেকে যথাসম্ভব নর্মাল রাখার চেষ্টা করেও ধরা পড়ে গেলাম তার কাছে।বিয়ে করার সময় জানতাম সে একজন ওসির মেয়ে।কিন্তু তখন এটা বুঝিনি বিয়ের পর সে আমার সংসারের ওসির পদটি গ্রহণ করে আজীবন আমাকে দিয়ে চোখের ইশারায় কাজ করিয়ে নেবে।আমার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
--- কি গো কি হল?আমাদের আইডি কার্ডগুলো এনেছো তো?
বউয়ের এই গলার স্বর শুনে আজ দশ বছর ধরে আমি কেন যে তোতলা হয়ে যাই আজও বুঝলাম না।তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
--- না গো খুঁ জে পাচ্ছি না আমার টা
--- টেবিলের উপর বই দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছিলে।ঢোকাতে ভুলে গেছো?
 আবার সেই বড় বড় চোখ। আট বছরের ছেলে জানতে চাইলো,
--- তাহলে এখন কি হবে বাবা?
--- কি আর হবে ?তোমরা সবাই গিয়ে শিলিগুড়ি অপেক্ষা করবে আমি পরের ট্রেন ধরে আসছি।
ভগ্নিপতি শুনে এগিয়ে এসে বললো,
--- কিন্তু শালাবাবু তুমিই তো আমাদের গাইড।
--- কিচ্ছু করার নেই জামাইবাবু।তোমাদের টিকিট আর আইডি কার্ডগুলো এই তোমার কাছে দিয়ে যাচ্ছি ।কোন অসুবিধা নেই।শিলিগুড়ি স্টেশনে দেখা হচ্ছে।
 বউয়ের মুখের দিকে ভালোভাবে না তাকিয়েই বললাম,
--- চিন্তা করোনা।মাত্র দু'ঘন্টার ডিফারেন্স।আমি এক্ষুনি নেমে যাচ্ছি তোমরা সাবধানে থেকো।
  বাড়ি পৌঁছেই আইডি কার্ড নিয়ে লোকালে ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়লাম।শোয়া তো দুরহস্ত!একটু বসার জায়গা চাই।
    হ্যাঁ বসতে একটু পেরেছিলাম।বসেই ঝিমুতে শুরু করলাম।হঠাৎ পরিচিত একটি গলার স্বরে চমকে তাকিয়ে সামনে যাকে দেখলাম এভাবে তাকে কোনদিন দেখতে পাবো ভাবিনি।সে আমার প্রথম প্রেম,সে আমার প্রথম ভালোলাগা। যার কথা ভাবলে আজও আমার শরীর মন শিহরিত হয়।সেই করুণা।
 তখন আমার ফাস্ট ইয়ার।করুণার তখন উচ্চমাধ্যমিক।ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবেশে দুজনেই তখন আচ্ছন্ন।একদিন আমাদের চিলেকোঠার ঘরে করুণা আমার পিছন থেকে এসে ঝাপটে ধরেছিল।মুহূর্তে নিজের বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে করুণাকে সামনে এনে ওর ঠোঁট দুটি আলতো স্পর্শ করেছিলাম। আট বছরের এক সন্তানের পিতা হয়েও আজও সেই অনুভূতিতে শরীর ও মনে শিহরণ জাগে।তখন আমি বেকার।তাই করুণার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়।অসহায়ের মত দেখা ছাড়া সেই মুহূর্তে আমার কিছু করার ছিল না।
করুণাকে দেখে বললাম,
--- বহুদিন পর তোমার সাথে দেখা হল।কেমন আছো?কোথায় যাচ্ছ?
করুণা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- আরে রজতদা যে!তুমি কোথায় চললে? আমি তো আমার কর্মস্থলে চললাম।
---কর্মস্থল?
--- আমি শিলিগুড়িতে একটা স্কুলে চাকরি করি।মায়ের কাছে এসেছিলাম।
--- আর তোমার স্বামী?
 করুণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।দু'বছর সংসার করেছি।ক্যান্সার ধরা পড়েছিল।অনেক দৌড়াদৌড়ি করে তার চাকরিটাই পেয়েছি।তানাহলে হয়ত না খেয়েই মরতে হত।শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয়নি।কারণ স্বামীর মৃত্যুর জন্য নাকি করুণাই দায়ী।তাই অলক্ষ্মী বউকে বাড়ির বাইরে থাকতে হচ্ছে।
সারাটা রাত করুণা তার দুঃখের কাহিনী বলে গেলো আর রজত চুপ করে শুধু ভেবেই গেলো - বিধাতা কেন এত নিষ্ঠুর?মানুষ যা চায় তা পায় না আর যা পায় তা চায় না।তবে কেন জীবনের প্রথম বেলায় সেই মানুষগুলির সাথে এতটা ভালোবাসায় জড়িয়ে যায় যা আমৃত্যু মানুষ ভুলতে পারে না।