দিতে পারি অগ্নিপরীক্ষা (কল্পবিজ্ঞান)
অনেকদিন পর সজলের সাথে বিপাশার দেখা এক পার্কে।বিপাশা তার নাতিকে নিয়ে পার্কে এসেছে।নাতি রিন্টু মাঠের ভিতর ছুটাছুটি করছে।অনতি দূরে একটি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বিপাশা বসে নাতির তদারকি করছে।হঠাৎ এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক এসে তার পাশে বসে।ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে পড়তে শুরু করেন।বিপাশা তাকিয়ে দেখে ভদ্রলোকের দিকে।বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোকের চুলগুলো সব সাদা।পরনে সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা।অদ্ভুত এক মার্জিত চেহারা।দেখলেই ভিতর থেকে একটা শ্রদ্ধা ভাব জেগে ওঠে।ভদ্রলোক বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বইটি পড়ছিলেন।বিপাশা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তার বা কানে বেশ বড় একটা জরুল।বুকটা এই সাতচল্লিশ বছর বয়সেও কেঁপে ওঠে।হঠাৎ করে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত ত্রিশ বছর আগের ঘটনাগুলো যেন এক নিমেষে চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে খেলে বেড়াতে লাগলো।
বাড়ির পাশেই বাড়ি ছিলো সজলদের। সজলের তখন প্রথম বর্ষ আর বিপাশার মাধ্যমিক সবে শেষ হয়েছে। পারাতুতো সম্পর্ক বলে বিপাশা সজলকে সজলদা বলেই ডাকতো।পড়াশুনায় সজল,বিপাশা দু'জনেই খুব ভালো ছিল। সজলের পরীক্ষার পর বিপাশা সজলের নোটসগুলো নিজেই গিয়ে নিয়ে এসেছিল।কিন্তু সজল যখন নোটসের খাতাগুলো বিপাশার হাতে দিচ্ছিল তখন বিপাশা লক্ষ্য করেছিলো সজলের শরীরের সেই পরিবর্তন। বিপাশাও নিজেকে সামলাতে নোটস নিয়েই একছুটে বাড়ি চলে এসেছিল।
রাস্তা-ঘাটে যখন তখন সজলের সাথে বিপাশার দেখা হয়েছে।মামুলি হেসে পড়া ছাড়া তেমন কোন কথা কোনদিনও হয়নি।খুব মার্জিত চেহারা আর পড়াশুনায় খুব ভালো বলে বিপাশার সজলের প্রতি একটা ভালোলাগা কাজ করতো।কিন্তু আজ যখন খাতাগুলো দিতে গিয়ে সজলের সামান্য স্পর্শেই ওর শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায় আর ঠিক তখনই বিপাশা লক্ষ্য করে সজলের হাতের রোমকূপগুলো পুরো দাঁড়িয়ে গেছে, শ্যামলা বর্ণের মানুষটার মুখটা পুরো লাল হয়ে গেছে;তখনই বিপাশা বুঝে ফেলে স্পর্শে বিদ্যুৎ শকটা সে একাই খায়নি।
এমনিতেই বিপাশা পড়াশুনা আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে সব সময়।বন্ধুবান্ধব যা সবই স্কুলেই। কারো বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া বা গল্প করা ওর ঠিক পোষায় না।কিন্তু সেদিনের পর থেকে বিকেল হলেই বিনা কারণে রাস্তায় একাই একটু ঘোরাঘুরি করতো যদি সজলের সাথে ওর দেখা হয়।একদিন বিপাশা নিজেদের গেট থেকে কিছুটা এগিয়ে গেছে আর ঠিক তখনই কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে ওকেই তাড়া করেছে।পড়িমরি ছুটতে ছুটতে সজলদের গেট খোলা পেয়ে সোজা তাদের বাড়ির ভিতরে।
সজল একাই বাড়িতে ছিলো।সকলের মা ছিলেন না সেদিন।সজল বেরিয়ে এসে জানতে চায়
--- এত হাঁফাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?
বিপাশা হাঁপাতে হাঁপাতে তোতলাতে লাগলো কিন্তু কথা কিছুই বলতে পারলো না।সজল বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- ঘরে চলো,একটু জল খাও।তারপর শুনবো সব।
ওদিকে কুকুরের তাড়া খেয়ে প্রচণ্ড ভয় আর এদিকে সজলের সান্নিধ্যে বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস!সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তখন তার।বিপাশা ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে। সজল তাকে একগ্লাস জল এনে দেয়।জলটা ঢকঢক করে খেয়েই বিপাশা উঠে দাঁড়ায়।সজল এগিয়ে গিয়ে বলে ,
--- বোসো, কথা আছে ।
কি দেখে এত ভয় পেয়েছিলে ?
--- কুকুর তাড়া করেছিলো।
সজল হো হো করে হেসে ওঠে।
হাঁ করে বিপাশা সজলের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,
-- এভাবে হাসলে কেন?আমি ভয় পেয়েছি দেখে তোমার হাসি পেলো ?
সজল খানিকটা এগিয়ে এসে বিপাশার চোখের দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি বলে বসলো,
--- হাসলাম এখন যে কথাটা বলবো শুনলে তুমি যদি আরও ভয় পেয়ে যাও তাই মনেকরে।
--- কি বলবে তুমি আমায়?
--- যদি বলি সারাজীবন আমার হয়ে থাকতে ;রাজি হবে?
সজল সোজা তাকিয়ে বিপাশার মুখের দিকে বিপাশা চোখটা নামিয়ে নিলেও সজল বুঝতে পারছে বিপাশা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
--- না,চুপ করে থাকলে হবে না।আমার কথার উত্তর মুখেই দিতে হবে।
বিপাশা উঠে পালিয়ে যেতে চায়।সজল হাত ধরে টেনে তাকে বুকের কাছে নিয়ে আসে। সজলের জামার বোতাম খোলা পেয়ে বিপাশা বুকে আলতো করে চুমু করতে করতে আদর মাখানো গলায় অস্ফুট স্বরে বলে,
-- সব কথা মুখে বলা যায় না।কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।
সজল বিপাশার মুখটা আলতো করে তুলে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে,
--- এখানকার পড়ার পাঠ চুকিয়ে বিদেশে যাবো।আমার জন্য অপেক্ষা করবে কিন্তু।
এরপর দেখা,কথা,ঘুরে বেড়ানো আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বহু বহুবার হয়েছে।তারপর একদিন সজলের বিদেশ গমন।
বিপাশা মুখটা ভদ্রলোকের মুখের কাছে নিয়ে জানতে চায়,
--- সজল না ?
চকিতে সজল মুখ তুলে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- বিপাশা ?তুমি এখানে?কত খুঁজেছি তোমায় বাইরে থেকে এসে।কেউ বলতে পারেনি।শুধু একটাই কথা বলেছে বহরমপুরে বোনের শ্বশুরবাড়ির কাছে থাকে।সেই সূত্র ধরে এখানে আমার ফ্ল্যাট কেনা যদি কখনো তোমার সাথে দেখা হয়।
ইতিমধ্যে নাতি এসে বললো,
--- দিদি বাড়ি চলো।
সজল বিপাশার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বিপাশা উত্তর দিলো,
--- আমার নাতি। বিদিপ্তার মেয়ের ঘরের ছেলে।আমার খুব নেওটা।বলতে পারো আমার কাছেই থাকে।যাবে আমার ফ্ল্যাটে?
সজল মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ,
--- ফ্ল্যাটে কে কে আছেন?
--- গেলেই দেখতে পাবে।তবে হ্যাঁ তোমার বা তোমার বাড়ির লোকের আপত্তি থাকলে --
কথা শেষ হয় না বিপাশার।সজল উঠে দাঁড়ায়।মনেমনে ভাবে নিজের চোখেই দেখতে চাই কে কে ফ্ল্যাটে আছে।
কমপ্লেক্সের ভিতর ঢুকলে সজল অবাক হয়।কিন্তু নিজেকে সংযত রাখে।পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটের একটিতে বোন বিদিপ্তা আর পাশেরটাতেই বিপাশা।চুপচাপ এগিয়ে চলে সজল।নাতিকে বোনের জিম্মায় দিয়ে তালা খুলে ভিতরে ঢোকে।সামনেই ড্রয়িং।খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো।বিপাশা সোফা দেখিয়ে বলে, "বোসো"।যাওয়ার সময় এসিটা চালিয়ে দিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে দু'গ্লাস সরবত নিয়ে।
--- এসব রাখো বিপাশা।অনেক কথা আছে।কিছু জানতে চাই আবার অনেক কিছু বলতেও চাই।
পাঁচ বছর বাদে দেশে ফিরে জানতে পারলাম তোমাকে বিয়েতে রাজি করাতে না পেরে বিদিপ্তার বিয়ে দিয়ে দেন কাকিমা।বিয়ের বছর খানেকের মধ্যে তোমার মা চলে যান।তারপর ওই বাড়ি বিক্রি করে বিদিপ্তার অনুরোধেই তুমি তার শ্বশুরবাড়ির কাছে বাড়ি কিনে চলে আসো।পড়ে অবশ্য সে বাড়িও বিক্রি করে এই ফ্ল্যাট কেনো।আজকের দিনের মত ফোন না থাকায় যোগাযোগ আমাদের হয়নি ঠিকই কিন্তু আমাদের তো অনেক কমন ফ্রেন্ড ছিল কাউকে একজনকে তো তোমার ঠিকানাটা বলে আসতে পারতে?কেন নিজেদের জীবন থেকে এতগুলো বছর যেতে দিলে?
-- তুমি বিয়ে করোনি ?
--- কি মনেহয় তোমার আমাকে?জীবনের শুরুতেই তোমায় ভালোবেসেছিলাম সেটা এত ঠুনকো ছিলো?তুমিও তো বিয়ে করোনি তাহলে আমি যদি জানতে চাই কেন করোনি? দুটো নিষ্পাপ সরল মনের ভালোবাসা দুটো জীবনকে আজীবন বঞ্চিত করেই রেখে দিলো শুধুমাত্র তোমার ভুলের জন্য।
চোখ ভর্তি জল নিয়ে বিপাশা সজলের হাতদুটি ধরে বলে,
-- যা শাস্তি দেবে তারজন্য আমি মাথা পেতে সেই শাস্তি মেনে নেবো।
--- ঠিক তো?অনেকটা সময় জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ঠিকই বাকি জীবনটা একসাথে একই ছাদের তলায় থাকতে চাই।আর একটা কথা তোমায় বলি শোনো আজ একবছর হল আমি এই কমপ্লেক্সের ডি-ব্লকে আছি।এটা বিধাতারই ইচ্ছা।বিশ্বাস করো বা না করো ভাগ্য বলে একটা কথা আছে।সময় না হলে ভাগ্যের মিঠা ফল পাওয়া যায় না গো।আমার বাবা,মা অনেক আগেই চলে গেছেন আমি এখন একা। চলো বিদিপ্তার কাছে গিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তটা জানিয়ে আসি।
মধ্যবয়স্ক দুটি নরনারী অতীতে দেখা স্বপ্নের পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে না পারলেও নূতন করে স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিদিপ্তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
শেষ
নাম - নন্দা মুখার্জী
ঠিকানা -১০১৭, বেহালা বিজি প্রেস,কল - ৬০
ফোন - 9903518626
মেল - nanda.mukherjee26@gmail.com