নিভৃত যতনে
"সিঁড়ি দিয়ে তার খোলা চুলে আঁচল উড়িয়ে আসার দিনটা আজও বড্ড প্রিয় --" রিতিশার চলে যাওয়ার পর থেকেই আজও অন্নমনস্ক হলেই স্মৃতির সাগরে পাড়ি দেয় সুশোভন।কত কথা মনেপড়ে তার।সেই প্রথম দিন থেকে কাটানো রিতিশার তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।কোনদিনও সুশোভন ভাবতে পারেনি যে হঠাৎ ঝড়ের মত জীবনে এসে হঠাৎ করেই রিতিশা এইভাবে ছেড়ে চলে যাবে ।
পিতৃমাতৃহীন অগোছালো জীবনে খুব ভালো না হলেও মোটামুটি চলে যাওয়ার মত একটি চাকরি পেয়েছিল সুশোভন।সংসার করার ইচ্ছা তার ছিল না।কিন্তু রিতিশার গুনে মুগ্ধ হয়ে সে তাকে বিয়ে করে।মাত্র এক বছরের সংসার তাদের।প্রতিটা জায়গায় রিতিশার স্মৃতি।ঘর থেকে যেমন তার ব্যবহার্য কোন জিনিস সে চাইলেই সরিয়ে ফেলতে পারছে না ঠিক তেমনই মনের অলিন্দে তার যে স্মৃতিগুলি জমে আছে তাকেও মুছে ফেলতে পারছে না।
সারা বিশ্বের এই চরম দুর্দিনের সময় লকডাউনে সবাই যখন ঘরবন্দী তখন সুশোভন ও রিতিশাও ঘরে।অবশ্য দিনের একটা নিদ্দিষ্ট সময় সুশোভনকে ঘরে বসেই তার অফিসের কাজগুলি করতে হয়।বাকিটা সময় দুজন মিলে হাসি,ঠাট্টায়,গল্পগুজব করেই সময় কাটায়।দেশের এই চরম ভয়াবহ দিনে মানুষ যখন ঘরে বসে বসে বোর হচ্ছে রিতিশা আর সুশোভন ডাল, ডিম, আলুসেদ্ধ খেয়েই হেসে খেলেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে।
আজ সাতদিন। রিতিশা চলে গেছে সুশোভনকে ছেড়ে। সুশোভনের মনে পড়ছে রিতিশার সাথে দেখা হয় প্রথম দিনের কথা।স্টেশনে দুজনেই দাঁড়িয়ে ছিল।ট্রেন আসাতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।সুশোভন উঠতে পারলেও রিতিশা সবে মাত্র ছেড়ে দেওয়া ট্রেনটাতে ওঠার জন্য দৌঁড়াতে থাকে।সুশোভন ট্রেন থেকেই একটি হাত বাড়িয়ে দেয়।সুশোভনের বাড়ানো হাতটি ধরেই রিতিশা চলন্ত ট্রেনের পাদানিতে পা দেয়। বলিষ্ট চেহারার সুশোভন তাকে এক টানে ট্রেনের কামরায় তুলে নেয়।
সুশোভন লক্ষ্য করে পুরো ট্রেন যাত্রী তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।সুশোভনও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।কিন্তু কি করবে সেও বুঝে উঠতে পারেনা।নিজের মুখটা একটু উপরের দিকে তুলে নিয়ে রিতিশার উদ্দেশ্যে বললো,"আপনি ট্রেনে উঠে পড়েছেন,এবার আমায় ছাড়ুন।"রিতিশা দুইহাতে আঁকড়ে ধরে সুশোভনের বুকে যে মুখ লুকিয়ে ছিল তা বোধকরি এতক্ষণ তার খেয়াল ছিল না।সুশোভনের কথায় তাকে ছেড়ে দিয়ে মুখটা নীচু করে বললো,"সরি, সরি আসলে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।অথচ এই ট্রেনটা মিস করলে ঠিক সময়ে বাড়িতে পৌঁছাতে পারতাম না।"
--- কিন্তু এতটা রিস্ক না নিলেই পারতেন।একটু দেরি করে বাড়ি পৌঁছালে এমন কোন ক্ষতি হত না।
--- আসলে বাবার ওষুধটা স্থানীয় দোকানগুলিতে পাইনি।ওখান থেকে বললো কলকাতা ছাড়া পাওয়া যাবে না।তাই দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসি।বাবা ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই।
এইভাবেই রিতিশা ও সুশোভন পরস্পরের কাছাকাছি আসে। রিতিশার বাবা চলে যাওয়ার অনেকদিন পর সুশোভন এসেছিলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে রিতিশার কাছে।সুশোভনের আসার খবরটা রিতিশার জানা থাকলেও কারণটা ছিল অজানা।গেট খুলেই রেখেছিলো রিতিশা সিঁড়ির নিচুতে দাঁড়িয়ে সুশোভন খুব জোড়ে সেদিন রিতিশাকে ডেকেছিল। রিতিশা তখন সবে স্নান করে এসে চুল আচড়াছিল।সুশোভনের ডাক শুনে রিতিশা তার খোলা চুল আর খোলা আঁচলে ছুটতে ছুটতে সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নিচুতে নেমে এসেছিল।আর মন্ত্রমুগ্ধের মত সুশোভন তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
কটা দিন ধরেই খুব কাশিতে কষ্ট পাচ্ছিল রিতিশা।সাথে মাঝে মধ্যে গা টা সামান্য গরম।ডাক্টার টেস্ট করতে দিলেন।করোনা পজেটিভ।দিন পাঁচেকের মধ্যেই সব শেষ।শেষ মুহূর্তে সুশোভন তার মুখটাও দেখতে পারেনি।
No comments:
Post a Comment