Wednesday, May 19, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩৬)

সুখের ঘরে আগুন (৩৬)

   প্রমিতার বাড়িতে গিয়ে ফুটফুটে ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে তাকে আদর করতে শুরু করে নিলয়।মুখে ভাতে বাবা,মা এসে তাকে আংটি দিয়ে আশীর্বাদ করে গেছিলেন।সে কিন্তু তার আদরের বোনপোটির জন্য একগাছা সোনার হার নিয়ে তাকে দেখতে গেছে।মামা বলে কথা!বেশ গল্পগুজব চলতে থাকে তাদের মধ্যে।হঠাৎ রিতেশ বলে,
--- ভায়া,বুড়ো হতে তো আর বেশি দেরি নেই। তা এবার তো সংসারী হতে হবে।
--- চিন্তা কোরো না। গাছে ঢিল বেঁধেছি ;খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের মনের আশা পূরণ হবে।
--- তা নিজেই পছন্দ করলে? ছাদনা তলায় যাওয়ার আগে সেই সোনামুখীকে আমাদের একটু দেখাবে না?
--- সে দেখতে পারবে। কটাদিন একটু অপেক্ষা করো ধর্য ধরো।
--- একটু বলো না ভায়া কিভাবে তার সাথে মাখোমাখো হলে?আগে নিজে দোলা খেলে নাকি আগেই তাকে দোলা দিলে?
--- বলবো বলবো।গল্প অনেক।একদিন সব জানতে পারবে।ভাঙ্গা কপালটা এবার জোড়া লাগবেই আশাকরি।
  বহুদিন পর শালা,ভগ্নিপতি মন খুলে বেশ ইয়ার্কি ঠাট্টা মারা হল।ওদের আলোচনার মাঝেই প্রমিতা উঠে চলে যায় তার ছেলেকে ব্রেষ্ট ফিডিং করাতে।ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে যখন এ ঘরে আসে তখন নিলয় আর রিতেশ যে পজিশনে খাটে বসে গল্প করছিলো ঠিক সেই পজিশনেই দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রমিতা ওদের আর ডিস্টার্ব না করে ছেলের পাশে গিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
  ফেরার সময় বোন,ভগ্নিপতি মিলে বার কয়েক বলে দিলো যাতে উঠবি বৌদিকে নিয়ে সে অন্তত বিয়ের আগে একবার তাদের বাড়ি আসে।নিলয় তাদের কথা দেয় পরেরবার এসে নিশ্চয় তাকে সাথে করে নিয়ে আসবে।ফিরতি পথে চলন্ত উবেরের ভিতর বসে তার অন্তরে এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করতে থাকে।অনেকদিন পর রিতেশের সাথে মন খুলে আড্ডা দিয়ে মন ও মেজাজ দুটোই বেশ ফুরফুরে হয়ে যায় তার।হঠাৎ তার মোবাইলটা বেজে ওঠে। মোবাইলটা পকেটে বের করে দেখে নিখিলেশ তাকে ফোন করেছে। নিখিলেশ মাঝেমধ্যে ফোন করে তাকে।সে ভুবনেশ্বর থাকতেও করে বা কলকাতায় আসার পরেও বেশ কয়েকবার নিখিলেশের সাথে তার কথা হয়েছে।মাত্র অল্প কয়েকদিনেই নিখিলেশ আর নিলয় বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে।এখন তারা আর 'তুমি' নয় তারা পরস্পরকে তুই তুকারি করেই কথা বলে।অফিস টাইমে কারো হাতে যখন কোন কাজ থাকে না তখন দুজনে এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে শুরু করে।নিখিলেশ মাঝে মধ্যেই অফিস ছুটির পরে নিলয়ের কোয়ার্টারে চলে আসে কারণ নিলয়ের কোয়ার্টারটা অফিসের অনেকটাই কাছে।রাতেও সেখানে থেকে অনেক রাত অবধি গল্পগুজব চলে।বেশ ফুরফুরে মেজাজের সময় নিখিলেশের ফোনটা পেয়ে সে খুবই খুশি হয়ে গেলো।হ্যালো বলতেই নিখিলেশ তাকে জানালো সে একটা বিশেষ কাজে কলকাতা এসেছে।
--- কোথায় এখন?
--- সবে নামলাম ট্রেন থেকে।
--- এখন তো আর হোটেলে থাকা যাবে না।এই গরীব বন্ধুর বাড়িতে পদধূলি দিতেই হবে।(বলেই নিলয় হাসতে লাগলো)
--- আমি এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি কলকাতা এলে।তবে আমরা দুজনে ফিরবো কিন্তু একই সাথে।সেইভাবেই আমার টিকিট কাটা।
--- তুই আত্মীয়কে ফোন করে বলে দে যাওয়ার আগে দেখা করে যাবি।ওখান থেকে একটা উবের নে,আমি অ্যাড্রেস বলে দিচ্ছি।
--- কিন্তু ওখানে ---- 
--- আরে কোন কিন্তু নয়।আমি মাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি তুই আসছিস।মা,বাবা দুজনেই খুব খুশি হবেন।কারণ তোর কথা তাদের কাছে আমি অনেক গল্প করেছি।আর অচলাকেও দেখবি সে কত স্মার্ট হয়েছে,পড়াশুনায় মন দিয়েছে।
  নিখিলেশ মনেমনে ভাবে এবার একটু তাড়াতাড়িই কলকাতা আসার উদ্দেশ্যই অচলাকে দেখা।সেই এক রাতে সামান্য সময়েই অচলা যে তার হৃদয়ে অনেকটাই জায়গা করে নিয়েছে সে কথা কাউকে না বলতে পারলেও নিজের হৃদয়কে তো ফাঁকি দিতে পারেনি।আর এটা জানতোই তার কলকাতা আসার খবর পেলেই নিলয় তাকে তার বাড়িতেই উঠতে বলবে।
 উবের এসে নিলয়দের রাস্তার মোড়ে দাঁড়াতেই নিলয় এগিয়ে যায় তার দিকে।সে গাড়ির ভিতর থেকেই মাকে ফোন করে ঘরে না ঢুকেই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে অম্বিকার সাথে ফোনেo কথা বলছিলো।নিখিলেশকে দেখতে পেয়েই সে ফোনটা কেটে দিয়ে তাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে।বাবা,মা দুজনেই তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।আর রান্নাবান্না শেষ করে অচলা তখন নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত।দরজা খোলাই ছিল।তাই কোন আওয়াজ অচলার কানে পৌঁছায়নি।সে একমনে পড়ার টেবিলে বসে পড়াশুনা করে যাচ্ছিলো।তাকে বলায় আছে সে যখন পড়াশুনা করবে যেন দরজাটা ভেজিয়ে রাখে।মলিনাদেবি নিজে উঠে গিয়ে চা করে আনেন। নিখিলেশের উৎসুক চোখদুটি এখানে আসার পর থেকেই অচলাকে খুঁজে চলেছে।কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহসটা করে উঠতে পারছে না।গল্পগুজব বেশ জোর কদমেই এগিয়ে চলে। নিখিলেশের ব্যাকুল চোখদুটি ঘরের চারিদিকে বারবার কি যেন খুঁজে চলেছে।হঠাৎ নিলয় বলে উঠলো,
--- মা,তোমার মেয়ে মনেহয় টের পায়নি আমরা বাড়িতে এসে গেছি। টের পেলেই কিন্তু পড়াশুনা পিছনে ফেলে এসে আতিথেয়তা শুরু করে দিত।
মলিনাদেবি ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলে উঠলেন,
--- একদম ঠিক কথা বলেছিস।কোন কাজ পেলেই হয়।আমাকে তো কিছুই করতে দেয় না।আজকাল তো বাজারেও যাওয়া ধরেছে।হাজার বারণ করলেও শুনছে কে?ঘড়ি ধরে ঠিক দশটায় উঠে আসবে।তোর বাবার ওই সময় একটা ওষুধ খাওয়ার সময় যে।খাওয়াদাওয়া,ওষুধ কোন কিছুর সময় এদিক থেকে ওদিক হতে দেবে না।তারউপর আছে আবার শাসন।
 কথাগুলো বলে তিনি হাসতে লাগেন।নিখিলেশ অবাক হয়ে শোনে অচলা কিভাবে এদের সকলের হৃদয় জয় করে নিয়েছে।কিন্তু পাছে দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাই অচলার আলোচনায় সে অংশগ্রহণ করে না।সেখানে নরেশবাবুও উপস্থিত ছিলেন।এবার তিনি বললেন,
--- কিন্তু মলি এটা তো তুমি বললে না ;সে কিন্তু সবকিছুর মাঝেও কখনোই পড়াশুনার ব্যাপারে ফাঁকি দেয় না।সব সময় তার একটাই কথা দাদা আমাকে যে সুযোগটা দিয়েছে তাকে কাজে লাগাতেই হবে।আমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে সব থেকে খুশি হবে দাদা।
--- এমনভাবে সে বাবা, মা,দাদা বলে ডাকে কখনোই মনে হয় না আমরা তার নিজের কেউ না। জানো নিখিলেশ,মেয়েটার ভিতর অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে অন্যকে আপন করে নেওয়ার।এই পড়াশুনা কাজকর্ম সবকিছু নিখুঁতভাবে করার পড়েও আমাদের সেবা যত্নের কোন ত্রুটি সে রাখে না।নিজের মেয়ে থাকলেও বোধহয় এতটা সে করতো না।সত্যিই এই বয়সে এসে অচলার মত একটি মেয়ে পেয়ে এই বুড়োবুড়ির আর একাকিত্বে ভুগতে হয় না।নিলয় এখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার পর আমাদের তো পাগল পাগল অবস্থা হয়ে গেছিলো।কিছুতেই সময় কাটতো না।তোমার মেসোমশাই সন্ধ্যায় বাইরে আড্ডা মারতে বেরিয়ে গেলেই আমার মাথাটা আরও গরম হয়ে যেত।সময় যেন কাটাতাম দুজনে ঝগড়া করেই।হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন মলিনাদেবী ।
 এদিকে অচলা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় দশটা বাজতে চললো।"মা,এত রাত হয়ে গেলো দাদা তো এখনো তার বন্ধুকে নিয়ে এলো না ----"বলতে বলতে সে ডাইনিং কাম ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখে সবাই বেশ আলোচনায় ব্যস্ত।
মলিনাদেবী বললেন,
--- ওই দেখ আমি বললাম না দশটা বাজলেই উনি উঠে আসবেন বাবার ওষুধ দিতে।
--- দাদা কখন এসছে সেটা তোমরা আমাকে জানাওনি?কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে অচলা।
নিখিলেশ অচলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আসলে তুমি পড়ছিলে তো তাই কেউ আর তোমাকে ডিস্টার্ব করেনি।তুমি কেমন আছো?
--- জীবনে কোনদিন ভাবতেই পারিনি যে আমি এত ভালো থাকতে পারবো।দাদা আমাকে একটা সুন্দর জীবন দিয়েছে।বাবা,মা দিয়েছে।বাবা,মায়ের স্নেহ ভালবাসা কোনদিন পাইনি।আর এখানে না এলে জানতেই পারতাম না সেই স্নেহ ভালোবাসা কেমন হয়।আপনি কেমন আছেন?
--- আমি ভালো আছি।
--- ওরে নিখিল (নিলয় এখন এই নামেই ডাকে নিখিলেশকে) ওর সাথে কথায় পেরে ওঠা ভীষণ মুস্কিল।কথা খুব গুছিয়ে বলতে পারে।
--- মা দাদা কিন্তু আবার আমার পিছনে লাগলো।
  নিখিলেশ সবকিছু দেখছে ,শুনছে আর মনেমনে ভাবছে একটা অচেনা মেয়েকে কিভাবে একটা পরিবার আপন করে নিয়েছে।অবশ্য এই কয়েক মাসে নিলয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই সে নিলয়ের কথাবার্তা,ব্যবহারেই বুঝতে পেরেছে তাদের পরিবারটা কত ভালো।"গাছের পাতা দেখেই বোঝা যায় গাছটি কেমন ফল দেবে"-- গুরুজনেরা কথাটা ঠিকই বলেন।

ক্রমশঃ 


      

No comments:

Post a Comment