Sunday, May 23, 2021

দ্বন্দ্ব

দ্বন্দ্ব

  'কবিতা ' সিনেমাটা ছোটবেলা থেকেই খুব প্রিয় ছিল দেবারতির।কিন্তু কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি নায়িকা মালা সিংহার মত তার জীবনটা হয়ে যাবে।চার ভাইবোনের মধ্যে দেবারতি ছিল সকলের বড়।বাবা ছিলেন বেসরকারি কোম্পানির মোটা মাইনের সুচাকুরে।মা গৃহবধূ হলেও খুব সুন্দর গান গাইতেন।দেবারতির মা মালতীদেবী যখন গান গেয়ে একটু একটু নাম করতে শুরু করেছেন তখন তার বাবা অর্থাৎ দেবারতির দাদু তার বিয়ে দিয়ে দেন।বিশাল বড় একান্নবর্তী পরিবারে এসে সবকিছু ভুলে সংসার নিয়েই থাকেন বা থাকতে বাধ্য হন। সুরেশবাবু চেষ্টা করেছিলেন তার স্ত্রীকে আবার গান ধরাতে।কিন্তু মালতিদেবির শ্বাশুড়ী অশান্তি এমন চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন যে ঘরের চালে কাকও বসতো না।তাই প্রথম সন্তান দেবারতির মধ্য দিয়েই তিনি নিজের শখ মেটাতে চেয়েছিলেন।শ্বাশুড়ীর আপত্তি তখন ধোপে টেকেনি।
 দেবারতি যখন কলেজে পড়ে তখন সুপ্রিয়র সাথে পরিচয়।তারপর দুজনের মন দেওয়ানেওয়ার পালা।মালতিদেবি ও সুরেশবাবু মেনে নেন এই সম্পর্ক।তখন সুরেশবাবুদের সেই বিশাল একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো।ভায়েরা সব আলাদা।পারিপারিক অনুষ্ঠান ছাড়া কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় না।যে যার পরিবার নিয়েই ব্যস্ত। সাতভাই আর তিন বোনের মধ্যে আজ অনেকেই নেই।
 সুরেশবাবু মেয়েকে বলেন সুপ্রিয়কে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসতে তিনি কথা বলতে চান।দুজনেরই গ্র্যাজুয়েশন সবে শেষ হয়েছে।দেবারতি গান নিয়েই আছে।প্রচুর ফ্যাংশনে সে এখন গান গাওয়ার সুযোগও পায় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।সুপ্রিয় চাকরির চেষ্টা করছে।বাবার কথামত সে একদিন সুপ্রিয়কে বাড়িতে নিয়ে আসে।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সুপ্রিয়র সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎই সুরেশবাবু অসুস্থ্য হয়ে পড়েন।সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু শেষরক্ষা হয় না।সকলকে ছেড়ে তিনি চিরতরে চলে যান।
  ছোট তিন তিনটি ভাইবোনের সব দায়িত্ব এসে পড়ে দেবারতির উপর।তার উপর আছে সংসার।চাকরির চেষ্টা করতে শুরু করে।রাতদিন গানের টিউশনি করে বেড়াতে লাগলো।মালতিদেবি পুরো নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।দেবারতির মনের ভিতর একটা দ্বন্দ্ব সবসময় কাজ করতো।বাবা তো সুস্থ্য স্বাভাবিকই ছিলেন।সুপ্রিয় যেদিন আসলো সেদিনই তিনি চলে গেলেন।মন সায় দেয় না তবুও বিষয়টা ভাবতে বাধ্য হয়।সে আস্তে আস্তে সুপ্রিয়কে এড়িয়ে যেতে শুরু করে।সুপ্রিয়ও বিষয়টা বুঝতে পারে।কিন্তু তার ভিতরেও একটা প্রশ্নচিহ্ন রয়েই যায়।অদ্ভুত,অজানা এক কালো হাত দেবারতি ও সুপ্রিয়র সম্পর্কটাকে দিনকে দিন দূরত্ব বাড়িতেই চলে।
  সুপ্রিয় চাকরি পেয়ে যায় ব্যাঙ্গালোর।খবর দিতে এসে দেবারতিকে বলে,
--- সারাজীবন অপেক্ষায় থাকবো।যদি কোনদিন সংসারের দায়িত্ব আর নিজের মনের দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারো আমায় জানিও।ছুটে চলে আসবো তোমার কাছে।
 এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর।দুই ভাই আর এক বোন সকলেই যে যার জীবনে প্রতিষ্ঠিত।দেবারতির এখন অনেক বড় গানের স্কুল।বেশ ভালো রোজগারও হয়।ক্যান্সার পেশেন্ট মা এখন।বোন শ্বশুরবাড়ি।স্কুল টিচার সে এখন।ভায়েরা বিয়ে করে যে যার মত আলাদা।কারো হাতে বিন্দুমাত্র সময় নেই দেবারতি আর মায়ের খবর নেওয়ার।বোন মাঝে মধ্যে এসে অবশ্য মাকে দেখে যায়।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘরে ফিরে অসুস্থ্য মায়ের পাশে শুয়ে যখন ঘুমানোর চেষ্টা করে তখন সুপ্রিয়র মুখটাই শুধু চোখের সামনে ভেসে ওঠে।মা চুপ করে থাকতে থাকতে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় দিনান্তে তিনি একটা কথা বলেন কিনা সন্দেহ।সেদিন দেবারতি তার পাশে শুয়ে একটা হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।মালতিদেবিও তার একটি হাত মেয়ের মাথায় রাখেন।
--- কিছু বলবে মা?
--- সুপ্রিয়র বিয়ে হয়ে গেছে?
--- জানিনা মা ---
তিনি চুপ করে গেলেন।দেবারতি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জানতে চাইলো,
-- কেন জানতে চাইলে বললে না ?
 একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে ' কিছু না ' বললেন।সেদিন ঘুমের মধ্যেই মা চলে গেলেন।ডক্টর ছ মাস সময় দিয়েছিলেন তিনি চলে গেলেন চার মাসের মাথায়।ভাই এবং ভাইবৌয়েরা এত কান্নাকাটি করলো মনে হচ্ছিলো তাদের বুক ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে মা চলে যাওয়াতে।বোন এসে একদিন ছিল দিদির কাছে।
 দেবারতি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলো।এখন যেন আরো বেশি করে সুপ্রিয়র কথা মনেহয় তার।কাজকর্ম মিটে যাওয়ার দুদিন পর হঠাৎ সুপ্রিয় এসে হাজির।অনেক কথার মাঝে সুপ্রিয় দেবারতিকে বললো,
--- মানুষ তার আয়ু নিয়েই জন্মায়।কারো জন্যই কারো জীবন চলে যেতে পারে না।যদি কেউ কাউকে খুন করে তাহলে সেটা অন্য ব্যাপার।আমি যদি সেদিন নাও আসতাম মেসোমশাইয়ের অঘটনটা ঘটতোই ।কোনদিন মুখ ফুটে কথাগুলি বলোনি আমায়।কিন্তু আমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কারণটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম বলেই নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।কারো মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করা মানে তাকে এক কথায় খুনি ভাবা।আমি আজও প্রতীক্ষায় আছি।বাকি জীবনটাও থাকতে রাজি।
 কান্নায় ভেঙে পরে দেবারতি।সুপ্রিয় এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত রাখে



No comments:

Post a Comment