সংসার কাহন (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)
সুনীলের মা সেই যে হাসপাতাল থেকে নাতনিকে সাথে করে মেয়ের বাড়িতে গেছেন তারপর থেকে আজ প্রায় 6 মাস সেখানেই তিনি রয়েছেন।এখানে আসার কোন নাম গন্ধ নেই। নন্দিতার সংসারে তার স্বামী এবং দেওর তাকে যথেষ্ট সহায়তা করে। সুনিল মাকে এ সম্পর্কে কোনো কথা না বললেও দেবেশ মাঝেমধ্যেই মায়ের সাথে প্রচন্ড ঝামেলা করে।কথা বলাও বন্ধ থাকে দু একদিন।দেবেশ রাগ করে তখন আর ফোন করে না।দু একদিন কেটে গেলেই মা খবরাখবর নেওয়ার জন্য কখনো কখনো দেবেশের সাথে নিজেই ইচ্ছে করে ফোন করেন।
নন্দিতার হেলপিংহান্ড পরমা খুব ভালো মেয়ে।সে নন্দিতাকে মাঝেমধ্যে রান্নাতেও সাহায্য করে থাকে। নন্দিতাও তাকে নানান ভাবে সাহায্য করে।তার ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে আসলে নন্দিতাকে তাকে দেখতে বলে সে রান্নাবান্নার দিকটা সেদিন সামলে দেয়।নন্দিতা নানানভাবে মেয়েটিকে আর্থিক সহায়তাও করে।কিন্তু সুনীল বা নন্দিতা কেউই এই এতগুলি মাস ধরে মাকে এখানে আসার কথা বলেনি।সেটা রাগে হোক বা অভিমানে। তখন এই ভাবেই চলছিল।এরই মধ্যে নন্দিতার একদিন লেবার পেইন ওঠে।সুনীল তখন অফিসে।ভাগ্যক্রমে দেবেশ সেদিন দুপুরে বাড়িতেই ছিল। দেবেশ তার দাদাকে ফোন করেই মাকে ফোন করে এবং বৌদির কথা জানায়।মা দেবেশ কে জানান,
--- আমি তো ডাক্তার নই তোর বৌদির পেইন উঠেছে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যা,আমি গিয়ে কি করবো?
দেবেশ রাগ করে ফোন কেটে দেয়।সে তার বৌদিকে নিয়ে হাসপাতাল পৌঁছায়। ইতিমধ্যে সুনীল সেখানে হাজির হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে অপেক্ষারত সুনীল, দেবেশ, আর নন্দিতার বাপের বাড়ির লোকজনের কাছে খবর আসে সুন্দর ফুটফুটে একটি ছেলে হয়েছে নন্দিতার।দারুন দেখতে হয়েছে; সাড়ে তিন কিলো তার ওজন হয়েছে।মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুল।তাকে দেখে সকলের মনে হচ্ছে যেন এক রাজপুত্র নন্দিতার কোল আলো করে এসেছে।সঙ্গে সঙ্গেই সুনীল মাকে ফোন করে জানায়।
ছেলে হওয়ার পর দ্বিতীয় দিনে নন্দিতার শ্বাশুড়ী তাকে দেখতে আসেন হাসপাতালেই।নন্দিতা তখন জানতে চায়,
--- মা আপনি কবে বাড়ি ফিরবেন?এখন তো আপনার নাতি এসেছে। আপনাকে তো এখন বাড়িতে ফিরতে হবে।
---কি করে ফিরব বলতো বৌমা?এই তো কদিন পরেই না দিদিভাইয়ের আমার মুখে ভাত।ভাবছি মুখেভাতটা হয়ে গেলে একবারেই বাড়ীতে ফিরে যাবো।আর তাছাড়া আমি চলে গেলে রেখা একাএকা বাচ্চা সংসার দুটো যে কী করে সামলাবে সেই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি।
---- কিন্তু মা এক মাস তো আমাদের আতুর থাকবে।আমি তো কিছু করতে পারবোনা এই সময়।আপনি বাড়িতে না গেলে আপনার ছেলেদের যে খুব অসুবিধা হবে।
---না না বৌমা এক মাস নয়;ছেলে হলে 21 দিন আতুর থাকে। তুমি এক কাজ করো তোমার মাকে এই সময় তোমার কাছে এনে কিছুদিন রাখো। তিনি তার নাতি আর মেয়েকে এই কটাদিন এসে একটু দেখাশোনা করবেন।
নন্দিতা আর কথা বাড়ায় না। যথাসময়ে নন্দিতা বাড়ি ফিরে আসে ছেলেকে নিয়ে।নিজের মাকেও খবর দিয়ে নিজের কাছে এনে রাখে।এছাড়া তার কাছে কোন উপায়ও ছিলোনা।সুনীল এবং দেবেশ নানান ভাবে সাহায্য করতে থাকে।পরমা আরো বেশ কয়েক ঘন্টা নন্দিতার সংসারের আটকে যায়।তবে এটা সে করে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাতে নন্দিতাকে ভালোবেসে।
এদিকে দেখতে দেখতে রেখার মেয়ে ঋষার মুখেভাতের দিন এগিয়ে আসে।কিন্তু সেদিন সকালে ঘটে এক বিপত্তি!নানান আত্মীয়-স্বজনের সমাগমে যখন সকলেই গল্পগুজব,হাসিঠাট্টায় মত্ত ঠিক সেই সময়েই মেঝেতে পড়ে থাকা জলে পা পিছলে পড়ে যান রেখার মা।সুনীল সকলেই বোনের বাড়িতে পৌঁছে গেছে।দেবেশ বেলায় আসবে।মায়ের পায়ে প্রচণ্ড চোট লাগে ,তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন।সুনীল মাকে নিয়ে হাসপাতাল ছোটে।ভাইকে ফোন করে বলে দেয় সে যেন ঋষার মুখে ভাত দিয়ে দেয়।নন্দিতার কাছে মায়ের অসুস্থতার কথা গোপন রাখা হয়।হয়তো তার কোন কারণ ছিল না কিন্তু সুনীল তার ভাইকে সে কথাই জানায়।
মায়ের গোড়ালীর ছোট একটি হাড় ভেঙ্গে যায়। পনেরদিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।সুনীল একাই অপারেশনের ধাক্কাটা সামলে নেয়।সাথে অবশ্য তার শ্বশুরমশাই ছিলেন সেই রাতে।দেবেশ সেদিন ভাগ্নির মুখেভাত দিয়ে যখন চলে আসতে যায় তখন রেখা আর তার ভগ্নিপতি অনেক কাকুতিমিনতি করে তাকে বিকেল অবধি থাকতে বলে।সে যখন রেখার বাড়ি থেকে হাসপাতাল পৌঁছায় তখন তার মাকে ওটি থেকে বের করে বেডে দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু জ্ঞান তখনও ভালোভাবে আসেনি।পরদিন অবশ্য ভগ্নিপতি সকলেই হাসপাতাল পৌঁছে গেছিলো।
যেদিন মাকে ছাড়া হবে রেখা ফোন করে দাদাকে বলে,
--- দাদা তুই মাকে বাড়িতেই নিয়ে যাস।আমি তো মা আর ঋষা দুজনকে সামলাতে পারবো না।
--- সে তুই না বললেও আমি মাকে এখন বাড়িতেই নিয়ে যেতাম।
নন্দিতার মা তখনো নন্দিতার কাছেই।তিনি সুনীলের মাকেও দেখাশুনা করতে লাগেন।ইতিমধ্যে নন্দিতাও সুস্থ্য হয়ে ওঠে।সুনীলের মায়ের পায়ে প্লাস্টার সুতরাং তিনি সবসময় শুয়েই থাকেন।দেবেশ ও সুনীল বেরোনোর আগেই তারা দুজনে মিলে মায়ের মাথা ধুয়ে গা স্পঞ্চ সহ বাকি কাজগুলি করেই বেরোয়।তারপরের কাজগুলি নন্দিতা এবং তার মা মিলেই করে।হঠাৎ নন্দিতার বাবার শরীর খারাপ হওয়াতে তিনি বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হন।নন্দিতা ওই দুধের শিশুটিকে নিয়েই শ্বাশুড়ীর সেবাযত্ন আর সংসারের কাজ করে চলে।পরমা এখনো আছে।তার কাজের পরিমাণ বাড়াতে নন্দিতা নিজে থেকেই তার মাইনেটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
একদিন দুপুরে যখন তার শ্বাশুড়ীকে খাটের উপরেই খেতে দিয়েছে তখন অসতর্ক বশত মাছের ঝোলের বাটিটা চাদরের উপর পড়ে যায়।তিনি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।নন্দিতা দেখতে পেয়ে বলে,
--- আমি আপনাকে আবার ঝোল এনে দিচ্ছি।আর আমি পরিষ্কার করে দেবো।আপনি এত নড়াচড়া করবেন না। পায়ে লেগে যাবে।
শ্বাশুড়ী চোখ ভর্তি জল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলেন,
--- ছেলে দুটো খেয়ে বেরিয়ে গেছে।আমাকে আমার মাছের ঝোল দিয়ে দিয়েছো।এবার তো আবার আমাকে দিতে গেলে তোমারটা দিতে হবে।
--- ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।আমি বাকি যা আছে তাই দিয়েই খেয়ে নেবো।এখন আপনি অসুস্থ্য না খেলে গায়ে শক্তি হবে কি করে?
--- আর তুমি যে কদিন আগে আমার দাদুভাইকে এনে দিলে।তুমি ঠিকভাবে না খেলে আমার দাদুভাই দুধটা পাবে কোথা দিয়ে?অনেক অত্যাচার করেছি তোমার উপর।ভাবিনি কখনো মেয়ের বিয়ে দিলে সে পর হয়ে যায়,স্বার্থপর হয়ে যায়।এটাও ভাবতে পারিনি পরের মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত আপন করে নেওয়া যায়।পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।তোমাকে চিনতে বা বুঝতে কোনোটাই পারিনি।স্বার্থপরের মত শুধু নিজের মেয়ের কথাটাই ভেবেছি।
নন্দিতা পুনরায় রান্নাঘর থেকে মাছের ঝোল এনে শ্বাশুড়ীর সামনে রেখে বললো,
--- খেয়ে নিন মা।আর ওসব কথা কোনদিন বলবেন না।আমি জানতাম আপনি একদিন ঠিক বুঝতে পারবেন।
তিনি নন্দিতার মাথায় হাত রেখে বলেন,
--- এই ঝোলটা দুজনে মিলে খাই।আমি একটু ঢেলে নিই বাকিটা তুমি নিয়ে রান্নাঘরে রাখো।পড়ে ভাত দিয়ে খেয়ে নিও।
এরপর থেকে নন্দিতার শ্বাশুড়ী আর কখনোই মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকেননি।ঘুরতে গেছেন।মেয়ে,জামাই থাকতেও বলেছে কিন্তু তিনি তার উত্তরে সবসময বলেছেন,"দাদুভাইকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হয়।"আসলে বৃদ্ধ বয়সে ছেলের বউয়ের হাতের যত্ন কে না চায়?
#আমার_লেখনীতে
#পরিবারের_পাঁচফোড়ন
No comments:
Post a Comment