Friday, May 21, 2021

ফিরে আসা

ফিরে আসা

 "লোকটাকে রোজ ওই একই সময়ে দেখতে পাই,কি অদ্ভুত সেই দৃষ্টি"-- কথাটা বলে অতসী একটু অন্য মনস্ক হয়ে যায়। দিবাকর তার পাশেই বসে একটা দূর্বাঘাস নিয়ে টুকরো টুকরো করছিল আর অতসীর কথা শুনছিল।কিন্তু অতসীকে চুপ করে যেতে দেখে সে চোখ তুলে পাশে বসা অতসীর গায়ে একটা ধাক্কা মেরে বলে,
--- চুপ করে গেলে যে?বল তারপর কি হল?এসব কথা তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেন?কোনদিন তার কাছে জানতে চাওনি কেন তিনি তোমার দিকে এরকম ভাবে তাকিয়ে থাকেন?
 অতসী দিবাকরের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- কিন্তু ভদ্রলোক তো শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কোন কথা তো তিনি আমার কাছে জানতে চান না তাই আমিও তার কাছে কোন কথা জানতে  চাইনি।
---তাহলে আমি একদিন তোমার সাথে তোমাদের পাড়াতে যাই। ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাই যে তিনি কেন তোমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকেন অথচ কোন কথা তুমি বলেন না।
--- না না তার কোন দরকার নেই।একজন বয়স্ক লোক তার পোশাক-আশাক বলে দেয় তিনি একজন ভদ্রলোক।
--- আরে আজকালকার দিনে পোশাক দেখে কি আর ভদ্র অভদ্র চেনা যায়?
---আমরা মেয়েরা অনেক কিছুই বুঝতে পারি একজন মানুষকে দেখে।যা তোমরা ছেলেরা পারো না।আমি নিশ্চয় একদিন ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইবো যে তিনি রোজ আমার দিকে তাকিয়ে ওইভাবে কি দেখেন অথচ কোন কথা বলেন না?আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি কেমন যেন একটা মায়া ভরা মুখ 
--- দেখো সেধে কোন বিপদ ডেকে এনো না।আর ঠিক আছে তুমি যখন বলছ তবে তাই হোক।কিন্তু যেদিন তুমি উনার সাথে কথা বলবে সেদিন আগে থাকতে আমাকে একটু জানিয়ে রেখো।সে রকম বুঝলে আমিও কাছেপিঠে থাকলে চলে যেতে পারবো।
দিবাকর একজন ব্যাংক কর্মচারী আর অতসী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কিছুদিন হল জয়েন করেছে। অতসী দিবাকরের সম্পর্কটা তাদের দুই বাড়ি থেকে মেনে নিয়েছে।বিয়ের ডেটও ফাইনাল হয়ে গেছে।প্রায় রোজই অফিস ছুটির পরে দুজনে একটু ফাঁকা জায়গায় বসে গল্পগুজব করে তারপর যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ায়।কিন্তু আজ প্রায়  চার পাঁচ দিন হল  একজন আগুন্তুক তার বাড়িতে ফেরার বড় রাস্তার মোড়ে একটি চায়ের দোকানে বেঞ্চের উপর বসে থাকেন আর সে যখন চায়ের দোকানটা পার হয় তখন তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেন।অথচ মুখে কোন কথা বলেন না।
অতসীর বাবা নেই।মা আছেন।মায়ের কাছে গল্প শুনেছে।তার যখন দুবছর বয়স  বাবা-মায়ের বনিবনা না হওয়ায় বাবা মা কে ছেড়ে চলে যান।মায়ের কাছে এটাও শুনেছে বাবা নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করে বিদেশে সংসার পেতেছেন।তাই তাদের ডিভোর্সটাও হয়নি।যেদিন রাতে তাদের মধ্যে চরম ঝগড়া হয় সেদিনই বাবা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান আর কোনদিন ফিরে আসেন না।কিন্তু মা আজও বাবার উদ্দেশ্যে শাঁখা সিঁদুর পলা সবই পরেন।
 দিবাকরের বাবা-মা দুজনেই আছেন।তারা অতসীর বাবা-মার ব্যাপারটা জানেন।কিন্তু বিয়েতে তাদের কোন আপত্তি নেই।তাদের একটাই বক্তব্য ছেলে মেয়ে উভয়ই  প্রতিষ্টিত।তারা একে অপরকে চেনে জানে।সংসার তারা করবে সুতরাং এ ব্যাপারে পরিবারের শুধুমাত্র মতটাই যথেষ্ট। অন্য কোন ব্যাপারে তারা নাক গলাতে চান না।
 দিবাকরের সাথে কথা বলার পরের দিন অতসী যখন বাড়ি ফেরে তখন দেখে ঠিক সেই একইভাবে ভদ্রলোক চায়ের দোকানের এক কর্নারে বসে আছেন। অতসী বাস থেকে নেমে ধীর পায়ে দোকানের কাছে এগিয়ে যায়।দোকানে তখনও কয়েকজন রয়েছেন খরিদ্দার। অতসী একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে ভদ্রলোকের পাশে এসে বসে।আজ লক্ষ্য করে ভদ্রলোকের পাশে রয়েছে একটা কাপড়ের ব্যাগ।অতসী বসার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকটি নিজের দুপায়ের উপর ব্যাগটি নিয়ে নেন। অতসী চুপচাপ ভদ্রলোকের পাশে বসে চা খেতে থাকে।কিন্তু সে আড়চোখে লক্ষ্য করে ভদ্রলোকটিকে।তিনি সেই একইভাবে অতসীর বিকে তাকিয়ে রয়েছেন।চা খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সে ভদ্রলোকের কাছে জানতে চায়,
--- আপনি চা খেয়েছেন?ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে না বলেন। কিন্তু সে একইভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।অতসী আর এক গ্লাস চায়ের অর্ডার দেয়।চা আসে।অতসী চায়ের গ্লাস ভদ্রলোকের হাতে দিতে দিতে জানতে চায়,
--- আগে আপনাকে এখানে কখনও দেখিনি।এখানে বুঝি আপনি নূতন এসেছেন?
ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে না বলেন।
অতসী পুনরায় তাকে বলে,
--- তাহলে আপনি এখানে কোন বাড়িতে থাকেন?আগে তো কোনদিন আপনাকে দোকান বা রাস্তাঘাটে কখনো দেখিনি। ভদ্রলোক বলেন,
--- তোমাকে যদি হাতে সময় থাকে তাহলে একটু ওদিকে ফাঁকা জায়গায় যাবে?তোমাকে কিছু কথা বলার আছে আমার।
অতসী অবাক না হয়ে অবাক হওয়ার ভান করে জানতে চায়,
--- আমাকে?ঠিক আছে চলুন।একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। ---হ্যাঁ মা তাই চলো।
 ভদ্রলোকের মুখে মা ডাকটা শুনে অতসীর অদ্ভুত একটা ভালোলাগা কাজ করে মনের ভিতরে। ভদ্রলোকের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে। ঠিক সেখান থেকে তার বাড়ির গেটটা দেখা যাচ্ছে।
--- বলুন কি বলতে চান --
--- আমি অনিমেশ চক্রবর্তী।
--- আমার বাবার নামটাও তাই।কি অদ্ভুত মিল।
 এবার ভদ্রলোক কোন কথা না বলে তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা থেকে একটা ছবি বাঁধানো বের করে অতসীর হাতে দেন।অতসী দেখে ছবিটিতে তার ছোটবেলার একটা ছবি যাতে সে তার বাবার কোলে রয়েছে।এই ছবিটা তাদের বাড়িতেও বাঁধানো আছে।অতসী হাতে ছবিটা নিয়ে বলে,
--- এটা আমি আর আমার বাবা।আপনি ছবিটা কোথায় পেলেন?এই একই ছবি আমাদের ঘরেও বাঁধানো আছে। আপনি ছবিটা দিতে এসেছেন?
ভদ্রলোক অসহায়ের মতো অতসী মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
---না মা এই ছবিটা দিতে আমি আসিনি।এই ছবিটাই যে মেয়েটি আছে সে তুমি আর যে  মানুষটা রয়েছে সে হচ্ছে আমি।আমি অনিমেষ চক্রবর্তী তোমার বাবা।
--- আমার বাবা?
--- আমিই তোর হতভাগ্য বাবা।
  অতসী চুপ করে তার বাবার কথাগুলো শুনতে থাকে।যখন তোর বছর দুয়েক বয়স তখন তোর মা আমাকে আর আমারই সহকর্মী একটি অল্প বয়সী মেয়েকে নিয়ে সন্দেহ করতে থাকে।অনেক বুঝিয়েছি।কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি।শেষ যেদিন তার সাথে আমার ঝামেলা হয় হঠাৎ করেই সে আমায় বলে বসে যে আমি যদি আর তার সাথে কথা বলি তাহলে তার মরা মুখ দেখবো।এটা ছিল আমার কাছে ফাঁসির সাজা ঘোষণার মত।এখন তুই বড় হয়েছিস বলতে একটু বাঁধা নেই তোর মাকে আমি আমার নিজের জীবনের থেকেও আজও বেশি ভালোবাসি।তাই সেই মুহূর্তে আমি এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই।আমি চাকরি করতাম একটি বিদেশী কোম্পানিতে।অনেক বলেকয়ে হাতে পায়ে ধরে চলে যাই আমেরিকা।কিন্তু কিছুদিন ধরে তোদের জন্য আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়।এমনিতেই এই বাইশ বছরে এমন কোন দিন নেই তোদের কথা মনে পড়েনি।কিন্তু কিছুদিন ধরে অফিসের কাজে মন বসাতে পারছিলাম না।শুধু তোদের কথা মনে পড়তো।তাই সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে আবার ফিরে এলাম তোদের কাছে।রাখবি আমাকে তোদের কাছে?আমি যা নিয়ে এসেছি তাতে বসে খেলেও আমাদের ঠিক চলে যাবে।
 অতসী বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, --এসব কি বলছ বাবা তুমি?আমি এখন চাকরি করি।আমি বড় হয়েছি।আজ আমি বুঝতে পারছি মা তার কাজের জন্য নিজে অনুতপ্ত।তাই আজও তোমার মঙ্গল কামনায় মা শাঁখা-সিঁদুর পরেন। শিব ঠাকুরের উপোস করেন। এমন কোনো দিন নেই শিব ঠাকুরের মাথায় জল না ঢেলে মাকে খেতে দেখেছি।কিন্তু বাবা তুমি তো আগেই আমাকে এ কথাগুলো বলতে পারতে।
--- ভয় করতো মা।যদি তুই বিশ্বাস না করিস,যদি কিছু বলতে গেলে চিৎকার করে লোক জড়ো করিস। পাড়ায় এখন সব নূতন নুতন মানুষজন।তাই কেউই আমায় চিনতে পারেনি।সেই এক সুবিধা হয়েছে আমার।
--- চলো বাবা,এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।আমরা বাড়ি যাই।মা তোমায় দেখে ভীষণ খুশি হবেন।
বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে সেই ছেলেবেলার মত বাবার হাত ধরেই অতসী বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

No comments:

Post a Comment