ঠিক সকাল সাড়ে নটা নাগাদ অম্বিকা নিলয়দের বাড়িতে চলে এলো।নিলয়ের বাবা-মা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।অচলা তৈরিই ছিল।মা,বাবাকে প্রণাম করে সে অম্বিকার সাথে বেরিয়ে পড়লো।অবশ্য নিলয়ের মা তাকে চা খাওয়ার জন্য বলেছিলেন।কিন্তু অম্বিকা জানায়,
--- মাসিমা,সবে পেট ভরে ভাত খেয়ে বেড়িয়েছি।আর একদিন এসে নাহয় চা খেয়ে যাবো।এখনই এখনই না বেরোলে খুব কষ্ট হবে রোদে যেতে।
অচলার সাথে অম্বিকার সেদিনই খুব ভাব হয়ে যায়। কথায় কথায় অম্বিকা এতবার নিলয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে অচলা সহজেই বুঝে ফেলে নিলয়ের সাথে তার রোজই কথা হয়।নিলয়ের কথা বলতে গেলে অচলা লক্ষ্য করে অম্বিকার চোখমুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।অম্বিকা যে তার দাদাকে ভালোবাসে অচলা সহজেই এটা ধরে ফেলে।তাই হাসতে হাসতে অম্বিকার কাছে সে জানতে চায়,
-- আচ্ছা অম্বিকাদি তুমি তো আমার দাদাকে খুব ভালবাসো। তাহলে আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো?দিদি ?নাকি বৌদি? অম্বিকা তখন নিজের জিভ বের করে দাঁতে কেটে বলে, ---আরে না,সে সুযোগ যদি কোন দিন আসে তাহলে নিশ্চয়ই দিদির থেকে বৌদি করে নিতে পারবে।এখন কিন্তু এসব কথা যেন মাসিমা,মেসোমশাই না জানেন।তোমার দাদা বলেছে,এবার এসে সে এই ব্যাপারে তাদের সাথে কথা বলবে।তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।তোমার দাদার ইচ্ছা তুমি লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াও।আর তার জন্য যা যা করণীয় তোমার দাদা করবে।আর বাইরে ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ি আমার হবু ননদিনির জন্য আমিই করব।
---সত্যি কথা বলতে কি জানো দিদি আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এই রকম একটা পরিবারে আমি আশ্রয় পাবো। আর নিলয়দার মতো একজন দাদা পাবো।সেদিন যে পরিস্থিতিতে আমি তার পিছন নিয়েছিলাম আজকে ভাবলে এখনো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।চিনিনা জানিনা একটা মানুষকে দেখে হঠাৎই মনে হয়েছিল বোধহয় এই মানুষটা আমাকে একটা রাতের মত আশ্রয় দিতে পারবে।কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি এই মানুষটাই আমার মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়াবে। আর তারপর বাবা-মা কি ভালো মানুষ!কখনোই বুঝতে পারি না যে তারা আমার রক্তের সম্পর্কে কেউ না।অবশ্য রক্তের সম্পর্কের কেউ হলেই যে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকবে, ভালোবাসা থাকবে তা কিন্তু নয়।আমি আমার নিজের জীবন দিয়ে এই সত্যটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি।ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট পেয়ে আজ এই জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি। ঈশ্বর রুপে একজন দাদা পেয়েছি।আর সেই দাদা আমাকে একটা পরিবার দিয়েছে,তার বাবা মাকে বাবা মা বলে ডাকার অধিকার দিয়েছে।আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শুধু স্বপ্ন দেখাচ্ছে তা নয় তোমার মত একজন মানুষের সংস্পর্শে এসে আলোর পথে হাঁটার সাহস যোগাচ্ছে।আর এই সবই হচ্ছে আমার দাদার জন্য।আমার জীবনে হঠাৎ করেই যে সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে যাবে এটা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল।আজ আমার আর কোন কষ্ট নেই।
--- সেতো সব বুঝলাম।কিন্তু দাদার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে কিন্তু মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে।
--- করবো দিদি।জীবনে যে সুযোগ আমি পেয়েছি সে সুযোগ আমি হাতছাড়া কিছুতেই করবো না।আমি তোমাদের সকলের এই পরিশ্রমের দাম দেবো।
সেন্টারে ঢুকে কিছু ফর্মে সই করে,টাকা জমা দিয়ে সামান্য কিছু বইপত্র নিয়ে ওরা বেরিয়ে পরে।সেন্টার থেকে বলে দেয় আবার পনেরদিন পরে আসতে।বাইরে বেরিয়ে অম্বিকা অচলাকে জোর করে ফুচকা খাওয়ায়।নিজেও খায়।তারপর বিকেলের আগেই দুজনে ফিরে আসে।
মাসখানেক পরে নিলয় আসে বাড়িতে।অচলা বেশ মন দিয়েই পড়াশুনা শুরু করে।সাথে সংসারের যাবতীয় কাজ।কিছুতেই সে মলিনাদেবীকে কোন কাজ করতে দেয় না।খুব ভোরে উঠে রান্না সহ সব কাজ সেরে নেয়। মা,বাবা ঘুম থেকে উঠার পরে একসাথে টিফিন করে দশটার মধ্যেই সে তার পড়ার টেবিলে চলে যায়।কোন কোনদিন সে এখন নিজেই বাজারে চলে যায়।পড়তে পড়তে কিছু আটকে গেলে বাচচাদের মত বই,খাতা নিয়ে বাবার কাছে চলে আসে।দুজন বুড়ো বুড়ির জীবনে অচলা যেন অক্সিজেন নিয়ে এসেছে।তাদেরও সময় বেশ ভালোভাবেই কেটে যায়।এদিকে নিলয় বাড়িতে আসায় তার বাবা,মা আশা করে থাকেন এবার নিশ্চয় সে অম্বিকা আর তার সম্পর্কের কথা তাদের বলবে।কিন্তু নিলয় কোন কথায় তাদের বলছে না দেখে স্বামীর সাথে আলাপালোচনা করে একদিন ডিনার টেবিলে মলিনাদেবী নিজেই উত্থাপন করেন।
--- হ্যাঁ রে নিলু,এবার তো তোকে সংসারী হতে হবে।
নিলয় খেতে খেতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,
--- হু
--- আরে হু কি রে ?মেয়ে দেখা শুরু করবো নাকি তুই নিজেই দেখবি।
--- রক্ষা করো মা,এবারে এ দায়িত্বটা আমি নিজেই নেবো।
এদের কথার মাঝখানে অচলা হঠাৎ করেই বলে বসে,
--- অম্বিকাদি তো আছে।ওর সাথেই তোমরা দাদার বিয়েটা ঠিক করো না।
কথাটা শুনে নিলয় ভিসুম খায় আর সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা জলের গ্লাসটা ধরে তার সামনে ধরে বলেন,
--- জলটা খেয়ে নে বাবা।এবার তুই তোর জীবনে যে সিদ্ধান্ত নিবি আমরা সেটাই মেনে নেবো।অম্বিকা মেয়েটা খুবই ভালো।আগে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল।ওর বাবা,মা এই সম্পর্কটা মেনে নেবেন কিনা সেটা কথা বলে দেখতে হবে।
--- না,না এই মুহূর্তে তোমাদের কোন কথা বলতে হবে না।আমি সময় হলে তোমাদের বলবো।
নিলয়ের খাওয়াও শেষ হয়ে গেছিলো।কথা কটা বলেই সে সেখান থেকে চলে গেলো।আজ সে আর অম্বিকা দুজনে মিলে সিনেমায় গেছিলো।অম্বিকা আজ ছুটি নিয়েছিল।সারাটা দুপুর দুজনে নানান জায়গায় ঘুরে ,সন্ধ্যায় সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরে।সকলেই তারা বেরিয়েছিল।দুপুরে নিশিতার বাড়ি খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।অম্বিকার সাথে কথা হয় তার আগে সে তার মা,বাবাকে কথাটা বলবে।তাদের মত থাকলে দু বাড়ির অভিভাবকেরা বিয়ের ডেট ফাইনাল করবেন।রাতে আম্বিকার সাথে এই বিষয়ে আবারও কথা হয়।
আগামীকাল নিলয়ের ভগ্নিপতি রিতেশের বাড়িতে তার বোনপোকে দেখতে যাওয়ার কথা। ফোনে কথা হয়েছে।নিলয় ভুলেই গেছে মাকে কথাটা জানাতে।অম্বিকার সাথে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে মাকে বলতে এসে দেখে তারা দরজা দিয়ে শুয়ে পড়েছেন।অচলার ঘরে লাইট জ্বলছে দেখে ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে দেখে অচলা টেবিল ল্যাম্পের আলোতে তখনো পড়ছে।নিলয়কে দেখতে পেয়ে বললো,
--- কিছু বলবে দাদা?
--- মাকে বলে দিস কাল দুপুরে আমি খাবো না।প্রমিতার বাড়িতে যাবো।
অচলা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ জানায়।নিলয় এগিয়ে এসে অচলার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
--- মাঝে মাঝে আমার কি মনেহয় জানিস?আগের জন্মে তুই নিশ্চয় আমার আপনার কেউ ছিলি।তাই এ জন্মে এভাবেই আমাদের দেখা হয়েছে।
--- আমার কাছে তুমি ভগবান দাদা!সেদিন যদি তুমি আমায় সাথে করে নিয়ে না যেতে তাহলে আমার যে কি হত ভাবতেই আমার গা শিউরে ওঠে।
--- যা ভাবলে গা শিউরে ওঠে তা ভাবিস কেন?পুরনো কথা কখনো আর মনে করবি না।তোর জীবনটাকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা করণীয় আমি করবো।কিন্তু পরিশ্রমটা তোকে করতে হবে।আমি চাই পড়াশুনা শিখে তুই নিজের পায়ে দাঁড়া।
--- একটা কথা বলবো দাদা?তুমি কিন্তু কিছু মনে করতে পারবে না।
--- হ্যাঁ বল না ।তোর এই পড়ার ব্যাপারে যদি কখনো কিছু কেনার দরকার হয় তুই অনায়াসে তোর আম্বিকাদিকে বলবি।ওকে বলায় আছে টাকাপয়সা নিয়ে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।
--- আচ্ছা দাদা,তুমি কবে আমার দিদিকে বৌদি করে নিয়ে আসবে?
--- এই অনেক রাত হল।এবার শুয়ে পর।আজ আর পড়তে হবে না।
নিলয় দ্রুত সেখান থেকে কেটে পরলো।তার বুঝতে আর বাকি রইলো না যে তার আর অম্বিকার ব্যাপারটা বাড়ির সবাই জেনে গেছে।এটাও ভাবলো একদিক থেকে ভালোই হয়েছে।তাকে নিজ মুখে আর বলতে হলো না কিছু।
অম্বিকা মনেমনে ভাবে আগে বাবাকে সে সবকিছু জানাবে।বাবা অবশ্য কোন দ্বিমত করবেন না বলেই তার বিশ্বাস।আর বাবা রাজি থাকলে মাকে তিনিই রাজি করিয়ে ছাড়বেন।কিন্তু মাকে রাজি করাতে গেলে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে বলেই তার ধারণা।আজ কালের মধ্যেই বাবাকে কথাটা বলতে হবে।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment