Sunday, May 30, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩৭)

সুখের ঘরে আগুন (৩৭)

   আজকে খাবার টেবিলে নিখিলেশ, নিলয়, আর নরেশবাবু আগে খেতে বসলেন।আজ মলিনাদেবী আর অচলা ওদের সাথে খেতে বসলো না।দুজনে মিলে ওদের পরিবেশন করলো।খেতে খেতে নিলয় নিখিলেশকে বললো,
--- তোর কি কাল কোন কাজ আছে?
--- হ্যাঁ ওই সকলের দিকে আমি একটু বেরোবো।
--- আমি সাথে গেলে অসুবিধা আছে?
--- কি যে বলিস না!তুই না বললেও আমি ঠিক তোকে আমার সাথে যেতে বলতাম।
--- কোথায়?
--- গেলেই জানতে পারবি।
  নিখিলেশ আড় চোখে কয়েকবার অচলার দিকে তাকায়।কিন্তু অচলা সেটা খেয়ালও করে না।ওদের খাওয়া হয়ে গেলে অচলা মলিনাদেবীকে বলে,
--- মা,তুমি একটু বসো।আমি বাবার ওষুধটা দিয়ে এসে খাবার বের করছি।
--- আচ্ছা ঠিক আছে তুই ওষুধ দিয়ে আয় এদিকটা আমি দেখছি।পুরো বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। হ্যাঁরে তুই কি ভেবেছিস?আমাকে কুরে না করে ছাড়বি না?
 নিখিলেশ তখন হাসতে হাসতে বলে,
--- কপাল করে ছেলেমেয়ে পেয়েছেন মাসিমা।সকলের কপালে এমন জোঠে না।
  কোন কথাই আর অচলার সাথে নিখিলেশের হয় না।পরদিন সকাল আটটার মধ্যেই নিলয় ও নিখিলেশ বেরিয়ে যায়।টিফিন খেতে বললে নিখিলেশ জানায় যেখানে ওরা যাচ্ছে সেখানেই টিফিন করবে।
  বেহালা ঠাকুরপুকুর থেকে ট্যাক্সিতে প্রায় পঁচিশ মিনিট।এসে পৌঁছায় সামালী বলে একটি গ্রামে।সেখান থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ।এবরোখেবরো ইটের রাস্তা।দুপাশে অসংখ্য নাম না জানা কত বড় বড় গাছ,ধানীজমি, সবুজে সবুজে কোন এক জায়গায় আকাশটাও যেন সেই সবুজ মাঠের প্রান্তরে গিয়ে মিশেছে।মনটা ভালো হয়ে যায় নিলয়ের।কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারেনা নিখিলেশ এই রাস্তা ধরে কোথায় চলেছে?তার মনের ভিতর কৌতুহল জমা হতে থাকে। কিন্তু কোন প্রশ্ন সে করে না তার বন্ধুকে।চুপচাপ নিখিলেশকে অনুসরণ করে চলেছে।নিখিলেশের কাছে একটা বেশ বড় ব্যাগ।ভুবনেশ্বর থেকে আসবার সময়েই সে ওই ব্যাগটা নিয়ে এসেছে।কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা এসে পৌঁছাল তাদের গন্তব্যে।একটা ছোট গেট ,বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বাঁশের চারিপাশে বেরা দেওয়া।প্রায় পাঁচ থেকে ছ'টা ঘর ওখানে।নিখিলেশকে দেখতে পেয়েই বেশ কিছু বাচ্চা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।তাদের ভিতর থেকেই একটি ছোট বাচ্চাকে নিখিলেশ কোলে তুলে নিলো।বয়স তার বছর পাঁচেক হবে বলেই নিলয়ের মনেহল।বাচ্চাটি কোলে উঠেই নিখিলেশের গলা জড়িয়ে চুমু খেতে লাগলো।বাচ্চাগুলোর আচার আচরণে নিলয়ের মনে হতে লাগলো যেন অনেকদিন পর তারা তাদের ভালোবাসার আপন কোন মানুষকে কাছে পেয়েছে।এরই মধ্যে একটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দুজন ভদ্রলোক ও একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা।তারা দুই বন্ধুকে সাদর আহ্বানে ভিতরে নিয়ে গেলেন।বাচ্চাগুলো কিন্তু অফিস রুমটাতে ঢুকলো না।নিলয় চুপচাপ শুধু সব লক্ষ্য করেই চলছিলো।নিখিলেশ ভদ্রমহিলাকে বলল,
--- দিদি,চলুন এগুলো ওদের দিয়ে দিই।
--- এগুলো বিকেলের জন্য রাখুন দাদা।আজ আপনি আসবেন বলে ওরা সকাল থেকে না খেয়েই আছে আপনার সাথে একসাথেই খাবে বলে।
--- ওমা তাই নাকি? বেলা যে অনেক হলো তাহলে চলুন, এক্ষুনি আমরা খেতে বসে যাই।ওদের তো খিদে পেয়ে গেছে। আহারে! আমাকে যদি আগে ফোন করে জানাতেন তাহলে আমি আরো সকাল-সকাল আসার চেষ্টা করতাম।কথাগুলো বলে নিখিলেশ উঠে দাঁড়িয়ে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- চল, টিফিন করে নি।আমি জানি তোর মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে।তোর সব প্রশ্নের উত্তর যেতে যেতে দেবো।এখন চল বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে।ওদের সাথে আমরাও খেতে বসে যাই। ওরা ওই অফিস রুম থেকে বেরিয়ে এসে আর একটা রুমের মধ্যে ঢোকে।সেই রুমে বেশ কয়েকটা টেবিল চেয়ার পাতা আছে।আর বাচ্চাদের বসে খাওয়ার মত নিচু ধরনের দুটো টেবিল আর টেবিলে খাওয়ার জন্য রয়েছে টেবিলের চিরিদিকে ছোট ছোট চারটে বেঞ্চ।ওখানে এসে বয়স্ক ভদ্রমহিলা বেশ বড় ধরনের একটা ঘণ্টা কয়েকবার বাজালেন।প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটটা বাচ্চা এসে ঐখানে এসে ঢুকলো।এর মধ্যে খুব ছোট বাচ্চাও আছে।এদের প্রত্যেকেরই বয়স পনের বছরের মধ্যে।যারা একটু বড় তাদের কেউ কেউ ছোট বাচ্চাগুলোকে কোলে করেই নিয়ে এসে নিদ্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে দিলো।বড়রা ছোটদের খাবার খেতে সাহায্যও করছে। ছোলার ডাল আর রুটি।একদম ছোট বাচ্চা দুটির জন্য সুজির হালুয়া।প্রতিটা বাচ্চার মধ্যে এত নিগূঢ় আত্মিক সম্পর্ক দেখলে মনেহয় এরা যেন একই পরিবারের সবাই।এতগুলি বাচ্চা কিন্তু কোন চিৎকার,চেঁচামেচি নেই।প্রত্যেকেই নিচু স্বরে এ ওর সাথে কথা বলছে।নিলয়ের এই সবকিছু দেখে ভীষণ ভালো লাগছে।তার বুঝতে একটুও বাকি নেই এই অনাথ আশ্রমের বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব অনেকটাই তার বন্ধু পালন করে।কিছুক্ষণ আগেই অফিস রুমে নিখিলেশ নিলয়ের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ফলে এক ভদ্রলোকের সাথে খাওয়াদাওয়া শেষে আলাপচারিতায় নিলয় জানতে পারে বছর পাঁচেক হল এই আশ্রমটি হয়েছে।গ্রামের বাপ মা হারা অনাথ ছেলেমেয়েগুলোর আশ্রয়স্থল এটাই।এদের লেখাপড়া,খেলাধুলা সবকিছুই শেখানো হয়।কেউ কেউ এদের মধ্যে খুব সুন্দর আঁকে।তাদের আঁকাও শেখানো হয়।যে চারজন এখানে বাচ্চাগুলোকে দেখভালের জন্য রয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষ।বিনা পারিশ্রমিকেই তারা ওদের দেখভাল করেন।ভদ্রলোক নিলয়কে জানালেন "আপনার সাথে আমাকে নিয়ে তিনজনের পরিচয় হল।আর একজন গেছেন একটু বাইরে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনতে।এই যে আমরা চারটি প্রাণী আমরাও কিন্তু সংসার বিতাড়িত মানুষ।যে দিদিকে দেখছেন উনি স্বামীহারা।সন্তানদের কাছে আশ্রয় হয়নি।আমরা বাকি তিনজনই ভালো চাকরি করতাম।তিনজনই বিপত্নীক।সংসারে সন্তানদের কাছে বোঝা।আমরা তিনজনই পেনশন পাই।আমাদের ধ্যানজ্ঞান এই আশ্রম।একা নিখিলেশবাবুর পক্ষে তো এতগুলো বাচ্চাকে মানুষ করা সম্ভব নয়।আমরাও আমাদের পুরোটাই এখানে এদের জন্যই খরচ করি।কিছু লোকজনও রাখতে হয়েছে নানান কাজের জন্য।তাদের স্বল্প পারিশ্রমিক না দিলে তো চলে না।তারাও তো গরীব মানুষ।"নিলয় মন্ত্রমুগ্ধের মত ভদ্রলোকের কথা শুনে চলেছে।নিখিলেশের প্রতি তার ভালোবাসা যেন এক নিমেষে কয়েকশত গুন বেড়ে গেলো।নিখিলেশকে প্রথম থেকেই সে ভালো ছেলে বলে জানতো।তাই অল্প কয়েকদিনেই তার সাথে বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় হয়।কিন্তু আজ এখানে না আসলে নিখিলেশের গুণের আর একটা দিক তার কাছে উন্মোচন হত না।
 দুপুর নাগাদ দুজনে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ে।বারবার তারা বলেছিলো দুটো ডাল,ভাত খেয়ে তবে বেরোতে।কিন্তু কিছু কাজ থাকায় নিখিলেশের ওদের বেরোতেই হল।
 ফেরার পথে নিখিলেশের কাছে নিলয় জানতে পারলো এই জমিটা তার নিজের।এটা তার বাবার কেনা জমি।গ্রামের অনাথ ছেলেমেয়েগুলোর কথা চিন্তা করেই সে এই আশ্রমটি গড়ে তোলে।কিন্তু প্রথম অবস্থায় কিভাবে শুরু করবে কিছুই বুঝতে না পেরে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে এই ব্যাপারে সে কথা বলতে যায়।তিনি সর্বরকম ভাবে তাকে শুধু সাহায্য করেনই না ;ছেলের সংসার থেকে বেরিয়ে এসে এই আশ্রমে আশ্রয় নেন। যার সাথে নিলয় কথা বলছিল তিনিই সেই ব্যক্তি।সরকারি স্কুল শিক্ষক ছিলেন।পেনশন পান। পুরো টাকাটাই তিনি ব্যয় করেন বাচ্চাগুলোর পিছনে।শুধু উনি নন বাকি দুজনও।দিদির কোন রোজগার নেই ঠিকই কিন্তু বাচ্চাগুলোকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন।" আমি আর কতটুকুই বা করতে পারি।বছরে তিন থেকে চারবার আসি ওদের কাছে।পিছুটান নেই।সামান্যই করি।উনারা না থাকলে আমার একার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হত না এই বিশাল দায়িত্ব সামলানো।নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি বাবা,মা হারা বাচ্চাদের কি কষ্ট।"
 নিখিলেশের কথা শেষ হলে নিলয় বললো,
--- তোদের সাথে আজ থেকে আমিও আছি।তোদের সকলের মত অতটা না পারলেও সামান্য কিছু তো করতে পারবো।প্রায় তিনমাস হতে চললো তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব।কিন্তু কখনোই তুই আমাকে এই আশ্রমের কথাটা জানাসনি।আসার আগেও যদি জানতে পারতাম প্রথমদিন কিছু তো ওদের জন্য কিনে নিয়ে আসতে পারতাম।
--- আরে,দেওয়ার দিন তো পালিয়ে যাচ্ছে না।এরপর থেকে যখন আসবো দুজনে একসাথেই আসবো।সব থেকে ভালো হত কি জানিস?আমরা দুজনেই যদি কলকাতা ট্রান্সফার পেতাম।সেটা তো কিছুতেই সম্ভব নয় এই মুহূর্তে।আমার তো মনেহয় কম করে পাঁচ বছর থাকতে হবে ভুবনেশ্বর। শোন নিলয়,আমি কিন্তু দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু বেরোব।যে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি সেখানে একটু যেতে হবে।
--- রাতে ফিরবি তো?
--- হ্যাঁ হ্যাঁ ফিরে আসবো।অভয় দিস তো একটা কথা বলি?
--- ন্যাকামো হচ্ছে?
নিখিলেশ হাসতে হাসতে বললো,
--- যতদিন তোর কাছে রাতে ভুবনেশ্বরে থেকেছি প্রতিদিনই দেখেছি একটা ফোন আসলেই চাপা স্বরে কথা বলতে বলতে তুই ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিস।বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি তিনি একজন ভদ্রমহিলা।যে কিনা নিলয়ের হৃদয় জুড়ে রয়েছে।
 --- একদম সঠিক অবজারভেশন!অবশ্যই পরিচয় করিয়ে দেবো।

ক্রমশঃ
  

Wednesday, May 26, 2021

নিভৃত যতনে

নিভৃত যতনে

 "সিঁড়ি দিয়ে তার খোলা চুলে আঁচল উড়িয়ে আসার দিনটা আজও বড্ড প্রিয় --" রিতিশার চলে যাওয়ার পর থেকেই আজও অন্নমনস্ক হলেই স্মৃতির সাগরে পাড়ি দেয় সুশোভন।কত কথা মনেপড়ে তার।সেই প্রথম দিন থেকে কাটানো রিতিশার তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।কোনদিনও সুশোভন ভাবতে পারেনি যে হঠাৎ ঝড়ের মত জীবনে এসে হঠাৎ করেই রিতিশা এইভাবে ছেড়ে চলে যাবে ।
  পিতৃমাতৃহীন অগোছালো জীবনে খুব ভালো না হলেও মোটামুটি চলে যাওয়ার মত একটি চাকরি পেয়েছিল সুশোভন।সংসার করার ইচ্ছা তার ছিল না।কিন্তু রিতিশার গুনে মুগ্ধ হয়ে সে তাকে বিয়ে করে।মাত্র এক বছরের সংসার তাদের।প্রতিটা জায়গায় রিতিশার স্মৃতি।ঘর থেকে যেমন তার ব্যবহার্য কোন জিনিস সে চাইলেই সরিয়ে ফেলতে পারছে না ঠিক তেমনই মনের অলিন্দে তার যে স্মৃতিগুলি জমে আছে তাকেও মুছে ফেলতে পারছে না।
  সারা বিশ্বের এই চরম দুর্দিনের সময় লকডাউনে সবাই যখন ঘরবন্দী তখন সুশোভন ও রিতিশাও ঘরে।অবশ্য দিনের একটা নিদ্দিষ্ট সময় সুশোভনকে ঘরে বসেই তার অফিসের কাজগুলি করতে হয়।বাকিটা সময় দুজন মিলে হাসি,ঠাট্টায়,গল্পগুজব করেই সময় কাটায়।দেশের এই চরম ভয়াবহ দিনে মানুষ যখন ঘরে বসে বসে বোর হচ্ছে রিতিশা আর সুশোভন ডাল, ডিম, আলুসেদ্ধ খেয়েই হেসে খেলেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে।
 আজ সাতদিন। রিতিশা চলে গেছে সুশোভনকে ছেড়ে। সুশোভনের মনে পড়ছে রিতিশার সাথে দেখা হয় প্রথম দিনের কথা।স্টেশনে দুজনেই দাঁড়িয়ে ছিল।ট্রেন আসাতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।সুশোভন উঠতে পারলেও রিতিশা সবে মাত্র ছেড়ে দেওয়া ট্রেনটাতে ওঠার জন্য দৌঁড়াতে থাকে।সুশোভন ট্রেন থেকেই একটি হাত বাড়িয়ে দেয়।সুশোভনের বাড়ানো হাতটি ধরেই রিতিশা চলন্ত ট্রেনের পাদানিতে পা দেয়। বলিষ্ট চেহারার সুশোভন তাকে এক টানে ট্রেনের কামরায় তুলে নেয়।
 সুশোভন লক্ষ্য করে পুরো ট্রেন যাত্রী তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।সুশোভনও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।কিন্তু কি করবে সেও বুঝে উঠতে পারেনা।নিজের মুখটা একটু উপরের দিকে তুলে নিয়ে রিতিশার উদ্দেশ্যে বললো,"আপনি ট্রেনে উঠে পড়েছেন,এবার আমায় ছাড়ুন।"রিতিশা দুইহাতে আঁকড়ে ধরে সুশোভনের বুকে যে মুখ লুকিয়ে ছিল তা বোধকরি এতক্ষণ তার খেয়াল ছিল না।সুশোভনের কথায় তাকে ছেড়ে দিয়ে মুখটা নীচু করে বললো,"সরি, সরি আসলে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।অথচ এই ট্রেনটা মিস করলে ঠিক সময়ে বাড়িতে পৌঁছাতে পারতাম না।"
--- কিন্তু এতটা রিস্ক না নিলেই পারতেন।একটু দেরি করে বাড়ি পৌঁছালে এমন কোন ক্ষতি হত না।
--- আসলে বাবার ওষুধটা স্থানীয় দোকানগুলিতে পাইনি।ওখান থেকে বললো কলকাতা ছাড়া পাওয়া যাবে না।তাই দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসি।বাবা ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই।
  এইভাবেই রিতিশা ও সুশোভন পরস্পরের কাছাকাছি আসে। রিতিশার বাবা চলে যাওয়ার অনেকদিন পর সুশোভন এসেছিলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে রিতিশার কাছে।সুশোভনের আসার খবরটা রিতিশার জানা থাকলেও কারণটা ছিল অজানা।গেট খুলেই রেখেছিলো রিতিশা সিঁড়ির নিচুতে দাঁড়িয়ে সুশোভন খুব জোড়ে সেদিন রিতিশাকে ডেকেছিল। রিতিশা তখন সবে স্নান করে এসে চুল আচড়াছিল।সুশোভনের ডাক শুনে রিতিশা তার খোলা চুল আর  খোলা আঁচলে ছুটতে ছুটতে সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নিচুতে নেমে এসেছিল।আর মন্ত্রমুগ্ধের মত সুশোভন তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
 কটা দিন ধরেই খুব কাশিতে কষ্ট পাচ্ছিল রিতিশা।সাথে মাঝে মধ্যে গা টা সামান্য গরম।ডাক্টার টেস্ট করতে দিলেন।করোনা পজেটিভ।দিন পাঁচেকের মধ্যেই সব শেষ।শেষ মুহূর্তে সুশোভন তার মুখটাও দেখতে পারেনি।

Monday, May 24, 2021

সংসারের লক্ষী

সংসারের লক্ষী

 --- ওহ্ বৌদি,তোমার এত ছোট ছোট বাটি মাজতে হয় কেন গো?এত বাটি দিয়ে তুমি রোজ কি করো?
  রান্নাঘরে কাজ করতে করতে রুলিমি গৃহকর্তী অপরুপাকে কথাটা বলে।
-- আরে আমি তো বাটিতে বাটিতে সকলেরটা ঢেলে রাখি রে।
আসলে একসাথে বসে খেতে গেলে খেতে খেতে হাতায় করে খাবার দেওয়াটা আমি একদম পছন্দ করি না।আর তাছাড়া তোর দাদা,ছেলেমেয়ে যাকে যেটা দেবো ভাবি সেটা কড়ায় থেকে তুলে না রাখলে আমি পড়ে খুঁজেই পাই না।
--- মেয়ে,তোমারটাও আলাদা করে রাখো ?
--- ওমা!মেয়েটা আমি সকলের আগে তুলে রাখি।আমি সবসময় একটা কথা ভাবি মেয়েটা আমার পরের ঘরে চলে যাবে।কি খাবে?তাকে কি খেতে দেওয়া হবে সেতো কোনদিন মুখ ফুটে কোন কথা পরেরবাড়িতে বলতে পারবে না।যা দেবে তাই খেতে হবে তাকে।আর যখন তার সম্পূর্ণ নিজের সংসার হবে তখন সে সন্তান,স্বামীকে খাইয়ে যা থাকবে তাই তাকে খেতে হবে।আর ছেলে তো সবসময় আমি যতদিন সংসারে আছি আমার হাতেই খাবে।শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও ভালো খাবারটা খাবে।তাই আমার মনেহয় সংসারে ছেলেদের না মেয়েদেরকেই মায়ের ভালো খাবারটা দেওয়া উচিত।কিন্তু মানুষ সেটা বোঝে না।অধিকাংশ বাড়িতেই ছেলেদেরকেই ভালো খাবারটা দেয়।
--- আমিও তো তাই করি গো বৌদি।আগে ছেলের বাপের জন্য তুলে রাখি তারপর যেটা ভালো থাকে ছেলেটাকে দিই।আমরা মা,মেয়ে ভাগযোগ করে অল্পই খাই।
--- কেন করিস এটা?মেয়েটা বিয়ে হলে পরের ঘরে চলে যাবে।তাকে গুছিয়ে ভালো খাবারটা কে দেবে?সারাদিন পরিশ্রমের পর সে খাবে সকলের খাওয়ার পর যেটা পড়ে থাকবে সেটা।জামাই নিয়ে যখন তোর কাছে আসবে তখনও তুই জামাইকেই বড় মাছের পিসটা দিবি।মেয়েরা কি অপরাধ করে পৃথিবীতে এসছে যে তাদের ভালো খাবার,ভালো থাকার কোন অধিকার নেই?সংসারের ভালো সবকিছুতেই ছেলেদের অধিকার?না,আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী নই।মেয়েরা হচ্ছে সংসারের লক্ষী।তাদের অবহেলা করলে সংসারে অমঙ্গল হয়।আমি একথা কখনোই বলছি না যে ছেলেকে আমি অবহেলা করি ।আমার বক্তব্য দুজনকেই আমি পেটে ধরেছি।আমার কাছে দুজনেরই সমান গুরুত্ব।একজনের জন্য আর একজনকে আমি অবহেলা করতে পারবো না।একদিন ছেলেকে বড় মাছের পিসটা দিই তো পরেরদিন মেয়েকে।আর ঠিক তার পরেরদিন তোর দাদাকে।
--- আর তুমি?
--- আমার মায়ের কাছ থেকে এ শিক্ষা পেয়েছি।মা দাদাকে আর আমাকে সমানভাবেই সবকিছু ভাগ করে দিতেন।তাই খাবারের প্রতি আমার কোন আর লোভ নেই।প্রচুর খেয়েছি বাপের বাড়িতে।তবে হ্যাঁ ওরা যদি খেয়াল করে আমার থালায় কম সব্জি বা ছোট মাছের পিস রয়েছে তখন তিনজনে মিলেই আমার থালায় তাদের খাবারের থেকে দিতে শুরু করে দেয়।
 তারপর হাসতে হাসতে বলতে লাগেন,
--- কার্যক্ষেত্রে তখন দেখা যায় আমার খাবারটাই বেশি হয়ে গেছে।কাউকে তুলে দিতে গেলেই তার মুখ হাড়ি হয়ে যায়।তবে কি জানিস সংসারটাই হচ্ছে মানবিকতা,মনুষ্যত্ববোধ শেখার প্রাথমিক স্থর।সংসারে একজনের সঠিক মূল্যায়ন তুই যখন করবি সেও কিন্তু তোর সঠিক মূল্যায়নটা করবে।
--- বাব্বা বৌদি পেটে একটু বিদ্যে ছিল তাই তোমার এই বড় বড় কথাগুলি বুঝতে পারলাম।তবে একটা জিনিষ খুব ভালো বুঝেছি আমরা মেয়েরা নিজেদের সংসার থেকেই মেয়েদেরকে বঞ্চিত করতে থাকি।তোমার মত চিন্তাধারা যদি সকলের থাকতো তাহলে হয়ত অনেক মেয়ের জীবনেই দুঃখের পাহাড় জমা হত না।আমি আজ থেকেই তোমার কথাগুলি মাথায় রেখে মেয়েটার খাবারদাবারের দিকে লক্ষ্য রাখবো।
--- শুধু খাবারদাবারই নয় ছেলের জন্য যা যা করছিস ঠিক তাই তাই মেয়েটার জন্যও করিস।আরে তুই তো মা।তোর দায়িত্ব কর্তব্য দুজনের প্রতিই সমান।
--- বৌদি, আজকে তোমায় একটা প্রণাম করি।আমি জানি তুমি প্রণামট্রনামে বিশ্বাস করো না।কিন্তু আজ আমায় বাঁধা দিও না।তোমার কথাগুলো আমার মনের একটা অন্ধকার দিক খুলে দিয়েছে।
রুলিমি ঢিপ হয়ে অপরূপাকে প্রণাম করে।

Sunday, May 23, 2021

দ্বন্দ্ব

দ্বন্দ্ব

  'কবিতা ' সিনেমাটা ছোটবেলা থেকেই খুব প্রিয় ছিল দেবারতির।কিন্তু কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি নায়িকা মালা সিংহার মত তার জীবনটা হয়ে যাবে।চার ভাইবোনের মধ্যে দেবারতি ছিল সকলের বড়।বাবা ছিলেন বেসরকারি কোম্পানির মোটা মাইনের সুচাকুরে।মা গৃহবধূ হলেও খুব সুন্দর গান গাইতেন।দেবারতির মা মালতীদেবী যখন গান গেয়ে একটু একটু নাম করতে শুরু করেছেন তখন তার বাবা অর্থাৎ দেবারতির দাদু তার বিয়ে দিয়ে দেন।বিশাল বড় একান্নবর্তী পরিবারে এসে সবকিছু ভুলে সংসার নিয়েই থাকেন বা থাকতে বাধ্য হন। সুরেশবাবু চেষ্টা করেছিলেন তার স্ত্রীকে আবার গান ধরাতে।কিন্তু মালতিদেবির শ্বাশুড়ী অশান্তি এমন চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন যে ঘরের চালে কাকও বসতো না।তাই প্রথম সন্তান দেবারতির মধ্য দিয়েই তিনি নিজের শখ মেটাতে চেয়েছিলেন।শ্বাশুড়ীর আপত্তি তখন ধোপে টেকেনি।
 দেবারতি যখন কলেজে পড়ে তখন সুপ্রিয়র সাথে পরিচয়।তারপর দুজনের মন দেওয়ানেওয়ার পালা।মালতিদেবি ও সুরেশবাবু মেনে নেন এই সম্পর্ক।তখন সুরেশবাবুদের সেই বিশাল একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো।ভায়েরা সব আলাদা।পারিপারিক অনুষ্ঠান ছাড়া কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় না।যে যার পরিবার নিয়েই ব্যস্ত। সাতভাই আর তিন বোনের মধ্যে আজ অনেকেই নেই।
 সুরেশবাবু মেয়েকে বলেন সুপ্রিয়কে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসতে তিনি কথা বলতে চান।দুজনেরই গ্র্যাজুয়েশন সবে শেষ হয়েছে।দেবারতি গান নিয়েই আছে।প্রচুর ফ্যাংশনে সে এখন গান গাওয়ার সুযোগও পায় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।সুপ্রিয় চাকরির চেষ্টা করছে।বাবার কথামত সে একদিন সুপ্রিয়কে বাড়িতে নিয়ে আসে।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সুপ্রিয়র সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎই সুরেশবাবু অসুস্থ্য হয়ে পড়েন।সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু শেষরক্ষা হয় না।সকলকে ছেড়ে তিনি চিরতরে চলে যান।
  ছোট তিন তিনটি ভাইবোনের সব দায়িত্ব এসে পড়ে দেবারতির উপর।তার উপর আছে সংসার।চাকরির চেষ্টা করতে শুরু করে।রাতদিন গানের টিউশনি করে বেড়াতে লাগলো।মালতিদেবি পুরো নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।দেবারতির মনের ভিতর একটা দ্বন্দ্ব সবসময় কাজ করতো।বাবা তো সুস্থ্য স্বাভাবিকই ছিলেন।সুপ্রিয় যেদিন আসলো সেদিনই তিনি চলে গেলেন।মন সায় দেয় না তবুও বিষয়টা ভাবতে বাধ্য হয়।সে আস্তে আস্তে সুপ্রিয়কে এড়িয়ে যেতে শুরু করে।সুপ্রিয়ও বিষয়টা বুঝতে পারে।কিন্তু তার ভিতরেও একটা প্রশ্নচিহ্ন রয়েই যায়।অদ্ভুত,অজানা এক কালো হাত দেবারতি ও সুপ্রিয়র সম্পর্কটাকে দিনকে দিন দূরত্ব বাড়িতেই চলে।
  সুপ্রিয় চাকরি পেয়ে যায় ব্যাঙ্গালোর।খবর দিতে এসে দেবারতিকে বলে,
--- সারাজীবন অপেক্ষায় থাকবো।যদি কোনদিন সংসারের দায়িত্ব আর নিজের মনের দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারো আমায় জানিও।ছুটে চলে আসবো তোমার কাছে।
 এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর।দুই ভাই আর এক বোন সকলেই যে যার জীবনে প্রতিষ্ঠিত।দেবারতির এখন অনেক বড় গানের স্কুল।বেশ ভালো রোজগারও হয়।ক্যান্সার পেশেন্ট মা এখন।বোন শ্বশুরবাড়ি।স্কুল টিচার সে এখন।ভায়েরা বিয়ে করে যে যার মত আলাদা।কারো হাতে বিন্দুমাত্র সময় নেই দেবারতি আর মায়ের খবর নেওয়ার।বোন মাঝে মধ্যে এসে অবশ্য মাকে দেখে যায়।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘরে ফিরে অসুস্থ্য মায়ের পাশে শুয়ে যখন ঘুমানোর চেষ্টা করে তখন সুপ্রিয়র মুখটাই শুধু চোখের সামনে ভেসে ওঠে।মা চুপ করে থাকতে থাকতে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় দিনান্তে তিনি একটা কথা বলেন কিনা সন্দেহ।সেদিন দেবারতি তার পাশে শুয়ে একটা হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।মালতিদেবিও তার একটি হাত মেয়ের মাথায় রাখেন।
--- কিছু বলবে মা?
--- সুপ্রিয়র বিয়ে হয়ে গেছে?
--- জানিনা মা ---
তিনি চুপ করে গেলেন।দেবারতি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জানতে চাইলো,
-- কেন জানতে চাইলে বললে না ?
 একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে ' কিছু না ' বললেন।সেদিন ঘুমের মধ্যেই মা চলে গেলেন।ডক্টর ছ মাস সময় দিয়েছিলেন তিনি চলে গেলেন চার মাসের মাথায়।ভাই এবং ভাইবৌয়েরা এত কান্নাকাটি করলো মনে হচ্ছিলো তাদের বুক ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে মা চলে যাওয়াতে।বোন এসে একদিন ছিল দিদির কাছে।
 দেবারতি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলো।এখন যেন আরো বেশি করে সুপ্রিয়র কথা মনেহয় তার।কাজকর্ম মিটে যাওয়ার দুদিন পর হঠাৎ সুপ্রিয় এসে হাজির।অনেক কথার মাঝে সুপ্রিয় দেবারতিকে বললো,
--- মানুষ তার আয়ু নিয়েই জন্মায়।কারো জন্যই কারো জীবন চলে যেতে পারে না।যদি কেউ কাউকে খুন করে তাহলে সেটা অন্য ব্যাপার।আমি যদি সেদিন নাও আসতাম মেসোমশাইয়ের অঘটনটা ঘটতোই ।কোনদিন মুখ ফুটে কথাগুলি বলোনি আমায়।কিন্তু আমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কারণটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম বলেই নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।কারো মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করা মানে তাকে এক কথায় খুনি ভাবা।আমি আজও প্রতীক্ষায় আছি।বাকি জীবনটাও থাকতে রাজি।
 কান্নায় ভেঙে পরে দেবারতি।সুপ্রিয় এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত রাখে



Friday, May 21, 2021

সংসার কাহন (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)

সংসার কাহন (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)

  সুনীলের মা সেই যে হাসপাতাল থেকে নাতনিকে সাথে করে   মেয়ের বাড়িতে গেছেন তারপর থেকে আজ প্রায় 6 মাস  সেখানেই তিনি রয়েছেন।এখানে আসার কোন নাম গন্ধ নেই। নন্দিতার সংসারে তার স্বামী এবং দেওর তাকে যথেষ্ট সহায়তা করে। সুনিল মাকে এ সম্পর্কে কোনো কথা না বললেও দেবেশ মাঝেমধ্যেই মায়ের সাথে প্রচন্ড ঝামেলা করে।কথা বলাও বন্ধ থাকে দু একদিন।দেবেশ রাগ করে তখন আর ফোন করে না।দু একদিন কেটে গেলেই মা খবরাখবর নেওয়ার জন্য কখনো কখনো দেবেশের সাথে নিজেই ইচ্ছে করে ফোন করেন।
নন্দিতার হেলপিংহান্ড পরমা খুব ভালো মেয়ে।সে নন্দিতাকে মাঝেমধ্যে রান্নাতেও সাহায্য করে থাকে। নন্দিতাও তাকে নানান ভাবে সাহায্য করে।তার ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে আসলে নন্দিতাকে তাকে দেখতে বলে সে রান্নাবান্নার দিকটা সেদিন সামলে দেয়।নন্দিতা নানানভাবে মেয়েটিকে আর্থিক সহায়তাও করে।কিন্তু সুনীল বা নন্দিতা কেউই এই এতগুলি মাস ধরে মাকে এখানে আসার কথা বলেনি।সেটা রাগে হোক বা অভিমানে। তখন এই ভাবেই চলছিল।এরই মধ্যে নন্দিতার একদিন লেবার পেইন ওঠে।সুনীল তখন অফিসে।ভাগ্যক্রমে দেবেশ সেদিন দুপুরে বাড়িতেই ছিল। দেবেশ তার দাদাকে ফোন করেই মাকে ফোন করে এবং বৌদির কথা জানায়।মা দেবেশ কে জানান,
--- আমি তো ডাক্তার নই তোর বৌদির পেইন উঠেছে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যা,আমি গিয়ে কি করবো?
 দেবেশ রাগ করে ফোন কেটে দেয়।সে তার বৌদিকে নিয়ে হাসপাতাল পৌঁছায়। ইতিমধ্যে সুনীল সেখানে হাজির হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে অপেক্ষারত সুনীল, দেবেশ, আর নন্দিতার বাপের বাড়ির লোকজনের কাছে খবর আসে সুন্দর ফুটফুটে একটি ছেলে হয়েছে নন্দিতার।দারুন দেখতে হয়েছে; সাড়ে তিন কিলো তার ওজন হয়েছে।মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুল।তাকে দেখে সকলের  মনে হচ্ছে যেন এক রাজপুত্র নন্দিতার কোল আলো করে এসেছে।সঙ্গে সঙ্গেই সুনীল মাকে ফোন করে জানায়।
 ছেলে হওয়ার পর দ্বিতীয় দিনে নন্দিতার শ্বাশুড়ী তাকে দেখতে আসেন হাসপাতালেই।নন্দিতা তখন জানতে চায়,
--- মা আপনি কবে বাড়ি ফিরবেন?এখন তো আপনার নাতি এসেছে। আপনাকে তো এখন বাড়িতে ফিরতে হবে।
---কি করে ফিরব বলতো বৌমা?এই তো কদিন পরেই না দিদিভাইয়ের  আমার মুখে ভাত।ভাবছি মুখেভাতটা হয়ে গেলে একবারেই বাড়ীতে ফিরে যাবো।আর তাছাড়া আমি চলে গেলে রেখা একাএকা বাচ্চা সংসার দুটো যে কী করে সামলাবে সেই চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি।
---- কিন্তু মা এক মাস তো আমাদের আতুর থাকবে।আমি তো কিছু করতে পারবোনা এই সময়।আপনি বাড়িতে না গেলে আপনার ছেলেদের যে খুব অসুবিধা হবে।
---না না বৌমা এক মাস নয়;ছেলে হলে 21 দিন আতুর থাকে। তুমি এক কাজ করো তোমার মাকে এই সময় তোমার কাছে এনে কিছুদিন রাখো। তিনি তার নাতি আর মেয়েকে এই কটাদিন এসে একটু দেখাশোনা করবেন।
 নন্দিতা আর কথা বাড়ায় না। যথাসময়ে নন্দিতা বাড়ি ফিরে আসে ছেলেকে নিয়ে।নিজের মাকেও খবর দিয়ে নিজের কাছে এনে রাখে।এছাড়া তার কাছে কোন উপায়ও ছিলোনা।সুনীল এবং দেবেশ নানান ভাবে সাহায্য করতে থাকে।পরমা আরো বেশ কয়েক ঘন্টা নন্দিতার সংসারের  আটকে যায়।তবে এটা সে করে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাতে নন্দিতাকে ভালোবেসে।
 এদিকে দেখতে দেখতে রেখার মেয়ে ঋষার মুখেভাতের দিন এগিয়ে আসে।কিন্তু সেদিন সকালে ঘটে এক বিপত্তি!নানান আত্মীয়-স্বজনের সমাগমে যখন সকলেই গল্পগুজব,হাসিঠাট্টায় মত্ত ঠিক সেই সময়েই মেঝেতে পড়ে থাকা জলে পা পিছলে পড়ে যান রেখার মা।সুনীল সকলেই বোনের বাড়িতে পৌঁছে গেছে।দেবেশ বেলায় আসবে।মায়ের পায়ে প্রচণ্ড চোট লাগে ,তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন।সুনীল মাকে নিয়ে হাসপাতাল ছোটে।ভাইকে ফোন করে বলে দেয় সে যেন ঋষার মুখে ভাত দিয়ে দেয়।নন্দিতার কাছে মায়ের অসুস্থতার কথা গোপন রাখা হয়।হয়তো তার কোন কারণ ছিল না কিন্তু সুনীল তার ভাইকে সে কথাই জানায়।
  মায়ের গোড়ালীর ছোট একটি হাড় ভেঙ্গে যায়। পনেরদিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।সুনীল একাই অপারেশনের ধাক্কাটা সামলে নেয়।সাথে অবশ্য তার শ্বশুরমশাই ছিলেন সেই রাতে।দেবেশ সেদিন ভাগ্নির মুখেভাত দিয়ে যখন চলে আসতে যায় তখন রেখা আর তার ভগ্নিপতি অনেক কাকুতিমিনতি করে তাকে বিকেল অবধি থাকতে বলে।সে যখন রেখার বাড়ি থেকে হাসপাতাল পৌঁছায় তখন তার মাকে ওটি থেকে বের করে বেডে দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু জ্ঞান তখনও ভালোভাবে আসেনি।পরদিন অবশ্য ভগ্নিপতি সকলেই হাসপাতাল পৌঁছে গেছিলো।
  যেদিন মাকে ছাড়া হবে রেখা ফোন করে দাদাকে বলে,
--- দাদা তুই মাকে বাড়িতেই নিয়ে যাস।আমি তো মা আর ঋষা দুজনকে সামলাতে পারবো না।
 --- সে তুই না বললেও আমি মাকে এখন বাড়িতেই নিয়ে যেতাম।
  নন্দিতার মা তখনো নন্দিতার কাছেই।তিনি সুনীলের মাকেও দেখাশুনা করতে লাগেন।ইতিমধ্যে নন্দিতাও সুস্থ্য হয়ে ওঠে।সুনীলের মায়ের পায়ে প্লাস্টার সুতরাং তিনি সবসময় শুয়েই থাকেন।দেবেশ ও সুনীল বেরোনোর আগেই তারা দুজনে মিলে মায়ের মাথা ধুয়ে গা স্পঞ্চ সহ বাকি কাজগুলি করেই বেরোয়।তারপরের কাজগুলি নন্দিতা এবং তার মা মিলেই করে।হঠাৎ নন্দিতার বাবার শরীর খারাপ হওয়াতে তিনি বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হন।নন্দিতা ওই দুধের শিশুটিকে নিয়েই শ্বাশুড়ীর সেবাযত্ন আর সংসারের কাজ করে চলে।পরমা এখনো আছে।তার কাজের পরিমাণ বাড়াতে নন্দিতা নিজে থেকেই তার মাইনেটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
 একদিন দুপুরে যখন তার শ্বাশুড়ীকে খাটের উপরেই খেতে দিয়েছে তখন অসতর্ক বশত মাছের ঝোলের বাটিটা চাদরের উপর পড়ে যায়।তিনি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।নন্দিতা দেখতে পেয়ে বলে,
--- আমি আপনাকে আবার ঝোল এনে দিচ্ছি।আর আমি পরিষ্কার করে দেবো।আপনি এত নড়াচড়া করবেন না। পায়ে লেগে যাবে।
 শ্বাশুড়ী চোখ ভর্তি জল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলেন,
--- ছেলে দুটো খেয়ে বেরিয়ে গেছে।আমাকে আমার মাছের ঝোল দিয়ে দিয়েছো।এবার তো আবার আমাকে দিতে গেলে তোমারটা দিতে হবে।
--- ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।আমি বাকি যা আছে তাই দিয়েই খেয়ে নেবো।এখন আপনি অসুস্থ্য না খেলে গায়ে শক্তি হবে কি করে?
--- আর তুমি যে কদিন আগে আমার দাদুভাইকে এনে দিলে।তুমি ঠিকভাবে না খেলে আমার দাদুভাই দুধটা পাবে কোথা দিয়ে?অনেক অত্যাচার করেছি তোমার উপর।ভাবিনি কখনো মেয়ের বিয়ে দিলে সে পর হয়ে যায়,স্বার্থপর হয়ে যায়।এটাও ভাবতে পারিনি পরের মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত আপন করে নেওয়া যায়।পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।তোমাকে চিনতে বা বুঝতে কোনোটাই পারিনি।স্বার্থপরের মত শুধু নিজের মেয়ের কথাটাই ভেবেছি।
 নন্দিতা পুনরায় রান্নাঘর থেকে মাছের ঝোল এনে শ্বাশুড়ীর সামনে রেখে বললো,
--- খেয়ে নিন মা।আর ওসব কথা কোনদিন বলবেন না।আমি জানতাম আপনি একদিন ঠিক বুঝতে পারবেন।
 তিনি নন্দিতার মাথায় হাত রেখে বলেন,
--- এই ঝোলটা দুজনে মিলে খাই।আমি একটু ঢেলে নিই বাকিটা তুমি নিয়ে রান্নাঘরে রাখো।পড়ে ভাত দিয়ে খেয়ে নিও।
  এরপর থেকে নন্দিতার শ্বাশুড়ী আর কখনোই মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকেননি।ঘুরতে গেছেন।মেয়ে,জামাই থাকতেও বলেছে কিন্তু তিনি তার উত্তরে সবসময বলেছেন,"দাদুভাইকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হয়।"আসলে বৃদ্ধ বয়সে ছেলের বউয়ের হাতের যত্ন কে না চায়?

#আমার_লেখনীতে
#পরিবারের_পাঁচফোড়ন

ফিরে আসা

ফিরে আসা

 "লোকটাকে রোজ ওই একই সময়ে দেখতে পাই,কি অদ্ভুত সেই দৃষ্টি"-- কথাটা বলে অতসী একটু অন্য মনস্ক হয়ে যায়। দিবাকর তার পাশেই বসে একটা দূর্বাঘাস নিয়ে টুকরো টুকরো করছিল আর অতসীর কথা শুনছিল।কিন্তু অতসীকে চুপ করে যেতে দেখে সে চোখ তুলে পাশে বসা অতসীর গায়ে একটা ধাক্কা মেরে বলে,
--- চুপ করে গেলে যে?বল তারপর কি হল?এসব কথা তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেন?কোনদিন তার কাছে জানতে চাওনি কেন তিনি তোমার দিকে এরকম ভাবে তাকিয়ে থাকেন?
 অতসী দিবাকরের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- কিন্তু ভদ্রলোক তো শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কোন কথা তো তিনি আমার কাছে জানতে চান না তাই আমিও তার কাছে কোন কথা জানতে  চাইনি।
---তাহলে আমি একদিন তোমার সাথে তোমাদের পাড়াতে যাই। ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাই যে তিনি কেন তোমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকেন অথচ কোন কথা তুমি বলেন না।
--- না না তার কোন দরকার নেই।একজন বয়স্ক লোক তার পোশাক-আশাক বলে দেয় তিনি একজন ভদ্রলোক।
--- আরে আজকালকার দিনে পোশাক দেখে কি আর ভদ্র অভদ্র চেনা যায়?
---আমরা মেয়েরা অনেক কিছুই বুঝতে পারি একজন মানুষকে দেখে।যা তোমরা ছেলেরা পারো না।আমি নিশ্চয় একদিন ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইবো যে তিনি রোজ আমার দিকে তাকিয়ে ওইভাবে কি দেখেন অথচ কোন কথা বলেন না?আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি কেমন যেন একটা মায়া ভরা মুখ 
--- দেখো সেধে কোন বিপদ ডেকে এনো না।আর ঠিক আছে তুমি যখন বলছ তবে তাই হোক।কিন্তু যেদিন তুমি উনার সাথে কথা বলবে সেদিন আগে থাকতে আমাকে একটু জানিয়ে রেখো।সে রকম বুঝলে আমিও কাছেপিঠে থাকলে চলে যেতে পারবো।
দিবাকর একজন ব্যাংক কর্মচারী আর অতসী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কিছুদিন হল জয়েন করেছে। অতসী দিবাকরের সম্পর্কটা তাদের দুই বাড়ি থেকে মেনে নিয়েছে।বিয়ের ডেটও ফাইনাল হয়ে গেছে।প্রায় রোজই অফিস ছুটির পরে দুজনে একটু ফাঁকা জায়গায় বসে গল্পগুজব করে তারপর যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ায়।কিন্তু আজ প্রায়  চার পাঁচ দিন হল  একজন আগুন্তুক তার বাড়িতে ফেরার বড় রাস্তার মোড়ে একটি চায়ের দোকানে বেঞ্চের উপর বসে থাকেন আর সে যখন চায়ের দোকানটা পার হয় তখন তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেন।অথচ মুখে কোন কথা বলেন না।
অতসীর বাবা নেই।মা আছেন।মায়ের কাছে গল্প শুনেছে।তার যখন দুবছর বয়স  বাবা-মায়ের বনিবনা না হওয়ায় বাবা মা কে ছেড়ে চলে যান।মায়ের কাছে এটাও শুনেছে বাবা নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করে বিদেশে সংসার পেতেছেন।তাই তাদের ডিভোর্সটাও হয়নি।যেদিন রাতে তাদের মধ্যে চরম ঝগড়া হয় সেদিনই বাবা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান আর কোনদিন ফিরে আসেন না।কিন্তু মা আজও বাবার উদ্দেশ্যে শাঁখা সিঁদুর পলা সবই পরেন।
 দিবাকরের বাবা-মা দুজনেই আছেন।তারা অতসীর বাবা-মার ব্যাপারটা জানেন।কিন্তু বিয়েতে তাদের কোন আপত্তি নেই।তাদের একটাই বক্তব্য ছেলে মেয়ে উভয়ই  প্রতিষ্টিত।তারা একে অপরকে চেনে জানে।সংসার তারা করবে সুতরাং এ ব্যাপারে পরিবারের শুধুমাত্র মতটাই যথেষ্ট। অন্য কোন ব্যাপারে তারা নাক গলাতে চান না।
 দিবাকরের সাথে কথা বলার পরের দিন অতসী যখন বাড়ি ফেরে তখন দেখে ঠিক সেই একইভাবে ভদ্রলোক চায়ের দোকানের এক কর্নারে বসে আছেন। অতসী বাস থেকে নেমে ধীর পায়ে দোকানের কাছে এগিয়ে যায়।দোকানে তখনও কয়েকজন রয়েছেন খরিদ্দার। অতসী একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে ভদ্রলোকের পাশে এসে বসে।আজ লক্ষ্য করে ভদ্রলোকের পাশে রয়েছে একটা কাপড়ের ব্যাগ।অতসী বসার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকটি নিজের দুপায়ের উপর ব্যাগটি নিয়ে নেন। অতসী চুপচাপ ভদ্রলোকের পাশে বসে চা খেতে থাকে।কিন্তু সে আড়চোখে লক্ষ্য করে ভদ্রলোকটিকে।তিনি সেই একইভাবে অতসীর বিকে তাকিয়ে রয়েছেন।চা খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সে ভদ্রলোকের কাছে জানতে চায়,
--- আপনি চা খেয়েছেন?ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে না বলেন। কিন্তু সে একইভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।অতসী আর এক গ্লাস চায়ের অর্ডার দেয়।চা আসে।অতসী চায়ের গ্লাস ভদ্রলোকের হাতে দিতে দিতে জানতে চায়,
--- আগে আপনাকে এখানে কখনও দেখিনি।এখানে বুঝি আপনি নূতন এসেছেন?
ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে না বলেন।
অতসী পুনরায় তাকে বলে,
--- তাহলে আপনি এখানে কোন বাড়িতে থাকেন?আগে তো কোনদিন আপনাকে দোকান বা রাস্তাঘাটে কখনো দেখিনি। ভদ্রলোক বলেন,
--- তোমাকে যদি হাতে সময় থাকে তাহলে একটু ওদিকে ফাঁকা জায়গায় যাবে?তোমাকে কিছু কথা বলার আছে আমার।
অতসী অবাক না হয়ে অবাক হওয়ার ভান করে জানতে চায়,
--- আমাকে?ঠিক আছে চলুন।একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। ---হ্যাঁ মা তাই চলো।
 ভদ্রলোকের মুখে মা ডাকটা শুনে অতসীর অদ্ভুত একটা ভালোলাগা কাজ করে মনের ভিতরে। ভদ্রলোকের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে। ঠিক সেখান থেকে তার বাড়ির গেটটা দেখা যাচ্ছে।
--- বলুন কি বলতে চান --
--- আমি অনিমেশ চক্রবর্তী।
--- আমার বাবার নামটাও তাই।কি অদ্ভুত মিল।
 এবার ভদ্রলোক কোন কথা না বলে তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা থেকে একটা ছবি বাঁধানো বের করে অতসীর হাতে দেন।অতসী দেখে ছবিটিতে তার ছোটবেলার একটা ছবি যাতে সে তার বাবার কোলে রয়েছে।এই ছবিটা তাদের বাড়িতেও বাঁধানো আছে।অতসী হাতে ছবিটা নিয়ে বলে,
--- এটা আমি আর আমার বাবা।আপনি ছবিটা কোথায় পেলেন?এই একই ছবি আমাদের ঘরেও বাঁধানো আছে। আপনি ছবিটা দিতে এসেছেন?
ভদ্রলোক অসহায়ের মতো অতসী মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
---না মা এই ছবিটা দিতে আমি আসিনি।এই ছবিটাই যে মেয়েটি আছে সে তুমি আর যে  মানুষটা রয়েছে সে হচ্ছে আমি।আমি অনিমেষ চক্রবর্তী তোমার বাবা।
--- আমার বাবা?
--- আমিই তোর হতভাগ্য বাবা।
  অতসী চুপ করে তার বাবার কথাগুলো শুনতে থাকে।যখন তোর বছর দুয়েক বয়স তখন তোর মা আমাকে আর আমারই সহকর্মী একটি অল্প বয়সী মেয়েকে নিয়ে সন্দেহ করতে থাকে।অনেক বুঝিয়েছি।কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি।শেষ যেদিন তার সাথে আমার ঝামেলা হয় হঠাৎ করেই সে আমায় বলে বসে যে আমি যদি আর তার সাথে কথা বলি তাহলে তার মরা মুখ দেখবো।এটা ছিল আমার কাছে ফাঁসির সাজা ঘোষণার মত।এখন তুই বড় হয়েছিস বলতে একটু বাঁধা নেই তোর মাকে আমি আমার নিজের জীবনের থেকেও আজও বেশি ভালোবাসি।তাই সেই মুহূর্তে আমি এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই।আমি চাকরি করতাম একটি বিদেশী কোম্পানিতে।অনেক বলেকয়ে হাতে পায়ে ধরে চলে যাই আমেরিকা।কিন্তু কিছুদিন ধরে তোদের জন্য আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়।এমনিতেই এই বাইশ বছরে এমন কোন দিন নেই তোদের কথা মনে পড়েনি।কিন্তু কিছুদিন ধরে অফিসের কাজে মন বসাতে পারছিলাম না।শুধু তোদের কথা মনে পড়তো।তাই সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে আবার ফিরে এলাম তোদের কাছে।রাখবি আমাকে তোদের কাছে?আমি যা নিয়ে এসেছি তাতে বসে খেলেও আমাদের ঠিক চলে যাবে।
 অতসী বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, --এসব কি বলছ বাবা তুমি?আমি এখন চাকরি করি।আমি বড় হয়েছি।আজ আমি বুঝতে পারছি মা তার কাজের জন্য নিজে অনুতপ্ত।তাই আজও তোমার মঙ্গল কামনায় মা শাঁখা-সিঁদুর পরেন। শিব ঠাকুরের উপোস করেন। এমন কোনো দিন নেই শিব ঠাকুরের মাথায় জল না ঢেলে মাকে খেতে দেখেছি।কিন্তু বাবা তুমি তো আগেই আমাকে এ কথাগুলো বলতে পারতে।
--- ভয় করতো মা।যদি তুই বিশ্বাস না করিস,যদি কিছু বলতে গেলে চিৎকার করে লোক জড়ো করিস। পাড়ায় এখন সব নূতন নুতন মানুষজন।তাই কেউই আমায় চিনতে পারেনি।সেই এক সুবিধা হয়েছে আমার।
--- চলো বাবা,এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।আমরা বাড়ি যাই।মা তোমায় দেখে ভীষণ খুশি হবেন।
বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে সেই ছেলেবেলার মত বাবার হাত ধরেই অতসী বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

Thursday, May 20, 2021

সংসার কাহন ( পর্ব ১)

 সংসার কাহন (পর্ব ১)

  পরিবারের সকলের ছোট আর অতি আদরের নন্দিতার বিয়ে হল অতি সাধারণ এক সরকারি কেরানীর সাথে।যেহেতু নন্দিতার বাবা সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন আর শরীরও খুব একটা ভালো নয়;বড় তিন ছেলের মধ্যে দুজনেই বিবাহিত।তিন ছেলেই সুচাকুরে।কিন্তু নন্দিতার বাবা,মা মনেমনে ভেবেছিলেন তাদের অবর্তমানে যদি নন্দিতার উপরে তার দাদারা কর্তব্যে কোন গাফিলতি করে তাই তারা বেঁচে থাকতেই তাকে পাত্রস্থ করতে চেয়েছিলেন।নন্দিতার ইচ্ছা ছিল সেও নিজের পায়ে দাঁড়াবে।ছিল সব দাদাদের আপত্তি।কিন্তু সমেশবাবু কোন আপত্তিতেই কোন গুরুত্ব না দিয়ে নন্দিতার বিয়ে দিয়ে দেন সুনীলের সাথে।
  পরিবারের ছোট মেয়ে যে বাড়িতে বউ হয়ে এলো সেখানে সে বড় বউ।তাই প্রথম প্রথম উঠতে বসতে কাজেকর্মে তাকে প্রতিটা মুহূর্তেই কটূক্তি শুনতে শুনতেই এক সময়ে সে সংসারে পাকা গিন্নী হয়ে উঠলো।কিন্তু যত সহজে কথাটা বলা গেলো তত সহজে সে এই জায়গাটা অর্জন করতে পারেনি।বিয়েদারি ছোট ননদ মাঝে মধ্যে বাপের বাড়িতে এসেও মা ও ছোটভায়ের কান ভারী করে তুলতো। বেচারা সুনীল!সে সকালে উঠেই ছুটতো বাজারে ।সেখান থেকে ফিরেই  নাকেমুখে দুটি গুজেই অফিস।ফিরতে ফিরতে রাত নটা।কোন কোনদিন রাস্তাঘাটের কারণে হয়তো দশটাও বেজে যেত।নিজেদের ঘরে ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়েই চলে যেত মায়ের ঘরে।গল্প করতে করতে চা,বিস্কুট খেত।মায়ের সাথে কি গল্প হত কোনদিন নন্দিতা যেমন দেখতে যায়নি ঠিক তেমনই সুনীলের কাছে জানতেও চায়নি।আর সুনীল নিজের থেকেও তাকে কোনকিছু কোনদিন বলেনি।স্বামী ঘরে ফিরলে সংসারের নানান খুঁটিনাটি বিষয়গুলি কোনদিনও সুনীলের কাছে বলে তাকে বিব্রত করতে চায়নি।অথচ সে বুঝতে পারতো সুনীলের কথাবার্তায় সুনীল ঘটনা যা ঘটেছে হয়ত তার উল্টোটাই শুনে বসে আছে।এটা সে প্রথম প্রমাণ পায় সুনীল একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢোকে।
--- এই বিস্কুটটা আমাদের ঘরেই রেখো।তোমার যখন খেতে ইচ্ছা করবে এর থেকেই খেও।
--- কিন্তু আমি তো সারাদিনে একটা বিস্কুট খাই সকালে চা দিয়ে।আর তো আমি বিস্কুট খাই না।
--- না, মানে বলছিলাম আমাদের বাড়িতে বিস্কুট একটা কৌটোতেই রাখা হয়।
  নন্দিতা তখনই বুঝতে পারে শ্বাশুড়ী মা একটা সাধারণ কথা ইনিয়েবিনিয়ে তিনি তার ছেলের কাছে লাগিয়েছেন।সে সুনীলকে বললো,
--- আমি জ্ঞানের থেকে দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে যে কোন জিনিষ সংসারের জন্য কিনে আনলেই তা দুটি পাত্রে রাখা হয়।মা বলেন,এক পাত্রে সব ঢেলে রাখলে তাড়াতাড়ি সেটা ফুরিয়ে যায়।তাই তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করেই আমি দুটি পাত্রে বিস্কুট রাখি।নিজের খাওয়ার জন্য নয়।তখন তো তিনি আমাকে কিছু বলেননি।এই সামান্য সাংসারিক কথাটাও তোমার কানে দিতে হল?
 সুনীল কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।নন্দিতা তাকে ডাক দিয়ে বিস্কুটের প্যাকেটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
--- এটা ও ঘরে নিয়ে যাও।আর কাল আমার জন্য এক প্যাকেট মুড়ি নিয়ে এসো।কারণ বিস্কুট দিয়ে চা খাওয়ার সখ আমার সারা জীবনের মত মিটে গেছে।
 সুনীল সবই বুঝতে পারলো তবুও ব্যাপারটা হালকা করার জন্য বললো,
--- এত রাগ করনা,মায়ের বয়স হয়েছে।সবসময় সব কথা বুঝতেও পারেননা।কি বুঝতে কি বুঝেছেন তাই হয়তো ---
--- তাই বলে সংসারের এইসব ব্যাপার তোমায় বলবেন? আমার ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিলেন,ঠাকুমার সাথে কি মায়ের ঝামেলা হয়নি?কিন্তু কোনদিন তাকে দেখিনি বাবা অফিস থেকে ফিরলে মায়ের সম্মন্ধে লাগাতে।

ক্রমশঃ 

Wednesday, May 19, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩৬)

সুখের ঘরে আগুন (৩৬)

   প্রমিতার বাড়িতে গিয়ে ফুটফুটে ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে তাকে আদর করতে শুরু করে নিলয়।মুখে ভাতে বাবা,মা এসে তাকে আংটি দিয়ে আশীর্বাদ করে গেছিলেন।সে কিন্তু তার আদরের বোনপোটির জন্য একগাছা সোনার হার নিয়ে তাকে দেখতে গেছে।মামা বলে কথা!বেশ গল্পগুজব চলতে থাকে তাদের মধ্যে।হঠাৎ রিতেশ বলে,
--- ভায়া,বুড়ো হতে তো আর বেশি দেরি নেই। তা এবার তো সংসারী হতে হবে।
--- চিন্তা কোরো না। গাছে ঢিল বেঁধেছি ;খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের মনের আশা পূরণ হবে।
--- তা নিজেই পছন্দ করলে? ছাদনা তলায় যাওয়ার আগে সেই সোনামুখীকে আমাদের একটু দেখাবে না?
--- সে দেখতে পারবে। কটাদিন একটু অপেক্ষা করো ধর্য ধরো।
--- একটু বলো না ভায়া কিভাবে তার সাথে মাখোমাখো হলে?আগে নিজে দোলা খেলে নাকি আগেই তাকে দোলা দিলে?
--- বলবো বলবো।গল্প অনেক।একদিন সব জানতে পারবে।ভাঙ্গা কপালটা এবার জোড়া লাগবেই আশাকরি।
  বহুদিন পর শালা,ভগ্নিপতি মন খুলে বেশ ইয়ার্কি ঠাট্টা মারা হল।ওদের আলোচনার মাঝেই প্রমিতা উঠে চলে যায় তার ছেলেকে ব্রেষ্ট ফিডিং করাতে।ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সে যখন এ ঘরে আসে তখন নিলয় আর রিতেশ যে পজিশনে খাটে বসে গল্প করছিলো ঠিক সেই পজিশনেই দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রমিতা ওদের আর ডিস্টার্ব না করে ছেলের পাশে গিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
  ফেরার সময় বোন,ভগ্নিপতি মিলে বার কয়েক বলে দিলো যাতে উঠবি বৌদিকে নিয়ে সে অন্তত বিয়ের আগে একবার তাদের বাড়ি আসে।নিলয় তাদের কথা দেয় পরেরবার এসে নিশ্চয় তাকে সাথে করে নিয়ে আসবে।ফিরতি পথে চলন্ত উবেরের ভিতর বসে তার অন্তরে এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করতে থাকে।অনেকদিন পর রিতেশের সাথে মন খুলে আড্ডা দিয়ে মন ও মেজাজ দুটোই বেশ ফুরফুরে হয়ে যায় তার।হঠাৎ তার মোবাইলটা বেজে ওঠে। মোবাইলটা পকেটে বের করে দেখে নিখিলেশ তাকে ফোন করেছে। নিখিলেশ মাঝেমধ্যে ফোন করে তাকে।সে ভুবনেশ্বর থাকতেও করে বা কলকাতায় আসার পরেও বেশ কয়েকবার নিখিলেশের সাথে তার কথা হয়েছে।মাত্র অল্প কয়েকদিনেই নিখিলেশ আর নিলয় বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে।এখন তারা আর 'তুমি' নয় তারা পরস্পরকে তুই তুকারি করেই কথা বলে।অফিস টাইমে কারো হাতে যখন কোন কাজ থাকে না তখন দুজনে এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে শুরু করে।নিখিলেশ মাঝে মধ্যেই অফিস ছুটির পরে নিলয়ের কোয়ার্টারে চলে আসে কারণ নিলয়ের কোয়ার্টারটা অফিসের অনেকটাই কাছে।রাতেও সেখানে থেকে অনেক রাত অবধি গল্পগুজব চলে।বেশ ফুরফুরে মেজাজের সময় নিখিলেশের ফোনটা পেয়ে সে খুবই খুশি হয়ে গেলো।হ্যালো বলতেই নিখিলেশ তাকে জানালো সে একটা বিশেষ কাজে কলকাতা এসেছে।
--- কোথায় এখন?
--- সবে নামলাম ট্রেন থেকে।
--- এখন তো আর হোটেলে থাকা যাবে না।এই গরীব বন্ধুর বাড়িতে পদধূলি দিতেই হবে।(বলেই নিলয় হাসতে লাগলো)
--- আমি এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি কলকাতা এলে।তবে আমরা দুজনে ফিরবো কিন্তু একই সাথে।সেইভাবেই আমার টিকিট কাটা।
--- তুই আত্মীয়কে ফোন করে বলে দে যাওয়ার আগে দেখা করে যাবি।ওখান থেকে একটা উবের নে,আমি অ্যাড্রেস বলে দিচ্ছি।
--- কিন্তু ওখানে ---- 
--- আরে কোন কিন্তু নয়।আমি মাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি তুই আসছিস।মা,বাবা দুজনেই খুব খুশি হবেন।কারণ তোর কথা তাদের কাছে আমি অনেক গল্প করেছি।আর অচলাকেও দেখবি সে কত স্মার্ট হয়েছে,পড়াশুনায় মন দিয়েছে।
  নিখিলেশ মনেমনে ভাবে এবার একটু তাড়াতাড়িই কলকাতা আসার উদ্দেশ্যই অচলাকে দেখা।সেই এক রাতে সামান্য সময়েই অচলা যে তার হৃদয়ে অনেকটাই জায়গা করে নিয়েছে সে কথা কাউকে না বলতে পারলেও নিজের হৃদয়কে তো ফাঁকি দিতে পারেনি।আর এটা জানতোই তার কলকাতা আসার খবর পেলেই নিলয় তাকে তার বাড়িতেই উঠতে বলবে।
 উবের এসে নিলয়দের রাস্তার মোড়ে দাঁড়াতেই নিলয় এগিয়ে যায় তার দিকে।সে গাড়ির ভিতর থেকেই মাকে ফোন করে ঘরে না ঢুকেই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে অম্বিকার সাথে ফোনেo কথা বলছিলো।নিখিলেশকে দেখতে পেয়েই সে ফোনটা কেটে দিয়ে তাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে।বাবা,মা দুজনেই তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।আর রান্নাবান্না শেষ করে অচলা তখন নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত।দরজা খোলাই ছিল।তাই কোন আওয়াজ অচলার কানে পৌঁছায়নি।সে একমনে পড়ার টেবিলে বসে পড়াশুনা করে যাচ্ছিলো।তাকে বলায় আছে সে যখন পড়াশুনা করবে যেন দরজাটা ভেজিয়ে রাখে।মলিনাদেবি নিজে উঠে গিয়ে চা করে আনেন। নিখিলেশের উৎসুক চোখদুটি এখানে আসার পর থেকেই অচলাকে খুঁজে চলেছে।কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহসটা করে উঠতে পারছে না।গল্পগুজব বেশ জোর কদমেই এগিয়ে চলে। নিখিলেশের ব্যাকুল চোখদুটি ঘরের চারিদিকে বারবার কি যেন খুঁজে চলেছে।হঠাৎ নিলয় বলে উঠলো,
--- মা,তোমার মেয়ে মনেহয় টের পায়নি আমরা বাড়িতে এসে গেছি। টের পেলেই কিন্তু পড়াশুনা পিছনে ফেলে এসে আতিথেয়তা শুরু করে দিত।
মলিনাদেবি ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলে উঠলেন,
--- একদম ঠিক কথা বলেছিস।কোন কাজ পেলেই হয়।আমাকে তো কিছুই করতে দেয় না।আজকাল তো বাজারেও যাওয়া ধরেছে।হাজার বারণ করলেও শুনছে কে?ঘড়ি ধরে ঠিক দশটায় উঠে আসবে।তোর বাবার ওই সময় একটা ওষুধ খাওয়ার সময় যে।খাওয়াদাওয়া,ওষুধ কোন কিছুর সময় এদিক থেকে ওদিক হতে দেবে না।তারউপর আছে আবার শাসন।
 কথাগুলো বলে তিনি হাসতে লাগেন।নিখিলেশ অবাক হয়ে শোনে অচলা কিভাবে এদের সকলের হৃদয় জয় করে নিয়েছে।কিন্তু পাছে দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাই অচলার আলোচনায় সে অংশগ্রহণ করে না।সেখানে নরেশবাবুও উপস্থিত ছিলেন।এবার তিনি বললেন,
--- কিন্তু মলি এটা তো তুমি বললে না ;সে কিন্তু সবকিছুর মাঝেও কখনোই পড়াশুনার ব্যাপারে ফাঁকি দেয় না।সব সময় তার একটাই কথা দাদা আমাকে যে সুযোগটা দিয়েছে তাকে কাজে লাগাতেই হবে।আমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে সব থেকে খুশি হবে দাদা।
--- এমনভাবে সে বাবা, মা,দাদা বলে ডাকে কখনোই মনে হয় না আমরা তার নিজের কেউ না। জানো নিখিলেশ,মেয়েটার ভিতর অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে অন্যকে আপন করে নেওয়ার।এই পড়াশুনা কাজকর্ম সবকিছু নিখুঁতভাবে করার পড়েও আমাদের সেবা যত্নের কোন ত্রুটি সে রাখে না।নিজের মেয়ে থাকলেও বোধহয় এতটা সে করতো না।সত্যিই এই বয়সে এসে অচলার মত একটি মেয়ে পেয়ে এই বুড়োবুড়ির আর একাকিত্বে ভুগতে হয় না।নিলয় এখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ার পর আমাদের তো পাগল পাগল অবস্থা হয়ে গেছিলো।কিছুতেই সময় কাটতো না।তোমার মেসোমশাই সন্ধ্যায় বাইরে আড্ডা মারতে বেরিয়ে গেলেই আমার মাথাটা আরও গরম হয়ে যেত।সময় যেন কাটাতাম দুজনে ঝগড়া করেই।হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন মলিনাদেবী ।
 এদিকে অচলা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় দশটা বাজতে চললো।"মা,এত রাত হয়ে গেলো দাদা তো এখনো তার বন্ধুকে নিয়ে এলো না ----"বলতে বলতে সে ডাইনিং কাম ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখে সবাই বেশ আলোচনায় ব্যস্ত।
মলিনাদেবী বললেন,
--- ওই দেখ আমি বললাম না দশটা বাজলেই উনি উঠে আসবেন বাবার ওষুধ দিতে।
--- দাদা কখন এসছে সেটা তোমরা আমাকে জানাওনি?কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে অচলা।
নিখিলেশ অচলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আসলে তুমি পড়ছিলে তো তাই কেউ আর তোমাকে ডিস্টার্ব করেনি।তুমি কেমন আছো?
--- জীবনে কোনদিন ভাবতেই পারিনি যে আমি এত ভালো থাকতে পারবো।দাদা আমাকে একটা সুন্দর জীবন দিয়েছে।বাবা,মা দিয়েছে।বাবা,মায়ের স্নেহ ভালবাসা কোনদিন পাইনি।আর এখানে না এলে জানতেই পারতাম না সেই স্নেহ ভালোবাসা কেমন হয়।আপনি কেমন আছেন?
--- আমি ভালো আছি।
--- ওরে নিখিল (নিলয় এখন এই নামেই ডাকে নিখিলেশকে) ওর সাথে কথায় পেরে ওঠা ভীষণ মুস্কিল।কথা খুব গুছিয়ে বলতে পারে।
--- মা দাদা কিন্তু আবার আমার পিছনে লাগলো।
  নিখিলেশ সবকিছু দেখছে ,শুনছে আর মনেমনে ভাবছে একটা অচেনা মেয়েকে কিভাবে একটা পরিবার আপন করে নিয়েছে।অবশ্য এই কয়েক মাসে নিলয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই সে নিলয়ের কথাবার্তা,ব্যবহারেই বুঝতে পেরেছে তাদের পরিবারটা কত ভালো।"গাছের পাতা দেখেই বোঝা যায় গাছটি কেমন ফল দেবে"-- গুরুজনেরা কথাটা ঠিকই বলেন।

ক্রমশঃ 


      

Monday, May 10, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩৫)

সুখের ঘরে আগুন (৩৫)

     ঠিক সকাল সাড়ে নটা নাগাদ অম্বিকা নিলয়দের বাড়িতে চলে এলো।নিলয়ের বাবা-মা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।অচলা তৈরিই ছিল।মা,বাবাকে প্রণাম করে সে অম্বিকার সাথে বেরিয়ে পড়লো।অবশ্য নিলয়ের মা তাকে চা খাওয়ার জন্য বলেছিলেন।কিন্তু অম্বিকা জানায়,
--- মাসিমা,সবে পেট ভরে ভাত খেয়ে বেড়িয়েছি।আর একদিন এসে নাহয় চা খেয়ে যাবো।এখনই এখনই না বেরোলে খুব কষ্ট হবে রোদে যেতে।
 অচলার সাথে অম্বিকার সেদিনই খুব ভাব হয়ে যায়। কথায় কথায় অম্বিকা এতবার নিলয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে অচলা সহজেই বুঝে ফেলে নিলয়ের সাথে তার রোজই কথা হয়।নিলয়ের কথা বলতে গেলে অচলা লক্ষ্য করে অম্বিকার চোখমুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।অম্বিকা যে তার দাদাকে ভালোবাসে অচলা সহজেই এটা ধরে ফেলে।তাই হাসতে হাসতে অম্বিকার কাছে সে জানতে চায়,
-- আচ্ছা অম্বিকাদি তুমি তো আমার দাদাকে খুব ভালবাসো। তাহলে আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো?দিদি ?নাকি বৌদি? অম্বিকা তখন নিজের জিভ বের করে দাঁতে কেটে বলে, ---আরে না,সে সুযোগ যদি কোন দিন আসে তাহলে নিশ্চয়ই দিদির থেকে বৌদি করে নিতে পারবে।এখন কিন্তু এসব কথা যেন মাসিমা,মেসোমশাই না জানেন।তোমার দাদা বলেছে,এবার এসে সে এই ব্যাপারে তাদের সাথে কথা বলবে।তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।তোমার দাদার ইচ্ছা তুমি লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াও।আর তার জন্য যা যা করণীয় তোমার দাদা করবে।আর বাইরে ছুটোছুটি, দৌড়াদৌড়ি আমার হবু ননদিনির জন্য আমিই করব।
---সত্যি কথা বলতে কি জানো দিদি আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এই রকম একটা পরিবারে আমি আশ্রয় পাবো। আর নিলয়দার মতো একজন দাদা পাবো।সেদিন যে পরিস্থিতিতে আমি তার পিছন নিয়েছিলাম আজকে ভাবলে এখনো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।চিনিনা জানিনা একটা মানুষকে দেখে হঠাৎই মনে হয়েছিল বোধহয় এই মানুষটা আমাকে একটা রাতের মত আশ্রয় দিতে পারবে।কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি এই মানুষটাই আমার মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়াবে। আর তারপর বাবা-মা কি ভালো মানুষ!কখনোই বুঝতে পারি না যে তারা আমার রক্তের সম্পর্কে কেউ না।অবশ্য রক্তের সম্পর্কের কেউ হলেই যে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকবে, ভালোবাসা থাকবে তা কিন্তু নয়।আমি আমার নিজের জীবন দিয়ে এই সত্যটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি।ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট পেয়ে আজ এই জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি। ঈশ্বর রুপে একজন দাদা পেয়েছি।আর সেই দাদা আমাকে একটা পরিবার দিয়েছে,তার বাবা মাকে বাবা মা বলে ডাকার অধিকার দিয়েছে।আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শুধু স্বপ্ন দেখাচ্ছে তা নয় তোমার মত একজন মানুষের সংস্পর্শে এসে আলোর পথে হাঁটার সাহস যোগাচ্ছে।আর এই সবই হচ্ছে আমার দাদার জন্য।আমার জীবনে হঠাৎ করেই যে সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে যাবে এটা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল।আজ আমার আর কোন কষ্ট নেই।
--- সেতো সব বুঝলাম।কিন্তু দাদার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে কিন্তু মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে।
--- করবো দিদি।জীবনে যে সুযোগ আমি পেয়েছি সে সুযোগ আমি হাতছাড়া কিছুতেই করবো না।আমি তোমাদের সকলের এই পরিশ্রমের দাম দেবো।
  সেন্টারে ঢুকে কিছু ফর্মে সই করে,টাকা জমা দিয়ে সামান্য কিছু বইপত্র নিয়ে ওরা বেরিয়ে পরে।সেন্টার থেকে বলে দেয় আবার পনেরদিন পরে আসতে।বাইরে বেরিয়ে অম্বিকা অচলাকে জোর করে ফুচকা খাওয়ায়।নিজেও খায়।তারপর বিকেলের আগেই দুজনে ফিরে আসে।
  মাসখানেক পরে নিলয় আসে বাড়িতে।অচলা বেশ মন দিয়েই পড়াশুনা শুরু করে।সাথে সংসারের যাবতীয় কাজ।কিছুতেই সে মলিনাদেবীকে কোন কাজ করতে দেয় না।খুব ভোরে উঠে রান্না সহ সব কাজ সেরে নেয়। মা,বাবা ঘুম থেকে উঠার পরে একসাথে টিফিন করে দশটার মধ্যেই সে তার পড়ার টেবিলে চলে যায়।কোন কোনদিন সে এখন নিজেই বাজারে চলে যায়।পড়তে পড়তে কিছু আটকে গেলে বাচচাদের মত বই,খাতা নিয়ে বাবার কাছে চলে আসে।দুজন বুড়ো বুড়ির জীবনে অচলা যেন অক্সিজেন নিয়ে এসেছে।তাদেরও সময় বেশ ভালোভাবেই কেটে যায়।এদিকে নিলয় বাড়িতে আসায় তার বাবা,মা আশা করে থাকেন এবার নিশ্চয় সে অম্বিকা আর তার সম্পর্কের কথা তাদের বলবে।কিন্তু নিলয় কোন কথায় তাদের বলছে না দেখে স্বামীর সাথে আলাপালোচনা করে একদিন ডিনার টেবিলে মলিনাদেবী নিজেই উত্থাপন করেন।
--- হ্যাঁ রে নিলু,এবার তো তোকে সংসারী হতে হবে।
 নিলয় খেতে খেতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,
--- হু 
--- আরে হু কি রে ?মেয়ে দেখা শুরু করবো নাকি তুই নিজেই দেখবি।
--- রক্ষা করো মা,এবারে এ দায়িত্বটা আমি নিজেই নেবো।
 এদের কথার মাঝখানে অচলা হঠাৎ করেই বলে বসে,
--- অম্বিকাদি তো আছে।ওর সাথেই তোমরা দাদার বিয়েটা ঠিক করো না।
 কথাটা শুনে নিলয় ভিসুম খায় আর সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবা জলের গ্লাসটা ধরে তার সামনে ধরে বলেন,
--- জলটা খেয়ে নে বাবা।এবার তুই তোর জীবনে যে সিদ্ধান্ত নিবি আমরা সেটাই মেনে নেবো।অম্বিকা মেয়েটা খুবই ভালো।আগে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল।ওর বাবা,মা এই সম্পর্কটা মেনে নেবেন কিনা সেটা কথা বলে দেখতে হবে।
--- না,না এই মুহূর্তে তোমাদের কোন কথা বলতে হবে না।আমি সময় হলে তোমাদের বলবো।
 নিলয়ের খাওয়াও শেষ হয়ে গেছিলো।কথা কটা বলেই সে সেখান থেকে চলে গেলো।আজ সে আর অম্বিকা দুজনে মিলে সিনেমায় গেছিলো।অম্বিকা আজ ছুটি নিয়েছিল।সারাটা দুপুর দুজনে নানান জায়গায় ঘুরে ,সন্ধ্যায় সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরে।সকলেই তারা বেরিয়েছিল।দুপুরে নিশিতার বাড়ি খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।অম্বিকার সাথে কথা হয় তার আগে সে তার মা,বাবাকে কথাটা বলবে।তাদের মত থাকলে দু বাড়ির অভিভাবকেরা বিয়ের ডেট ফাইনাল করবেন।রাতে আম্বিকার সাথে এই বিষয়ে আবারও কথা হয়।
  আগামীকাল নিলয়ের ভগ্নিপতি রিতেশের বাড়িতে তার বোনপোকে দেখতে যাওয়ার কথা। ফোনে কথা হয়েছে।নিলয় ভুলেই গেছে মাকে কথাটা জানাতে।অম্বিকার সাথে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে মাকে বলতে এসে দেখে তারা দরজা দিয়ে শুয়ে পড়েছেন।অচলার ঘরে লাইট জ্বলছে দেখে ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে দেখে অচলা টেবিল ল্যাম্পের আলোতে তখনো পড়ছে।নিলয়কে দেখতে পেয়ে বললো,
--- কিছু বলবে দাদা?
--- মাকে বলে দিস কাল দুপুরে আমি খাবো না।প্রমিতার বাড়িতে যাবো।
 অচলা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ জানায়।নিলয় এগিয়ে এসে অচলার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
--- মাঝে মাঝে আমার কি মনেহয় জানিস?আগের জন্মে তুই নিশ্চয় আমার আপনার কেউ ছিলি।তাই এ জন্মে এভাবেই আমাদের দেখা হয়েছে।
--- আমার কাছে তুমি ভগবান দাদা!সেদিন যদি তুমি আমায় সাথে করে নিয়ে না যেতে তাহলে আমার যে কি হত ভাবতেই আমার গা শিউরে ওঠে।
--- যা ভাবলে গা শিউরে ওঠে তা ভাবিস কেন?পুরনো কথা কখনো আর মনে করবি না।তোর জীবনটাকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা করণীয় আমি করবো।কিন্তু পরিশ্রমটা তোকে করতে হবে।আমি চাই পড়াশুনা শিখে তুই নিজের পায়ে দাঁড়া।
--- একটা কথা বলবো দাদা?তুমি কিন্তু কিছু মনে করতে পারবে না।
--- হ্যাঁ বল না ।তোর এই পড়ার ব্যাপারে যদি কখনো কিছু কেনার দরকার হয় তুই অনায়াসে তোর আম্বিকাদিকে বলবি।ওকে বলায় আছে টাকাপয়সা নিয়ে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।
--- আচ্ছা দাদা,তুমি কবে আমার দিদিকে বৌদি করে নিয়ে আসবে?
--- এই অনেক রাত হল।এবার শুয়ে পর।আজ আর পড়তে হবে না।
নিলয় দ্রুত সেখান থেকে কেটে পরলো।তার বুঝতে আর বাকি রইলো না যে তার আর অম্বিকার ব্যাপারটা বাড়ির সবাই জেনে গেছে।এটাও ভাবলো একদিক থেকে ভালোই হয়েছে।তাকে নিজ মুখে আর বলতে হলো না কিছু।
   অম্বিকা মনেমনে ভাবে আগে বাবাকে সে সবকিছু জানাবে।বাবা অবশ্য কোন দ্বিমত করবেন না বলেই তার বিশ্বাস।আর বাবা রাজি থাকলে মাকে তিনিই রাজি করিয়ে ছাড়বেন।কিন্তু মাকে রাজি করাতে গেলে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে বলেই তার ধারণা।আজ কালের মধ্যেই বাবাকে কথাটা বলতে হবে।

ক্রমশঃ