সুখের ঘরে আগুন (৩৭)
আজকে খাবার টেবিলে নিখিলেশ, নিলয়, আর নরেশবাবু আগে খেতে বসলেন।আজ মলিনাদেবী আর অচলা ওদের সাথে খেতে বসলো না।দুজনে মিলে ওদের পরিবেশন করলো।খেতে খেতে নিলয় নিখিলেশকে বললো,
--- তোর কি কাল কোন কাজ আছে?
--- হ্যাঁ ওই সকলের দিকে আমি একটু বেরোবো।
--- আমি সাথে গেলে অসুবিধা আছে?
--- কি যে বলিস না!তুই না বললেও আমি ঠিক তোকে আমার সাথে যেতে বলতাম।
--- কোথায়?
--- গেলেই জানতে পারবি।
নিখিলেশ আড় চোখে কয়েকবার অচলার দিকে তাকায়।কিন্তু অচলা সেটা খেয়ালও করে না।ওদের খাওয়া হয়ে গেলে অচলা মলিনাদেবীকে বলে,
--- মা,তুমি একটু বসো।আমি বাবার ওষুধটা দিয়ে এসে খাবার বের করছি।
--- আচ্ছা ঠিক আছে তুই ওষুধ দিয়ে আয় এদিকটা আমি দেখছি।পুরো বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। হ্যাঁরে তুই কি ভেবেছিস?আমাকে কুরে না করে ছাড়বি না?
নিখিলেশ তখন হাসতে হাসতে বলে,
--- কপাল করে ছেলেমেয়ে পেয়েছেন মাসিমা।সকলের কপালে এমন জোঠে না।
কোন কথাই আর অচলার সাথে নিখিলেশের হয় না।পরদিন সকাল আটটার মধ্যেই নিলয় ও নিখিলেশ বেরিয়ে যায়।টিফিন খেতে বললে নিখিলেশ জানায় যেখানে ওরা যাচ্ছে সেখানেই টিফিন করবে।
বেহালা ঠাকুরপুকুর থেকে ট্যাক্সিতে প্রায় পঁচিশ মিনিট।এসে পৌঁছায় সামালী বলে একটি গ্রামে।সেখান থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ।এবরোখেবরো ইটের রাস্তা।দুপাশে অসংখ্য নাম না জানা কত বড় বড় গাছ,ধানীজমি, সবুজে সবুজে কোন এক জায়গায় আকাশটাও যেন সেই সবুজ মাঠের প্রান্তরে গিয়ে মিশেছে।মনটা ভালো হয়ে যায় নিলয়ের।কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারেনা নিখিলেশ এই রাস্তা ধরে কোথায় চলেছে?তার মনের ভিতর কৌতুহল জমা হতে থাকে। কিন্তু কোন প্রশ্ন সে করে না তার বন্ধুকে।চুপচাপ নিখিলেশকে অনুসরণ করে চলেছে।নিখিলেশের কাছে একটা বেশ বড় ব্যাগ।ভুবনেশ্বর থেকে আসবার সময়েই সে ওই ব্যাগটা নিয়ে এসেছে।কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা এসে পৌঁছাল তাদের গন্তব্যে।একটা ছোট গেট ,বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বাঁশের চারিপাশে বেরা দেওয়া।প্রায় পাঁচ থেকে ছ'টা ঘর ওখানে।নিখিলেশকে দেখতে পেয়েই বেশ কিছু বাচ্চা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।তাদের ভিতর থেকেই একটি ছোট বাচ্চাকে নিখিলেশ কোলে তুলে নিলো।বয়স তার বছর পাঁচেক হবে বলেই নিলয়ের মনেহল।বাচ্চাটি কোলে উঠেই নিখিলেশের গলা জড়িয়ে চুমু খেতে লাগলো।বাচ্চাগুলোর আচার আচরণে নিলয়ের মনে হতে লাগলো যেন অনেকদিন পর তারা তাদের ভালোবাসার আপন কোন মানুষকে কাছে পেয়েছে।এরই মধ্যে একটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দুজন ভদ্রলোক ও একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা।তারা দুই বন্ধুকে সাদর আহ্বানে ভিতরে নিয়ে গেলেন।বাচ্চাগুলো কিন্তু অফিস রুমটাতে ঢুকলো না।নিলয় চুপচাপ শুধু সব লক্ষ্য করেই চলছিলো।নিখিলেশ ভদ্রমহিলাকে বলল,
--- দিদি,চলুন এগুলো ওদের দিয়ে দিই।
--- এগুলো বিকেলের জন্য রাখুন দাদা।আজ আপনি আসবেন বলে ওরা সকাল থেকে না খেয়েই আছে আপনার সাথে একসাথেই খাবে বলে।
--- ওমা তাই নাকি? বেলা যে অনেক হলো তাহলে চলুন, এক্ষুনি আমরা খেতে বসে যাই।ওদের তো খিদে পেয়ে গেছে। আহারে! আমাকে যদি আগে ফোন করে জানাতেন তাহলে আমি আরো সকাল-সকাল আসার চেষ্টা করতাম।কথাগুলো বলে নিখিলেশ উঠে দাঁড়িয়ে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
--- চল, টিফিন করে নি।আমি জানি তোর মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে।তোর সব প্রশ্নের উত্তর যেতে যেতে দেবো।এখন চল বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে।ওদের সাথে আমরাও খেতে বসে যাই। ওরা ওই অফিস রুম থেকে বেরিয়ে এসে আর একটা রুমের মধ্যে ঢোকে।সেই রুমে বেশ কয়েকটা টেবিল চেয়ার পাতা আছে।আর বাচ্চাদের বসে খাওয়ার মত নিচু ধরনের দুটো টেবিল আর টেবিলে খাওয়ার জন্য রয়েছে টেবিলের চিরিদিকে ছোট ছোট চারটে বেঞ্চ।ওখানে এসে বয়স্ক ভদ্রমহিলা বেশ বড় ধরনের একটা ঘণ্টা কয়েকবার বাজালেন।প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটটা বাচ্চা এসে ঐখানে এসে ঢুকলো।এর মধ্যে খুব ছোট বাচ্চাও আছে।এদের প্রত্যেকেরই বয়স পনের বছরের মধ্যে।যারা একটু বড় তাদের কেউ কেউ ছোট বাচ্চাগুলোকে কোলে করেই নিয়ে এসে নিদ্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে দিলো।বড়রা ছোটদের খাবার খেতে সাহায্যও করছে। ছোলার ডাল আর রুটি।একদম ছোট বাচ্চা দুটির জন্য সুজির হালুয়া।প্রতিটা বাচ্চার মধ্যে এত নিগূঢ় আত্মিক সম্পর্ক দেখলে মনেহয় এরা যেন একই পরিবারের সবাই।এতগুলি বাচ্চা কিন্তু কোন চিৎকার,চেঁচামেচি নেই।প্রত্যেকেই নিচু স্বরে এ ওর সাথে কথা বলছে।নিলয়ের এই সবকিছু দেখে ভীষণ ভালো লাগছে।তার বুঝতে একটুও বাকি নেই এই অনাথ আশ্রমের বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব অনেকটাই তার বন্ধু পালন করে।কিছুক্ষণ আগেই অফিস রুমে নিখিলেশ নিলয়ের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ফলে এক ভদ্রলোকের সাথে খাওয়াদাওয়া শেষে আলাপচারিতায় নিলয় জানতে পারে বছর পাঁচেক হল এই আশ্রমটি হয়েছে।গ্রামের বাপ মা হারা অনাথ ছেলেমেয়েগুলোর আশ্রয়স্থল এটাই।এদের লেখাপড়া,খেলাধুলা সবকিছুই শেখানো হয়।কেউ কেউ এদের মধ্যে খুব সুন্দর আঁকে।তাদের আঁকাও শেখানো হয়।যে চারজন এখানে বাচ্চাগুলোকে দেখভালের জন্য রয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষ।বিনা পারিশ্রমিকেই তারা ওদের দেখভাল করেন।ভদ্রলোক নিলয়কে জানালেন "আপনার সাথে আমাকে নিয়ে তিনজনের পরিচয় হল।আর একজন গেছেন একটু বাইরে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনতে।এই যে আমরা চারটি প্রাণী আমরাও কিন্তু সংসার বিতাড়িত মানুষ।যে দিদিকে দেখছেন উনি স্বামীহারা।সন্তানদের কাছে আশ্রয় হয়নি।আমরা বাকি তিনজনই ভালো চাকরি করতাম।তিনজনই বিপত্নীক।সংসারে সন্তানদের কাছে বোঝা।আমরা তিনজনই পেনশন পাই।আমাদের ধ্যানজ্ঞান এই আশ্রম।একা নিখিলেশবাবুর পক্ষে তো এতগুলো বাচ্চাকে মানুষ করা সম্ভব নয়।আমরাও আমাদের পুরোটাই এখানে এদের জন্যই খরচ করি।কিছু লোকজনও রাখতে হয়েছে নানান কাজের জন্য।তাদের স্বল্প পারিশ্রমিক না দিলে তো চলে না।তারাও তো গরীব মানুষ।"নিলয় মন্ত্রমুগ্ধের মত ভদ্রলোকের কথা শুনে চলেছে।নিখিলেশের প্রতি তার ভালোবাসা যেন এক নিমেষে কয়েকশত গুন বেড়ে গেলো।নিখিলেশকে প্রথম থেকেই সে ভালো ছেলে বলে জানতো।তাই অল্প কয়েকদিনেই তার সাথে বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় হয়।কিন্তু আজ এখানে না আসলে নিখিলেশের গুণের আর একটা দিক তার কাছে উন্মোচন হত না।
দুপুর নাগাদ দুজনে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ে।বারবার তারা বলেছিলো দুটো ডাল,ভাত খেয়ে তবে বেরোতে।কিন্তু কিছু কাজ থাকায় নিখিলেশের ওদের বেরোতেই হল।
ফেরার পথে নিখিলেশের কাছে নিলয় জানতে পারলো এই জমিটা তার নিজের।এটা তার বাবার কেনা জমি।গ্রামের অনাথ ছেলেমেয়েগুলোর কথা চিন্তা করেই সে এই আশ্রমটি গড়ে তোলে।কিন্তু প্রথম অবস্থায় কিভাবে শুরু করবে কিছুই বুঝতে না পেরে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে এই ব্যাপারে সে কথা বলতে যায়।তিনি সর্বরকম ভাবে তাকে শুধু সাহায্য করেনই না ;ছেলের সংসার থেকে বেরিয়ে এসে এই আশ্রমে আশ্রয় নেন। যার সাথে নিলয় কথা বলছিল তিনিই সেই ব্যক্তি।সরকারি স্কুল শিক্ষক ছিলেন।পেনশন পান। পুরো টাকাটাই তিনি ব্যয় করেন বাচ্চাগুলোর পিছনে।শুধু উনি নন বাকি দুজনও।দিদির কোন রোজগার নেই ঠিকই কিন্তু বাচ্চাগুলোকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন।" আমি আর কতটুকুই বা করতে পারি।বছরে তিন থেকে চারবার আসি ওদের কাছে।পিছুটান নেই।সামান্যই করি।উনারা না থাকলে আমার একার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হত না এই বিশাল দায়িত্ব সামলানো।নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি বাবা,মা হারা বাচ্চাদের কি কষ্ট।"
নিখিলেশের কথা শেষ হলে নিলয় বললো,
--- তোদের সাথে আজ থেকে আমিও আছি।তোদের সকলের মত অতটা না পারলেও সামান্য কিছু তো করতে পারবো।প্রায় তিনমাস হতে চললো তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব।কিন্তু কখনোই তুই আমাকে এই আশ্রমের কথাটা জানাসনি।আসার আগেও যদি জানতে পারতাম প্রথমদিন কিছু তো ওদের জন্য কিনে নিয়ে আসতে পারতাম।
--- আরে,দেওয়ার দিন তো পালিয়ে যাচ্ছে না।এরপর থেকে যখন আসবো দুজনে একসাথেই আসবো।সব থেকে ভালো হত কি জানিস?আমরা দুজনেই যদি কলকাতা ট্রান্সফার পেতাম।সেটা তো কিছুতেই সম্ভব নয় এই মুহূর্তে।আমার তো মনেহয় কম করে পাঁচ বছর থাকতে হবে ভুবনেশ্বর। শোন নিলয়,আমি কিন্তু দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু বেরোব।যে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি সেখানে একটু যেতে হবে।
--- রাতে ফিরবি তো?
--- হ্যাঁ হ্যাঁ ফিরে আসবো।অভয় দিস তো একটা কথা বলি?
--- ন্যাকামো হচ্ছে?
নিখিলেশ হাসতে হাসতে বললো,
--- যতদিন তোর কাছে রাতে ভুবনেশ্বরে থেকেছি প্রতিদিনই দেখেছি একটা ফোন আসলেই চাপা স্বরে কথা বলতে বলতে তুই ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিস।বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি তিনি একজন ভদ্রমহিলা।যে কিনা নিলয়ের হৃদয় জুড়ে রয়েছে।
--- একদম সঠিক অবজারভেশন!অবশ্যই পরিচয় করিয়ে দেবো।
ক্রমশঃ