গোবিন্দবাবুর কথা শুনে যখন সকলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সঞ্জয়ও বেরোনোর উদ্যোগ করতেই তিনি ভাগ্নের কানের কাছে মুখটা নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন,
-- ওরে ছাগল,তোকে বেরোতে বলিনি তুই একটু মেয়েটার সাথে একাকী কথা বল।
মামার কথা বলার ধরণ দেখে সঞ্জয় হেসে ফেলে।একে একে সকলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।সকলের শেষে বেরোন গোবিন্দবাবু।তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিচ্ছেন দেখে সকলেই এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে।আর ওদিকে ঘরের ভিতরে দুটি তরুণ,তরুণী খাটের দুপাশে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর সঞ্জয় নিজেই সুচন্দার কাছে জানতে চাইলো,
--- পড়াশুনা তো শেষ এরপর কি করার ইচ্ছা আছে?
--- চাকরির চেষ্টা করবো যদি বাঁধা না পাই।
--- একটা কথা তোমায় আমি দিতে পারি এর পরেও যদি তুমি পড়তে চাও আমাদের বাড়ি থেকে কোন আপত্তি করবে না।আর যদি চাকরির চেষ্টা করে চাকরি পাও তাতেও আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।আমাদের অর্থ নেই ঠিকই কিন্তু ভালোবাসার মন আছে পরিবারের সকলের।আমি হয়ত কোনদিন তোমায় নিয়ে ফাইভ স্টারে খাওয়াতে পারবো না কিন্তু পেট ভরে তিনবেলা খাবারের কোন কষ্ট কোনদিনও হবে না।
--- এসব কথা বলছেন কেন?আমার বাড়ির থেকে সব দেখেশুনেই তো বিয়েতে রাজি হয়েছে।
--- আমি তোমায় তুমি বলছি।আমাদের বিয়ের ফাইনাল ডেট ঠিক হয়ে গেছে।তাই আমাকে আপনি নয় তুমি বলে বলো।তাতে দেখবে নিজেও মন খুলে কথা বলতে পারবে।
আরো কিছু বলার আছে।খুব কষ্ট করে মামার সাহায্যে মা আমাদের মানুষ করেছেন।আজ আমরা একটু সুখের মুখ দেখেছি। আমিই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম।আমাদের বাড়িতে এসে সবকিছু মানিয়ে যদি চলতে পারো দেখো সকলে তোমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে।হয়ত প্রতিবছর দার্জিলিং নিয়ে গিয়ে তোমায় সূর্যোদয় দেখাতে পারবো না কিন্তু ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলোর মত আমার ঘরের পূর্বদিকের জানলা দিয়ে প্রথম আলোটা তোমার রোজ চোখে পড়বে।আমি তোমাকে হয়ত পাহাড়ে চড়াতে পারবো না ঠিকই, পারবোনা তোমাকে প্রতি মাসে সোনার গয়না কিনে দিতে কিন্তু আজীবন তোমাকে সুখের আভরণে মুড়িয়ে রাখতে পারবো।পারবো ভালোবাসার আবরণে জড়িয়ে রাখতে।
সেদিন সঞ্জয়ের এই কথাগুলোই খুব ভালো লেগেছিল সুচন্দার।সঞ্জয়ের মামার বাড়িতে সুচন্দাকে বলা কথাগুলো আজীবন সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছে।কোথাও কোন খামতি রাখেনি।জীবনের সমস্ত না পাওয়াগুলো সঞ্জয়ের সাথে বিয়ের পর সুচন্দা একটু একটু করে বলতে গেলে প্রায় ভুলেই গেছিল।
সুচন্দা ও সঞ্জয়ের বিয়ের দিন ঠিক হল ১১ই জুলাই। ডেটটা ঠিক হওয়ার পর ছমাস বিয়েটা পিছিয়ে দিতে হল সঞ্জয়দের বাড়ির কোন এক পারিবারিক সমস্যার কারণে।
সুচন্দার আরো এক বোনের বিয়ে দেওয়া তখনো বাকি।সুচন্দার মা বাড়ির সকলকে জানালেন বড় বোন থাকতে ছোটবোনের বিয়ে দেওয়াটা ঠিক ভালো দেখায় না।তাই তোমরা সকলে মিলে এই ছ'মাসের মধ্যে সুতন্দ্রার বিয়ের ব্যবস্থা করো।তড়িঘড়ি পেপারে বিজ্ঞাপন এবং নানান জায়গায় ঘটক লাগিয়ে সুতন্দ্রার জন্য ছেলে দেখা শুরু করা হল।উপযুক্ত পাত্রও মিললো।দিদির বিয়ের সময় সুচন্দা শিলিগুড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরলো তার মায়ের একান্ত ইচ্ছায় যাতে তার বিয়েটাও নিজের বাড়ি থেকেই হয়।কিন্তু এই প্রথমবার সুচন্দা বাড়িতে ফিরে সুমিতের কোন খোঁজ আর করলো না।কিন্তু তাই বলে সে যে সুমিতকে ভুলে গেছে তা কিন্তু মোটেই নয়।
জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ফেলে আসা অনেক অতীতকেই আমরা কখনো ইচ্ছায় আবার কখনো বা অনিচ্ছায় মনের মধ্যেই ঘুম পাড়িয়ে রাখি।সদায় ব্যস্ত জীবনে এইসব ঘুমন্ত অতীত তখনই জেগে ওঠে যখন কিছুটা সময় হলেও একা থাকা হয়।
বিয়ে হয়ে যায় বেশ ধুমধাম করেই সুমিতের সাথে সুচন্দার।বিয়েটা যেহেতু আষাঢ় মাসে হয়েছিল তাই বিয়ের দিন সকাল থেকে সঞ্জয়দের বাড়ির দিকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল।সঞ্জয়ের মেঝভাই আর সঞ্জয়ের বন্ধুরা মিলে সকালে যখন হলুদ নিয়ে আসে তখন ওদের বাড়ির দিকটা মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে আর সুচন্দাদের বাড়ির দিকে আকাশ ঘনমেঘে চারিদিক আচ্ছন্ন করে রেখেছে যেন টোকা দিলেই ঝরঝর করে বৃষ্টি শুরু হবে।এই বৃষ্টির কারণেই অনেক বরযাত্রী যেমন আসতে পারেনি ঠিক তেমনই সুচন্দাদের অনেক আত্মীয় পাড়া-প্রতিবেশী দূরদূরান্ত থেকে পৌঁছাতে পারেনি।অনেকেই কিছু পথ এসে কাকভেজা হয়ে পুনরায় বাড়ি ফিরে গেছেন।এরফলে প্রচুর খাবারদাবার বেশি হয়।এবং এইসব খাবার কিছু গরীব অসহায় মানুষদের সাহায্যার্থে বিলিয়েও দেওয়া হয়।
স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে থাকে বিস্তর ফাঁড়াক।মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন সে ভাবতেই পারে না তার সে স্বপ্ন একদিন সফল নাও হতে পারে।হঠাৎ আসা কাল বৈশাখী ঝড়ের মত যখন সেই স্বপ্ন ভেংগে চৌচির হয়ে যায় তখন টালমাটাল অবস্থায় সময়ের হাত ধরে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে বা ছিঁড়ে যাওয়া মালাটির ফুলগুলিকে বুকে পাথর বেঁধে অন্য সুতোয় নূতন করে গাঁথতে হয়ত কিছুটা সময় লাগে,হয়ত বুকের ক্ষতটা মাঝে মধ্যেই দগদগে হয়ে যন্ত্রণা দেয় কিন্তু তবুও সামনে পড়ে থাকা অনন্ত পথে হাঁটার জন্য মালাটি গাঁথতেই হয়।কারণ যখন সে বাস্তবের মুখোমুখি হয় তখন স্বপ্ন দেখা মানুষটির মনেহয় তার চারপাশের দরজা বন্ধ।অন্ধকারে একাকী সে পথ হাতড়ে ফেরে। সামান্যতম আলোর দিশা পেলেই সে কিন্তু তার তছনচ হওয়া জীবনটাকে ঠিক গুছিয়ে নিতে পারে। সঞ্জয় ঠিক আলোর দিশা হয়েই সুচন্দার এলোমেলো জীবনটাকে গুছিয়ে দিয়েছিল।ভালোবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে সুচন্দার অতীতের কিছু না জেনেই সুচন্দার জীবনটাকে ভরিয়ে দিয়েছিল।ছোটখাটো মনোমালিন্য যে তাদের মধ্যে হত না তা কিন্তু নয়।কিন্তু সেটা ছিল তাৎক্ষণিক।পারিবারিক অশান্তিও ছিল শ্বাশুড়ী ও দেওরদের সাথে।কিন্তু সবই সাময়িক।সুচন্দার শ্বাশুড়ী তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।সাধারণত তিনি তার এই বড় বৌমাটির কোন দোষই দেখতে পেতেন না।অনেক সময় এমন হয়েছে সুচন্দা ও সঞ্জয় যখন ঝামেলা করছে তিনি তার ভিতর ঢুকে তার ছেলের বিপক্ষে গিয়ে আদরের বৌমাটিকেই সমর্থন জানিয়েছেন।আর ঠিক এরূপ পরিস্থিতিতে সঞ্জয় হেসে পরে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছে,
--- আমার মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয় তুমি আমার মা নাকি ওর মা।এরকম শ্বাশুড়ী আমি কোনদিন দেখিনি বাপু!ছেলে,বউ ঝগড়া করলে শ্বাশুড়ী থাকেন তার বউয়ের পক্ষে।
অবশ্য সঞ্জয় এটা মুখে বলতো ঠিকই কিন্তু মনেমনে খুব খুশিই হত মাকে বউয়ের দিকে দেখে।আবার অনেক সময় এমনও হয়েছে সুচন্দা হয়ত সঞ্জয়কে কিছু বলেছে সঞ্জয় সেটা মানতে চাইছে আর ঠিক তখনই সুচন্দা হাসতে হাসতে সঞ্জয়কে বলেছে,
--- দাঁড়াও মাকে ডাকছি।কোনটা ঠিক হবে মা নিজে এসে মীমাংসা করে দেবেন।
সুখে, দুখে এগিয়ে চলে তাদের জীবন।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment