Tuesday, March 29, 2022

ঝরাপাতা (আঠারো পর্ব)

ঝরাপাতা (আঠারো পর্ব)
  গ্রামের সহজ,সরল সুমিতের জীবনে দু'দুবার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসার প্রতি তার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।নারী সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকেই তার মনে যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছিলো ইতিকার বিয়ের পর থেকে তা সম্পূর্ণভাবে ঘৃণায় পরিণত হয়।সে মনেমনে ভাবে প্রেম,ভালোবাসা তার জন্য নয়।জীবনে যেকোন পরিস্থিতিতে সে আর কখনোই কোনো মেয়েকে হয়ত আর বিশ্বাসই করতে পারবে না।
  সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজেকেই নিজেই বোঝায় সুচন্দা তার জীবন থেকে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো তারজন্য সুচন্দাকে কোন অবস্থাতেই দোষ দেওয়া যায় না।সেও ছিল পরিস্থিতির স্বীকার।আবার বেশ কয়েক বছর বাদে ইতিকা তার জীবনে যখন আসলো তখন কিছুটা হলেও সুচন্দার স্মৃতি মলিন হতে শুরু করেছে। তারও হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে গেলো বা বলা ভালো জোর করে তাকে বিয়ে দেওয়া হল।আসলে অধিকাংশ মেয়েদের জীবন এগিয়ে চলে প্রথমে তার বাবা পরবর্তীতে তার স্বামীর কথামত।তাদের নিজেদের মতামত,সুখ,ইচ্ছা সবকিছুই যেন অন্যের ইচ্ছামত চলে।তাই এক্ষেত্রেও পরিবারের মতকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে ইতিকা।প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা তাদের জীবনে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই পরিবারে সুখ,শান্তি কেনার চেষ্টা করে। ব্যতিক্রমও যে একেবারেই থাকে না তা কিন্তু নয়।সেই আদিকাল থেকে মেয়েদের জীবনে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে নিজের সাথে নিজের।চোখের জল থাকে সকলের অলক্ষ্যে আর কষ্টটা থাকে বুকের ভিতর পাথর চাপা।
 সুমিতের ভালোবাসার প্রতি একটা ঘৃনা জন্মালেও মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধার যে আসন ইতিকার বিয়ের পর টলমল ছিলো; নিজের মনে নিজেই ব্যাখ্যা করে তার অনেকটার উত্তর সে পেয়ে যায়।সুমিতের জীবন এগিয়ে চলে মনের মধ্যে কিছু চাপা কষ্ট নিয়ে।সময়ের সাথে সাথে জীবনের কাটাও যে ঘুরতে থাকে।
  চাকরি সূত্রে এখন সুমিত দেশের বাইরে পাঁচ বছর।বছরে একবার সে দেশে ফেরে,আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করে।সাধ্যমত চেষ্টা করে অর্থনৈতিক কারণে তারা যে কাজগুলি করে উঠতে পারছে না সেগুলি মীমাংসা করে দিতে।বাবা, মায়ের ইচ্ছাতেই এবং পছন্দে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। সুমিতদের এক আত্মীয়ের বিয়েতে সুমিতের মায়ের একটি মেয়েকে দেখে খুব পছন্দ হয়।খোঁজ খবর নিয়ে তাদের কথা দেন তারা মেয়েটিকে তাদের ঘরের বউ করে আনবেন।সুমিত দেশে ফিরলে তাকে কথাটা জানালে সে বেঁকে বসে। কিছুতেই সে বিয়ে করতে রাজি হয় না।ছোটবোন বিশাখাকে ছেলেবেলা থেকেই সুমিত খুব ভালোবাসে।অনেক সময় এমন হয়েছে হয়ত সুমিত জীদ করছে কিন্তু বিশাখা বুঝিয়ে বললে সে সেই কথা শুনেছে।বিশাখা বাড়িতে এসে দাদাকে বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য বললে সে বলে,
--- আমার জীবনের সমস্ত কথায় তুই জানিস।সে সুচন্দা হোক কিংবা ইতিকা।পৃথিবীর প্রতিটা নারীকে আমি সম্মান করি কিন্তু কোন নারীকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে আর বিশ্বাস করি না।মন থেকে আমি আর কাউকে কোনদিনও ভালোবাসতে পারবো না।শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন অর্থ নেই।
--- দাদা, কারো জন্যই কারো জীবন থেমে থাকে না।আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।যে ঘটনা দুটো তোর জীবনে ঘটেছে তারজন্য কিন্তু ওই দুজনের কেউই দায়ী নয়।দুজনেই পরিস্থিতির স্বীকার। কে বলতে পারে হয়ত তোর জীবনে আসা দুটো নারীই সকলের অজান্তে চোখের জল ফেলছে বুকে পাথর বেঁধে।তুই তো কারোরই  মনের খবর জানার সুযোগই পাসনি।মেয়েরা এমন অনেককিছু জীবনে মেনে নিতে বাধ্য হয় যা জেনেবুঝে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার সমান হয়।নিজেকে পুড়িয়ে তারা পরিবারের মানসম্মান ,সুখশান্তি কেনে।সব ক্ষেত্রেই যে এমনটা হয় তা কিন্তু বলছি না।কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এটাই ঘটছে।
তারপর কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলে,
  --তুই রাজি হয়ে যা দাদা।দেখ বাবা,মাও তো চায় তাদের ছেলের বউ দেখে যাবে।দেখবি তুই ঠিক সুখী হবি।
-- কিন্তু --
-- কোন কিন্তু নয়।তুই এক কাজ কর;তুই বিয়ের আগে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে সামনাসামনি একবার দেখে আয়।তোর কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে তখন নাহয় জেনে নিবি।
--- কিন্তু বিয়ের আগে মেয়ের সাথে কি করে দেখা করবো?তার বাবা,মা রাজী হবেন কেন?
--- তুই বড্ড বেশি বকিস দাদা। সব কথা সব সময় সবাইকে বলেকয়ে করতে হবে কেন?মেয়ের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা আমিই করে দেবো।কেউই জানতে পারবে না। দয়া করে তুই কথাটা অন্য কাউকে বলিস না।তোর তো আবার " সদা সত্য কথা বলিবে"- নীতিতে বিশ্বাসী।
 বিয়ের কথা ফাইনাল হওয়ার পর বিশাখা ঠিক ম্যানেজ করে তার উঠবি বৌদিকে বাড়ি থেকে বের করে এনে দাদার সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দেয়।কিন্তু সরল প্রকৃতির সুমিত কথারচ্ছলে তার উঠবি বউকে বলে,
--- জীবনে দু'দুটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম কিন্তু কেউই আমার হয়নি।আমি আমার সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবাসার আপ্রাণ চেষ্টা করবো কিন্তু তুমি কি আমার এই কথা জানার পর আমায় ভালোবাসতে পারবে?
--- বাবা,মা যেখানে বিয়ে ঠিক করেছেন সেখানে আমার অমত করার কোন প্রশ্নই আসে না।আর অমত করলেও বা কে শুনছে?আগে তোমার জীবনে কতবার প্রেম এসেছে তা জেনে আমার কি লাভ বলো?বিয়ের পর আমি তোমার কাজ থেকে সম্পূর্ণ ভালোবাসা চাই সেটা পেলেই হবে।
 সেদিন ধীরার কথাগুলো সুমিতকে একটা মানসিক শান্তি দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও সেদিন বুঝতে পারেনি তার এই সরলতার দাম দিতে হবে আজীবন একটু একটু করে।বিয়ের আগে ধীরার সাথে দেখা করতে গিয়ে সেদিনই সে তার জীবনের অশান্তির বিষবৃক্ষটি রোপণ করে এসেছিল।
 ধীরার ছিল আকাশচুম্বী চাহিদা।সে চাহিদা পূরণে সুমিত ছিল সক্ষম।সমস্ত মনপ্রাণ উজাড় করে ধীরাকে ভালোবেসে তার সকল চাহিদা পূরণ করেও সুখী হওয়া বলতে যা বোঝায় তা কোনদিনও হতে পারেনি সুমিত।কিন্তু সে তো পরের কথা।
  বিয়ের অধিকাংশ বাজার সুমিতের দিদি ও বোন মিলেই করে।বিয়ের প্রায় দু'তিন দিন আগে থাকতেই তারা তাদের ছেলেদের নিয়ে বাপের বাড়িতে হাজির হয়ে যায়।অনেকদিন পর সমস্ত ভাইবোনগুলো একজায়গায় হয়ে সবাই খুব আনন্দে সময় কাটাতে থাকে।কেউ টের না পেলেও সুমিতের মনের ভিতর একটা ঝড় কিন্তু মাঝে মধ্যেই  দমকা বাতাস দিয়ে চলেছে আর তার ফলেই সুমিত কখনো কখনো একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে।
 সুমিতের বিয়ের দিন সকালে এসে হাজির হয় তার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহপাঠী দোদুল।

ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment