ঝরাপাতা (ষোলো পর্ব)
সুমিত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে খুব ভালো ফল করে কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়।কিন্তু কলেজে পড়াকালীন সময়ে এক বছরের জুনিয়র ইতিকার সাথে তার বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠে।যখন সুচন্দাকে হারানোর ক্ষতটা অনেকটাই মিলিয়ে গেছে তখন সুমিত পুনরায় আবিস্কার করলো সে ইতিকাকে ভালোবাসে।ইতিকা সুচন্দার মত অতটা সুন্দরী না হলেও একটা আলগা শ্রী আছে।সব থেকে সুমিতের যেটা ভালো লেগেছিলো তা হল ইতিকার মধ্যে অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিলো সুমিতের অনেক মনের কথায় সে না বলতেই বুঝে ফেলতো।সেও ছিল গ্রামের মেয়ে।কিন্তু কলকাতায় একটি বাড়িতে পেয়িং গেষ্ট হিসাবে থাকতো।কলেজে তো দেখা হতই দু,একদিন ছুটির দিনে ভিক্টোরিয়া, গড়ের মাঠ,মনুমেন্ট - ঘোরাটা বেশ ভালই হত।ভবিষ্যত পরিকল্পনায় দুজনেই তখন মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ছে।একদিন দেখা না হলেই দুজনেই যেন অস্থির হয়ে উঠতো।
সুমিত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে চাকরি পাওয়াতে দুজনেই ঠিক করল বিয়েটা সুমিতের পড়া শেষ হলেই তারা এবার সেরে ফেলবে।কোম্পানির থেকে সুমিতকে জানানো হয়েছিল তার কাজের উপরে নির্ভর করবে কোম্পানি তাকে তাদের বিদেশে পাঠাবে কিনা।একদিন কলেজে ইতিকা সুমিতকে জানালো যে,
--- এই,আগামীকাল আমি যে বাড়িতে পেইংগেষ্ট হিসাবে থাকি ওরা না দুদিনের জন্য আত্মীয়ের বিয়ের জন্য বাড়িতে থাকবে না।আমাকে বলেছে ওদের রান্নাঘরে দুটোদিন রান্না করে নিতে।বাজার ওরাই করে রেখে গেছে।তুমি আসবে ওই বাড়িতে?
-- যেতে তো কোন অসুবিধাই নেই।কিন্তু পাড়ার লোক দেখে ফেললে তোমার বদনাম হবে।তাছাড়া উনারা ফিরলে যদি পাড়ার লোকেরা তাদের কাছে বলে দেয় তাহলে তোমার নামে নানান ধরনের বদনাম দেবে তোমায় রাখতেও তারা অস্বীকৃতি জানাতে পারেন।
-- আরে এতসব কিছুই হবেনা।তুমি সব ব্যাপারে এত ভাবো কেন?একটা কিছু করতে গেলে কি হবে,কি হতে পারে,হলে কি হবে -- বাবারে বাবা!আমি এতকিছু জানিনা তুমি কাল সন্ধ্যায় আসছো ব্যাস।
--- আমার মন সায় দিচ্ছে না।
--- তুমি এত ভীতু আমি জানতাম না তো!
--- এটা ভীতুর প্রশ্ন নয়।মানসম্মানের প্রশ্ন।এতে আমার কিছুই হবে না।কিন্তু তোমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হতে পারে।
--- আমি এসব কিছু শুনতে চাই না।তুমি কাল সন্ধ্যায় আমার কাছে আসছো এটাই ফাইনাল।
সুমিতকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে ইতিকা উঠে দাঁড়িয়ে মুখটা সুমিতের খুব কাছে এনে হেসে পড়ে বললো,
--- না আসলে আমি কিন্তু খুব রাগ করবো।
এরপর কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ,
--- অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু।
সুমিতের বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো।ইতিকা এভাবে অনেকবার অনেক কথা বলেছে তবে আজকে এই কথাটার মধ্যে এমন কি আছে যার জন্য তার বুকের ভিতরটা তোলপাল করছে!কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলো ইতি? বাড়ি ফিরেও মাথা থেকে ইতিকার মুচকি হাসি দিয়ে কথাটার মানে বোঝার অনেক চেষ্টা করেছে।
পরদিন ছিল রবিবার।যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও মনের মধ্যে ওঠা নানান প্রশ্নের উথালপাতাল ঢেউয়ের মীমাংসা করতেই সুমিত রওনা দেয় ইতিকা যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়িতে।ইতিকা যেন জানতোই সুমিত আসবে।সাদর অভ্যর্থনে সে সুমিতকে নিয়ে তার ঘরে যায়।পুরো একটা বাড়িতে এক ঘরে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা একান্তে বসে গল্প করলেও সুমিত বেশ কয়েকবারই উঠে দাঁড়িয়েছে চলে আসবে বলে।যে সুমিত অতি সামান্য সময় সুচন্দাকে কাছে পেয়ে মুহূর্তে তাকে ভালোবাসার প্রলেপ ঠোঁটে এঁকে দিতে আগেপিছে কিছুই ভেবেছিল না সেই সুমিত আজ আর একটু পরিণত।হয়ত ভালোবাসার আঘাত তাকে পরিণত করে তুলেছে।কিন্তু তবুও সে একজন পুরুষ!যে ইতিকাকে সে কলেজে ,সিনেমা হলে,ভিক্টোরিয়ায় দেখেছে,পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটেছে আজ সেই ইতিকাকে বড্ড অচেনা লাগছে সুমিতের।যাওয়ার সাথে সাথেই সুমিতের জন্য সে চা,জলখাবার নিয়ে আসে।জলখাবারটা সে আগে থাকতেই তৈরি করে রেখেছিল।নিজেকে খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়েছে।সুমিতের কাছে তাকে আজ খুব মায়াবী লাগছে।
নানান ধরণের গল্পগুজবের মাঝে ইতিকা জানতে চায়
--- আচ্ছা সুমিত আমরা কবে বিয়ে করছি
--- বাড়িতে মাকে আমি সব জানিয়েছি ।মা ই বাবাকে সব জানাবেন।আমি চাকরিতে জয়েন করার ছমাস পরই আমাদের বিয়েটা হবে।কারণ ওই কোম্পানির থেকে জানিয়েছে আমার কাজ করার ধরণ যদি ওদের পছন্দ হয় তাহলে একবছরের মাথায় ওরা আমাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেবে।তাই আমার ইচ্ছে তোমায় নিজের করে রেখে তারপর আমি বাইরে যাবো।
সুমিতের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আচমকা ইতিকা সুমিতের কাছে এসে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।সুমিত বসেই ছিল খাটের উপর।সুমিতের ঠোঁটের কাছে নিজের মুখটি এনে আলতো করে কামড়ে রাখে। সেই মুহূর্তে দুটো নরনারী ভুলে গেলো বেশ কয়েক মিনিট জাগতিক সবকিছু।এক স্বর্গীয় সুখে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রইলো।হারিয়ে গেলো কি হবে,কি হতে পারে এসব চিন্তা!
ইতিকা অতি স্বাভাবিক থাকলেও সুমিতের এই ঘটনার পর কিছুটা হলেও মনের ভিতর এক অনুশোচনাবোধ কাজ করতে থাকে।সে কিছুতেই যেন ইতিকার দিকে আগের মত চোখ তুলে তাকিয়ে ফ্রী ভাবে গল্প করতে পারে না।দেখা তাদের রোজই হয় কলেজে।কথাও হয় কিন্তু সুমিতের মনের মধ্যে কেমন যেন এক দ্বন্দ্ব কাজ করে।বিয়ের আগে ইতিকার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াটা কিছুতেই সে মন থেকে মানতে পারে না।ইতিকাকে সে তার পরীক্ষার আগেই জানায়
--- পরীক্ষার শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমি বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই।যদিও তোমার ফাইনাল পরীক্ষার আরো কয়েক মাস বাকি ।তুমি তোমার বাড়িতে বলে তোমার বাবা,মাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বোলো।
--- আমি বুঝতে পারছি সেদিনের ঘটনার পর তুমি আমার সাথে ফ্রী হয়ে মিশতে পারছো না।কিন্তু কেন বলো তো ?আমরা তো একে অপরকে ভালোবাসি।আর ভালোবেসে কাছে আসলে তারমধ্যে অপরাধটা কোথায়?আমি চেয়েছি তাই এটা ঘটেছে।এত অপরাধ বোধে ভুগো না। পরীক্ষা শেষ হোক আমি বাড়িতে গিয়ে বাবা,মাকে তোমাদের বাড়িতে পাঠাবো।
পরীক্ষা শেষ হয়। ইতিকার তখনো একবছর বাকি।সুমিত এবং ইতিকা একই গ্রামের না হলেও কিছুটা দূরত্বের দুই গ্রামে তাদের বাস।তাই একে অন্যের বাড়িতে না গেলেও দুজনেই দুজনের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জানতো।সুমিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর চাকরিতে জয়েন করার পরেও যখন ইতিকার বাড়ি থেকে সুমিতদের বাড়িতে কোন প্রস্তাব আসে না অর্থাৎ ইতিকার বাবা,মাকে দেখতে পায় না তখন একদিন সুমিত ইতিকার মুখে শোনা তাদের গ্রামের নাম আর তার বাবার নামটা মনে রেখে গুটি গুটি পায়ে তার ইতিদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment