Saturday, March 26, 2022

ঝরাপাতা (সতের পর্ব)

 ঝরাপাতা (সতের পর্ব)

  সুমিত পথ চলতি মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে আস্তে আস্তে ইতিকাদের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। শেষমেষ সে এসে পৌঁছায় তার ইতির বাড়ির সামনে।বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারে কাল বা পরশু এই বাড়িতেই বড় কোন অনুষ্ঠান হয়ে গেছে।সে গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে বাড়ির ভিতর অভিমুখে এগিয়ে চলা অপরিচিত একজনের কাছে জানতে চায় 
--- দাদা এটা কি ইতিকাদের বাড়ি?
--- হ্যাঁ ভাই।ওর তো কাল বিয়ে হয়ে গেলো।এই কিছুক্ষণ আগেই ও শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো।আপনি কি ওর বন্ধু?জানেন না যে ওর বিয়ে হয়েছে গতকাল।আর জানবেন বাই কি করে?এত তাড়াতাড়ি কেন যে বাড়ির লোকজন তার বিয়ে দিলো বুঝতেই পারলাম না।মেয়েটা তো কলকাতা পড়াশুনা করছিলো।এখনো তার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়নি।তার মধ্যেই মাঝপথেই এক মাঝ বয়সী লোকের সাথে তার হঠাৎ করেই বিয়ে দিয়ে দিলো।কিছুই বুঝলাম না!
 ভদ্রলোক কথাগুলি বলছেন ঠিকই কিন্তু সুমিতের মাথায় তখন কিছুই ঢুকছে না।গেটের কাছে ইতস্তত কিছু চেয়ার,টেবিল ছড়ানো ছিটানো ছিল।হয়ত ডেকরেটর ভদ্রলোক সেগুলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।হঠাৎ মাথাটা ঘুরে যাওয়ায় পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা ভদ্রলোকটি খপ করে তার হাত ধরে একটি চেয়ারে বসিয়ে দেন।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মনের মধ্যে জমা হওয়া প্রশ্নের কোন সমাধান সূত্র খুঁজে না পেয়ে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।অবশ্য তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটি সুমিতকে বারবার জিজ্ঞাসা করেন সে ঠিক আছে কিনা,সে একাই তার বাড়ি যেতে পারবে কিনা?হঠাৎ করে তার এমন কি হল যে সমস্ত শরীর তার ঠকঠক করে কাঁপছে?
 কোন কথারই উত্তর দিতে সুমিত পারেনি।হঠাৎ করেই যেন তার সমস্ত বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছিলো।কোন প্রকারে নিজের শরীরটা টেনে বাড়ি ফেরে।মন তো সেই কিশোর বয়সেই একবার ভেঙেচুরে তছনচ হয়ে গেছিলো।তখনই তো জীবনের সব মানে সুমিতের কাছে শূন্যে পৌঁছেছিল।সুচন্দাকে ছাড়া জীবনে আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না বলেই সে ভেবে নিয়েছিলো।কিন্তু সময় সেই ক্ষতের উপর প্রলেপ ফেলেও দিয়েছিল।কিন্তু হঠাৎ করে মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানে সুমিতের জীবনে আবার বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘটনা ঘটে গেলো।কিছুতেই সে মাথায় আনতে পারছে না কেন এমনটা ইতিকা করলো নাকি তাকে এরূপটা করতে বাধ্য করা হল?বেশ কয়েকটা দিন খাওয়া দাওয়া ভুলে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখলো।সুমিতের মা বিশাখাকে খবর দিলেন।সেও এসে দাদার মুখ থেকে একটাও কথা বের করতে পারলো না।কিন্তু বুদ্ধিমতী বিশাখা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে কারণ আগেও একবার সে তার দাদাকে এভাবেই ভেঙ্গে পড়তে দেখেছে।
 পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার আগেই সুমিতকে চাকরিতে জয়েন করতে হল।কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়া মনটাকে নিয়ে জীবনের স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে পা দিয়েও সেভাবে সে কিছুতেই খুশি হতে পারে না।চাকরি পাওয়ার যে আনন্দ তা দ্বিগুণ কষ্ট হয়ে বুকে চেপে বসে।এই চাকরি পেয়েই সে ইতিকাকে বিয়ে করবে বলে সব ঠিক করে রেখেছিল।অফিস কিংবা বাড়ি যেকোন জায়গাতেই কাজ ছাড়া প্রতিটা মুহূর্তে সে ইতিকার কথা ভাবে আর মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে যেভাবেই হোক সে শেষবারের মত একবার হলেও ইতিকার সাথে দেখা করবেই।জানতে চাইবে তার কাছে কি এমন ঘটলো যে পনেরদিনের মধ্যে এমন একটা ডিসিশন নিতে সে বাধ্য হল।
 প্রথম থেকেই অফিসে সুমিত তার কাজ দিয়ে উপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।সকলেই সুমিতকে এক ডাকেই চেনে।যে সময়টুকু সুমিত কাজ নিয়ে থাকে সেই সময়টুকুই শুধু ইতিকার কথা সে ভুলে থাকে।কাজ শেষে আবার যে সেই।ভালোবাসা বারবার তার জীবনে কেন এমন আঘাত হানছে কিছুতেই সে বুঝতে পারে না। সম্পূর্ণটুকুই দিয়ে সে সুচন্দাকে যেমন ভালোবেসেছিলো ঠিক তেমনই সে তার সবটুকু দিয়েই ইতিকাকেও ভালোবেসেছিলো।কাউকেই সে ঠকাতে চায়নি কখনো।তবে কেন তার জীবনে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না হয়ে আঘাত হয়ে বুকে বাজে?
 চাকরি জীবনের মাস তিনেক হওয়ার পর আবার একদিন সে তার গ্রামের বাড়িতে যায় শুধুমাত্র ইতিকার সাথে একবার দেখা করার জন্য। অফিসও তাকে জানিয়ে দিয়েছে ছমাসের মধ্যেই তাকে বাইরে যেতে হবে।তাই দেশ ছাড়ার আগে একবার সে জেনে যেতে চায় কেন ইতিকা এমন করলো তার সাথে।
 সুমিত তাদের গ্রামের বাড়িতে এসে একদিন সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলো ইতিকাদের গ্রামে।সেই গ্রামের কাউকেই সে চেনে না। বুকের ভিতর দলা পাকানো একটা ব্যথা তবুও তাকে জানতে হবে আসল ঘটনাটা কি?সুমিত যখন ইতিকাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে তখনো জানতো না তার সাথে ইতিকার দেখা হবে কিনা।কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যেই সুমিত চলে আসে ইতিকাদের গ্রামে।বাড়ির গেটের সামনে এসেও সে সেই বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায় না।সরে আসে সেখান থেকে।আশেপাশে কাউকেই দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর সে মনেমনে ভাবে, " আজকে যেভাবেই হোক সমস্ত ঘটনাটার একটা উত্তর তাকে পেতেই হবে।"সন্ধ্যা তখন হয়হয়।গ্রামের রাস্তাঘাটে তখনো সব জায়গায় ইলেকট্রিক আলো এসে পৌঁছায়নি।কিছু দূরে সে একটা আলোর আভাস পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়।দেখে একটা চায়ের স্টল।বসে পড়ে সেখানে।চায়ের অর্ডার দেয়।দু একজন খরিদ্দার যারা ছিলো তারাও তাদের চায়ের দাম মিটিয়ে চলে যায়।দোকানদারের সাথে যাকে বলে খেজুরে আলাপ শুরু করে সুমিত।একথা সেকথার পর সুমিত বলে,
--- কয়েকদিন আগেও এখানে একটি কাজে এসেছিলাম।তখন ঐ বাড়িতে (আঙ্গুলের সাহায্যে ইতিকাদের বাড়ির দিক নির্দেশ করে) দুদিন আগে একটা বিয়ে হয়েছে বলে মনেহল।
--- হ্যাঁ ওই বাড়িতে হঠাৎ করেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো।আর বলবেন না দাদা।আমরা তো ভবতোষবাবুর মেয়ের বিয়ে শুনে অবাক!তারপর কানাঘুষোতে জানলাম কলকাতা শহরে পড়তে পড়তে একটা বকাটে ছেলের সাথে প্রেম পিরিত হয়।তারউপর ছেলেটা আবার কায়স্থ।ভবতোষবাবুর লোকের বাড়ি বাড়ি পুজো করেই দিন গুজরান।কায়স্থ ছেলেটার সাথে মেয়েটার বিয়ে হলে তো গ্রামে কেউ আর তাকে পুজোর জন্য ডাকবে না।তাই সাত তাড়াতাড়ি মেয়েটার ডবলেরও বেশি বয়সের একটা বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে দিল।আর সব চাইতে মজার কথা কি জানেন দাদা ?যে বুড়োর সাথে মেয়েটার বিয়ে দিলো সেই বুড়োটা মেয়েটার স্কুলের শিক্ষক ছিল।আগে একটা বিয়ে ছিল।বউটা মরে যাওয়ায় এই বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে করেছে।ওই ভবতোষবাবু মেয়েটাকে ভয় দেখিয়েছিল যদি সে এই বিয়ে না করে তাহলে তিনি গলায় দড়ি দেবেন।মেয়েটার কিছু করারও ছিল না।সন্তান হয়ে বাবার মৃত্যুর কারণ আর কি করে হবে বলেন?কত মেয়ের জীবনের স্বপ্ন যে এইভাবেই ভেঙ্গে যায় কেউ কি আর তার খবর রাখে?
 সুমিত নিজের চোখের জল লুকাতে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment