স্বীকারোক্তি
ঝিকে মেরে বউকে বোঝানো - আমাকে সরাসরি কখনোই কিছু বলতেন না।কথা তিনি হাওয়ায় ছাড়তেন।এতটাই জোরে যাতে আমার কানে আসে।অনেকটা ওই ঝিকে মেরে বউকে শাসন করার মত আর কি!
সুব্রত আমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছিল।প্রথম দিকে আমার বাড়ির মত ছিল না।ধনী পরিবারের সন্তান না হলেও আমাদের কোন অভাব ছিল না।কিন্তু সুব্রতদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না।সুব্রত সবে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে,একমাত্র সন্তান বিধবা মায়ের।খুব বড় এবং খুব ভালো না হলেও নিজেদের একটা বাড়ি আছে।মা,বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন।
আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে একমাত্র বাবা ই আপত্তি জানিয়েছিলেন।কিন্তু সুব্রতর মায়ের ছিল ঘোর আপত্তি।কারণ ছিল আমার গায়ের রং ছিল কালো।সুব্রত এবং ওর মায়ের গায়ের রং ছিল খুব ফর্সা।কিন্তু সুব্রত মায়ের কথার পাত্তা না দিয়ে তার অমতেই আমাকে বউ করে ঘরে এনে তুলেছিলেন।
অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো দেওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজার দিন থেকে আমাকে বিধিরে বিধিরে কথা শোনাতেন আমার শ্বাশুড়ি মা।সিন্নি মাখার আগেই পাশের বাড়ির কাকিমাকে বললেন,
--- আসলে কি জানেন দিদি কারো গায়ের রং কালো হলে আমি আবার তার হাতে মাখা সিন্নি খেতে পারি না।
এরপর থেকে প্রতিটা কাজে আমায় খোঁটা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন আমি কালো বলে কোনকিছু মাখার অধিকার আমার নেই।একদিন সুব্রত অফিস যাওয়ার তাড়া থাকায় আমি আলুসেদ্ধ মেখেছিলাম বলে তিনি সেদিন সেটা খেলেনই না।কিন্তু কোনদিনও সুব্রতকে এসব কথা বলতাম না।
ছেলে কিন্তু খুব ফর্সা হয়েছিল।সে ছিল ঠাকুমার চোখের মণি।ছেলে শুভেন্দুও মাঝে মাঝে বুঝতে পারতো তার ঠাকুমা দিনে যতগুলো কথা বলেন তার অধিকাংশই তার মাকে উদ্দেশ্য করেই বলেন।কিন্তু আমি কোনদিনও তাকে তার ঠাকুমাকে কিছু বলতে সুযোগ দিইনি।প্রতিবারই বলেছি,
--- ঠাকুমার বয়স হয়েছে।এই বয়সে মানুষ এরূপ আচরণ করে থাকেন।তুমি কিছু বললে ঠাকুমা খুব কষ্ট পাবেন।আর এসব কথা বাবা যেন না জানেন।তাহলে তিনিও কষ্ট পাবেন।
ছেলের বয়স যখন বারো বছর হঠাৎ একদিন আমার শ্বাশুড়ি মা বাথরুমের ভিতর পরে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায়।তড়িঘড়ি ছেলেকে দিয়ে উবের বুক করে মা ছেলে মিলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাই।সুব্রত অফিস থেকে হাসপাতালেই আসে।দেড়মাস পড়ে তাকে বাড়ি আনা হয়।কিন্তু হাসপাতাল থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল তিনি যেন খুব একটা হাঁটাচলা না করেন।তাই অধিকাংশ সময় তিনি শুয়েই থাকতেন।একমাত্র নিজের স্নান,আর প্রয়োজনে বাথরুমে যাওয়া ছাড়া তিনি উঠতেন না।এই কাজেও তাকে আমি কিংবা শুভেন্দু বাড়ি থাকলে সাহায্য করতে হত।কারণ সুব্রত খুব তাড়াতাড়িই অফিস বেরিয়ে যেত।আর শ্বাশুড়ী মা তখন ঘুমিয়ে থাকতেন।আস্তে আস্তে সে ক্ষমতাও তার চলে যায়।তখন আমিই তাকে তিনবেলা খাবার মেখে খাইয়ে দিতাম।আমি যখন তাকে খাওয়াতাম তখন তার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তো।আমি বুঝতে পারতাম কি কারণে তিনি কাঁদছেন কিন্তু কোনদিন তাকে ধরা দিইনি।
একদিন তার ছেলে আর নাতির সামনে আমায় ডেকে নিয়ে নিজের সমস্ত অপরাধের কথা স্বীকার করেন আর হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন।সুব্রত আর শুভেন্দু দুজনে অবাক হয়ে একবার আমার মুখের দিকে আর একবার শ্বাশুড়ী মায়ের মুখের দিকে তাকাতে থাকে।প্রথম প্রথম তার এই ব্যবহারে কষ্ট পেলেও পরে কিন্তু আমার গা সওয়া হয়ে গেছিলো।তবে আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি তিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলের সামনে এইভাবে স্বীকারোক্তি দেবেন।
এর কিছুদিন পরই তিনি মারা যান।
No comments:
Post a Comment