ঝরাপাতা (উনিশ পর্ব)
দোদুলকে দেখে সুমিত ভীষণ খুশি হয়।সুমিত ভাবতেই পারেনি অত দূর থেকে মাত্র কয়েকটা বছরের বন্ধুত্বের টানে দোদুল তার বিয়েতে আসবে।দোদুলকে দেখে সুমিত আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
--- বিশ্বাস কর দোদুল তোকে আমার বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো দেখে নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।আমি ভাবতেই পারিনি হাজার হাজার মাইল পার হয়ে তুই আমার বিয়েতে আসবি।
--- আসলে কি জানিস সুমিত?সত্যি কথা বলতে তোর বিয়ে উপলক্ষ্যে এখানে আসা হয়নি।তুই যখন আমায় টেলিফোনে জানালি যে তুই এবার বিয়ে করে বউ সাথে নিয়ে ফিরবি তখন তোর মনে আছে নিশ্চয় আমি তারিখটা জানতে চেয়েছিলাম।কারণ সেই মুহূর্তে আমারও দেশে ফিরবার কথা হচ্ছিল।অত্যন্ত ক্যাজুয়ালী কথাটা জানতে চেয়েছিলাম।কিন্তু দেখলাম আমার দেশে ফেরার পরদিন তোর বিয়ের তারিখ।তাই তোকে আর সেই মুহূর্তে কিছু বলিনি।সেদিন তুই আমি আসলে তুই খুশি হবি,যদি ছুটি পাই তাহলে যেন আসি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথায় বললি।ইচ্ছা করেই তখন বলিনি যে আমি আসছি।তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ারই ইচ্ছা ছিল।
-- সে যাই হোকনা কেন তুই আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি।আমি তো শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছি কিন্তু ইয়ার তোমার সেই অস্মিতার খবর কি?
--- বলবো সব বলবো।তবে আজ নয়।অনেক ঘটনা ঘটে গেছে জীবনের উপর দিয়ে।ওটাকেও একটা ফয়সালা করার জন্যই দেশে আসা।
সুমিতের গায়ে হলুদের পর দুই বন্ধু মিলে আবার পুরনো আলোচনায় ফিরে যায়।সুমিত জানতে চায়,
--- এবার একটু খোলসা করে বলতো ব্যাপার কি?কবে বিয়ে করছিস অস্মিতাকে?
দোদুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
--- ভালোবাসাটা মনেহয় বিয়ে পর্যন্ত গড়ালো না। অস্মিতা বাড়ির বড় মেয়ে।হঠাৎ করেই ওর বাবা হার্ট অ্যাটাক হয়।তখন ও সবে চাকরিতে ঢুকেছে।হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন ঠিকই কিন্তু শরীরের নিচের অংশ পুরো প্যারালাইজড হয়ে যায়।প্রচুর খরচ সাথে ছোট ভাইবোনগুলির দায়িত্ব।ওর মায়ের বাইরের জগৎ সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না।সব দায়িত্ব এসে পড়লো অস্মির উপর।জমানো টাকায় বছর খানেক বাবার চিকিৎসা সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে।কিন্তু সে কত দিন?রাজকোষও তো শুন্য হয়ে যায় একসময়।দিনকে দিন অস্মির উপর চাপ বাড়তে থাকে।বাইরে থেকেই সমস্ত খবরাখবর পেতাম অফিসে টেলিফোনের মাধ্যমে।চিঠিপত্র সপ্তাহে দু একটা হাতে পেতাম নিজেও দিতাম।সব সময় তাকে একটা কথায় জানিয়েছি তার এই যুদ্ধে আমি তার পাশে আছি।অর্থ সাহায্য করতে চাইলে সব সময় ফিরিয়ে দিয়েছে।শেষবার চিঠিতে জানিয়েছে সে যদি বিয়ে করে তাহলে তার ছোট ছোট ভাইবোনগুলো পথে ভেসে যাবে।আমি যেন অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে নিই।আজ ছ'মাস আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি।অফিসে ফোন করে জেনেছি ও ওই অফিস থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছে।বহু চিঠি লিখেছি কিন্তু উত্তর পাইনি।তাই এবার সরাসরি এসেছি মুখোমুখি বসতে।তোর বিয়ের পাঠ মিটিয়ে তবে শিলিগুড়ি ফিরবো এরকমই মাকে জানিয়ে দিয়েছি।
সুমিতের বৌভাতের দিন রাতেই শেষ ট্রেনের যাত্রী হয়ে রিজার্ভেশন না পেয়ে সারাটা রাত বসেই পরদিন ভোরে দোদুল শিলিগুড়ি ফিরলো।বাড়ির সকলেই যেহেতু জানতো দোদুল আর অস্মিতার কথা তাই দুপুরে খাবার টেবিলে মা তাদের বিয়ের কথাটা তোলেন।দোদুল তাদের বলে,
-- হঠাৎ করে অস্মিতার বাবার অসুস্থ্যতার কারণে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার উপর পড়েছে।ওর ভাইবোনগুলো সবাই ওর ছোট ---
দোদুলের কথা শুনে স্বামী স্ত্রী দু'জনে দুজনের মুখের দিকে তাকালেন তারা বুঝতে পারলেন অস্মিতার সাথে তাহলে দোদুলের বহুদিন কোন যোগাযোগ নেই।কারণ অস্মিতার বাবা মারা গেছেন প্রায় তিনমাস হতে চললো।দোদুলের বাবা তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- কতদিন তোমার সাথে তার কথা নেই?
নিরীহ অপরাধীর মত মুখ করে দোদুল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- কেন বলো তো?
--- আসলে তোমার কথা শুনে এটাই আমার মনে হল।সে বাড়ির কোন খবরই তুমি জানো না।
--- কেন কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো ?
দোদুলের মা তখন বললেন,
--- অনেককিছুই ঠিক নেই। অস্মিতার বাবা প্রায় তিনমাস হল মারা গেছেন।খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন।বাড়িতেই ছিলেন হার্টঅ্যাটাকের পর তার শরীরের নিচের অংশ পুরো প্যারালাইজড ছিল। অস্মিতার অফিস ছাড়াও নানান কাজে তাকে ব্যস্ত থাকতে হত।মেজো মেয়ে অম্বিকা তার বাবার সেবাযত্ন করতো। হ্যাঁ তার মাও সংসারের যাবতীয় কাজ করে সময় পেলেই তিনিও তার যত্নের কোন ত্রুটি রাখতেন না।একদিন স্বামীকে মাথা ধুইয়ে গা মুছিয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজেই ঘরে পড়ে থাকা জলে পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে নেন।প্লাস্টার করে তাকে বাড়িতে আনার সাতদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় অ্যাটাকেই অস্মিতার বাবা চলে যান।সমস্ত ঝড়ঝাপটা ওই মেয়েটির উপরেই পড়ে।অদ্ভুত মানসিক দৃঢ়তা!ওর বাবার মৃত্যুর খবর লোক মারফৎ জেনে তোমার মা আর আমি দুজনেই গেছিলাম।যেটুকু সময় আমরা সেখানে ছিলাম আমরা আবিস্কার করেছিলাম এক দশভূজা যেন দশ হাতে সব দিক সামলাচ্ছে।এখন বুঝতে পারছি তোমাকেও ও কিছুই জানায়নি।কিন্তু তবুও আমার মনের দ্বন্দ্ব কিছুতেই যাচ্ছে না,আমি কিছুতেই মাথায় আনতে পারছি না ;ওর বাবা চলে গেলো ঠিক সেই সময়েই মা পা ভেঙ্গে শয্যাশায়ী হলেন,এত বড় দুটি খবর তোমার কাছে গোপন করে যাওয়ার কারণ কি?
চোখ ভর্তি জল নিয়ে দোদুল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- বেশ কয়েক মাস আগে আমায় একটি চিঠিতে জানিয়েছিল এই সম্পর্কটা থেকে ও বেরিয়ে যেতে চায়।বাবার ওই অসুস্থ্যতার সময়ে ও ভালোভাবেই বুঝে গেছিল বিয়ে করে ছোট ভাইবোনগুলোকে ছেড়ে ও সুখী হতে পারবে না।তাছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার দায়িত্বটা তো এখন তার হাতেই।তাই তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সুখকে সে বিসর্জন দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।এতকিছু যে তার পরিবার বিশেষত তার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে আমাকে সে কোন কথায় জানায়নি।তার অফিসে ফোন করে জেনেছি সে এখন ওই অফিসেও নেই।এই কারণেই আমার এবার আসা।সবকিছু সামনাসামনি বসে খোলসা করা দরকার।তাকে বহুবার আমি জানিয়েছি তার এই যুদ্ধে আমি তার সাথেই আছি।কিন্তু সেখানেও তার আপত্তি।
--- তুমি যে দেশে ফিরেছ তাহলে সেতো নিশ্চয় সেটা জানে না?
--- না
--- তাহলে একটু বিশ্রাম নিয়ে তুমি বেরিয়ে পড়ো ।মেয়েটা একা লড়াই করে চলেছে তার পাশে এখন তোমার থাকা প্রয়োজন।
--- এটাই তাকে আমি বুঝাতে পারিনি অনেক চেষ্টা করেও।
--- যাক আর দেরি কোরো না।সারাটা রাত জার্নি করে এসেছ একটু ঘুমিয়ে বেরিয়ে পড়।
ক্রমশঃ