Wednesday, March 30, 2022

ঝরাপাতা (উনিশ পর্ব)

 ঝরাপাতা (উনিশ পর্ব)
  দোদুলকে দেখে সুমিত ভীষণ খুশি হয়।সুমিত ভাবতেই পারেনি অত দূর থেকে মাত্র কয়েকটা বছরের বন্ধুত্বের টানে দোদুল তার বিয়েতে আসবে।দোদুলকে দেখে সুমিত আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
--- বিশ্বাস কর দোদুল তোকে আমার বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো দেখে নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।আমি ভাবতেই পারিনি হাজার হাজার মাইল পার হয়ে তুই আমার বিয়েতে আসবি।
--- আসলে কি জানিস সুমিত?সত্যি কথা বলতে তোর বিয়ে উপলক্ষ্যে এখানে আসা হয়নি।তুই যখন আমায় টেলিফোনে জানালি যে তুই এবার বিয়ে করে বউ সাথে নিয়ে ফিরবি তখন তোর মনে আছে নিশ্চয় আমি তারিখটা জানতে চেয়েছিলাম।কারণ সেই মুহূর্তে আমারও দেশে ফিরবার কথা হচ্ছিল।অত্যন্ত ক্যাজুয়ালী কথাটা জানতে চেয়েছিলাম।কিন্তু দেখলাম আমার দেশে ফেরার পরদিন তোর বিয়ের তারিখ।তাই তোকে আর সেই মুহূর্তে কিছু বলিনি।সেদিন তুই আমি আসলে তুই খুশি হবি,যদি ছুটি পাই তাহলে যেন আসি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথায় বললি।ইচ্ছা করেই তখন বলিনি যে আমি আসছি।তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ারই ইচ্ছা ছিল।
-- সে যাই হোকনা কেন তুই আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি।আমি তো শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছি কিন্তু ইয়ার তোমার সেই অস্মিতার খবর কি?
--- বলবো সব বলবো।তবে আজ নয়।অনেক ঘটনা ঘটে গেছে জীবনের উপর দিয়ে।ওটাকেও একটা ফয়সালা করার জন্যই দেশে আসা।
 সুমিতের গায়ে হলুদের পর দুই বন্ধু মিলে আবার পুরনো আলোচনায় ফিরে যায়।সুমিত জানতে চায়,
--- এবার একটু খোলসা করে বলতো ব্যাপার কি?কবে বিয়ে করছিস অস্মিতাকে?
 দোদুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
--- ভালোবাসাটা মনেহয় বিয়ে পর্যন্ত গড়ালো না। অস্মিতা বাড়ির বড় মেয়ে।হঠাৎ করেই ওর বাবা হার্ট অ্যাটাক হয়।তখন ও সবে চাকরিতে ঢুকেছে।হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন ঠিকই কিন্তু শরীরের নিচের অংশ পুরো প্যারালাইজড হয়ে যায়।প্রচুর খরচ সাথে ছোট ভাইবোনগুলির দায়িত্ব।ওর মায়ের বাইরের জগৎ সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিল না।সব দায়িত্ব এসে পড়লো অস্মির উপর।জমানো টাকায় বছর খানেক বাবার চিকিৎসা সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে।কিন্তু সে কত দিন?রাজকোষও তো শুন্য হয়ে যায় একসময়।দিনকে দিন অস্মির উপর চাপ বাড়তে থাকে।বাইরে থেকেই সমস্ত খবরাখবর পেতাম অফিসে টেলিফোনের মাধ্যমে।চিঠিপত্র সপ্তাহে দু একটা হাতে পেতাম নিজেও দিতাম।সব সময় তাকে একটা কথায় জানিয়েছি তার এই যুদ্ধে আমি তার পাশে আছি।অর্থ সাহায্য করতে চাইলে সব সময় ফিরিয়ে দিয়েছে।শেষবার চিঠিতে জানিয়েছে সে যদি বিয়ে করে তাহলে তার ছোট ছোট ভাইবোনগুলো পথে ভেসে যাবে।আমি যেন অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে নিই।আজ ছ'মাস আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি।অফিসে ফোন করে জেনেছি ও ওই অফিস থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছে।বহু চিঠি লিখেছি কিন্তু উত্তর পাইনি।তাই এবার সরাসরি এসেছি মুখোমুখি বসতে।তোর বিয়ের পাঠ মিটিয়ে তবে শিলিগুড়ি ফিরবো এরকমই মাকে জানিয়ে দিয়েছি।
 সুমিতের বৌভাতের দিন রাতেই শেষ ট্রেনের যাত্রী হয়ে রিজার্ভেশন না পেয়ে সারাটা রাত বসেই পরদিন ভোরে দোদুল শিলিগুড়ি ফিরলো।বাড়ির সকলেই যেহেতু জানতো দোদুল আর অস্মিতার কথা তাই দুপুরে খাবার টেবিলে মা তাদের বিয়ের কথাটা তোলেন।দোদুল তাদের বলে,
-- হঠাৎ করে অস্মিতার বাবার অসুস্থ্যতার কারণে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার উপর পড়েছে।ওর ভাইবোনগুলো সবাই ওর ছোট --- 
 দোদুলের কথা শুনে স্বামী স্ত্রী দু'জনে দুজনের মুখের দিকে তাকালেন তারা বুঝতে পারলেন অস্মিতার সাথে তাহলে দোদুলের বহুদিন কোন যোগাযোগ নেই।কারণ অস্মিতার বাবা মারা গেছেন প্রায় তিনমাস হতে চললো।দোদুলের বাবা তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- কতদিন তোমার সাথে তার কথা নেই?
 নিরীহ অপরাধীর মত মুখ করে দোদুল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- কেন বলো তো?
--- আসলে তোমার কথা শুনে এটাই আমার মনে হল।সে বাড়ির কোন খবরই তুমি জানো না।
--- কেন কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো ?
দোদুলের মা তখন বললেন,
--- অনেককিছুই ঠিক নেই। অস্মিতার বাবা প্রায় তিনমাস হল মারা গেছেন।খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন।বাড়িতেই ছিলেন হার্টঅ্যাটাকের পর তার শরীরের নিচের অংশ পুরো প্যারালাইজড ছিল। অস্মিতার অফিস ছাড়াও নানান কাজে তাকে ব্যস্ত থাকতে হত।মেজো মেয়ে অম্বিকা তার বাবার সেবাযত্ন করতো। হ্যাঁ তার মাও সংসারের যাবতীয় কাজ করে সময় পেলেই তিনিও তার যত্নের কোন ত্রুটি রাখতেন না।একদিন স্বামীকে মাথা ধুইয়ে গা মুছিয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজেই ঘরে পড়ে থাকা জলে পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে নেন।প্লাস্টার করে তাকে বাড়িতে আনার সাতদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় অ্যাটাকেই অস্মিতার বাবা চলে যান।সমস্ত ঝড়ঝাপটা ওই মেয়েটির উপরেই পড়ে।অদ্ভুত মানসিক দৃঢ়তা!ওর বাবার মৃত্যুর খবর লোক মারফৎ জেনে তোমার মা আর আমি দুজনেই গেছিলাম।যেটুকু সময় আমরা সেখানে ছিলাম আমরা আবিস্কার করেছিলাম এক দশভূজা যেন দশ হাতে সব দিক সামলাচ্ছে।এখন বুঝতে পারছি তোমাকেও ও কিছুই জানায়নি।কিন্তু তবুও আমার মনের দ্বন্দ্ব কিছুতেই যাচ্ছে না,আমি কিছুতেই মাথায় আনতে পারছি না ;ওর বাবা চলে গেলো ঠিক সেই সময়েই মা পা ভেঙ্গে শয্যাশায়ী হলেন,এত বড় দুটি খবর তোমার কাছে গোপন করে যাওয়ার কারণ কি?
 চোখ ভর্তি জল নিয়ে দোদুল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- বেশ কয়েক মাস আগে আমায় একটি চিঠিতে জানিয়েছিল এই সম্পর্কটা থেকে ও বেরিয়ে যেতে চায়।বাবার ওই অসুস্থ্যতার সময়ে ও ভালোভাবেই বুঝে গেছিল বিয়ে করে ছোট ভাইবোনগুলোকে ছেড়ে ও সুখী হতে পারবে না।তাছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার দায়িত্বটা তো এখন তার হাতেই।তাই তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সুখকে সে বিসর্জন দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।এতকিছু যে তার পরিবার বিশেষত তার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে আমাকে সে কোন কথায় জানায়নি।তার অফিসে ফোন করে জেনেছি সে এখন ওই অফিসেও নেই।এই কারণেই আমার এবার আসা।সবকিছু সামনাসামনি বসে খোলসা করা দরকার।তাকে বহুবার আমি জানিয়েছি তার এই যুদ্ধে আমি তার সাথেই আছি।কিন্তু সেখানেও তার আপত্তি।
--- তুমি যে দেশে ফিরেছ তাহলে সেতো নিশ্চয় সেটা জানে না?
--- না 
--- তাহলে একটু বিশ্রাম নিয়ে তুমি বেরিয়ে পড়ো ।মেয়েটা একা লড়াই করে চলেছে তার পাশে এখন তোমার থাকা প্রয়োজন।
--- এটাই তাকে আমি বুঝাতে পারিনি অনেক চেষ্টা করেও।
--- যাক আর দেরি কোরো না।সারাটা রাত জার্নি করে এসেছ একটু ঘুমিয়ে বেরিয়ে পড়।

ক্রমশঃ



    

Tuesday, March 29, 2022

ঝরাপাতা (আঠারো পর্ব)

ঝরাপাতা (আঠারো পর্ব)
  গ্রামের সহজ,সরল সুমিতের জীবনে দু'দুবার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসার প্রতি তার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।নারী সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকেই তার মনে যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছিলো ইতিকার বিয়ের পর থেকে তা সম্পূর্ণভাবে ঘৃণায় পরিণত হয়।সে মনেমনে ভাবে প্রেম,ভালোবাসা তার জন্য নয়।জীবনে যেকোন পরিস্থিতিতে সে আর কখনোই কোনো মেয়েকে হয়ত আর বিশ্বাসই করতে পারবে না।
  সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজেকেই নিজেই বোঝায় সুচন্দা তার জীবন থেকে হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো তারজন্য সুচন্দাকে কোন অবস্থাতেই দোষ দেওয়া যায় না।সেও ছিল পরিস্থিতির স্বীকার।আবার বেশ কয়েক বছর বাদে ইতিকা তার জীবনে যখন আসলো তখন কিছুটা হলেও সুচন্দার স্মৃতি মলিন হতে শুরু করেছে। তারও হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে গেলো বা বলা ভালো জোর করে তাকে বিয়ে দেওয়া হল।আসলে অধিকাংশ মেয়েদের জীবন এগিয়ে চলে প্রথমে তার বাবা পরবর্তীতে তার স্বামীর কথামত।তাদের নিজেদের মতামত,সুখ,ইচ্ছা সবকিছুই যেন অন্যের ইচ্ছামত চলে।তাই এক্ষেত্রেও পরিবারের মতকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে ইতিকা।প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরা তাদের জীবনে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমেই পরিবারে সুখ,শান্তি কেনার চেষ্টা করে। ব্যতিক্রমও যে একেবারেই থাকে না তা কিন্তু নয়।সেই আদিকাল থেকে মেয়েদের জীবনে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে নিজের সাথে নিজের।চোখের জল থাকে সকলের অলক্ষ্যে আর কষ্টটা থাকে বুকের ভিতর পাথর চাপা।
 সুমিতের ভালোবাসার প্রতি একটা ঘৃনা জন্মালেও মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধার যে আসন ইতিকার বিয়ের পর টলমল ছিলো; নিজের মনে নিজেই ব্যাখ্যা করে তার অনেকটার উত্তর সে পেয়ে যায়।সুমিতের জীবন এগিয়ে চলে মনের মধ্যে কিছু চাপা কষ্ট নিয়ে।সময়ের সাথে সাথে জীবনের কাটাও যে ঘুরতে থাকে।
  চাকরি সূত্রে এখন সুমিত দেশের বাইরে পাঁচ বছর।বছরে একবার সে দেশে ফেরে,আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করে।সাধ্যমত চেষ্টা করে অর্থনৈতিক কারণে তারা যে কাজগুলি করে উঠতে পারছে না সেগুলি মীমাংসা করে দিতে।বাবা, মায়ের ইচ্ছাতেই এবং পছন্দে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। সুমিতদের এক আত্মীয়ের বিয়েতে সুমিতের মায়ের একটি মেয়েকে দেখে খুব পছন্দ হয়।খোঁজ খবর নিয়ে তাদের কথা দেন তারা মেয়েটিকে তাদের ঘরের বউ করে আনবেন।সুমিত দেশে ফিরলে তাকে কথাটা জানালে সে বেঁকে বসে। কিছুতেই সে বিয়ে করতে রাজি হয় না।ছোটবোন বিশাখাকে ছেলেবেলা থেকেই সুমিত খুব ভালোবাসে।অনেক সময় এমন হয়েছে হয়ত সুমিত জীদ করছে কিন্তু বিশাখা বুঝিয়ে বললে সে সেই কথা শুনেছে।বিশাখা বাড়িতে এসে দাদাকে বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য বললে সে বলে,
--- আমার জীবনের সমস্ত কথায় তুই জানিস।সে সুচন্দা হোক কিংবা ইতিকা।পৃথিবীর প্রতিটা নারীকে আমি সম্মান করি কিন্তু কোন নারীকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে আর বিশ্বাস করি না।মন থেকে আমি আর কাউকে কোনদিনও ভালোবাসতে পারবো না।শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন অর্থ নেই।
--- দাদা, কারো জন্যই কারো জীবন থেমে থাকে না।আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।যে ঘটনা দুটো তোর জীবনে ঘটেছে তারজন্য কিন্তু ওই দুজনের কেউই দায়ী নয়।দুজনেই পরিস্থিতির স্বীকার। কে বলতে পারে হয়ত তোর জীবনে আসা দুটো নারীই সকলের অজান্তে চোখের জল ফেলছে বুকে পাথর বেঁধে।তুই তো কারোরই  মনের খবর জানার সুযোগই পাসনি।মেয়েরা এমন অনেককিছু জীবনে মেনে নিতে বাধ্য হয় যা জেনেবুঝে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার সমান হয়।নিজেকে পুড়িয়ে তারা পরিবারের মানসম্মান ,সুখশান্তি কেনে।সব ক্ষেত্রেই যে এমনটা হয় তা কিন্তু বলছি না।কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এটাই ঘটছে।
তারপর কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলে,
  --তুই রাজি হয়ে যা দাদা।দেখ বাবা,মাও তো চায় তাদের ছেলের বউ দেখে যাবে।দেখবি তুই ঠিক সুখী হবি।
-- কিন্তু --
-- কোন কিন্তু নয়।তুই এক কাজ কর;তুই বিয়ের আগে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে সামনাসামনি একবার দেখে আয়।তোর কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে তখন নাহয় জেনে নিবি।
--- কিন্তু বিয়ের আগে মেয়ের সাথে কি করে দেখা করবো?তার বাবা,মা রাজী হবেন কেন?
--- তুই বড্ড বেশি বকিস দাদা। সব কথা সব সময় সবাইকে বলেকয়ে করতে হবে কেন?মেয়ের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা আমিই করে দেবো।কেউই জানতে পারবে না। দয়া করে তুই কথাটা অন্য কাউকে বলিস না।তোর তো আবার " সদা সত্য কথা বলিবে"- নীতিতে বিশ্বাসী।
 বিয়ের কথা ফাইনাল হওয়ার পর বিশাখা ঠিক ম্যানেজ করে তার উঠবি বৌদিকে বাড়ি থেকে বের করে এনে দাদার সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দেয়।কিন্তু সরল প্রকৃতির সুমিত কথারচ্ছলে তার উঠবি বউকে বলে,
--- জীবনে দু'দুটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম কিন্তু কেউই আমার হয়নি।আমি আমার সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবাসার আপ্রাণ চেষ্টা করবো কিন্তু তুমি কি আমার এই কথা জানার পর আমায় ভালোবাসতে পারবে?
--- বাবা,মা যেখানে বিয়ে ঠিক করেছেন সেখানে আমার অমত করার কোন প্রশ্নই আসে না।আর অমত করলেও বা কে শুনছে?আগে তোমার জীবনে কতবার প্রেম এসেছে তা জেনে আমার কি লাভ বলো?বিয়ের পর আমি তোমার কাজ থেকে সম্পূর্ণ ভালোবাসা চাই সেটা পেলেই হবে।
 সেদিন ধীরার কথাগুলো সুমিতকে একটা মানসিক শান্তি দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও সেদিন বুঝতে পারেনি তার এই সরলতার দাম দিতে হবে আজীবন একটু একটু করে।বিয়ের আগে ধীরার সাথে দেখা করতে গিয়ে সেদিনই সে তার জীবনের অশান্তির বিষবৃক্ষটি রোপণ করে এসেছিল।
 ধীরার ছিল আকাশচুম্বী চাহিদা।সে চাহিদা পূরণে সুমিত ছিল সক্ষম।সমস্ত মনপ্রাণ উজাড় করে ধীরাকে ভালোবেসে তার সকল চাহিদা পূরণ করেও সুখী হওয়া বলতে যা বোঝায় তা কোনদিনও হতে পারেনি সুমিত।কিন্তু সে তো পরের কথা।
  বিয়ের অধিকাংশ বাজার সুমিতের দিদি ও বোন মিলেই করে।বিয়ের প্রায় দু'তিন দিন আগে থাকতেই তারা তাদের ছেলেদের নিয়ে বাপের বাড়িতে হাজির হয়ে যায়।অনেকদিন পর সমস্ত ভাইবোনগুলো একজায়গায় হয়ে সবাই খুব আনন্দে সময় কাটাতে থাকে।কেউ টের না পেলেও সুমিতের মনের ভিতর একটা ঝড় কিন্তু মাঝে মধ্যেই  দমকা বাতাস দিয়ে চলেছে আর তার ফলেই সুমিত কখনো কখনো একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে।
 সুমিতের বিয়ের দিন সকালে এসে হাজির হয় তার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহপাঠী দোদুল।

ক্রমশঃ 

Saturday, March 26, 2022

ঝরাপাতা (সতের পর্ব)

 ঝরাপাতা (সতের পর্ব)

  সুমিত পথ চলতি মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে আস্তে আস্তে ইতিকাদের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। শেষমেষ সে এসে পৌঁছায় তার ইতির বাড়ির সামনে।বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারে কাল বা পরশু এই বাড়িতেই বড় কোন অনুষ্ঠান হয়ে গেছে।সে গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে বাড়ির ভিতর অভিমুখে এগিয়ে চলা অপরিচিত একজনের কাছে জানতে চায় 
--- দাদা এটা কি ইতিকাদের বাড়ি?
--- হ্যাঁ ভাই।ওর তো কাল বিয়ে হয়ে গেলো।এই কিছুক্ষণ আগেই ও শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো।আপনি কি ওর বন্ধু?জানেন না যে ওর বিয়ে হয়েছে গতকাল।আর জানবেন বাই কি করে?এত তাড়াতাড়ি কেন যে বাড়ির লোকজন তার বিয়ে দিলো বুঝতেই পারলাম না।মেয়েটা তো কলকাতা পড়াশুনা করছিলো।এখনো তার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়নি।তার মধ্যেই মাঝপথেই এক মাঝ বয়সী লোকের সাথে তার হঠাৎ করেই বিয়ে দিয়ে দিলো।কিছুই বুঝলাম না!
 ভদ্রলোক কথাগুলি বলছেন ঠিকই কিন্তু সুমিতের মাথায় তখন কিছুই ঢুকছে না।গেটের কাছে ইতস্তত কিছু চেয়ার,টেবিল ছড়ানো ছিটানো ছিল।হয়ত ডেকরেটর ভদ্রলোক সেগুলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।হঠাৎ মাথাটা ঘুরে যাওয়ায় পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা ভদ্রলোকটি খপ করে তার হাত ধরে একটি চেয়ারে বসিয়ে দেন।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মনের মধ্যে জমা হওয়া প্রশ্নের কোন সমাধান সূত্র খুঁজে না পেয়ে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।অবশ্য তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটি সুমিতকে বারবার জিজ্ঞাসা করেন সে ঠিক আছে কিনা,সে একাই তার বাড়ি যেতে পারবে কিনা?হঠাৎ করে তার এমন কি হল যে সমস্ত শরীর তার ঠকঠক করে কাঁপছে?
 কোন কথারই উত্তর দিতে সুমিত পারেনি।হঠাৎ করেই যেন তার সমস্ত বাকশক্তি রহিত হয়ে গেছিলো।কোন প্রকারে নিজের শরীরটা টেনে বাড়ি ফেরে।মন তো সেই কিশোর বয়সেই একবার ভেঙেচুরে তছনচ হয়ে গেছিলো।তখনই তো জীবনের সব মানে সুমিতের কাছে শূন্যে পৌঁছেছিল।সুচন্দাকে ছাড়া জীবনে আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না বলেই সে ভেবে নিয়েছিলো।কিন্তু সময় সেই ক্ষতের উপর প্রলেপ ফেলেও দিয়েছিল।কিন্তু হঠাৎ করে মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানে সুমিতের জীবনে আবার বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘটনা ঘটে গেলো।কিছুতেই সে মাথায় আনতে পারছে না কেন এমনটা ইতিকা করলো নাকি তাকে এরূপটা করতে বাধ্য করা হল?বেশ কয়েকটা দিন খাওয়া দাওয়া ভুলে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখলো।সুমিতের মা বিশাখাকে খবর দিলেন।সেও এসে দাদার মুখ থেকে একটাও কথা বের করতে পারলো না।কিন্তু বুদ্ধিমতী বিশাখা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে কারণ আগেও একবার সে তার দাদাকে এভাবেই ভেঙ্গে পড়তে দেখেছে।
 পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার আগেই সুমিতকে চাকরিতে জয়েন করতে হল।কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়া মনটাকে নিয়ে জীবনের স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে পা দিয়েও সেভাবে সে কিছুতেই খুশি হতে পারে না।চাকরি পাওয়ার যে আনন্দ তা দ্বিগুণ কষ্ট হয়ে বুকে চেপে বসে।এই চাকরি পেয়েই সে ইতিকাকে বিয়ে করবে বলে সব ঠিক করে রেখেছিল।অফিস কিংবা বাড়ি যেকোন জায়গাতেই কাজ ছাড়া প্রতিটা মুহূর্তে সে ইতিকার কথা ভাবে আর মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে যেভাবেই হোক সে শেষবারের মত একবার হলেও ইতিকার সাথে দেখা করবেই।জানতে চাইবে তার কাছে কি এমন ঘটলো যে পনেরদিনের মধ্যে এমন একটা ডিসিশন নিতে সে বাধ্য হল।
 প্রথম থেকেই অফিসে সুমিত তার কাজ দিয়ে উপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।সকলেই সুমিতকে এক ডাকেই চেনে।যে সময়টুকু সুমিত কাজ নিয়ে থাকে সেই সময়টুকুই শুধু ইতিকার কথা সে ভুলে থাকে।কাজ শেষে আবার যে সেই।ভালোবাসা বারবার তার জীবনে কেন এমন আঘাত হানছে কিছুতেই সে বুঝতে পারে না। সম্পূর্ণটুকুই দিয়ে সে সুচন্দাকে যেমন ভালোবেসেছিলো ঠিক তেমনই সে তার সবটুকু দিয়েই ইতিকাকেও ভালোবেসেছিলো।কাউকেই সে ঠকাতে চায়নি কখনো।তবে কেন তার জীবনে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না হয়ে আঘাত হয়ে বুকে বাজে?
 চাকরি জীবনের মাস তিনেক হওয়ার পর আবার একদিন সে তার গ্রামের বাড়িতে যায় শুধুমাত্র ইতিকার সাথে একবার দেখা করার জন্য। অফিসও তাকে জানিয়ে দিয়েছে ছমাসের মধ্যেই তাকে বাইরে যেতে হবে।তাই দেশ ছাড়ার আগে একবার সে জেনে যেতে চায় কেন ইতিকা এমন করলো তার সাথে।
 সুমিত তাদের গ্রামের বাড়িতে এসে একদিন সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলো ইতিকাদের গ্রামে।সেই গ্রামের কাউকেই সে চেনে না। বুকের ভিতর দলা পাকানো একটা ব্যথা তবুও তাকে জানতে হবে আসল ঘটনাটা কি?সুমিত যখন ইতিকাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে তখনো জানতো না তার সাথে ইতিকার দেখা হবে কিনা।কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যেই সুমিত চলে আসে ইতিকাদের গ্রামে।বাড়ির গেটের সামনে এসেও সে সেই বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায় না।সরে আসে সেখান থেকে।আশেপাশে কাউকেই দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর সে মনেমনে ভাবে, " আজকে যেভাবেই হোক সমস্ত ঘটনাটার একটা উত্তর তাকে পেতেই হবে।"সন্ধ্যা তখন হয়হয়।গ্রামের রাস্তাঘাটে তখনো সব জায়গায় ইলেকট্রিক আলো এসে পৌঁছায়নি।কিছু দূরে সে একটা আলোর আভাস পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়।দেখে একটা চায়ের স্টল।বসে পড়ে সেখানে।চায়ের অর্ডার দেয়।দু একজন খরিদ্দার যারা ছিলো তারাও তাদের চায়ের দাম মিটিয়ে চলে যায়।দোকানদারের সাথে যাকে বলে খেজুরে আলাপ শুরু করে সুমিত।একথা সেকথার পর সুমিত বলে,
--- কয়েকদিন আগেও এখানে একটি কাজে এসেছিলাম।তখন ঐ বাড়িতে (আঙ্গুলের সাহায্যে ইতিকাদের বাড়ির দিক নির্দেশ করে) দুদিন আগে একটা বিয়ে হয়েছে বলে মনেহল।
--- হ্যাঁ ওই বাড়িতে হঠাৎ করেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো।আর বলবেন না দাদা।আমরা তো ভবতোষবাবুর মেয়ের বিয়ে শুনে অবাক!তারপর কানাঘুষোতে জানলাম কলকাতা শহরে পড়তে পড়তে একটা বকাটে ছেলের সাথে প্রেম পিরিত হয়।তারউপর ছেলেটা আবার কায়স্থ।ভবতোষবাবুর লোকের বাড়ি বাড়ি পুজো করেই দিন গুজরান।কায়স্থ ছেলেটার সাথে মেয়েটার বিয়ে হলে তো গ্রামে কেউ আর তাকে পুজোর জন্য ডাকবে না।তাই সাত তাড়াতাড়ি মেয়েটার ডবলেরও বেশি বয়সের একটা বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে দিল।আর সব চাইতে মজার কথা কি জানেন দাদা ?যে বুড়োর সাথে মেয়েটার বিয়ে দিলো সেই বুড়োটা মেয়েটার স্কুলের শিক্ষক ছিল।আগে একটা বিয়ে ছিল।বউটা মরে যাওয়ায় এই বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে করেছে।ওই ভবতোষবাবু মেয়েটাকে ভয় দেখিয়েছিল যদি সে এই বিয়ে না করে তাহলে তিনি গলায় দড়ি দেবেন।মেয়েটার কিছু করারও ছিল না।সন্তান হয়ে বাবার মৃত্যুর কারণ আর কি করে হবে বলেন?কত মেয়ের জীবনের স্বপ্ন যে এইভাবেই ভেঙ্গে যায় কেউ কি আর তার খবর রাখে?
 সুমিত নিজের চোখের জল লুকাতে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।

ক্রমশঃ

Monday, March 21, 2022

সন্তানের ভালোবাসা

সন্তানের ভালোবাসা

   এক প্লেট পকোড়া!!দুই ভাইবোন আনন্দে উচ্ছল হয়ে মায়ের হাতে পকোড়ার প্লেট দেখে তক্তপোষ থেকে সঞ্জীব আর লাবনী মায়ের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।মা লতিকা বলে 
-- এর মধ্যে দশটা পকোড়া আছে।এক এক জনের পাঁচটা করে।
 লাবনীর বয়স এই আট বছর।আর সঞ্জীব ছয়।লাবনী তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- তোমার আছে মা?
--- আছে রে আছে।আমারটা রান্নাঘরে রেখে এসেছি।আমি চা করতে করতে খেয়ে নেবো।তোরা দুজনে এটা খেয়ে পড়তে বসবি।
  কথা কটি বলে লতিকা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।আজ মনটা তার খুবই ভালো আছে।অনেকদিন পর ছেলেমেয়ের মনের আশা পূরণ করতে পেরে সে খুবই খুশি।
  আজ দুবছর হল তপন হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ করেই চলে গেছে।সামান্য একটা দোকানে কাজ করে যে অল্প বিস্তর টাকা তপন রোজগার করতো তাতে কষ্ট করে দুই সন্তান সহ তারা ভালোই ছিলো।অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী কিন্তু তার মধ্যেও ভালোবাসার কোন খামতি ছিল না।বাড়িটা ছিলো নিজেদের। বংশ পরম্পরায় জমি দখল করে থাকতে থাকতে কোন এক সময় সে বাড়িটা নিজেদেরই হয়ে গেছে।সরকার থেকে এই দখলকৃত জমির উপর তৈরি করা বাড়ির মালিকদের মালিকানা স্বত্ব স্বরূপ দলিলও দিয়েছে।
 হঠাৎ করেই তপনের চলে যাওয়ার পরে লতিকা অথৈ সমুদ্রে পড়ে।জমানো পুঁজি তো কিছুই নেই।কোনরকমে পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর পরই লতিকা দুটো বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা করে নেয়।এখন সে বেশ কয়েকটি বাড়িতেই রান্নার কাজ করে।দুবেলা অন্নের অভাব তার নেই ঠিকই।বাচ্চা দুটিকে স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছে শুধু নয় একজন গৃহ শিক্ষকের কাছে তাদের পড়তেও পাঠায়।এখন সে চারটে বাড়িতে শুধুমাত্র রান্নার কাজ করে।রোজই কোন না কোন বাড়ি থেকে কিছু না কিছু খাবার সে পায়।সেগুলো সব সময়ের জন্যই সে বাড়িতে নিয়ে আসে।কিন্তু অনেক সময় ছেলেমেয়ের সখ,আহ্বলাদগুলো পূরণ করে উঠতে পারে না।তাই মাঝে মধ্যে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
 এবারে পুজোর সময় বেরিয়ে বাচ্চাদুটি ফুটপাথের উপরে পকোড়া বিক্রি হচ্ছে দেখে দুজনেই পকোড়া খেতে চেয়েছিল।লতিকা এগিয়েও গেছিলো কিনবে বলে।পকোড়াগুলো ছিল বেশ বড় বড়।এক একটা দাম ছিলো কুড়ি টাকা করে।ব্যাগ খুলে লতিকা দেখে তার ব্যাগে আছে মাত্র তিরিশটি টাকা।তাই সেদিন সে তাদের আর পকোড়া কিনে দিতে পারে না।কিন্তু মনের মধ্যে থেকে যায় একটা ভীষণ চাপা কষ্ট!
 আজ ছিল রমেনবাবুর ছেলের মুখেভাত।সেই প্রথম থেকেই এই বাড়িতে লতিকা কাজ করছে।রমেনবাবু এবং তার স্ত্রী লতিকাকে খুবই ভালোবাসেন বিপদে-আপদে নানানভাবে লতিকাকে সাহায্যও করেন।সকাল থেকে অনুষ্ঠান বাড়িতে যন্ত্রের মত খেটে চলেছে লতিকা।এই অনুষ্ঠানে স্টাটারে পকোড়া ছিল।নিমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই না আসাতে প্রচুর খাবার বেঁচে যায়।অনেকেই খেয়ে আবার পার্সেল নিয়ে বাড়ি ফেরে। লতিকাও তিনটে পার্সেল পায়।সাথে বেশ কয়েকটা পকোড়া।
 সঞ্জীব আর লাবনী পকোড়া খেতে খেতে হঠাৎ তাদের মনেহয় মা বোধহয় তাদের মিথ্যা কথা বলেছে।মায়ের জন্য মনেহয় পকোড়া নেই।দুজনেই দুটি পকোড়া হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ছুটে আসে।মাকে দুজনে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে মুখের সামনে পকোড়া ধরতেই লতিকা দুজনকেই দুহাতে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
--- তোরা দুজনে মন ভরে পকোড়া খা আর আমার জন্য থাক তোদের এই ভালোবাসাটা।


Sunday, March 13, 2022

ঝরাপাতা (ষোলো পর্ব)

ঝরাপাতা (ষোলো পর্ব)

   সুমিত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে খুব ভালো ফল করে কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই বিদেশী কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়।কিন্তু কলেজে পড়াকালীন সময়ে এক বছরের জুনিয়র ইতিকার সাথে তার বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠে।যখন সুচন্দাকে হারানোর ক্ষতটা অনেকটাই মিলিয়ে গেছে তখন সুমিত পুনরায় আবিস্কার করলো সে ইতিকাকে ভালোবাসে।ইতিকা সুচন্দার মত অতটা সুন্দরী না হলেও একটা আলগা শ্রী আছে।সব থেকে সুমিতের যেটা ভালো লেগেছিলো তা হল ইতিকার মধ্যে অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিলো সুমিতের অনেক মনের কথায় সে না বলতেই বুঝে ফেলতো।সেও ছিল গ্রামের মেয়ে।কিন্তু কলকাতায় একটি বাড়িতে পেয়িং গেষ্ট হিসাবে থাকতো।কলেজে তো দেখা হতই দু,একদিন ছুটির দিনে ভিক্টোরিয়া, গড়ের মাঠ,মনুমেন্ট - ঘোরাটা বেশ ভালই হত।ভবিষ্যত পরিকল্পনায় দুজনেই তখন মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ছে।একদিন দেখা না হলেই দুজনেই যেন অস্থির হয়ে উঠতো।
  সুমিত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে চাকরি পাওয়াতে  দুজনেই ঠিক করল বিয়েটা সুমিতের পড়া শেষ হলেই তারা এবার সেরে ফেলবে।কোম্পানির থেকে সুমিতকে জানানো হয়েছিল তার কাজের উপরে নির্ভর করবে কোম্পানি তাকে তাদের বিদেশে পাঠাবে কিনা।একদিন কলেজে ইতিকা সুমিতকে জানালো যে,
--- এই,আগামীকাল আমি যে বাড়িতে পেইংগেষ্ট হিসাবে থাকি ওরা না দুদিনের জন্য আত্মীয়ের বিয়ের জন্য বাড়িতে থাকবে না।আমাকে বলেছে ওদের রান্নাঘরে দুটোদিন রান্না করে নিতে।বাজার ওরাই করে রেখে গেছে।তুমি আসবে ওই বাড়িতে?
-- যেতে তো কোন অসুবিধাই নেই।কিন্তু পাড়ার লোক দেখে ফেললে তোমার বদনাম হবে।তাছাড়া উনারা ফিরলে যদি পাড়ার লোকেরা তাদের কাছে বলে দেয় তাহলে তোমার নামে নানান ধরনের বদনাম দেবে তোমায় রাখতেও তারা অস্বীকৃতি জানাতে পারেন।
-- আরে এতসব কিছুই হবেনা।তুমি সব ব্যাপারে এত ভাবো কেন?একটা কিছু করতে গেলে কি হবে,কি হতে পারে,হলে কি হবে -- বাবারে বাবা!আমি এতকিছু জানিনা তুমি কাল সন্ধ্যায় আসছো ব্যাস।
--- আমার মন সায় দিচ্ছে না।
--- তুমি এত ভীতু আমি জানতাম না তো!
--- এটা ভীতুর প্রশ্ন নয়।মানসম্মানের প্রশ্ন।এতে আমার কিছুই হবে না।কিন্তু তোমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হতে পারে।
--- আমি এসব কিছু শুনতে চাই না।তুমি কাল সন্ধ্যায় আমার কাছে আসছো এটাই ফাইনাল।
 সুমিতকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে ইতিকা উঠে দাঁড়িয়ে মুখটা সুমিতের খুব কাছে এনে হেসে পড়ে বললো,
--- না আসলে আমি কিন্তু খুব রাগ করবো।
এরপর কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ,
--- অপেক্ষায় থাকবো কিন্তু।
 সুমিতের বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো।ইতিকা এভাবে অনেকবার অনেক কথা বলেছে তবে আজকে এই কথাটার মধ্যে এমন কি আছে যার জন্য তার বুকের ভিতরটা তোলপাল করছে!কিসের ইঙ্গিত দিয়ে গেলো ইতি? বাড়ি ফিরেও মাথা থেকে ইতিকার মুচকি হাসি দিয়ে কথাটার মানে বোঝার অনেক চেষ্টা করেছে।
 পরদিন ছিল রবিবার।যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও মনের মধ্যে ওঠা নানান প্রশ্নের উথালপাতাল ঢেউয়ের মীমাংসা করতেই সুমিত রওনা দেয় ইতিকা যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়িতে।ইতিকা যেন জানতোই সুমিত আসবে।সাদর অভ্যর্থনে সে সুমিতকে নিয়ে তার ঘরে যায়।পুরো একটা বাড়িতে এক ঘরে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা একান্তে বসে গল্প করলেও সুমিত বেশ কয়েকবারই উঠে দাঁড়িয়েছে চলে আসবে বলে।যে সুমিত অতি সামান্য সময় সুচন্দাকে কাছে পেয়ে মুহূর্তে তাকে ভালোবাসার প্রলেপ ঠোঁটে এঁকে দিতে আগেপিছে কিছুই ভেবেছিল না সেই সুমিত আজ আর একটু পরিণত।হয়ত ভালোবাসার আঘাত তাকে পরিণত করে তুলেছে।কিন্তু তবুও সে একজন পুরুষ!যে ইতিকাকে সে কলেজে ,সিনেমা হলে,ভিক্টোরিয়ায় দেখেছে,পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটেছে আজ সেই ইতিকাকে বড্ড অচেনা লাগছে সুমিতের।যাওয়ার সাথে সাথেই সুমিতের জন্য সে চা,জলখাবার নিয়ে আসে।জলখাবারটা সে আগে থাকতেই তৈরি করে রেখেছিল।নিজেকে খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়েছে।সুমিতের কাছে তাকে আজ খুব মায়াবী লাগছে।
  নানান ধরণের গল্পগুজবের মাঝে ইতিকা জানতে চায়
--- আচ্ছা সুমিত আমরা কবে বিয়ে করছি
--- বাড়িতে মাকে আমি সব জানিয়েছি ।মা ই বাবাকে সব জানাবেন।আমি চাকরিতে জয়েন করার ছমাস পরই আমাদের বিয়েটা হবে।কারণ ওই কোম্পানির থেকে জানিয়েছে আমার কাজ করার ধরণ যদি ওদের পছন্দ হয় তাহলে একবছরের মাথায় ওরা আমাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেবে।তাই আমার ইচ্ছে তোমায় নিজের করে রেখে তারপর আমি বাইরে যাবো।
 সুমিতের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আচমকা ইতিকা সুমিতের কাছে এসে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।সুমিত বসেই ছিল খাটের উপর।সুমিতের ঠোঁটের কাছে নিজের মুখটি এনে আলতো করে কামড়ে রাখে। সেই মুহূর্তে দুটো নরনারী ভুলে গেলো বেশ কয়েক মিনিট জাগতিক সবকিছু।এক স্বর্গীয় সুখে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রইলো।হারিয়ে গেলো কি হবে,কি হতে পারে এসব চিন্তা!
 ইতিকা অতি স্বাভাবিক থাকলেও সুমিতের এই ঘটনার পর কিছুটা হলেও মনের ভিতর এক অনুশোচনাবোধ কাজ করতে থাকে।সে কিছুতেই যেন ইতিকার দিকে আগের মত চোখ তুলে তাকিয়ে ফ্রী ভাবে গল্প করতে পারে না।দেখা তাদের রোজই হয় কলেজে।কথাও হয় কিন্তু সুমিতের মনের মধ্যে কেমন যেন এক দ্বন্দ্ব কাজ করে।বিয়ের আগে ইতিকার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াটা কিছুতেই সে মন থেকে মানতে পারে না।ইতিকাকে সে তার পরীক্ষার আগেই জানায় 
--- পরীক্ষার শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমি বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই।যদিও তোমার ফাইনাল পরীক্ষার আরো কয়েক মাস বাকি ।তুমি তোমার বাড়িতে বলে তোমার বাবা,মাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বোলো।
--- আমি বুঝতে পারছি সেদিনের ঘটনার পর তুমি আমার সাথে ফ্রী হয়ে মিশতে পারছো না।কিন্তু কেন বলো তো ?আমরা তো একে অপরকে ভালোবাসি।আর ভালোবেসে কাছে আসলে তারমধ্যে অপরাধটা কোথায়?আমি চেয়েছি তাই এটা ঘটেছে।এত অপরাধ বোধে ভুগো না। পরীক্ষা শেষ হোক আমি বাড়িতে গিয়ে বাবা,মাকে তোমাদের বাড়িতে পাঠাবো।
  পরীক্ষা শেষ হয়। ইতিকার তখনো একবছর বাকি।সুমিত এবং ইতিকা একই গ্রামের না হলেও কিছুটা দূরত্বের দুই গ্রামে তাদের বাস।তাই একে অন্যের বাড়িতে না গেলেও দুজনেই দুজনের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জানতো।সুমিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর চাকরিতে জয়েন করার পরেও যখন ইতিকার বাড়ি থেকে সুমিতদের বাড়িতে কোন প্রস্তাব আসে না অর্থাৎ ইতিকার বাবা,মাকে দেখতে পায় না তখন একদিন সুমিত ইতিকার মুখে শোনা তাদের গ্রামের নাম আর তার বাবার নামটা মনে রেখে গুটি গুটি পায়ে তার ইতিদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

ক্রমশঃ
 

Friday, March 11, 2022

কৃতকর্মের ফল

কৃতকর্মের ফল
  সেই ছেলেবেলা থেকে শ্রেষ্ঠার স্বভাব কষ্ট পেলে দরজা বন্ধ করে কাঁদা।এখন শ্রেষ্ঠার বয়স বাইশ বছর।আজও তার স্বভাবের কোন ব্যতিক্রম হয়নি।
 শ্রেষ্ঠার জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা যান।হাসপাতাল থেকেই শ্রেষ্ঠা চলে যায় তার মামাবাড়িতে। ছমাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠাকে মানুষ করার অজুহাতে তার বাবা আবার বিয়ে করে আনেন।
  কিন্তু মামাবাড়ি থেকে শ্রেষ্ঠাকে আনার কোন লক্ষণ তার বাবার মধ্যে ছিলো না।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার স্ত্রী ললিতা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়।আগের পক্ষে কালীপদর যে একটি মেয়ে ছিল বউয়ের আদর,সোহাগ পেতে আর সংসারের সুখ কিনতে কালীপদ ইচ্ছাকৃত তা ভুলেই গেছিল।
  শ্রেষ্ঠা যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন তার দিদিমার মৃত্যু হওয়াতে তার মামী তাকে রাখতে অস্বীকার করায় মামা একদিন সন্ধ্যার সময় ছেঁড়া এক ব্যাগের মধ্যে কয়েকটি জামাকাপড় আর তার ক্লাসের বইগুলি সমেত শ্রেষ্ঠার বাবার বাড়িতে তাকে পৌঁছে দিয়ে যায়। কালীপদর পক্ষে মেয়েকে চেনা সম্ভব ছিল না তিনি শ্যালককে দেখে ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিলেন 
  খাওয়া-পরায় বিনা মাইনের ঝি মিলে গেলো ললিতার।মুখ বুঝে সারাক্ষণ কাজ করলেও উপরি হিসাবে মুখ ঝামটাটা প্রতিক্ষণে পেয়ে যেত।কালীপদ এ ব্যাপারে ছিল অন্ধ। শ্রেষ্ঠা তার বুকের কষ্ট লাঘব করতে ছোট্ট একটা ঘরের এক ভাঙ্গা চেয়ারের উপর বসে চোখের জলে বুকের কষ্ট লাঘব করতো।কোন খাট ছিল না।শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা সিমেন্টের মেঝেতেই মাদুর আর একটা শত ছেঁড়া তোষকের উপর তাকে রাত কাটাতে হত।
  বাইশ বছরের এক মেয়েকে কিছু টাকার লোভে পঁয়তাল্লিশ বছরের এক পৌঢ় এর সাথে বিয়ে ঠিক করে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার দায়িত্ব পালন করতে কালীপদ বিন্দুমাত্র ভাবেনি।
  দুবছর ধরে নিত্য রাতে ধর্ষিতা শ্রেষ্ঠা একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রমেশের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পাশের বাড়ির সাহায্যে ডাক্তার এনে জানতে পারে ঘুমের মধ্যে রমেশের মৃত্যু হয়েছে।কারও মৃত্যু যে অন্য কারো জীবনে শান্তির শ্বাস হয়ে আসে আজ শ্রেষ্ঠা তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলো।
 টাকা,পয়সা,সোনাদানা রমেশের কোনকিছুরই অভাব ছিল না।শুধু তিন তিনবার বিয়ে করার পর কোন বউ ই বেশিদিন টেকেনি।একটা ঘর ছেড়েছে রাতের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আর দুজন মারা গেছে।লোকটির কপালে বউ টেকে না!যদিও এবারে শ্রেষ্ঠা টিকে গেলেও সে নিজেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিল।
 জন্মের পর এই প্রথম শ্রেষ্ঠা সুখের মুখ দেখলো রমেশের মৃত্যুর পর।এই ঘটনার বছর তিনেক পর একদিন সন্ধ্যার সময় তার বাবা একটি ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে তার দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।
 বাবার কাছ থেকে জানতে পারে তার সৎমায়ের মৃত্যুর পর তার ভাই বিয়ে করে আনে।কিন্তু সে কিছুতেই কালীপদকে বাড়িতে থাকতে দেবে না কারণ কালীপদ তার বাড়িটা ছেলের নামেই করে দিয়েছিল অনেক আগেই।আজ তাকে ছেলে আর বউ মিলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
 এখন শ্রেষ্টার বাবা তার কাছেই থাকে।যখন কালীপদ তার মেয়েকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন তার চোখ থেকে অবিরল ধারায় জল পড়ে।আর শ্রেষ্ঠার মন এক শান্ত ,সুশীতল, অনিবর্চনীয় সুখানুভূতি লাভ করে।


 

Thursday, March 10, 2022

অন্তর দিয়ে দেখো

অন্তর দিয়ে দেখো 
  ছোটবেলা থেকেই দুই ভাই ছিল হরিহর আত্মা।মাত্র দেড় বছরের ছোটবড়।ভায়ের যেমন দাদাকে না হলে চলে না দাদারও ঠিক ভাইকে না হলে একমুহুর্ত চলে না।একসাথে খাওয়া,একসাথে ঘুমাতে যাওয়া সবকিছুই সেই ছেলেবেলা থেকে একসাথেই।বিজয় বড় আর সুজয় ছোট।
   বড় জনের বিয়ের পরও এই সম্পর্কের মধ্যে কোন চিড় ধরেনি।বৌদির সাথে সুজয়ের খুবই ভালো সম্পর্ক হয়ে ওঠে।একদম বন্ধুর মত দুজনের কথাবার্তা।বিজয়েরও খুব ভালো লাগে তার স্ত্রীর সাথে ভায়ের এই বন্ধুসুলভ সম্পর্ক।বিজয়ের মা কোনদিনও তার রান্নাঘর ছাড়া অন্য দিকে নজর দেননি ছেলের বিয়ের পরেও না।বড়বৌ আল্পনা রান্নাবান্না করলেও তিনি সব সময়ের জন্যই ওই রান্নাঘরে থেকেই তাকে নানানভাবে সাহায্য করে যান।
   সুজয়ের বিয়ে ঠিক হয়।তার বায়নাতেই বৌদি নিজে মেয়ে দেখে পছন্দ করে।বারবার বলা সর্তেও সুজয় মেয়ে দেখতে যায় না তার সেই এক কথা,
--- যেখানে বৌদি মেয়ে পছন্দ করে এসেছে সেখানে আমি কি করতে যাবো?আর এইজন্যই তো আমি বৌদিকে পাঠিয়েছি মেয়ে পছন্দ করতে।আমি কতক্ষণ আর বাড়ি থাকবো?বৌদিই তো তাকে সাথে নিয়ে সব সময় থাকবে।
  সুজয়ের বিয়ে হয়ে গেলো।যেহেতু তাদের বাবা নেই তাই সুজয়ের বিয়েতে তার মায়ের কাজ করলো বৌদি আল্পনা।বিজয়ের বিয়েতে অবশ্য মায়ের কাজ করেছিলেন তাদের মামী।এবার সুজয়ের কথামত আল্পনায় সব দায়িত্ব পালন করে।
  বিয়ের পরে দিনপনের বেশ আনন্দে হাসিতে জা,ভাসুর,স্বামীর সাথে বিনিতার কেটে গেলেও একদিন হঠাৎ করেই বিনিতা তার স্বামীর প্রতি ক্ষেপে যায়।সুজয়ের একটায় অপরাধ সে অফিস থেকে ফেরার পর বৌদিকে চা করতে বলে বিনিতা তখন নিজে গিয়ে চা করে এনে সুজয়কে দেয়।সুজয় চা মুখে দিয়েই বলে,
--- এটা তো আমার বৌদির হাতের চা নয়!তুমি কেন চা করতে গেলে?অফিস থেকে ফিরে বৌদির হাতের চা না খেলে আমার ঠিক ভালো লাগে না।
 ব্যাস শুরু হল সংসারে অশান্তি। জায়ে জায়ে মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধের পথে।মায়ের পরামর্শে দুই ভাই শুধু মাকে জানিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একই সাথে দীঘায় গিয়ে উঠলো।ফোনের সুইচ বন্ধ।
  রাতটা কোন রকমে কাটলে সকাল হতেই বিনিতা ছুটে এলো তার বড় জায়ের কাছে।কান্নাকাটি করে হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দিলো। আল্পনা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অতি শান্ত স্বরে বললো,
-- আমার মনেহচ্ছে ছোট ওরা দুজনে একসাথেই কোথাও গেছে।আসলে দুই ভায়ের মধ্যে তো খুব ভালো সম্পর্ক কিন্তু কিছুদিন যাবৎ আমাদের জন্য সেই সম্পর্ক একটু হলেও আলগা হয়েছে।ওরা আমাদের জব্দ করতেই এ কাজ করেছে।মা মনেহয় ব্যাপারটা জানেন।তাই তিনি চুপচাপ আছেন।ওরা দুইভাই যদি বন্ধু হতে পারে আমরা দুই জা কেন বন্ধু হয়ে থাকতে পারবো না?আয় আজ থেকে তুই আর আমি একে অপরের বন্ধু হয়ে থাকি।
 বিনিতা বললো,
-- তুমি যা বলছো সেটা কি ঠিক?ওর কোন বিপদ হয়নি তো?
--- আরে না, কোন বিপদ হয়নি।আমি মাকে চুপচাপ দেখেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি।
   দুপুরবেলা খাবার টেবিলে দুই জা শ্বাশুড়ীকে দেখিয়ে দেখিয়ে গল্প করে হেসে হেসে একে অপরের গায়ে যেন ঢলে পড়ছে।শ্বাশুড়ী তা দেখে নিজে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করলেন।তিনি ফোন করে চাপা স্বরে ছেলেদের সব জানালেন।
  রাতে খাওয়ার আগেই কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দুই জা দরজা খুলতে না গিয়ে গল্প করতে বসে গেলো।শ্বাশুড়ী মা গিয়ে দরজা খুললেন।দুই ভাই হাসতে হাসতে এসে ঘরে ঢুকলো।

Saturday, March 5, 2022

ঝরাপাতা (পনের পর্ব)

 ঝরাপাতা (পনের পর্ব)

   গোবিন্দবাবুর কথা শুনে যখন সকলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সঞ্জয়ও বেরোনোর উদ্যোগ করতেই তিনি ভাগ্নের কানের কাছে মুখটা নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন,
-- ওরে ছাগল,তোকে বেরোতে বলিনি তুই একটু মেয়েটার সাথে একাকী কথা বল।
 মামার কথা বলার ধরণ দেখে সঞ্জয় হেসে ফেলে।একে একে সকলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।সকলের শেষে বেরোন গোবিন্দবাবু।তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিচ্ছেন দেখে সকলেই এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে।আর ওদিকে ঘরের ভিতরে দুটি তরুণ,তরুণী খাটের দুপাশে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর সঞ্জয় নিজেই সুচন্দার কাছে জানতে চাইলো,
--- পড়াশুনা তো শেষ এরপর কি করার ইচ্ছা আছে?
--- চাকরির চেষ্টা করবো যদি বাঁধা না পাই।
--- একটা কথা তোমায় আমি দিতে পারি এর পরেও যদি তুমি পড়তে চাও আমাদের বাড়ি থেকে কোন আপত্তি করবে না।আর যদি চাকরির চেষ্টা করে চাকরি পাও তাতেও আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।আমাদের অর্থ নেই ঠিকই কিন্তু ভালোবাসার মন আছে পরিবারের সকলের।আমি হয়ত কোনদিন তোমায় নিয়ে ফাইভ স্টারে খাওয়াতে পারবো না কিন্তু পেট ভরে তিনবেলা খাবারের কোন কষ্ট কোনদিনও হবে না।
 --- এসব কথা বলছেন কেন?আমার বাড়ির থেকে সব দেখেশুনেই তো বিয়েতে রাজি হয়েছে।
--- আমি তোমায় তুমি বলছি।আমাদের বিয়ের ফাইনাল ডেট ঠিক হয়ে গেছে।তাই আমাকে আপনি নয় তুমি বলে বলো।তাতে দেখবে নিজেও মন খুলে কথা বলতে পারবে।
 আরো কিছু বলার আছে।খুব কষ্ট করে মামার সাহায্যে মা আমাদের মানুষ করেছেন।আজ আমরা একটু সুখের মুখ দেখেছি। আমিই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম।আমাদের বাড়িতে এসে সবকিছু মানিয়ে যদি চলতে পারো দেখো সকলে তোমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে।হয়ত প্রতিবছর দার্জিলিং নিয়ে গিয়ে তোমায় সূর্যোদয় দেখাতে পারবো না কিন্তু ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলোর মত আমার ঘরের পূর্বদিকের জানলা দিয়ে প্রথম আলোটা তোমার রোজ চোখে পড়বে।আমি তোমাকে হয়ত পাহাড়ে চড়াতে পারবো না ঠিকই, পারবোনা তোমাকে প্রতি মাসে সোনার গয়না কিনে দিতে কিন্তু আজীবন তোমাকে সুখের আভরণে মুড়িয়ে রাখতে পারবো।পারবো ভালোবাসার আবরণে জড়িয়ে রাখতে।
  সেদিন সঞ্জয়ের এই কথাগুলোই খুব ভালো লেগেছিল সুচন্দার।সঞ্জয়ের মামার বাড়িতে সুচন্দাকে বলা কথাগুলো আজীবন সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছে।কোথাও কোন খামতি রাখেনি।জীবনের সমস্ত না পাওয়াগুলো সঞ্জয়ের সাথে বিয়ের পর সুচন্দা একটু একটু করে বলতে গেলে প্রায় ভুলেই গেছিল।
 সুচন্দা ও সঞ্জয়ের বিয়ের দিন ঠিক হল ১১ই জুলাই। ডেটটা ঠিক হওয়ার পর ছমাস বিয়েটা পিছিয়ে দিতে হল সঞ্জয়দের বাড়ির কোন এক পারিবারিক সমস্যার কারণে।
   সুচন্দার আরো এক বোনের বিয়ে দেওয়া তখনো বাকি।সুচন্দার মা বাড়ির সকলকে জানালেন বড় বোন থাকতে ছোটবোনের বিয়ে দেওয়াটা ঠিক ভালো দেখায় না।তাই তোমরা সকলে মিলে এই ছ'মাসের মধ্যে সুতন্দ্রার বিয়ের ব্যবস্থা করো।তড়িঘড়ি পেপারে বিজ্ঞাপন এবং নানান জায়গায় ঘটক লাগিয়ে সুতন্দ্রার জন্য ছেলে দেখা শুরু করা হল।উপযুক্ত পাত্রও মিললো।দিদির বিয়ের সময় সুচন্দা শিলিগুড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরলো তার মায়ের একান্ত ইচ্ছায় যাতে তার বিয়েটাও নিজের বাড়ি থেকেই হয়।কিন্তু এই প্রথমবার সুচন্দা বাড়িতে ফিরে সুমিতের কোন খোঁজ আর করলো না।কিন্তু তাই বলে সে যে সুমিতকে ভুলে গেছে তা কিন্তু মোটেই নয়।
  জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ফেলে আসা অনেক অতীতকেই আমরা কখনো ইচ্ছায় আবার কখনো বা অনিচ্ছায় মনের মধ্যেই ঘুম পাড়িয়ে রাখি।সদায় ব্যস্ত জীবনে এইসব ঘুমন্ত অতীত তখনই জেগে ওঠে যখন কিছুটা সময় হলেও একা থাকা হয়।
  বিয়ে হয়ে যায় বেশ ধুমধাম করেই সুমিতের সাথে সুচন্দার।বিয়েটা যেহেতু আষাঢ় মাসে হয়েছিল তাই বিয়ের দিন সকাল থেকে সঞ্জয়দের বাড়ির দিকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল।সঞ্জয়ের মেঝভাই আর সঞ্জয়ের বন্ধুরা মিলে সকালে যখন হলুদ নিয়ে আসে তখন ওদের বাড়ির দিকটা মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে আর সুচন্দাদের বাড়ির দিকে আকাশ ঘনমেঘে চারিদিক আচ্ছন্ন করে রেখেছে যেন টোকা দিলেই ঝরঝর করে বৃষ্টি শুরু হবে।এই বৃষ্টির কারণেই অনেক বরযাত্রী যেমন আসতে পারেনি ঠিক তেমনই সুচন্দাদের অনেক আত্মীয় পাড়া-প্রতিবেশী দূরদূরান্ত থেকে পৌঁছাতে পারেনি।অনেকেই কিছু পথ এসে কাকভেজা হয়ে পুনরায় বাড়ি ফিরে গেছেন।এরফলে প্রচুর খাবারদাবার বেশি হয়।এবং এইসব খাবার কিছু গরীব অসহায় মানুষদের সাহায্যার্থে বিলিয়েও দেওয়া হয়।
 স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে থাকে বিস্তর ফাঁড়াক।মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে তখন সে ভাবতেই পারে না তার সে স্বপ্ন একদিন সফল নাও হতে পারে।হঠাৎ আসা কাল বৈশাখী ঝড়ের মত যখন সেই স্বপ্ন ভেংগে চৌচির হয়ে যায় তখন টালমাটাল অবস্থায় সময়ের হাত ধরে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে বা ছিঁড়ে যাওয়া মালাটির ফুলগুলিকে বুকে পাথর বেঁধে অন্য সুতোয় নূতন করে গাঁথতে হয়ত কিছুটা সময় লাগে,হয়ত বুকের ক্ষতটা মাঝে মধ্যেই দগদগে হয়ে যন্ত্রণা দেয় কিন্তু তবুও সামনে পড়ে থাকা অনন্ত পথে হাঁটার জন্য মালাটি গাঁথতেই হয়।কারণ যখন সে বাস্তবের মুখোমুখি হয় তখন স্বপ্ন দেখা মানুষটির মনেহয় তার চারপাশের দরজা বন্ধ।অন্ধকারে একাকী সে পথ হাতড়ে ফেরে। সামান্যতম আলোর দিশা পেলেই সে কিন্তু তার তছনচ হওয়া জীবনটাকে ঠিক গুছিয়ে নিতে পারে। সঞ্জয় ঠিক আলোর দিশা হয়েই সুচন্দার এলোমেলো জীবনটাকে গুছিয়ে দিয়েছিল।ভালোবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে সুচন্দার অতীতের কিছু না জেনেই সুচন্দার জীবনটাকে ভরিয়ে দিয়েছিল।ছোটখাটো মনোমালিন্য যে তাদের মধ্যে হত না তা কিন্তু নয়।কিন্তু সেটা ছিল তাৎক্ষণিক।পারিবারিক অশান্তিও ছিল শ্বাশুড়ী ও দেওরদের সাথে।কিন্তু সবই সাময়িক।সুচন্দার শ্বাশুড়ী তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন।সাধারণত তিনি তার এই বড় বৌমাটির কোন দোষই দেখতে পেতেন না।অনেক সময় এমন হয়েছে সুচন্দা ও সঞ্জয় যখন ঝামেলা করছে তিনি তার ভিতর ঢুকে তার ছেলের বিপক্ষে গিয়ে আদরের বৌমাটিকেই সমর্থন জানিয়েছেন।আর ঠিক এরূপ পরিস্থিতিতে সঞ্জয় হেসে পরে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছে,
--- আমার মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয় তুমি আমার মা নাকি ওর মা।এরকম শ্বাশুড়ী আমি কোনদিন দেখিনি বাপু!ছেলে,বউ ঝগড়া করলে শ্বাশুড়ী থাকেন তার বউয়ের পক্ষে।
 অবশ্য সঞ্জয় এটা মুখে বলতো ঠিকই কিন্তু মনেমনে খুব খুশিই হত মাকে বউয়ের দিকে দেখে।আবার অনেক সময় এমনও হয়েছে সুচন্দা হয়ত সঞ্জয়কে কিছু বলেছে সঞ্জয় সেটা মানতে চাইছে আর ঠিক তখনই সুচন্দা হাসতে হাসতে সঞ্জয়কে বলেছে,
--- দাঁড়াও মাকে ডাকছি।কোনটা ঠিক হবে মা নিজে এসে মীমাংসা করে দেবেন।
 সুখে, দুখে এগিয়ে চলে তাদের জীবন।

ক্রমশঃ

Wednesday, March 2, 2022

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি

  ঝিকে মেরে বউকে বোঝানো - আমাকে সরাসরি কখনোই কিছু বলতেন না।কথা তিনি হাওয়ায় ছাড়তেন।এতটাই জোরে যাতে আমার কানে আসে।অনেকটা ওই ঝিকে মেরে বউকে শাসন করার মত আর কি!
  সুব্রত আমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছিল।প্রথম দিকে আমার বাড়ির মত ছিল না।ধনী পরিবারের সন্তান না হলেও আমাদের কোন অভাব ছিল না।কিন্তু সুব্রতদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না।সুব্রত সবে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে,একমাত্র সন্তান বিধবা মায়ের।খুব বড় এবং খুব ভালো না হলেও নিজেদের একটা বাড়ি আছে।মা,বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন।
 আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে একমাত্র বাবা ই আপত্তি জানিয়েছিলেন।কিন্তু সুব্রতর মায়ের ছিল ঘোর আপত্তি।কারণ ছিল আমার গায়ের রং ছিল কালো।সুব্রত এবং ওর মায়ের গায়ের রং ছিল খুব ফর্সা।কিন্তু সুব্রত মায়ের কথার পাত্তা না দিয়ে তার অমতেই আমাকে বউ করে ঘরে এনে তুলেছিলেন।
 অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো দেওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজার দিন থেকে আমাকে বিধিরে বিধিরে কথা শোনাতেন আমার শ্বাশুড়ি মা।সিন্নি মাখার আগেই পাশের বাড়ির কাকিমাকে বললেন,
--- আসলে কি জানেন দিদি কারো গায়ের রং কালো হলে আমি আবার তার হাতে মাখা সিন্নি খেতে পারি না।
  এরপর থেকে প্রতিটা কাজে আমায় খোঁটা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন আমি কালো বলে কোনকিছু মাখার অধিকার আমার নেই।একদিন সুব্রত অফিস যাওয়ার তাড়া থাকায় আমি আলুসেদ্ধ মেখেছিলাম বলে তিনি সেদিন সেটা খেলেনই না।কিন্তু কোনদিনও সুব্রতকে এসব কথা বলতাম না।
 ছেলে কিন্তু  খুব ফর্সা হয়েছিল।সে ছিল ঠাকুমার চোখের মণি।ছেলে শুভেন্দুও মাঝে মাঝে বুঝতে পারতো তার ঠাকুমা দিনে যতগুলো কথা বলেন তার অধিকাংশই তার মাকে উদ্দেশ্য করেই বলেন।কিন্তু আমি কোনদিনও তাকে তার ঠাকুমাকে কিছু বলতে সুযোগ দিইনি।প্রতিবারই বলেছি,
--- ঠাকুমার বয়স হয়েছে।এই বয়সে মানুষ এরূপ আচরণ করে থাকেন।তুমি কিছু বললে ঠাকুমা খুব কষ্ট পাবেন।আর এসব কথা বাবা যেন না জানেন।তাহলে তিনিও কষ্ট পাবেন।
      ছেলের বয়স যখন বারো বছর হঠাৎ একদিন আমার শ্বাশুড়ি মা বাথরুমের ভিতর পরে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায়।তড়িঘড়ি ছেলেকে দিয়ে উবের বুক করে মা ছেলে মিলে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাই।সুব্রত অফিস থেকে  হাসপাতালেই আসে।দেড়মাস পড়ে তাকে বাড়ি আনা হয়।কিন্তু হাসপাতাল থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল তিনি যেন খুব একটা হাঁটাচলা না করেন।তাই অধিকাংশ সময় তিনি শুয়েই থাকতেন।একমাত্র নিজের স্নান,আর প্রয়োজনে বাথরুমে যাওয়া ছাড়া তিনি উঠতেন না।এই কাজেও তাকে আমি কিংবা শুভেন্দু বাড়ি থাকলে সাহায্য করতে হত।কারণ সুব্রত খুব তাড়াতাড়িই অফিস বেরিয়ে যেত।আর শ্বাশুড়ী মা তখন ঘুমিয়ে থাকতেন।আস্তে আস্তে সে ক্ষমতাও তার চলে যায়।তখন আমিই তাকে তিনবেলা খাবার মেখে খাইয়ে দিতাম।আমি যখন তাকে খাওয়াতাম তখন তার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তো।আমি বুঝতে পারতাম কি কারণে তিনি কাঁদছেন কিন্তু কোনদিন তাকে ধরা দিইনি।
  একদিন তার ছেলে আর নাতির সামনে আমায় ডেকে নিয়ে নিজের সমস্ত অপরাধের কথা স্বীকার করেন আর হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন।সুব্রত আর শুভেন্দু দুজনে অবাক হয়ে একবার আমার মুখের দিকে আর একবার শ্বাশুড়ী মায়ের মুখের দিকে তাকাতে থাকে।প্রথম প্রথম তার এই ব্যবহারে কষ্ট পেলেও পরে কিন্তু আমার গা সওয়া হয়ে গেছিলো।তবে আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি তিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলের সামনে এইভাবে স্বীকারোক্তি দেবেন।
  এর কিছুদিন পরই তিনি মারা যান।